০৩৮. কৈরাতপর্ব্বাধ্যায়

৩৮তম অধ্যায়

কৈরাতপর্ব্বাধ্যায়

জনমেজয় বৈশম্পায়নকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে ভগবান! অক্লিষ্টকর্ম্মা দীর্ঘবাহু অর্জ্জুন কিরূপে অস্ত্ৰ-সমুদয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন? কিরূপে মনুষ্যশূন্য বনে নির্ভীকের ন্যায় প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন? তথায় থাকিয়া কি কি কর্ম্ম করিয়াছিলেন? আর কিরূপেই বা ভগবান ভবানীপতি ও সুররাজ ইন্দ্রকে প্রসন্ন করিয়া বর প্রাপ্ত হইয়াছিলেন? হে সর্ব্বজ্ঞ! আপনি সমুদয় দিব্য ও মানুষ বৃত্তান্ত অবগত আছেন, আমি সেই সমুদয় বৃত্তান্ত আপনার নিকট শ্রবণ করিতে বাসনা করি; আর অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য, সংগ্রামে অপরাজিত, মহাবীর ধনঞ্জয় মহাদেবের সহিত যে অত্যাশ্চৰ্য্য লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রাম করিয়াছিলেন, যাহা শ্রবণ করিবামাত্র মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণের যুগপৎ দৈন্য, হর্ষ ও বিস্ময়বশতঃ হৃৎকম্প হইয়াছিল, আপনি ঐ বৃত্তান্ত ও অর্জ্জুনের অন্যান্য সমুদয় কাৰ্য্য বর্ণন করুন। হে ব্ৰহ্মন! মহাত্মা ধনঞ্জয়ের অনুমাত্রও নিন্দার কাৰ্য্য নাই, অতএব আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক তাহার সমুদয় চরিত্রও সবিস্তরে কীর্ত্তন করুন।

অর্জ্জুনকর্ত্তৃক মহাদেবের তপস্যা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! আমি দেবাদিদেব মহাদেবের সহিত মহাত্মা অর্জ্জুনের সমাগম ও গাত্রসংস্পৰ্শ প্রভৃতি সমুদয় দিব্য অদ্ভুত কথা কহিতেছি, শ্রবণ কর। অমিততেজাঃ মহারথ অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিরের নিয়োগানুসারে দিব্য গাণ্ডীব ধনু ও কনকমুষ্ঠিযুক্ত খড়্গধারণপূর্ব্বক ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতি এবং সুররাজ পুরন্দরের সন্দর্শন জন্য স্বকাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত স্থির সঙ্কল্প হইয়া একাকী সত্বর হিমাচলের উদ্দেশে উত্তরমুখে প্ৰস্থান করিলেন। তিনি ক্ৰমে ক্ৰমে কণ্টকাকীর্ণ নানাবিধফলপুষ্প-মৃগপক্ষিসমাকীর্ণ, সিদ্ধচারণগণনিষেবিত অরণ্যানী অতিক্রমপূর্ব্বক সেই নির্জ্জন কাননে প্রবেশ করিবামাত্র আকাশে শঙ্ঘনাদ ও পটহধ্বনি হইল, ভূতলে পুষ্পবৃষ্টি পতিত হইতে লাগিল ও মেঘজল চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন করিল।

তখন ধনুৰ্দ্ধারাগ্রগণ্য ধনঞ্জয় সেই মহাগিরি হিমাচলের সমীপবর্ত্তী দুৰ্গম অরণ্যানী-সমুদয় অতিক্রমপূর্ব্বক গিরিপৃষ্ঠে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ঐ পর্ব্বতে পুষ্পভারাবনত বৃক্ষসমুদয়ের উপরিভাগে নানাজাতীয় বিহঙ্গমগণ নিরন্তর সুমধুরস্বরে গান করিতেছে। বিপুল আবর্ত্তবতী স্রোতস্বতী-সকল চতুর্দ্দিকে শোভমান হইতেছে। ঐ নিম্নগা-সমুদয়ের জল অতিপবিত্ৰ, সুশীতল ও বৈদূৰ্য্যমণির ন্যায় নির্ম্মলপ্ৰভ; উভয়পার্শ্বে মনোহর বনরাজি বিরাজিত রহিয়াছে এবং হিংস, কারণ্ডব, সারস, ক্ৰৌঞ্চ, পুংস্কোকিল, ময়ুর প্রভৃতি পক্ষিগণ চতুর্দ্দিকে কলকণ্ঠে সতত সুমধুর ধ্বনি করিতেছে। মহামনাঃ অর্জ্জুন তদর্শনে যৎপরোনাস্তি প্রীত হইলেন।

তখন তিনি সেই পর্ব্বতের উপরিভাগস্থ পরমরমণীয় বনোদ্দেশে দর্ভময় বাস পরিধানপূর্ব্বক দণ্ড ও অজিনে মণ্ডিত হইয়া ভূতলে পতিত স্বয়ং বিশীর্ণ পত্ৰমাত্র উপযোগ করিয়া ঘোরতর তপানুষ্ঠান আরম্ভ করিলেন। তিনি প্রথম মাসে ত্রিরাত্ৰান্তর, দ্বিতীয় মাসে ষড়রাত্ৰান্তর এবং তৃতীয় মাসে পক্ষান্তরে ফল ভক্ষণ করিয়া তপশ্চরণ করিলেন; চতুর্থ মাস সমুপস্থিত হইলে কেবল বায়ুভক্ষণপূর্ব্বক উৰ্দ্ধহস্তে পদাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগমাত্রে পৃথিবী স্পর্শ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন। সতত অবগাহন করাতে তাঁহার মস্তকস্থিত জটাকলাপ বিদ্যুতের ন্যায় পিঙ্গলবৰ্ণ হইয়া উঠিল।

তখন সমুদয় মহর্ষিগণ একত্ৰ মিলিত হইয়া মহাত্মা অর্জ্জুনের কঠোর তপস্যার বিষয় জ্ঞাপন করিবার নিমিত্ত দেবাদিদেব মহাদেবের নিকটে গমন করিলেন ও প্ৰণতিপুরঃসর কহিতে লাগিলেন, “হে দেবেশ্বর! মহাতেজঃ অর্জ্জুন হিমাচলে ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিয়াছেন, তাঁহার তপঃপ্রভাবে চতুর্দ্দিক ধূমায়িতপ্রায় হইয়া উঠিয়াছে। আমরা তাহার কি অভিপ্রায়, কিছুই বুঝিতে পারি নাই, কিন্তু তপঃপ্রভাবে সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়াছি; অতএব আপনি উহাকে নিবৃত্ত করুন।”

সর্ব্বভূতপতি বিশুদ্ধাত্মা মহর্ষিগণের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে তপোধনগণ! তোমরা অর্জ্জুনের নিমিত্ত বিষণ্ন হইও না, সত্বর স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান কর। আমি মহাত্মা ধনঞ্জয়ের অভিপ্ৰায় বুঝিয়াছি; স্বৰ্গ, আয়ুঃ বা ঐশ্বৰ্য্যলাভে তাহার আকাঙ্ক্ষা নাই। আমি অদ্যই তাহার অভিলাষ পূর্ণ করিব।”

তখন সত্যবাদী মহর্ষিগণ মহাদেবের বাক্য-শ্রবণে যৎপরোনাস্তি হোষ্টচিত্তে স্ব স্ব নিকেতনে প্ৰতিগমন করিলেন।