হিমালয় গিরিবরে ইন্দ্রের নন্দন।
করেন তপস্যা আরাধিতে ত্রিলোচন।।
গলিত বৃক্ষের পত্র ভক্ষ্য পক্ষান্তরে।
কত দিনে মাসেকেতে খান একবারে।।
কতদিন দুই চারি মাসে একদিনে।
কতদিন অর্জ্জুন থাকেন বায়ুপানে।।
এক পদাঙ্গুলিভরে রহেন দাঁড়ায়ে।
ঊর্দ্ধ দুই বাহু করি নিরালম্ব হয়ে।।
তাঁর তপে সন্তাপিত হল গিরিবাসী।
গন্ধর্ব্ব চারণ সিদ্ধ যত মহাঋষি।।
হরের চরণে গিয়া নিবেদিল সব।
হিমালয়ে কেমন থাকিব বল ভব।।
পর্ব্বত তাপিত দেব অর্জ্জুনের তপে।
আজ্ঞা কর, মোরা সবে থাকি কোন রূপে।।
গিরিশ বলেন, সবে যাহ নিজাশ্রয়ে।
আমি বর দিয়া শান্ত করি ধনঞ্জয়ে।।
এত বলি মেলানি দিলেন সর্ব্বজনে।
মায়ায় কিরাতরূপে ধরে ততক্ষণে।।
কিরাত গৃহিণীরূপা নগেন্দ্র নন্দিনী।
সে রূপেতে হইলেন তাঁহার সঙ্গিনী।।
শ্রীমন্ত পিনাক ধনু পৃষ্ঠে শরাসন।
অর্জ্জুনের সম্মূখে গেলেন ত্রিলোচন।।
হেনকালে এক মহা বরাহ আইল।
গর্জ্জিয়া অর্জ্জুন পানে ত্বরিত ধাইল।।
বরাহ দেখিয়া পার্থ গাণ্ডীব লইয়া।
সন্ধান পূরেন ধনুগুণ টঙ্কারিয়া।।
বলিলেন ডাকিয়া কিরাত ভগবান।
বরাহে তপস্বী তুমি না মারহ বাণ।।
দূর হৈতে তাড়িয়া আনিলাম বরাহ।
তুমি কেন বরাহেরে মারিবারে চাহ।।
না শুনিয়া পার্থ তহে করি অনাদর।
বরাহের উপরে মারেন তীক্ষ্ণশর।।
কিরাত যে দিব্য অস্ত্র মারিল শূকরে।
দুই অস্ত্রে যেন বজ্র পর্ব্বত বিদরে।।
গিরিশৃঙ্গে শরবৃষ্টি দেখি ভয়ঙ্কর।
মায়া ত্যজি হইল দারুণ কলেবর।।
পার্থ বলে, কে তুমি কিরাত নারী সঙ্গ।
আমারে তিলেক তোর নাহিক ভ্রভঙ্গ।।
বরাহরে অস্ত্র আমি মারি আগুয়ান।
তুমি কি কারণে তারে প্রহারিলে বাণ।।
এই দোষে তোর আজি লইব পরাণ।
হাসিয়া উত্তর করিলেন ভগবান।।
কোথা হৈতে কে তুমি আইলে তপচারী।
এ ভূমিতে মৃগয়ার আমি অধিকারী।।
মারিলাম আমি বাণ, পড়িল শূকর।
তুমি অস্ত্র মার কেন শূকর উপর।।
অনুচিত কৈলে আর চাহ মারিবারে।
যত শক্তি আছে তব দেকাও আমারে।।
ক্রোধে ধনঞ্জয় অস্ত্র করেন প্রহার।
ডাকিয়া কিরাত বলে, আমি আছি মার।।
পুনঃ পুনঃ ধনঞ্জয় প্রহারয়ে শর।
জলদ বরিষে যেন পর্ব্বত উপর।।
পাষাণে সরিষা যেন পড়িল ঠিকরে।
তিলমাত্র মোহ না হইল কলেবরে।।
বায়ব্য অনল অস্ত্র ছিল পার্থ স্থানে।
সব অস্ত্র প্রহার করেন ত্রিলোচনে।।
কিরাতের অঙ্গে বাণ বিদ্ধ নাহি হয়।
তাহা হেরি পার্থের চিত্তে জাগে বিস্ময়।।
এত বাণ বরিষণে কিছু নাহি হয়।
বিস্ময় মানিয়া মনে ভাবে ধনঞ্জয়।।
কিবা যম পুরন্দর কিবা ভূতনাথ।
অন্য কে সহিতে পারে এই অস্ত্রাঘাত।।
যে হউক আমি আমি করিব সংহার।
ক্রোধেতে নিলেন বীর খড়গ তীক্ষ্ণধার।।
শিবের মস্তকে বাজি হৈল দুই খণ্ড।
পাষাণে বাজিয়া যেন পড়ে ইক্ষুদণ্ড।।
খড়্গ ব্যর্থ গেল, হাতে অস্ত্র নাহি আর।
গাণ্ডীব ধনুক লয়ে করেন প্রহার।।
হাসিয়া নিলেন ধনু কাড়ি ত্রিলোচন।
ক্রোধে পার্থ শিলাবৃষ্টি করে বরিষণ।।
পর্ব্বত উপরে যেন শিলা চূর্ণ হয়।
ক্রোধে প্রহারেন মুষ্টি বীর ধনঞ্জয়।।
করিলেন ক্রোধে মুষ্টি প্রহার ধূর্জ্জটি।
মুষ্ট্যাঘাতে শব্দ যেন হৈল চটচটি।।
ভুজে ভুজে ঊরু ঊরু চরণে চরণে।
মল্লযুদ্ধ ক্ষণকাল হৈল দুই জনে।।
দুই অঙ্গ ঘরষণে অগ্নি বাহিরায়।
অতি ক্রোধে ধূর্জ্জটি প্রহারিলেন তাঁয়।।
মৃতবৎ হয়ে পার্থ পড়েন ভূতলে।
