৩৫তম অধ্যায়
যুদ্ধার্থী ভীমের স্বভাবোচিত সত্বরতা
ভীম কহিলেন, “হে মহারাজ! ফেনের ন্যায় আসার ও ফলের ন্যায় পতনশীল মানবগণ কালের বশীভূত হইয়া কালকে প্রত্যক্ষ বোধ করে, কিন্তু সে কাল শরের ন্যায় শীঘ্ৰগামী, স্রোতের ন্যায় নিত্যবাহী, অনন্ত, অপ্রমেয় ও সর্ব্বান্তকারী; অতএব ঈদৃশ কালে সন্ধি করা নিতান্ত নিস্ফল। হে রাজন! যেমন অঞ্জনচুর্ণ সূচিদ্বারা ক্ৰমে ক্ৰমে অপহৃত হইলে তাহার শেষ হওয়া অসম্ভব, তদ্রূপ ক্ষণবিনশ্বর মানবগণের এই অনন্তকাল প্রতীক্ষা করা সম্ভবপর নহে; যে ব্যক্তির পরমায়ু অপরিমিত অথবা যে ব্যক্তি পরমায়ুর পরিমাণ অবগত হইয়াছে ও সমুদয় বিষয় প্রত্যক্ষ করিতে পারে, তাহারই সময় প্রতীক্ষা করিয়া থাকা উচিত। হে মহারাজ! হয়ত এই ত্ৰয়োদশবর্ষ প্রতীক্ষা করিতেই সমস্ত আয়ুর পর্য্যবসান হইয়া আমাদিগকেও কালের করাল বদনে প্রবেশ করিতে হইবে। মৃত্যু শারীরিগণের শরীরে নিয়তই আশ্রয় করিয়া আছে, অতএব আমাদের মরণের অব্যবহিতপূর্ব্বেই রাজ্যলাভ-ঘটনা হইতে পারে। যে ব্যক্তি শৌৰ্য্যাদি গুণবিরহের জন্য লোকের নিকট অবিদিত ও বৈরনিৰ্য্যাতন করিতে অসমর্থ হইয়া পরমোৎকৃষ্ট কীৰ্তিলাভ করিতে পারে না, সে কেবল ভূমির ভারস্বরূপ হইয়া পরিশেষে বলীবৰ্দের ন্যায় অবসন্ন হইয়া পড়ে। যে পুরুষ ক্ষীণবল, নিরুদ্যোগী ও বৈরানিৰ্য্যাতনে পরাঙ্মুখ হয়, সেই দুর্জাত পুরুষের জন্ম কোন কর্ম্মেরই নহে।
“হে মহারাজ! আপনার বাহুদ্বয় সুবর্ণের অদ্বিতীয় অধিকারী ও কীর্ত্তি রাজকুলোচিত; অতএব আপনি সংগ্রামে শত্ৰুনাশ করিয়া নিজভূৰ্জার্জ্জিত ঐশ্বৰ্য্য উপভোগ করুন। যে পুরুষ প্রতারকের প্ৰাণসংহার করিয়া সদ্যই নরকে গমন করে, তাহার সেই নরকও স্বর্গের সমান বোধ হইতে থাকে। হে মহারাজ! অমর্ষজনিত সন্তাপ হুতাশন অপেক্ষাও সমধিক দীপ্তিমান, আমি দিবানিশি সেই সন্তাপে সন্তপ্ত হইয়া শয়ন পৰ্য্যন্তও পরিত্যাগ করিয়াছি। ধনুগুণবিকর্ষণে বরিষ্ঠ ও সিংহসম বিক্রমশালী এই ধনঞ্জয় একাকী সমস্ত ধনুৰ্দ্ধারকে সংহার করিতে পারে, কিন্তু এক্ষণে যৎপরোনাস্তি সন্তপ্ত ও মত্ত হস্তীর ন্যায় মনস্তাপে পরিতাপিত হইতেছে। নকুল, সহদেব ও বীরপ্ৰসবিনী বৃদ্ধমাতা আপনার প্রিয়কামনায় জড় ও মুকের ন্যায় হইয়া রহিয়াছেন। সৃঞ্জয়প্রমুখ বান্ধবেরা এক্ষণে আপনার হিতচিন্তায় রত হইয়া কালাতিপাত করিতেছেন, আমি ও প্রতিবিন্ধ্যজননী দ্রৌপদী নিতান্ত সন্তাপিত হইয়া বনবাসক্লেশ সহ্য করিতেছি। হে মহারাজ! এই বীরেরা সকলেই সংগ্রামপ্রিয়, কিন্তু সম্প্রতি বিপন্ন হইয়া হীনবলের ন্যায় অবস্থিতি করিতেছেন, অতএব এক্ষণে আমি যাহা কহিতেছি, তাহা সকলেরই অভিপ্রেত হইবে, সন্দেহ নাই।
