৩৫তম অধ্যায়
বিবিধ পাপ-প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা
বেদব্যাস বলিলেন, “মনুষ্য যদি একবার পাণ করিয়া পুনরায় পাপে প্রবৃত্ত না হয়, তাহা হইলে সে তপস্যা, যজ্ঞ ও দানদ্বারা সেই পূৰ্ব্বকৃত পাপ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে। ব্রহ্মহত্যাকারী খট্বাঙ্গ [খাটের পায়া] ও নরকপাল[মড়ার] ধারণপূৰ্ব্বক ভিক্ষা করিয়া একবারমাত্র আহার, সতত অধ্যবসায়সম্পন্ন, অসূয়াশূন্য, অধঃশায়ী হইয়া যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান, ভৃত্যের সাহায্যনিরপেক্ষ হইয়া স্বয়ং কাৰ্য্যসংসাধন এবং জনসমাজে আপনার কুকর্ম্ম প্রকাশ করিলে দ্বাদশ বৎসরের পর স্বীয় পাপ হইতে বিমুক্ত হয়। এতদ্ভিন্ন পণ্ডিতদিগের ব্যবস্থা বা স্বেচ্ছানুসারে শস্ত্রধারীদিগের শস্ত্রে জীবন পরিত্যাগ, অধঃশিরাঃ হইয়া প্রজ্বলিত হুতাশনে তিনবার আত্মনিক্ষেপ, বেদপাঠ করিতে করিতে শত যোজন গমন, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে সর্ব্বস্ব বা জীবনযাপনোপযোগী ধন অথবা পরিচ্ছদসমবেত গৃহপ্রদান এবং গো ও ব্রাহ্মণের রক্ষাসম্পাদন— এই সকলের অন্যতর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলেও ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ হইতে মুক্তিলাভ হইতে পারে; আর যে ব্যক্তি প্রতিনিয়ত যৎসামান্যরূপে আহার করে, সে ছয় বৎসরে; যে ব্যক্তি মাসের মধ্যে সপ্তাহ প্রাতঃকালে আহার, সপ্তাহ সায়ংকালে আহার, সপ্তাহ অযাচিত-ব্রত অবলম্বন ও সপ্তাহ উপবাস করে, সে তিন বৎসরে; যে ব্যক্তি একমাস প্রাতঃকালে আহার, একমাস সায়ংকালে আহার, একমাস অযাচিত-ব্রত অবলম্বন ও একমাস উপবাস করে, সে এক বৎসরে এবং যে ব্যক্তি কেবল উপবাসে কালযাপন করে, সে অল্পদিবসের মধ্যেই ব্রহ্মহত্যা পাপ হইতে বিমুক্ত হয়। অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠান করিলেও ব্রহ্মহত্যাপাপ হইতে মুক্ত হইতে পারে। শ্রুতি অনুসারে যে ব্যক্তি অশ্বমেধসমাধানান্তে স্নান করে, সে সমস্ত পাপ হইতে বিমুক্ত হয়। যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণের নিমিত্ত যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করে, তাহাকে আর ব্রহ্মহত্যাপাপ ভোগ করিতে হয় না। সহস্ৰ ধেনু পাত্রসাৎ [সুপাত্রে প্রদান] করিতে পারিলে ব্রহ্মহত্যা ও অন্যান্য গুরুতর পাপ হইতে মুক্তিলাভ করা যায়। যে ব্যক্তি পঞ্চবিংশতি সহস্ৰ দুগ্ধবতী কপিলা দান করে এবং যে ব্যক্তি প্রাণসঙ্কটসময় উপস্থিত হইলে সাধু দরিদ্রদিগকে সহস্ৰ দুগ্ধবতী সবৎসা ধেনু দান করে, সে নিস্পাপ হয়। যে ব্যক্তি নিয়মশীল ব্রাহ্মণগণকে একশত কাম্বোজদেশীয় অশ্ব দান করে, তাহার পাপভয়নিবারণ হয়। যদি কেহ অন্ততঃ একজনেরও প্রার্থনানুরূপ অর্থদান করিয়া জনসমাজে কীৰ্ত্তন না করে, তাহা হইলে সে ইহলোক ও