৩৭তম অধ্যায়
দুর্য্যেধনাদির সহিত অভিমন্যুর যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন্! অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন অভিমন্যুর শরে স্বীয় সৈন্যগণকে ছিন্ন ভিন্ন দেখিয়া ক্রোধাবিষ্ট চিত্তে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন দ্রোণাচার্য্য দুৰ্য্যোধনকে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান দেখিয়া যোদ্ধাদিগকে কহিলেন, হে বীরগণ! তোমরা অবিলম্বে দুর্য্যোধনের অনুসরণ কর; অভিমন্যু আমাদিগের সমক্ষে বীরগণকে বিনাশ করিতেছে; এক্ষণে তোমরা ভয় পবিত্যাগ পূর্ব্বক অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হও এবং কৌরবগণকে পরিত্রাণ কর। তখন মহাবল পরাক্রান্ত সমরবিজয়ী সুহৃদগণ তাঁহার আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া ভীত মনে দুৰ্য্যোধনকে বেষ্টন করিলেন। পরে দ্রোণাচার্য্য, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ, কৃতবর্ম্মা, শকুনি, বৃহদ্বল, মদ্ররাজ, ভূরি, ভূরিশ্রবা, শল ও পৌরব বৃষসেন অনবরত শর বর্ষণ পূর্ব্বক অভিমন্যুকে নিবারিত ও বিমোহিত করিয়া রাজা দুৰ্য্যোধনকে মুক্ত করিলেন। অভিমন্যু আস্যদেশ হইতে আচ্ছিন্ন গ্রাসের ন্যায় এই ব্যাপার সহ্য করিতে সমর্থ হইলেন না। সুতরাং শরজালে অশ্ব, সারথী ও মহারথদিগকে পরাঙ্মুখ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। দ্ৰোণ প্রভৃতি মহারথগণ আমিষলোলুপ সিংহ সদৃশ অভিমন্যুর সিংহনাদ সহ্য করিতে না পারিয়া রথসমূহে তাঁহাকে বেষ্টন পূর্ব্বক বিবিধ লাঞ্ছন-লাঞ্ছিত শর জাল পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাবীর অভিমন্যু নিশিত শরনিকরে অন্তরীক্ষেই সেই সমস্ত অস্ত্র নিরস্ত করিয়া তাঁহাদিগকে বিদ্ধ করিলেন। তখন এই ব্যাপার নিতান্ত অদ্ভুত বলিয়া প্রতীয়মান হইতে লাগিল। অনন্তর দ্ৰোণ প্রভৃতি মহাবীরগণ রোষপরবশ হইয়া সমরে অপরাঙ্মুখ অভিমন্যুকে বিনাশ করিবার মানসে আশীবিষ সদৃশ শরনিকরে আচ্ছন্ন করিলেন। অভিমন্যু একাকী বেলার ন্যায় বিক্ষোভিত সমুদ্র সদৃশ সেই বল সমুদায় ধারণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে পরস্পর সংহারে প্রবৃত্ত উভয় পক্ষের কেহই রণস্থল হইতে পরাঙ্মুখ হইলেন না। তখন দুঃসহ নয়, দুশাসন দ্বাদশ, কৃপাচার্য্য তিন, দ্রোণ সপ্তদশ, বিবিংশতি সপ্ততি, কৃতবর্ম্মা সাত, বৃহদ্বল আট, অশ্বত্থামা সাত, ভূরিশ্রবা তিন, মদ্ররাজ ছয়, শকুনি দুই ও রাজা দুৰ্য্যোধন তিন শরে অভিমন্যুকে বিদ্ধ করিলে মহাপ্রতাপশালী অভিমন্যু যেন নৃত্য করিতে করিতেই তাঁহাদিগকে তিন তিন শরে বিদ্ধ করিলেন।
অভিমন্যু-রনে কর্ণ-শল্যাদির ত্রাস
দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি বীরগণ অভিমন্যুকে এইরুপ ভরপ্রদর্শন করিলেও তিনি সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া অভ্যাসকৃত বল প্ৰদৰ্শনপূর্ব্বক বিনতানন্দন গরুড় ও অনিলতুল্যবেগশালী, সারথির আদেশানুবর্ত্তী অশ্ব দ্বারা ত্বরমাণ অশ্মকেশ্বরকে নিবারণ করিলেন। শ্ৰীমান অশ্মকেশ্বর অভিমন্যুর অভিমুখীন হইয়া থাক থাক বলিয়া দশ শরে তাঁহাকে বিদ্ধ করিলে মহাবীর অভিমন্যু সহাস্যমুখে দশ শরে তাঁহার সারথি, অশ্ব, ধ্বজ, বাহুযুগল, ধনু ও মস্তক পৃথিবীতে নিপাতিত করিলেন। তখন অশ্মকেশ্বরের সৈন্য সমুদায় পলায়ন করিতে লাগিল। অনন্তর কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, গান্ধাররাজ শকুনি, শল, শল্য, ভূরিশ্রবা, ক্ৰাথ, সোমদত্ত, বিবিংশতি, বৃষসেন, সুষেণ, কুণ্ডভেদি, প্রতৰ্দন, বৃন্দারক, ললিথ, প্রবাহু, দীর্ঘলোচন ও দুৰ্য্যোধন ক্রোধভরে অভিমন্যুর প্রতি শর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। অভিমন্যু শরনিকরে নিতান্ত বিদ্ধ হইয়া কর্ণের প্রতি বৰ্ম্ম ও কায়ভেদী এক শর সন্ধান করিলেন। সেই শর কর্ণের বর্ম্ম ভেদ করিয়া বল্মীকমধ্যে পন্নগ-প্রবেশের ন্যায় ধরণীতলে প্রবেশ করিল। মহাবল পরাক্রান্ত কর্ণ সেই নিদারুণ প্রহারে ব্যথিত ও বিহ্বল হইয়া ভূকম্পকালীন অচলের ন্যায় নিতান্ত বিচলিত হইয়া উঠিলেন। অনন্তর অভিমন্যু একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অন্য নিশিত শরত্ৰয়ে দীর্ঘলোচন, সুষেণ ও কুগুভেদিকে বিদ্ধ করিলে কর্ণ তাঁহার প্রতি পঞ্চ বিংশতি নারাচ, অশ্বত্থামা বিংশতি শর ও কৃতবর্ম্মা সাত শর নিক্ষেপ করিলেন। সৈন্যগণ শরাচিতকলেবর, নিতান্ত ক্রুদ্ধ, অর্জ্জুনাত্মজ অভিমন্যু পাশহস্ত অন্তকের ন্যায় রণস্থলে বিচরণ করিতেছেন নিরীক্ষণ করিল। মহাবীর অভিমন্যু সন্নিহিত শল্যকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া কৌরব সৈন্যগণকে বিভীষিকা প্রদর্শন পূর্ব্বক আক্রোশ করিতে লাগিলেন। শল্য মৰ্ম্ম ভেদী শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া রথোপস্থে নিশণ্ন ও বিমোহিত হইলেন। আপনার সৈন্যগণ, শল্যকে শরবিদ্ধ নিরীক্ষণ করিয়া সিংহপীড়িত মৃগের ন্যায় দ্রোণাচার্যের সমক্ষেই পলায়ন করিতে লাগিল। তখন দেবতা, চারণ, সিদ্ধ ও পিতৃগণ এবং অবনিতল গত ভূত সমুদায় সামরিক যশে অভিমন্যুকে অর্চনা করিতে আরম্ভ করিলে তিনি হুতহুতাশনের ন্যায় অপূৰ্ব্ব শোভা প্রাপ্ত হইলেন।