“হে রাজন! দুর্ব্বল নীচ জনেরা আমাদের রাজ্য অপহরণ করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে ভোগ করিতেছে, ইহা অপেক্ষা ঘোরতর বিপদ আর কি হইবে? হে অসত্যভীরু! আপনি স্বীয় স্বভাবদোষে দয়ালুতানিবন্ধন অশেষ ক্লেশ সহ্য করিতেছেন, কিন্তু অন্য কেহ। এ বিষয়ে আপনাকে প্রশংসা করিতেছেন না। আপনার বুদ্ধি অর্থজ্ঞানশূন্য, বেদাক্ষরমাত্রাভ্যাসী, অত্যন্ত কুৎসিত শ্রোত্রিয়ের ন্যায় কেবল গুরূপদিষ্ট মনুবচন দহন করিতেছে, কিন্তু তত্ত্বার্থ পরিদর্শন করিতে সমর্থ নহে। আপনি ব্ৰাহ্মণের ন্যায় দয়াময় হইয়া কি নিমিত্ত ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিলেন? ক্ষত্ৰকুলে প্রায়ই ক্রুরবুদ্ধি পুরুষেরা জন্মপরিগ্রহ করিয়া থাকে। আপনি ভগবান মনুপ্রণীত রাজধর্ম্ম শ্রবণ করিয়াছেন, তথাপি ক্রুর প্রতারক, অশান্ত ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে কি নিমিত্ত ক্ষমা করিতেছেন? হে পুরুষব্যাঘ্র! কর্ত্তব্যবিষয়ে কি অজগর সৰ্পের ন্যায় নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিবেন? আপনি আমাদিগকে সংগোপন রাখিবার অভিলাষী হইয়া একমুষ্টি তৃণদ্বারা হিমালয়কে আবৃত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। যেমন দিনকর গগনমণ্ডলে কদাচ আচ্ছন্ন হইতে পারে। না, তদ্রূপ আপনি বুদ্ধি, বল, শাস্ত্র ও আভিজাত্যসম্পন্ন এবং বিখ্যাত হইয়া এই পৃথিবীতে ছদ্মবেশে কখন অজ্ঞাতচৰ্য্যা আচরণ করিতে পরিবেন না। অনুপ-জাত [ নির্জ্জনস্থানজাত] শাখাপুষ্পপলাশশালী [পল্লব] শালসদৃশ ও ঐরাবতের ন্যায় বিশ্রুতকীর্ত্তি অৰ্জ্জুন কি প্রকারে অজ্ঞাত হইয়া বিচরণ করিবে? নকুল ও সহদেব এই সিংহসঙ্কাশ শিশুদ্বয়ই বা কি প্রকারে অজ্ঞাতচারী হইবে? পুণ্যকীর্ত্তি বীরপ্ৰসবিনী দ্রৌপদীই বা কি প্রকারে আত্মগোপন করিবেন? আমি কৌমারাবস্থা অবধি নিখিল প্রজামণ্ডলীর মধ্যে বিখ্যাত ও সর্ব্বসমক্ষে পরিচিত হইয়া আসিয়াছি, এক্ষণে তৃণদ্বারা সুমেরুগোপনের ন্যায় আমার অজ্ঞাতচৰ্য্যা অতি অসম্ভব! আমরা অনেকানেক রাজা ও রাজপুত্রকে রাজ্যচ্যুত করিয়াছি; তাহারা এক্ষণে ধৃতরাষ্ট্রের অনুগত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। পূর্ব্বে তাহারা আমাদের নিকট পরাভূত ও বিবাসিত হইয়াছিল, এক্ষণে তাহারা ধৃতরাষ্ট্রের হিতৈষী হইয়া আমাদিগের পরাভব চেষ্টা না করিয়া কদাচি ক্ষান্ত হইবে না। তাহারা অবশ্যই আমাদের অন্বেষণের নিমিত্ত ছদ্মচারী চরগণ প্রেরণ করিবে। তাহারা আমাদিগকে জানিতে পারিয়া বিপক্ষদিগের নিকট প্ৰকাশ করিলে অবশ্যই মহাদাভয় সমুপস্থিত হইবে। মহারাজ! পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, যেমন পূতিকরঞ্জ-লতা সোমলতার প্রতিনিধি হয়, সেইরূপ এক এক মাস এক এক বৎসরের প্রতিনিধি হইতে পারে; এমতে আমরা ত্ৰয়োদশ মাস সম্যকরূপে বনে বাস করিয়াছি; অতএব এই ত্ৰয়োদশ মাস ত্ৰয়োদশবর্ষ বলিয়া গণনা করুন। অথবা আপনি শত্রুনাশে কৃতসঙ্কল্প হউন, কেন না, উত্তমভারবাহী বৃষভকে পৰ্য্যাপ্তরূপে তৃপ্তিজনক ভোজন প্রদান করিলে মিথ্যাবচনজনিত পাপ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পরিবেন। সংগ্রাম ভিন্ন ক্ষত্রিয়গণের আর ধর্ম্ম নাই।”