৩৬তম অধ্যায়
দ্বাদশ অধ্যায় – ভক্তিযোগ
“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! যাহারা ত্বদ্গতচিত্তে [অনন্যমনে–একমাত্র ভগবানে মন রাখিয়া] তোমার উপাসনা করে এবং যাহারা কেবল অক্ষয় ও অব্যক্ত ব্রহ্মের আরাধনা করিয়া থাকে, এই উভয়বিধ লোকের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়?’
“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! যাহারা ত্বদ্গতচিত্তে [অনন্যমনে–একমাত্র ভগবানে মন রাখিয়া] তোমার উপাসনা করে এবং যাহারা কেবল অক্ষয় ও অব্যক্ত ব্রহ্মের আরাধনা করিয়া থাকে, এই উভয়বিধ লোকের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! যাহারা আমার প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত ও নিবিষ্টমনা হইয়া পরম ভক্তিসহকারে আমার উপাসনা করিয়া থাকে, তাহারাই আমার মতে প্রধান যোগী; আর যাহারা সর্ব্বত্র সমদৃষ্টিসম্পন্ন, সর্ব্বভূতে হিতানুষ্ঠাননিরত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া অক্ষয়, অনির্দেশ্য [নির্দেশের অতীত–‘ইহা এই’ এই প্রকার পরিচয়ের বহির্ভূত], অব্যক্ত, অচিন্তনীয়, সর্ব্বব্যাপী, হ্রাসবৃদ্ধিহীন, কূটস্থ [হৃদয়স্থ–হৃদয়ের অন্তঃস্তরস্থ] এবং নিত্য পরব্রহ্মের উপাসনা করে, তাহারা আমাকেই প্রাপ্ত হয়। দেহাভিমানীরা অতি কষ্টে অব্যক্ত গতি লাভ করিতে সমর্থ হয়; অতএব যাহারা অব্যক্ত ব্রহ্মে আসক্তমনা হয়, তাহারা অধিততর দুঃখভোগ করিয়া থাকে; যাহারা মৎপরায়ণ হইয়া আমাকে সমস্ত কার্য সমর্পণপূর্ব্বক একান্ত ভক্তিসহকারে আমাকেই ধ্যান ও উপাসনা করে, আমি তাহাদিগকে অচিরকালমধ্যে এই মৃত্যুর আকর সংসার-সাগর হইতে উদ্ধার করিয়া থাকি।
“হে অর্জ্জুন! তুমি আমাতে স্থিরতর রূপে চিত্ত আহিত [সংন্যস্ত] ও বুদ্ধি সন্নিবেশিত কর; তাহা হইলে পরকালে আমাতেই বাস করিতে সমর্থ হইবে। যদি আমার প্রতি চিত্ত স্থির রাখিতে না পার, তাহা হইলে আমার অনুস্মরণরূপ অভ্যাসযোগ দ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হইতে অভিলাষ কর। যদি তদ্বিষয়েও অসমর্থ হও, তাহা হইলে তুমি আমার প্রীতিসম্পাদনার্থ ব্রত, পূজা প্রভৃতি কার্য-সকল অনুষ্ঠান করিলেও মোক্ষলাভ সমর্থ হইবে। যদি ইহাতেও অশক্ত হও, তাহা হইলে একমাত্র আমারই শরণাপন্ন হইয়া সংযতচিত্তে সকল কর্ম্মফল পরিত্যাগ কর; কারণ, বিবেকশূন্য অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেয়স্কর; জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যান শ্রেয়স্কর; ধ্যান অপেক্ষা কর্ম্মফলপরিত্যাগ শ্রেয়স্কর, কর্ম্মফল পরিত্যাগ করিলে শান্তিলাভ হয়। যে ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তি দ্বেষশূন্য, কৃপালু, মমতাবিহীন, নিরহঙ্কার, সমদুঃখ-সুখ, ক্ষমাবান্, সতত প্রসন্নচিত্ত, অপ্রমত্ত, জিতেন্দ্রিয় ও দৃঢ়নিশ্চয়, যিনি আমাতেই মন ও বুদ্ধি সমর্পণ করিয়াছেন এবং সুখ ও দুঃখ সমান জ্ঞান করেন, তিনিই আমার প্রিয়; লোক-সকল যাঁহা হইতে উদ্বিগ্ন হয় না, যিনি লোকদিগকে উদ্বিগ্ন করেন না এবং যিনি অনুচিত হর্ষ, অমর্ষ, ভয় ও উদ্বেগশূন্য, তিনি আমার প্রিয়। যিনি নিস্পৃহ, শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতরহিত ও আধিশূন্য এবং যিনি সকাম কর্ম্মসকল পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনিই আমার প্রিয়। যিনি শোক, হর্ষ, দ্বেষ, আকাঙ্খা ও পূণ্য-পাপ পরিত্যাগ করিয়া ভক্তিমান্ হয়েন, তিনিই আমার প্রিয়। যিনি সর্ব্বসঙ্গ পরিত্যাগপূর্ব্বক শত্রু ও মিত্র, মান ও অপমান, শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ, নিন্দা ও প্রশংসা তুল্যরূপ বিবেচনা করিয়া থাকেন, যৎকিঞ্চিত লাভে সন্তুষ্ট হয়েন, কোন স্থলেই প্রতিনিয়ত বাস করেন না এবং স্থিরমতি ও স্থিরভক্তিসম্পন্ন হইয়াছেন, তিনিই আমার প্রিয়। যিনি মৎপরায়ণ হইয়া পরম শ্রদ্ধাসহকারে উক্ত প্রকার ধর্ম্মরূপ অমৃত পান করেন, তিনিই আমার প্রিয়।’”