চিত্রসেনে ডাকি তবে কহে পুরন্দর।
পার্থেরে থাকিতে স্থান দেহ মনোহর।।
ঊর্ব্বশীরে পাঠাইবে অর্জ্জুনের স্থানে।
তুষ্ট যেন করে পার্থে বিবিধ বিধানে।।
আজ্ঞা পেয়ে চিত্রসেন পার্থে লয়ে গেল।
দিব্য মনোহর স্থান রহিবারে দিল।।
বিচিত্র উত্তম শয্যা রত্নে আসন।
পরিচর্য্যা হেতু নিয়োজিল বহুজন।।
তবে চিত্রসেন গেল ঊব্বশীর স্থান।
অর্জ্জুনের গুণ কহে করিয়া বাখান।।
রূপে গুণে শৌর্য্যে বীর্য্যে পার্থ বীরবর।
অর্জ্জুনের তুল্য নাহি বিশ্বে কোন নর।।
তার প্রীতি হেতু আজ্ঞা কৈল পুরন্দর।
আজি নিশি ঊর্ব্বশী তাহার সেবা কর।।
ঊর্ব্বশী বলিল, পার্থে ভালরূ জানি।
কামেতে কাতর অঙ্গ তাঁর কথা শুনি।।
আপনার গৃহে তুমি যাহ মহাশয়।
এই আমি চলিলাম যথা ধনঞ্জয়।।
এত বলি স্নান করি পরে দিব্যবাস।
পারিজাত মাল্যে বান্ধে দিব্য কেশপাশ।।
চন্দন কস্তূরি অঙ্গে করিল লেপন।
রত্ন অলঙ্কার অঙ্গে করিল ভূষণ।।
সহজ রূপেতে মুনিজন মন মোহে।
মন সঙ্গে হরে প্রাণ যার পানে চাহে।।
সুবেশা সুকেশা, হইয়া অর্দ্ধ নিশিতে।
পার্থালয়ে চলে ঊব্বর্শী গজগতিতে।।
দ্বারপাল জানাইল অর্জ্জুন গোচরে।
ঊর্ব্বশী অপ্সরী আসি রহিয়াছে দ্বারে।।
ভীত হইলেন শুনি কুন্তীর নন্দন।
নিশাকালে ঊর্ব্বশী আইল কি কারণ।।
উঠিয়া গেলেন তবে ইন্দ্রের কুমার।
ঊব্বশীরে বিনয়ে করেন নমস্কার।।
কি করিব, আজ্ঞা তুমি করহ আমায়।
এত রাত্রে কি কারণে আসিলে হেথায়।।
বিস্ময় মানিয়া মনে ঊব্বর্শী চাহিল।
কামনা পূরিল নাহি, হৃদয় জ্বলিল।।
চিত্রসেন যা বলিল ইন্দ্র অনুমতি।
একে একে সব কথা কহে পার্থ প্রতি।।
ইন্দ্রের আজ্ঞায় আমি আইনু হেথায়।
আজি নিশি ক্রীড়া কর লইয়া আমায়।।
যখন করিল নৃত্য বিদ্যাধরীগণ।
সবে এড়ি মোরে তুমি করিলে দর্শন।।
জানিয়া আমারে পাঠাইল পুরন্দর।
ইন্দ্র আজ্ঞা মোর প্রতি, নিজ প্রীতি কর।।
শুনিয়া অর্জ্জুন বীর কর্ণে হাত দিয়া।
হেঁটমাথে স্নানমুখে কহে শিহরিয়া।।
শুনিবার যোগ্য নহে তোমার এ বাণী।
কেন হেন দুষ্ট কথা কহ ঠাকুরাণী।।
তব কর্ম্ম আমি কভু না দেখি না শুনি।
হে ঊর্ব্বর্শী তোমায় জননী সমা গণি।।
কহিলে যে তুমি মোরে চাহিলে সভায়।
যে হেতু চাহিনু আমি কহিব, তোমায়।।