পরলোকে আপনার পবিত্রতাসম্পাদন করিতে সমর্থ হয়। যে ব্যক্তি একবার মাত্র সুরাপান করে, অগ্নিবর্ণ [অগ্নিতুল্য তপ্ত] সুরাপান করিলেই উভয়লোকে তাহার আত্মা পবিত্র হয়। পৰ্ব্বতের শিখরদেশ হইতে পতন, অগ্নি বেশ ও মহাপ্রস্থান[তনুত্যাগ জন্য হিমালয় আরোহণ] দ্বারা সমস্ত পাপখণ্ডন হইয়া থাকে। ব্রহ্মা কহিয়াছেন যে, সুরাপায়ী ব্রাহ্মণ বৃহস্পতিসত্ৰ [বৃহস্পতিযাগ] অনুষ্ঠান করিলে ব্রহ্মলোকে গমন করিতে সমর্থ হয়। সুরাপায়ী ব্যক্তি যদি ভূমিদানরূপ প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক বিশুদ্ধ ও মৎসরশূন্য হইয়া পুনরায় উহা পান না করে, তাহা হইলে তাহার পাপ বিনষ্ট হইয়া যায়। যে ব্যক্তি গুরুপত্নী হরণ করে, সে লৌহফলক তপ্ত করিয়া শয়ন ও আপনার লিঙ্গচ্ছেদন পূৰ্ব্বক ঊৰ্দ্ধদৃষ্টি হইয়া বনে গমন করিবে। শরীর পরিত্যাগ করিলে অশুভ কৰ্ম্ম হইতে বিমুক্ত হওয়া যায়। স্ত্রীলোকেরা আহারবিহার পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নিয়মাবলম্বন করিলে এক বৎসরের মধ্যেই পাপবিমুক্ত হয়। মহাব্রতের অনুষ্ঠান, সৰ্ব্বস্ব দান অথবা গুরুকাৰ্য্যসাধনার্থ যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিলে সমুদয় অশুভকাৰ্য্য হইতে নিষ্কৃতি লাভ করা যায়। যে ব্যক্তি গুরুর নিকট মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ বা তাহার দ্রব্য অপহরণ করে, সে গুরুর প্রিয়কাৰ্য্য সাধন করিতে পারিলেই সেই পাপ হইতে বিমুক্ত হয়। যে ব্যক্তি স্ত্রীসংসৰ্গাদিদ্বারা নিয়ম লঙ্ঘন করে, সে ব্রহ্মহত্যাবিহিত ব্রত পালন ও ছয়মাস গোচৰ্ম্ম পরিধান করিলে নিস্পাপ হয়। যে ব্যক্তি পরদারাভিগমন ও পরবিত্তাপহরণ করে, সে সংবৎসর নিয়মানুষ্ঠান করিলে পাপশূন্য হয়। যে ব্যক্তি যে পরিমাণে অন্যের অর্থ অপহরণ করে, সে যে কোন উপায়ে হউক, তাহাকে সেই পরিমাণে অর্থ প্রদান করিতে পারিলে তাহার সেই পাপ বিনষ্ট হইয়া যায়। যে ব্যক্তি জ্যেষ্ঠভ্রাতৃসত্ত্বে বিবাহ করে, সে ও তাহার জ্যেষ্ঠভ্রাতা উভয়ে দ্বাদশরাত্রি নিয়মাবলম্বনপূৰ্ব্বক ব্রতপালন করিলে উভয়েই পবিত্র হয়; কিন্তু সেই কনিষ্ঠভ্রাতাকে পিতৃলোকের উদ্ধার সাধনার্থ অবশ্যই পুনরায় বিবাহ করিতে হইবে। তাহা হইলে তাহার পূৰ্ব্ববিবাহিত পত্নীও নির্দোষ ও পরিশুদ্ধ হইবে। ধৰ্ম্মবিৎ পণ্ডিতেরা কহেন, স্ত্রীলোকেরা চাতুর্ম্মাস্যব্রত অনুষ্ঠান করিলেই শুদ্ধি লাভ করে। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা স্ত্রীলোকদিগকে মানসিক পাপে দূষিত বিবেচনা করেন না; কেন না, ভস্মদ্বারা পাত্র যেমন শুদ্ধ হয়, তদ্রূপ মহিলাগণ রজোযোগ হইলেই বিশুদ্ধ হইয়া থাকে। কাংস্যপাত্র শুদ্রের উচ্ছিষ্ট, গোকর্ত্তৃক আঘ্রাত বা ব্রাহ্মণের গণ্ডুষদ্বারা দূষিত হইলে উহা দশবিধ শোধনীয় দ্রব্যে শুদ্ধ করিবে। ব্রাহ্মণের চতুষ্পদ, ক্ষত্রিয়ের ত্রিপাদ, বৈশ্যের দ্বিপাদ ও শূদ্রের একমাত্র ধর্ম্ম বিদ্যমান আছে। লোকে ধৰ্ম্মের তারতম্য অনুসারেই উহাদিগের গৌরব ও লাঘব অবধারণ করিবে। পশু-পক্ষিবধ ও বৃক্ষচ্ছেদন করিলে আপনার কুকৰ্ম্ম জনসমাজে প্রচারপূৰ্ব্বক তিনরাত্রি বায়ু ভক্ষণ করিয়া থাকিবে। অগম্যাগমন করিলে ছয়মাস ভস্মে শয়ন ও আর্দ্র বস্তু পরিধানপূর্ব্বক বিচরণ করিবে।
“হে মহারাজ! কুকার্য্য অনুষ্ঠান করিলে দৃষ্টান্তশাস্ত্র, যুক্তি ও প্রজাপতিনিৰ্দিষ্ট বিধি অনুসারে এইরূপ প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। যে ব্রাহ্মণ অহিংস, মিতভাষী ও পরিমিতভোজী হইয়া পবিত্রস্থানে গায়ত্রী জপ করে, তাহার সমস্ত পাপ ধ্বংস হয়। দ্বিজগণ দিবসে অনাবৃত স্থলে উপবেশন, রজনীযোগে তথায় নিদ্রাসেবন, দিবসে তিনবার ও রজনীতে তিনবার বস্ত্র পরিধানপূৰ্ব্বক স্নান এবং স্ত্রী, শূদ্র ও পতিত ব্যক্তির সহিত আলাপ পরিত্যাগ করিলে অজ্ঞানকৃত পাপ হইতে বিমুক্ত হইতে পারেন। হে মহারাজ! সমুদয় প্রাণীগণই দেহান্তে নিজ নিজ শুভাশুভ কার্য্যের ফলভোগ করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি অতিরিক্ত পাপ অথবা পুণ্যকার্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাহাকে তাহার অতিরিক্ত ফলভোগ করিতে হয়। অতএব জ্ঞান, তপস্যা ও সকাৰ্য্যদ্বারা শুভফল পরিবর্দ্ধিত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। লোকে পাপকাৰ্য্য হইতে বিরত হইয়া শুভকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান ও নিত্য ধনদান করিলে নিস্পাপ হইতে পারে। এক্ষণে যে পাপের যেরূপ প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম। মহাপাতক ভিন্ন সমুদয় পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত আছে। অন্যান্য ভক্ষাভক্ষ্য ও বাচ্যাবাচ্যবিষয়ে জ্ঞানকৃত ও অজ্ঞানকৃত এই দুইপ্রকার পাপ আছে; জ্ঞানকৃত পাপ গুরু ও অজ্ঞানকৃত পাপ লঘু। আস্তিক ও শ্রদ্ধান্বিত ব্যক্তিরা বিধিপূৰ্ব্বক প্রায়শ্চিত্ত করিলেই পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন। নাস্তিক, দাম্ভিক ও অশ্রদ্ধাবান ব্যক্তিরা প্রায়ই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে প্রবৃত্ত হয় না; প্রায়শ্চিত্ত করিলেও তাহাদের পাপনাশের সম্ভাবনা নাই। যে পুরুষ ইহলোকে সুখলাভের প্রত্যাশা করে, তাহাকে অবশ্যই শিষ্টাচার আশ্রয় ও শিষ্ট ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করিতে হইবে। তুমি শিষ্টাচারযুক্ত; বিশেষতঃ প্রাণ ও ধনরক্ষাৰ্থ যুদ্ধে ক্ষত্রিয়দিগকে সংহার করিয়াছ, অতএব অবশ্যই পাপ হইতে মুক্ত হইবে। যদি তোমার নিতান্তই আপনাকে পাপী বলিয়া বোধ হইয়া থাকে, তবে প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান কর। মূঢ়ের ন্যায় ক্রোধের বশবর্ত্তী হইয়া প্রাণত্যাগ করা তোমার নিতান্ত অকর্ত্তব্য।”