৩৪তম অধ্যায়
বেদব্যাসকর্ত্তৃক বিবিধ পাপ-প্রায়শ্চিত্ত কথন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! ইহলোকে মানবগণ কি কি কাৰ্য্য করিয়া প্রায়শ্চিত্তে অধিকারী হয় এবং কি কি কাৰ্য্য করিলে পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
বেদব্যাস কহিলেন, “যে ব্যক্তি বিধিবিহিত কার্য্যের অনুষ্ঠান, নিষিদ্ধ কার্য্যের অনুষ্ঠান ও কপট ব্যবহার করে, যে ব্যক্তি ব্রহ্মচারী হইয়া সূর্য্যোদয়ের পর শয্যা হইতে গাত্রোত্থান ও সূৰ্য্যাস্তুসময়ে শয়ন করে, যে ব্যক্তি কুনখ ও শ্যাবদন্ত[কৃষ্ণবর্ণ দন্ত বা দন্তের ফাঁকে ক্ষুদ্র দন্ত]যুক্ত হয়, যে পুরুষ জ্যেষ্ঠের বিবাহ না হইতে বিবাহ করে, যাহার অনুঢ়াবস্থায় তাহার কনিষ্ঠের বিবাহ হয়, যে ব্যক্তি ব্রহ্মহত্যা ও পরনিন্দা করে, যে ব্যক্তি শ্বশুরের জ্যেষ্ঠকন্যা অনূঢ়া[অবিবাহিতা] থাকিতে কনিষ্ঠার পাণিগ্রহণে প্রবৃত্ত হয় এবং যে ব্যক্তি কনিষ্ঠার বিবাহের পর জ্যেষ্ঠাকে বিবাহ করে, আর যাহারা ব্রত ধ্বংস, দ্বিজাতিহত্যা, অপাত্রে দান, সৎপাত্রে কৃপণতা, অনেক জীবের প্রাণসংহার, মাংস বিক্রয়, বেদ বিক্রয়, অগ্নি পরিত্যাগ, গুরু ও স্ত্রীলোকের প্রাণসংহার, অকারণে পশুচ্ছেদন, গৃহদাহ, মিথ্যাবাক্য-প্রয়োগ, গুরুর প্রতি অত্যাচার ও মর্য্যাদা লঙঘন করে, তাহাদিগকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়।
“হে মহারাজ! এতদ্ভিন্ন লোকে যেসমস্ত বেদবিরুদ্ধ কাৰ্য্য করিয়া থাকে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। স্বধৰ্ম্ম-পরিত্যাগ, পরধৰ্ম্ম-আশ্রয়, অযাজ্যযাজন[অন্ত্যজ পতিতাদির পৌরোহিত্য], অভক্ষ্যভক্ষণ, শরণাগত ব্যক্তিকে পরিত্যাগ, ভৃত্যগণের ভরণপোষণে অনাস্থা, লবণাদি বিক্রয়, তির্য্যগযোনি[পশুপক্ষী প্রভৃতি]বধ, ক্ষমতাসত্ত্বে গোগ্রাসাদি নিত্য দেয় বস্তুর অপ্রদান, দক্ষিণা-দানপরাঙ্মুখতা, ব্রাহ্মণের অবমাননা, অনুপযুক্ত সময়ে পুত্রগণকে বিভাজ্য ধন প্রদান, গুরুপত্নীহরণ ও যথাসময়ে ধর্ম্মপত্নীর সহবাস পরিত্যাগ নিতান্ত নিন্দনীয়। যাহারা ঐ সকল কাৰ্য্যানুষ্ঠান করে, তাহারা অধার্ম্মিক। তাহাদের ঐ সকল কুকর্ম্মের নিমিত্ত প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়।
