৩৪তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক ভীমবাক্যের অনুমোদন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহানুভব সত্যব্রত যুধিষ্ঠির ভীমসেনের বাক্য শ্রবণানন্তর ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “ভ্রাতঃ! আমি তোমার বাক্যরূপ শল্যদ্বারা ব্যথিত হইয়াও তোমাকে অভিযোগ করিতে পারি না; আমার অন্যায়াচরণেই তোমরা এরূপ বিষাদ-সাগরে পতিত হইয়াছ, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি দুৰ্য্যোধনের রাজ্যজিহীর্ষু [রাজ্যহরণে ইচ্ছুক] হইয়া অক্ষাগ্ৰহণ করিয়াছিলাম, ইহা জানিতে পারিয়া ধূর্ত্ত শকুনি দুৰ্য্যোধনের প্রতিনিধি হইয়া আমার সহিত অক্ষক্রীড়া করিতে লাগিল। আমি শঠতা করিতে অক্ষম, কিন্তু শঠশিরোমণি সৌবল সভামধ্যে শঠতাসহকারে অক্ষসমূহ বিক্ষেপ করিয়া জয়লাভ করিল। আমি যখন তাহার কুটিলতা বুঝিতে পারিয়া অক্ষগুলিকে তদীয় অভিলাষানুরূপ অযুগ [ঘুঁটির জোড়া ভাঙ্গা] ও যুগবন্ধ [ঘুঁটির জোড়া মিলান—চালের চতুরতা] হইতে দেখিলাম, তখন আমার নিবৃত্ত হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু ক্রোধোদয় হইয়া আমর ধৈর্য্য বিনষ্ট করায় আমি নিবৃত্ত হইতে অসমর্থ হইয়াছিলাম। পুরুষের ধৈৰ্য্যলোপ হইলে কি পৌরুষ, কি অভিমান, কি বীরত্ব কিছুতেই তাহাকে সংযত করিতে পারে না। বোধ হয়, এই প্রকার ভবিতব্যতাই ছিল, তন্নিমিত্তই তোমার কথাতে দোষারোপ করিতে পারি না। যখন দুৰ্য্যোধন রাজ্যহরণাভিলাষে আমাদিগকে ব্যসনে নিমগ্ন করিয়া দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ করিয়াছিল, তখন দ্ৰৌপদী হইতেই আমরা পরিত্রাণপ্ৰাপ্ত হইয়াছিলাম।
“আমরা পুনর্ব্বার দ্যূতের নিমিত্ত সভামধ্যে সমাগত হইলে ধৃতরাষ্ট্রনন্দন দুৰ্য্যোধন ভরতগণের সমক্ষে কহিল যে, হে অজাতশত্ৰো! দ্যূতে পরাজিত হইলে তোমাকে ও তোমার ভ্রাতৃগণকে দ্বাদশবৎসর বনবাসে এবং একবৎসর অজ্ঞাতবাসে কালব্যাপন করিতে হইবে; যদ্যপি ভারতচরেরা তোমার অজ্ঞাতবাস জানিতে পারে, তাহা হইলে পুনরায় দ্বাদশবর্ষ অরণ্যে ও একবর্ষ অজ্ঞাতচারে বাস করিতে হইবে; আর যদ্যপি তোমরা আমাদিগের চরগণকে মুগ্ধ করিয়া তাহাদিগের অজ্ঞাতে ঐ অজ্ঞাতবাস বৎসর অতিবাহিত করিতে পার, তাহা হইলে পঞ্চনাদদেশ নিশ্চয়ই তোমাদের হইবে। যদি আমাদিগকে পরাজিত করিতে সমর্থ হও, তাহা হইলে আমরাও এইরূপ আচরণ করিব। এইমাত্র পণ স্থির করিলাম। ইহা শ্রবণ করিয়া তুমি ও ধনঞ্জয় কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান না করায় আমিও সেই পণে অনুমোদন করিলাম।
