ষট্ত্রিংশ অধ্যায়
শেষ নাগের সর্পসঙ্গত্যাগ
শৌনক কহিলেন, বৎস সূতনন্দন! তুমি মহাবলপরাক্রান্ত অতিদুর্দ্ধর্ষ প্রধান প্রধান সর্পগণের নাম কীর্ত্তন করিলে, এক্ষণে ঐ সকল সর্পগণ জননীদত্ত শাপ-শ্রবণানন্তর কি করিয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিয়া আমার কৌতুহলাক্রান্ত চিত্তকে সন্তুষ্ট কর।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, তাহাদিগের সর্ব্বজ্যেষ্ঠ মহাযশা ভগবান্ শেষ নাগ স্বীয় জননী কদ্রুকে পরিত্যাগ করিয়া, বায়ুভক্ষ, ব্রতপরায়ণ, একান্তচিত্ত, জটাবল্কলধারী ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া গন্ধমাদন, বদরিকাশ্রম, গোকর্ণ, পুষ্কর, হিমবান্ প্রভৃতি পুণ্যতীর্থে গমনপূর্ব্বক অতি কঠোর তপস্যা করিতে লাগিলেন। তপোনুষ্ঠানকালে তাঁহার গাত্রের মাংস, চর্ম্ম ও শিরাসমুদয় শুষ্কপ্রায় হইয়া গেল।
সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা তাঁহাকে তপস্যায় একান্ত অনুরক্ত দেখিয়া স্বয়ং তৎসন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘নাগরাজ! তুমি এ কি কর্ম্ম করিতেছ? অতঃপর প্রজাগণের হিতসাধনে সচেষ্ট হও, তোমার তীব্র তপস্যার দ্বারা সমস্ত প্রজাগণ সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়াছে, আর তপস্যায় প্রয়োজন নাই, অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।”
শেষ কহিলেন, “আমার সহোদর ভ্রাতৃগণ অতি মূঢ়, আমি তাহাদিগের সহিত একত্র বাস করিতে বাসনা করি না, আপনি তদ্বিষয়ে অনুমতি প্রদান করুন। তাহারা শত্রুর ন্যায় সর্ব্বদা পরস্পর বিবাদবিসংবাদ করে, অতত্রব আমার আর যেন তাহাদিগের মুখ দেখিতে না হয়। এই অভিলাষেই আমি তপস্যা করিতে আসিয়াছি। তাহারা সর্ব্বদা সপুৎত্র বিনতার অনিষ্টচেষ্টা করে। বিহঙ্গমশ্রেষ্ঠ বৈনতেয় আমাদিগের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা, তিনি পিতা কশ্যপের বরপ্রভাবে মহাবলপরাক্রান্ত হইয়াছেন। আমার সহোদরগণ সর্ব্বদা তাঁহার প্রতি ঈর্ষাপ্রকাশ করে। তন্নিমিত্ত আমি স্থির করিয়াছি যে, তপোনুষ্ঠান করিয়া কলেবর পরিত্যাগ করিব, তাহা হইলে লোকান্তরেও আর সেই দুরাত্মাদিগের মুখাবলোকন করিতে হইবে না।”
শেষ নাগের ধরাধারণ
ব্রহ্মা শেষ নাগের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “বৎস শেষ! আমি তোমার সোদরগণের আচার-ব্যবহার বিলক্ষণরূপে অবগত আছি এবং তাহারা জননী কর্ত্তৃক অভিশপ্ত হইয়াছে, তাহাও জানি। অতএব তোমার ভ্রাতৃগণের দৌরাত্ম্যপ্রযুক্ত আর শোক করিবার আবশ্যকতা নাই, আমি অদ্য তোমাকে বরদান করিতেছি, অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। হে পন্নগোত্তম! আমি তোমার প্রতি পরম সন্তুষ্ট হইয়াছি। সৌভাগ্যক্রমে তোমার ধর্ম্মে মনন হইয়াছে দেখিয়া যৎপরোনাস্তি প্রীত হইলাম, আশীর্ব্বাদ করি, তোমার বুদ্ধি ধর্ম্মে সুস্থিরা হউক।”
শেষ কহিলেন, “হে সর্ব্বলোকপিতামহ! আমি এই বর প্রার্থনা করি, যেন ধর্ম্মে, শমগুণে ও তপস্যায় আমার অচলা ভক্তি থাকে।” ব্রহ্মা কহিলেন, “বৎস! আমি তোমার শম ও দম দেখিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম, কিন্তু হে বৎস! তোমাকে এই সর্ব্বলোকহিতকর কার্য্যটি সম্পাদন করিতে হইবে। পর্ব্বত কাননাদি-সমবেত এই ধরণীমণ্ডলকে তোমায় এইরূপে ধারণ করিতে হইবে যেন, উহা আর বিচলিত না হইতে পারে।” শেষ কহিলেন, “হে বরপ্রদ প্রজাপতে! হে ধরানাথ! হে ভূতনাথ! হে জগন্নাথ! আপনি যেরূপ আজ্ঞা করিতেছেন, আমি ঐরূপে মহী ধারণ করিব, কিন্তু আপনি পৃথিবীকে আমার মস্তকোপরি স্থাপন করুন।” ব্রহ্মা কহিলেন, “হে ভুজঙ্গোত্তম! পৃথিবী স্বয়ং তোমাকে যে পথ প্রদান করিলেন, তুমি সেই পথ দিয়া ধরিত্রীর অধোভাগে আগমনপূর্ব্বক ইঁহাকে ধারণ কর তাহা হইলেই আমার পরম প্রীতিকর কার্য্য করা হইবে।”
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ভুজঙ্গমাগ্রজ শেষ “যে আজ্ঞা” বলিয়া পৃথিবীদত্ত বিবর দ্বারা রসাতলে প্রবেশপূর্ব্বক সসাগরা বসুন্ধরাকে মস্তকোপরি ধারণ করিলেন। এইরূপে মহাব্রতশালী ভগবান্ অনন্ত ব্রহ্মার নির্দেশানুসারে একাকী ধরা ধারণ করিয়া পাতালতলে বাস করিতে লাগিলেন। সর্ব্বামরোত্তম ভগবান্ পিতামহ খগবর বিনতানন্দনকে অনন্তদেবের সখা করিয়া দিলেন।