“এক্ষণে যে যে স্থলে লোকে কুকর্ম্ম করিলেও পাপে লিপ্ত হয় না, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বেদপারগ ব্রাহ্মণও যদি জিঘাংসাপরবশ হইয়া অস্ত্রগ্রহণপূর্ব্বক সংগ্রামে ধাবমান হয়, তাহাকে বিনাশ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ঐরূপ ব্রাহ্মণকে নিপাতিত করিলে কখনই ব্রহ্মহত্যার পাপভোগ করিতে হয় না। বেদপ্রমাণানুসারে স্বধর্ম্মভ্রষ্ট আততায়ী ব্রাহ্মণকে বিনাশ করিলেও ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না। কারণ, হত্যাকারীর ক্রোধই তাহার শত্রুকোপের প্রতি ধাবমান হইয়া অরাতির প্রাণসংহার করে। যে ব্যক্তি অজ্ঞানতাবশতঃ বা প্রাণনাশক উৎকট পীড়ার সময় সুবিচক্ষণ চিকিৎসকের আদেশানুসারে মদিরা পান করে, তাহার পূনৰ্ব্বার সংস্কার করিলেই সে পাপ হইতে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ হয়। ইতিপূৰ্ব্বে অভক্ষ্য ভক্ষণ প্রভৃতি যত প্রকার পাপকার্য্য কীৰ্ত্তন করিলাম, প্রায়শ্চিত্তদ্বারা সেসমুদয় পাপেরই ধ্বংস হইতে পারে। গুরুর আজ্ঞানুসারে গুরুপত্নীতে গমন করিলে তন্নিবন্ধন পাপভোগ করিতে হয় না, মহর্ষি উদ্দালক শিষ্যদ্বারা স্বীয় পুত্র শ্বেতকেতুকে উৎপাদিত করিয়াছিলেন। যে ব্যক্তি গুরুর নিমিত্ত আপৎকালে ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতির ধন হরণ করে, তাহাকে চৌর্য্যদোষে দূষিত হইতে হয় না। ফলতঃ ভোগাভিলাষে সতত চৌর্য্যে ব্যাপৃত থাকিলেই তন্নিবন্ধন পাপ ভোগ করিতে হয়। আপনার বা অপরের প্রাণরক্ষা, গুরুর কার্য্যসাধন, বিবাহসম্পাদন এবং স্ত্রীলোকের সন্তোষসাধনের নিমিত্ত মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করা দূষ্য নহে। স্বপ্নে ব্রাহ্মণের রেতঃস্খলন [বীৰ্য্যপতন] হইলে তাহার পুনৰ্ব্বার উপনয়ন করিতে হয় না; কেবল সমিদ্ধ অগ্নিতে আজ্যহোম করিলেই উহার প্রায়শ্চিত্ত করা হয়। জ্যেষ্ঠভ্রাতা পতিত বা প্রব্রজিত হইলে তাহার অনূঢ়াবস্থায় কনিষ্ঠের পাণিগ্রহণ দোষাবহ নহে। অভিযাচিত হইয়া পরস্ত্রী সম্ভোগ করিলে পাপভাগী হইতে হয় না। পশুগণ বিধিনির্দেশানুসারে পবিত্রতা লাভ করিয়াছে; অতএব শ্রাদ্ধাদি কাৰ্য্য ভিন্ন পশুহত্যায় উপদেশ প্রদান করা নিতান্ত কর্ত্তব্য। অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত অযোগ্য ব্রাহ্মণকে ধনদান ও সৎপাত্রে অপ্রদান দোষাবহ নহে। স্ত্রী ব্যভিচারিণী হইলে তাহাকে পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। উহাতে সেই স্ত্রী পবিত্রতা লাভ করিতে পারে, স্বামীকেও কোন পাপে লিপ্ত হইতে হয় না। সোমরসের তত্ত্ব অবগত হইয়া তাহা বিক্রয়, অসমর্থ ভৃত্যকে পরিত্যাগ এবং গোরক্ষাৰ্থ বনদাহ করা দোষাবহ নহে। হে মহারাজ! যে যে স্থলে যেসকল কাৰ্য্য করিলে মানবগণকে পাপভোগ করিতে হয় না, তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে প্রায়শ্চিত্তের বিষয় বিস্তারপূৰ্ব্বক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।”