পূর্ব্বে মুনিগণ মুখে ইহা শ্রুত ছিল।
তোমার উদরে পুরুবংশ বৃদ্ধি হৈল।।
পুরু আদি করি তার যতেক পুরুষে।
ক্ষয় হৈল, তুমি আছ নবীন বয়সে।।
এ হেতু বিস্ময় বড় মানিলাম মনে।
পুনঃ পুনঃ চাহিলাম তাহার কারণে।।
পূর্ব্ব পিতামহী তুমি, মোর গুরুজন।
হেন অসম্ভব কথা কহ কি কারণ।।
ঊর্ব্বশী বলিল, আমি নহি যে কাহার।
স্বইচ্ছায় যথা তথা করি যে বিহার।।
অকারণে গুরু বলি পাতিলে সম্বন্ধ।
ভ্রান্তিবশে কিবা হেতু চিত্তে রাখ ধন্দ।।
যাত সব মহারাজ হৈল পুরুবংশে।
তপঃ পুণ্যফলে সবে স্বর্গেতে আইসে।।
ক্রীড়ারস করে সবে সহিত আমার।
সে সব বচন কেহ না করে বিচার।।
তুমি কেন হেন কথা কহ ধনঞ্জয়।
করহ আমার প্রীতি, খণ্ডাও বিস্ময়।।
অজ্জুন কহেন, তুমি মোর ঠাকুরাণী।
তুমি যে পরম গুরু কুলের জননী।।
যথা কুন্তী, যথা মাদ্রী, যথা শচীন্দ্রাণী।
ইহা সব হৈতে তোমা গরিষ্ঠেতে গণি।।
নিজগৃহে যাও মাতা করি যে প্রণাম।
পুত্রবৎ জ্ঞান মোরে কর অবিরাম।।
শুনি ঊর্ব্বশীর হৃদে হৈল মহাতাপ।
ক্রোধমুখে অর্জ্জুনের প্রতি দিল শাপ।।
তব পিতৃ আদেশেতে আসি তব গৃহে।
নিস্ফলে ফিরিয়া যাই, প্রাণে নাহি সহে।।
না করিলে কামপূর্ণ পুরুষের কাজ।
এই দোষে নপুংসক হবে নারী মাঝ।।
নর্ত্তক রূপেতে রবে মোর এই শাপ।
এত বলি নিজালয়ে গেল করি তাপ।।
শাপ করি চিন্তিত অন্তর ধনঞ্জয়।
শোকে দুঃখে নিশি বঞ্চে নিদ্রা নাহি হয়।।
প্রাতঃকালে চিত্রসেনে লইয়া সংহতি।
দেবরাজ চরণে ভক্তিতে করে নতি।।
নিশার বৃত্তান্ত যত কহেন অর্জ্জুন।
শুনিয়া বিস্ময়ে কন সহস্রলোচন।।
ধন্য কুন্তী, তোমা পুত্র গর্ভেতে ধরিল।
তোমা হৈতে কুরুবংশ পবিত্র হইল।।
মহর্ষি তপস্বী দেবর্ষি জিনিলে সবারে।
তোমা পুত্র শ্লার্ঘ্য করি মানি আপনারে।।
শাপ হেতু চিত্তে দুঃখ না ভাব অর্জ্জুন।
শাপ নহে, তব পক্ষে ইথে লাভ জেন।।
অবশ্য অজ্ঞাত এক বৎসর রহিবে।
সেই কালে নপুংশক নর্ত্তক হইবে।।
বৎসরেক পূর্ণ হৈলে শাপ হবে ক্ষয়।
শুনিয়া অর্জ্জুন অতি সানন্দ হৃদয়।।
অর্জ্জুনের চরিত্র যে জন শুনে গায়।
কদাচিৎ তার চিত্ত পাপে নাহি যায়।।
পূর্ব্বার্জ্জিত যত পাপ ভস্ম হয়ে যায়।
আরণ্যকপর্ব্ব গীত কাশীদাস গায়।।