ক্ষণেক চেতন পেয়ে থাক থাক বলে।।
যাবৎ না পূজি মম ইষ্ট ত্রিলোচন।
তাবৎ থাকহ তুমি কিরাত দুর্জ্জন।।
এত বলি শিবলিঙ্গ করিয়া রচন।
নানাবিধ পুষ্পরাশি কৈলেন চয়ন।।
পূজিয়া মৃত্তিকা লিঙ্গে দেন পুষ্পমালা।
সেই মাল্যেতে শোভিল কিরাতের গলা।।
দেখিয়া অর্জ্জুন হইলেন সবিস্ময়।
নিশ্চয় জানিলেন যে এই মৃত্যুঞ্জয়।।
বিনয় কহেন পার্থ করি প্রণিপাত।
করিলাম দুষ্কৃতি যে ক্ষম ভূতনাথ।।
শিব বলে, যে কর্ম্ম করিলে ধনঞ্জয়।
দেবাসুর মানুষে কাহার শক্তি নয়।।
আমার সহিত সম করিলে সমর।
তুমি আমি সমশক্তি নাহিক অন্তর।।
দিব্যচক্ষু দিব তোমা দৃষ্ট হৈবে সব।
এত বলি দিব্যচক্ষু দেন দেবদেব।।
দিব্যচক্ষু পাইয়া দেখেন ধনঞ্জয়।
উমার সহিত উমাকান্ত দয়াময়।।
অর্জ্জুন করেন স্তুতি যড়ি দুই কর।
জয় শিব, জয় শম্ভু, জয় ভূতেশ্বর।।
ত্রিনেত্র ত্রিগুণময় ত্রিলোকের নাথ।
ত্রিবিক্রমপ্রিয় হর ত্রিপুরনিপাত।।
হেলায় করিলা প্রভু দক্ষযজ্ঞ নাশ।
ইঙ্গিতে বিজয় কৈলা মৃত্যু কামপাশ।।
নমো বিষ্ণুরূপ তুমি, বিধাতার ধাতা।
ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ চতুর্ব্বর্গদাতা।।
অজ্ঞানে করিনু প্রভু কাজ অবিহিত।
চরণে শরণ লৈনু, ক্ষম গঙ্গানাথ।।
হাসিয়া অর্জ্জুনে দেব দেন আলিঙ্গণ।
ক্ষমিলেন অজ্ঞাতের প্রহার পীড়ন।।
শিব বলে, আপনারে নাহি জান তুমি।
পূর্ব্বকথা কহি শুন যাহা জানি আমি।।
নারায়ণ সহ তুমি নর ঋষি রূপে।
সংসার ধরিলে অতিশয় উগ্রতপে।।
এই যে গাণ্ডীব ধনু আছয়ে তোমার।
তোমা বিনা ধরিবারে শক্তি আছে কার।।
তোমা হৈতে কাড়িয়া লইনু মায়াবলে।
মায়ায় হরিনু আমি এ তূণ যুগলে।।
পুনরপি সেই অস্ত্রে পূর্ণ হৌক তূণ।
নিজ ধনু তূণ তুমি ধরহ অর্জ্জুন।।
প্রীত হইলাম আমি মাগি লহ বর।
শুনিয়া কহেন পার্থ যুড়ি দুই কর।।
যদি কৃপা আমারে করিলা গঙ্গাব্রত।
আজ্ঞা কর, পাই আমি অস্ত্র পাশুপত।।
শঙ্কর বলেন, তাহা লহ ধনঞ্জয়।
অন্য জনে নহে শক্ত পাশুপত লয়।।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের এ অস্ত্র নাহি জানে।
পৃথিবী সংহার হেতু আছে মম স্থানে।।
যে অস্ত্র যুড়িলে লক্ষ লক্ষ অস্ত্র হয়।
শক্তিশেল কোটি কোটি অস্ত্র বরিষয়।।
প্রীতিতে তোমার বশ হইলাম আমি।
ধরিবার যোগ্য হও, অস্ত্র লহ তুমি।।
বিধাতার বাক্যে লহ নরালোকে জন্ম।
এই অস্ত্রে বীরবর সাধ দেবকর্ম্ম।।
এত বলি মন্ত্র সহ দেন ত্রিলোচন।
মূর্ত্তিমন্ত হয়ে অস্ত্র আইল তখন।।
অস্ত্র দিয়া মহেশ বলেন পুনর্ব্বার।
এ অস্ত্রে কারে পাছে করহ সংহার।।
এ অস্ত্রে রক্ষা নাহি পায় ত্রিভুবন।
স্বযোগ্য পাইলে অস্ত্র করিবে ক্ষেপণ।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব করি নিবেদন।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেতে করিবা আগমন।।
শিব কন, সখা তব বৈকুণ্ঠের পতি।
হরিহর এক আত্মা জান মহামতি।।
কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধ হইবে যখন।
তাহাতে সাহায্য আমি করিব তখন।।
এত বলি হর হইলেন অন্তর্দ্ধান।
অস্ত্র পেয়ে ধনঞ্জয় আনন্দ বিধান।।
আপনারে প্রশংসা করেন ধনঞ্জয়।
এত কৃপা কৈল হর, শত্রুকে কি ভয়।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে সাধু নর।।