“তখন দুৰ্য্যোধনও শান্তির নিমিত্ত কিঞ্চিম্মাত্র চিন্তা না করিয়া সাতিশয় ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া উঠিল ও আপনার বশতাপন্ন কৌরবগণকে প্রোৎসাহিত করিতে লাগিল। পরিশেষে আমাদিগের দ্যূতক্রীড়া অতি জঘন্য হইলে আমরাই পরাজিত হইয়া বিবাসিত হইলাম। এইরূপে নিষ্কাশিত হইয়া বহুক্লেশে জঘন্যবেশে দেশে দেশে ও বনে বনে ভ্রমণ করিতেছি। কোন ব্যক্তি সাধুগণের সমক্ষে ঈদৃশী প্রতিজ্ঞা করিয়া পুনরায় রাজ্যলাভের নিমিত্ত উহা উল্লঙ্ঘন করিতে পারে? আৰ্য্যব্যক্তির পক্ষে ধর্ম্মপথ অতিক্রম করিয়া রাজ্যলাভ করা মরণ অপেক্ষাও অধিকতর ক্লেশকর হইয়া উঠে। হে ভীম! তুমি যখন দ্যূতস্থলে পরিঘাস্ত্র পরিমাজিত করিয়া আমার বাহুদ্বয় ভস্মসাৎ করিতে উদ্যত হইয়াছিলে, তখন কেবল ধনঞ্জয় তোমাকে নিবারণ করিয়াছিল; কিন্তু যদি তুমি তখন বীরত্ব প্রকাশ করিতে, তাহা হইলে কোন প্রকার অনিষ্ট ঘটনা হইতে পারিত না। তুমি সকলের পৌরুষজ্ঞ হইয়া কি নিমিত্ত প্ৰতিজ্ঞা করিবার পূর্ব্বে এরূপ বাক্য বলিতে বিরত ছিলো? এক্ষণে কালকল্প বিপদপ্রাপ্ত হইয়া আমার প্রতি ঈদৃশ বাক্যবাণ প্রয়োগ করিলে কি হইবে? হে ভীম! আমরা যে যজ্ঞসেনীর তাদৃশ দুরবস্থান দর্শন করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছিলাম, সেই দুঃখই এক্ষণে বিষরসের ন্যায় আমার হৃদয় জীর্ণ ও কায় শীর্ণ করিতেছে। হে ভারতপ্রবীর! যেমন কৃষীবলেরা বীজ বপন করিয়া ফলরাশির প্রতীক্ষা করিয়া থাকে, তদ্রূপ তুমি সুখোদায়ের সময় প্রতীক্ষা কর। কৌরববীর মধ্যে যে-সকল কথা কহিয়াছ, আজি তদনুযায়ী কর্ম্মকরা কোনক্রমে উচিত নহে। যদি প্রতারিত ব্যক্তি অরিকুলকে বলসম্পন্ন জানিয়া তৎক্ষণাৎ ছেদ করিতে পারে, তাহা হইলে তাহার পুরুষকার নানাগুণে মণ্ডিত ও জীবলোকে জীবনধারণ সফল হইয়া উঠে, সেই ব্যক্তিই সমগ্র রাজলক্ষ্মী প্রাপ্ত হইতে পারে, শত্ৰুগণও তাহার নিকট অবনত হইয়া থাকে। যেমন অমরবর্গ ইন্দ্রের আজ্ঞানুবতী হইয়া সুখে কালাতিপাত করিয়া থাকেন, তদ্রূপ মিত্ৰগণ শীঘ্ৰ তাহার বশবর্ত্তী হইয়া জীবনকাল অতিবাহিত করে। হে বীর! নিশ্চয় বোধ করিবে যে, আমার প্রতিজ্ঞা কদাচ মিথ্যা হইবে না। আমি দেবত্ব ও জীবন অপেক্ষাও ধর্ম্মকে প্ৰিয়তম জ্ঞান করিয়া থাকি। রাজ্য, ধন, পুত্র ও যশ এই সমস্ত বস্তু সত্যের এক কণারও সদৃশ হইতে পারে না।’