চতুস্ত্রিংশ অধ্যায়
ইন্দ্রের সহিত গরুড়ের মিত্রতা
গরুড় কহিলেন, “হে দেবরাজ! তোমার স্বেচ্ছাক্রমে অদ্যাবধি তোমার সহিত আমার মিত্রত্ব-সংস্থাপন হইল। আমার বল নিতান্ত দুঃসহ ও একান্ত মহৎ। যদিচ স্বকীয় গুণকীর্ত্তন ও বল-প্রশংসা করা পণ্ডিতমণ্ডলীর অনুমোদিত নহে, বিশেষতঃ অকারণে আত্মপ্রশংসা অতিশয় অন্যায়, তথাপি তুমি আমার সখা এবং আগ্রহাতিশয়সহকারে জিজ্ঞাসা করিতেছ, এই নিমিত্ত কহিতে প্রবৃত্ত হইলাম, শ্রবণ কর। আমার বলের কথা অধিক কি বলিব, আমি পর্ব্বতকাননাদিসহিতা এই সসাগরা বসুন্ধরাকে অক্লেশে একপক্ষে বহন করিতে পারি। আর যদি তুমি ঐ পক্ষ অবলম্বন কর, তবে তোমাকেও লইয়া যাইতে পারি। চরাচর বিশ্বকে বহন করিতে হইলেও আমার কিছুমাত্র পরিশ্রম বোধ হয় না।”
গরুড় এইরূপে স্বীয় বলের পরিচয় প্রদান করিলে সর্ব্বলোকহিতকারী দেবরাজ কহিলেন, “হে বিহঙ্গরাজ! তুমি যাহা কহিলে, তোমাতে সকলই সম্ভব; এক্ষণে আমার সহিত সখ্যসংস্থাপন কর এবং অমৃতে যদি প্রয়োজন না থাকে, তবে আমাকে প্রত্যর্পণ কর; এই অমৃত যাহাদিগকে অর্পণ করিবে, তাহারাই আমাদিগের উপর উপদ্রব করিবে।” গরুড় কহিলেন, “হে সহস্রলোচন! আমি কোন কারণবশতঃ এই অমৃত লইয়া যাইতেছি, প্রার্থনা করিলে ইহার বিন্দুমাত্রও কাহাকে প্রদান করিব না; কিন্তু আমি যেস্থানে ইহা রাখিব, তুমি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপহরণ করিও।” ইন্দ্র কহিলেন, “হে বিহঙ্গরাজ! আমি তোমার এই কথা শ্রবণ করিয়া যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হইলাম, এক্ষণে আমার নিকটে অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।” তখন গরুড় কদ্রুপুৎত্রদিগের দৌরাত্ম্য ও মাতার ছলকৃত দাসীভাব স্মরণ করিয়া কহিলেন, “আমি সকলের ঈশ্বর হইয়াও তোমার নিকট বর প্রার্থনা করিতেছি, যেন মহাবল সর্পসকল আমার ভক্ষ্য হয়।” দানবনিসূদন ইন্দ্র “তথাস্তু” বলিয়া দেবদেব যোগীশ্বর মহাত্মা হরির নিকট গমন করিলেন। চক্রপাণি দেবরাজ-মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া গরুড়াভিলষিত বিষয়ে অনুমোদন করিলেন।
বিনতার দাস্যমুক্তি
অনন্তর ভগবান্ ত্রিদশেশ্বর গরুড়কে পুনর্ব্বার কহিলেন, “তুমি অমৃত স্থাপন করিলেই আমি তাহা অপহরণ করিব।” এই বলিয়া সাদর-সম্ভাষণে তাঁহাকে বিদায় দিলেন। গরুড় অনতিবিলম্বে স্বীয় জননী-সন্নিধানে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক হৃষ্টমনে সর্পদিগকে কহিলেন, “এই আমি অমৃত আহরণ করিয়াছি; এক্ষণে ইহা এই কুশের উপর রাখিতেছি, তোমরা শীঘ্র স্নানপূজা করিয়া পান কর। দেখ, তোমরা যাহা কহিয়াছিলে, তাহা আমি সম্পাদন করিলাম; অতএব অদ্যাবধি আমার মাতা দাস্যবৃত্তি হইতে মুক্ত হউন।” সর্পগণ “তথাস্তু” বলিয়া স্নান করিতে গমন করিল। এই অবসরে দেবরাজ ইন্দ্র অমৃত অপহরণ করিয়া স্বর্গে প্রস্থান করিলেন। সর্পেরা স্নান, পূজা ও মঙ্গলাচরণ সমাপন করিয়া প্রফুল্লমনে অমৃতপান করিতে আসিয়া দেখিল, গরুড় যে কুশাসনে অমৃত রাখিব বলিয়াছিলেন, তথায় অমৃত নাই। পরে বিবেচনা করিল, আমরা যেমন ছলক্রমে বিনতাকে দাসী করিয়াছিলাম, তেমনি ছলে অমৃত হরণ করিয়াছে। তখন নাগগণ এই স্থানে অমৃত রাখিয়াছিল, এই বিবেচনা করিয়া সেই কুশাসন অবলেহন করিতে লাগিল। তাহাতেই তাহাদিগের জিহ্বা দুই খণ্ডে বিভক্ত হইয়াছে এবং পরম পবিত্র অমৃত কুশে সংস্পৃষ্ট হইয়াছিল বলিয়া তদবধি কুশের নাম পবিত্র হইয়াছে। মহাত্মা গরুড় এইরূপে অমৃতের হরণ ও আহরণ করিয়াছিলেন এবং সর্পদিগকে দ্বিজিহ্ব [দুইটি জিহ্বাযুক্ত] করিয়াছিলেন।
অনন্তর খগরাজ পরিতুষ্ট-মনে সেই কাননে বিহার করিয়া ভুজঙ্গমগণ ভক্ষণপূর্ব্বক স্বীয় জননী বিনতাকে আনন্দিত করিলেন। যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণগণ-সন্নিধানে এই অপূর্ব্ব উপাখ্যান শ্রবণ বা পাঠ করিবে, সে মহাত্মা খগরাজ গরুড়ের চরিত-কীর্ত্তন-প্রযুক্ত পাপস্পর্শশূন্য হইয়া স্বর্গারোহণ করিবে, সন্দেহ নাই।