৩৩তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের পুনঃ শোক ব্যাসের পুনঃ সান্ত্বনা
তখন যুধিষ্ঠির ব্যাসকে বিনীতবচনে কহিলেন, “পিতামহ! আমি রাজ্যলোভে পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা, শ্বশুর, গুরু, মাতুল, পিতামহ, সম্বন্ধী, ভাগিনেয়, সুহৃৎ ও জ্ঞাতিগণ এবং নানা দিগ্দেশ হইতে সমাগত মহীপালগণকে নিহত করিয়াছি। এক্ষণে আমি সেই ধর্ম্মপরায়ণ মহাবলপরাক্রান্ত ভূপালগণের অভাবে কি লইয়া অবস্থান করিব? এই পৃথিবী সেই সমস্ত পার্থিববিহীন হইয়াছে, ইহা বারংবার চিন্তা করাতে আমার হৃদয় অদ্যাপি নিরন্তর দুঃখানলে দগ্ধ হইতেছে। জ্ঞাতিবধ ও অন্যান্য অসংখ্য মনুষ্যের নিধন স্মরণ করিয়া আমার অন্তঃকরণে শোকসাগর সমুচ্ছলিত হইয়াছে। হায়! যে সমস্ত মহিলারা পতি, পুত্র ও ভ্রাতৃবিহীন হইয়াছে, আজ তাহাদিগের কি অবস্থা ঘটিবে? তাহারা পাণ্ডব ও যাদবগণকে পরম শত্ৰু স্থির করিয়া চীৎকার করিতে করিতে দীনভাবে ভূতলে নিপতিত হইবে এবং পতি, পুত্র, ভ্রাতা ও পিতৃগণকে নিরীক্ষণ না করিয়া তাহাদের প্রতি প্রীতি ও স্নেহনিবন্ধন প্রাণপরিত্যাগ করিবে, সন্দেহ নাই। ধৰ্ম্মের গতি সূক্ষ্ম। সেই বন্ধুবান্ধববিহীন কামিনীগণের প্রাণত্যাগনিবন্ধন আমাদিগকে প্রকারান্তরে স্ত্রীবধপাতকেও লিপ্ত হইতে হইল। হায়। আমরা সুহৃদগণকে বিনাশ করিয়া যে ঘোরতর পাপানুষ্ঠান করিয়াছি, তাহার নিমিত্ত আমাদিগকে নিশ্চয়ই অধঃশিরাঃ হইয়া নরকে নিপতিত হইতে হইবে। ঐ পাপের প্রতিকারের নিমিত্ত আমি অতিকঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ধ্বক কলেবর পরিত্যাগ করিবার অভিলাষ করিয়াছি। এক্ষণে কোন্ আশ্রম অবলম্বন করিলে ঐ পাপ বিনষ্ট হইতে পারে, আপনি তাহা নির্দেশ করিয়া দিন।”
যুধিষ্ঠিরের প্রতি ব্যাসের অশ্বমেধ উপদেশ
মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন রাজা যুধিষ্ঠিরের সেই বাক্যশ্রবণে সবিশেষ বিবেচনা করিয়া কহিলেন, “বৎস! ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে বিষাদসাগরে নিমগ্ন হওয়া তোমার নিতান্ত অনুচিত হইতেছে। দেখ, তোমার জ্ঞাতিবর্গ ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ বিপুল যশ ও মহতী শ্ৰীলাভের অভিলাষে ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া আপনাদের অপরাধেই আপনারা নিহত হইয়াছেন। তুমি, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব তোমরা কেহই তাঁহাদিগকে বিনাশ কর নাই। ধৰ্ম্মসাক্ষী কালই প্রাণীদিগের প্রাণ অপহরণ করিয়া থাকে। তাহার অনুগ্রহের পাত্র সংসারে কেহই নাই। যুদ্ধাদি ব্যাপার নিমিত্ত মাত্র; প্রাণীগণ ঈশ্বরের নিয়মানুসারেই পরস্পর নিহত হইয়া থাকে। কাল পুণ্যপাপের সাক্ষিস্বরূপ ও কর্ম্মসূত্রাত্মক। উহা সকলকে সুখদুঃখবহুল কর্ম্মফল প্রদান করিয়া থাকে। হে মহারাজ! এক্ষণে তুমি একবার সেইসমস্ত ক্ষত্রিয়গণের কাৰ্য্য সবিশেষ পর্য্যালোচনা কর; তাহারা আত্মবিনাশজনক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াই কালকবলে নিপতিত হইয়াছে। আর তুমি আপনার কর্ম্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেও সুস্পষ্ট বুঝিতে পারিবে যে, তুমি ব্রতপরায়ণ শান্তস্বভাব হইয়াও কেবল দৈবপ্রভাবে সেইরূপ হিংসাজনক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলে। ত্বষ্ট[২]নিৰ্মিত যন্ত্র যেমন পরিচালকের অধীন, তদ্রূপ এই জগৎ কালকৃত কৰ্ম্মের সম্যক আয়ত্ত। যখন পুরুষের যদৃচ্ছাক্রমে উৎপত্তি ও যদৃচ্ছাক্রমে বিনাশ হইয়া থাকে, তখন শোক ও হর্ষ প্রকাশ করা নিতান্ত নিষ্ফল। হে মহারাজ! এক্ষণে তোমার এই যে মিথ্যা মনঃপীড়া উপস্থিত হইয়াছে, ইহার নিমিত্ত তুমি প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান কর। এইরূপ কিংবদন্তী আছে যে, পূৰ্ব্বে দেবতা ও অসুরগণ পরস্পর শ্রীলাভার্থী হইয়া একাদিক্রমে দ্বাত্রিংশৎসহস্র বৎসর ঘোরতর যুদ্ধ করিয়াছিলেন। পরে দেবগণ অসুরগণকে নিহত ও তাহাদিগের শোণিতে পৃথিবী সমাচ্ছন্ন করিয়া স্বর্গ অধিকার করেন। আর ত্রিলোকমধ্যে শালাবৃক নামে বিখ্যাত অষ্টাশীতি সহস্র বেদপারগ ব্রাহ্মণ পৃথিবী লাভ করিয়া দর্পপ্রভাবে দানবগণকে সাহায্য দান করিবার নিমিত্ত বর্ম ধারণ করিলে, সুরগণ তাঁহাদিগকে বিনাশ করিয়াছেন। অতএব যাহারা অধর্ম্মে প্রবর্ত্তিত বা ধৰ্ম্ম উন্মূলিত করিবার চেষ্টা করে, তাহাদিগকে অবিলম্বেই সংহার করা কর্ত্তব্য। বিশেষতঃ যদি এক ব্যক্তিকে বিনাশ করিলে একটি কুল অথবা একটি কুল নির্মূল করিলে সমস্ত রাজ্য নিরাপদ হয়, তবে তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য। উহাতে ধৰ্ম্মের কিছুমাত্র হানি হয় না। কোন স্থলে অধৰ্ম্ম ধর্ম্মের ন্যায় এবং কোন স্থানে ধৰ্ম্ম অধৰ্ম্মের ন্যায় লক্ষিত হয়; কিন্তু পণ্ডিত ব্যক্তিরা কোন্টি যথার্থ ধর্ম্ম আর কোনটি যথার্থ অধর্ম্ম, তাহা অনায়াসে হৃদয়ঙ্গম[মনোমধ্যে ধারণা] করিতে পারেন। তুমি অতি বিচক্ষণ, অতএব এ স্থলে ধৈৰ্য্যাবলম্বন করাই তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি দেবগণের পূৰ্ব্ব প্রদর্শিত পদবীতেই পদার্পণ করিয়াছ। যাহারা রাজ্যলাভার্থী হইয়া অন্যের প্রাণসংহার করে, তাহাদিগকে কখনই নিরয়গামী হইতে হয় না। অতএব তুমি এক্ষণে ভ্রাতৃগণ ও বন্ধুবৰ্গকে আশ্বাস প্রদান কর। যে দুরাত্মা সতত পাপানুষ্ঠানের। চেষ্টা করে, পাপকার্য্য বুঝিতে পারিয়াও তাহাতে প্রবৃত্ত হয় এবং পাপকর্ম্ম সম্পাদন করিয়া কিছুমাত্র লজ্জিত হয় না, তাহাকে প্রতিনিয়ত সেই পাপের ফলভোগ করিতে হয়। ঐরূপ ব্যক্তির পাপ প্রায়শ্চিত্তদ্বারা কদাপি বিনষ্ট হইবার নহে; কিন্তু তুমি পাপশূন্য-হৃদয়ে দুর্য্যোধনের দোষে অনিচ্ছাপূৰ্ব্বক ভূপতিগণের বধব্যাপারে প্রবৃত্ত হইয়া অনুতাপ করিতেছ। এক্ষণে তুমি অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেই সমুদয় পাপ হইতে নিষ্কৃতি পাইবে। ভগবান পুরন্দর দেবগণসমভিব্যাহারে অরাতিগণকে পরাজয়পূৰ্ব্বক ক্রমে ক্রমে একশত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া নিস্পাপ ও শতক্রতুনামে বিখ্যাত হইয়াছেন। এক্ষণে তিনি স্বচ্ছন্দে দেবগণের সহিত বিবিধ সুখসম্ভোগ করিতেছেন। অপ্সরাগণ তাহার শুশ্রূষায় এবং দেবতা ও ঋষিগণ তাঁহার উপাসনায় নিরত রহিয়াছেন। হে মহারাজ! এক্ষণে তুমিও ইন্দ্রের ন্যায় স্বীয়। ভুবলে শত্রুপক্ষ পরাজিত করিয়া এই সসাগরা ধরিত্রীর অধীশ্বর হইয়াছ, অতএব যেসমস্ত মহীপাল সংগ্রামে নিহত হইয়াছেন, তুমি তাঁহাদিগের রাজ্যে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগের ভ্রাতা, পুত্র ও পৌত্রগণকে স্ব স্ব অধিকার প্রদানপূৰ্ব্বক গর্ভস্থ সন্তানগণকে রক্ষা ও প্রজারঞ্জন [প্রজাগণের চিত্ত-সন্তোষ] করিয়া ধৰ্ম্মানুসারে পৃথিবীপালনে প্রবৃত্ত হও। যাহাদিগের পুত্র নাই, তাহাদিগের কন্যাগণকে রাজ্য প্রদান কর। স্ত্রীলোকেরা স্বভাবতঃ সাতিশয় ভোগাভিলাষপরতন্ত্র; সুতরাং তাহারা রাজ্যপদ লাভ করিলে নিশ্চয়ই শোক পরিত্যাগ করিবে। হে মহারাজ। তুমি এইরূপে সমুদয় রাজ্যে আশ্বাস প্রদান করিয়া জয়শালী দেবরাজের ন্যায় অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠান কর। মহাত্মা ক্ষত্রিয়গণ কৃতান্তের বলপ্রভাবে স্ব স্ব কৰ্ম্মানুসারে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন; অতএব তাহাদের নিমিত্ত শোক করা তোমার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। এক্ষণে তুমি ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মানুসারে নিষ্কণ্টক রাজ্য লাভ করিয়াছ; অতঃপর স্বধৰ্ম্মপ্রতিপালনে যত্নবান্ হও; তাহা হইলেই পরলোকে মঙ্গললাভে সমর্থ হইবে।”