অষ্টত্রিংশ অধ্যায়
নাগরক্ষার গুপ্তবাণী
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, বাসুকির ও অন্যান্য নাগগণের এই সকল বাক্য শ্রবণ করিয়া এলাপত্র নামক সর্প বাসুকিকে সন্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ভুজঙ্গমনাথ! সেই সর্পসত্র অবশ্যই হইবে সন্দেহ নাই এবং যে জনমেজয় রাজা হইতে আমাদিগের মহৎ ভয় উপস্থিত, তাঁহাকেও বঞ্চিত করিতে পারা যাইবে না। হে রাজন্! যে ব্যক্তি দৈবপর হয়, তাহার দৈবের উপর নির্ভর করাই সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। কারণ, সে স্থলে দৈব ব্যতিরেকে তাহার রক্ষা পাইবার আর কোন উপায়ান্তর নাই। হে পন্নগোত্তম! আমাদিগের এ ভয়কে দৈব-ভয় বলিতে হইবে, অতএব দৈব অবলম্বন করাই উত্তম কল্প বোধ হইতেছে। এ বিষয়ে আমি যাহা কহিতেছি, তোমরা অবধানপূর্ব্বক শ্রবণ কর। যখন মাতা আমাদিগকে শাপ দেন, আমি সেই সময়ে ত্রাসাকুলিতচিত্তে তাঁহার ক্রোড়ে বলিয়া দেবগণের এই কথা শুনিয়াছিলাম। দেবগণ সাতিশয় দুঃখিত হইয়া ব্রহ্মার নিকট গিয়া কহিলেন, “হে পিতামহ! পাষাণহৃদয়া কদ্রু আপনার সম্মুখেই স্বীয় প্রিয়পুৎত্রগণকে যেরূপ দারুণ অভিসম্পাত করিলেন, মাতা হইয়া পুৎত্রের প্রতি সেরূপ শাপ প্রদান করিতে কেহই পারে না। আপনিও “এবমস্ত” বলিয়া তাঁহার সেই বাক্যে অনুমোদন করিলেন; অতএব হে ব্রহ্মন্! আপনি কি নিমিত্ত তাঁহাকে স্ব-সমক্ষে শাপ প্রদানে উদ্যত দেখিয়াও নিবারণ করিলেন না, তাহা শুনিতে বাসনা করি।’
ব্রহ্মা কহিলেন, ‘সর্পগণ অতিশয় তীক্ষ্ণবিষ, খল ও প্রজাগণের অহিতকারী, অতএব আমি প্রজাগণের হিতকামনায় শাপ প্রদানোদ্যতা কদ্রু নিবারণ করি নাই; কিন্তু সর্পসত্রে কেবল তীক্ষ্ণবিষ, নীচাশয় ও পাপাচার বিষধরদিগেরই বিনাশ হইবে; ধার্ম্মিক নাগগণের কোন অপচয় হইবে না। তৎকালে তাঁহারা যে প্রকারে ঐ শাপ হইতে মুক্ত হইবেন, তাহা শ্রবণ কর। যাযাবরবংশ অসাধারণ-ধীশক্তিসম্পন্ন, তপোনিরত, জিতেন্দ্রিয়, জরৎকারু নামে এক মহর্ষি জন্মগ্রহণ করিবেন। তাঁহার ঔরসে আস্তীক নামে এক পুৎত্র জন্মিবেন। তিনি মহারাজ জনমেজয়কে সর্পযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে নিষেধ করিবেন। তাহা হইলে ধর্ম্মশীল সর্পগণের পরিত্রাণ হইবে।’
ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া দেবগণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ব্রহ্মন্! মহাতপা, মহাবীর্য্য, মুনিবর জরৎকারু কাহার গর্ভে সেই মহানুভব পুৎত্র আস্তীককে উৎপাদন করিবেন?’ ব্রহ্মা কহিলেন, ‘বীর্য্যবান্ জরৎকারু সনাম্নী কন্যাতে সেই মহাবীর্য্যসম্পন্ন পুৎত্র উৎপাদন করিবেন। সর্পরাজ বাসুকির জরৎকারুনাম্নী এক ভগিনী আছেন। তাঁহার গর্ভে সেই পুৎত্র জন্মিবেন এবং তৎকর্ত্তৃক সর্পকুলের পরিত্রাণ হইবে।’ দেবগণ ব্রহ্মার এই বাক্য শ্রবণ করিয়া ‘তথাস্তু’ বলিলেন। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মাও তাঁহাদিগকে এই কথা বলিয়া ত্রিদশালয়ে প্রস্থান করিলেন।
অতএব হে নাগাধিরাজ বাসুকে! নাগগণের ভয়শান্তির নিমিত্ত সেই সুব্রত ভিক্ষমাণ [ভাবী যাচ্ঞাকারী– যিনি ভিক্ষা করিবেন] মহর্ষিকে তোমার জরৎকারুনাম্নী ভগিনী ভিক্ষাস্বরূপ সম্প্রদান কর, তাহা হইলেই নাগকুল পরিত্রাণ পাইবে। আমি নাগগণের এই মোক্ষোপায় শ্রবণ করিয়াছি।”