৩৩তম অধ্যায়
অভিমন্যুবধপর্ব্বাধ্যায় – দুর্য্যোধন খোদক্তি
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অমিতবলশালী অর্জ্জুনের প্রভাবে আমাদিগের সৈন্য সমুদায় ছিন্ন ভিন্ন, দ্রোণের অভিলাষ নিষ্ফল ও যুধিষ্ঠির সুরক্ষিত হইলে যুদ্ধনির্জ্জিত, বৰ্মশূন্য ধূলিধূষরিত সমরজয়ী বিপক্ষগণ কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত সাতিশয় হাস্যাস্পদ কৌরবগণ উদ্বিগ্নমনে দশদিক্ অবলোকন করত দ্রোণের অনুমতিক্রমে সমর অবহার করিয়া অর্জ্জুনের অসংখ্য গুণগ্রামের প্রশংসা ও তাঁহার সহিত কৃষ্ণের সাখ্যভাব শ্রবণে চিন্তা ও মৌন ভাব অবলম্বন পূর্ব্বক অভিশপ্তের ন্যায় অব স্থন করিতে লাগিলেন।
অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন প্রভাতকালে শত্রুর উন্নতি দর্শনে একান্ত বিমনায়মান ও নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া প্রণয় ও অভিমান সহকারে যোদ্ধাদিগের সমক্ষে দ্রোণকে কহিলেন, হে আচাৰ্য্য! আমরা আপনার বধ্যমধ্যে পরিগণিত হইয়াছি; কেন না আপনি যুধিষ্ঠিরকে সমীপস্থ দেখিয়া আজিও গ্রহণ করিলেন না। আপনি যাহাকে গ্রহণ করিবার অভিলাষ করিবেন, সে আপনার সম্মুখবর্তী হইলে, যদি দেবগণের সহিত পাণ্ডবেরা তাঁহাকে রক্ষা করেন, তাহা হইলেও সে পরিত্রাণ পাইতে পারে না। আপনি অগ্রে প্রসন্ন মনে আমাকে বর প্রদান করিয়া এক্ষণে তাহার অন্যথা করিতেছেন; কিন্তু আর্য্য ব্যক্তিরা কদাচ ভক্তজনের আশা ভঙ্গ করেন না।
দ্রোণের আশ্বাসবাণী – চক্রব্যূহ রচনা
তখন দ্রোণাচাৰ্য্য নিতান্ত লজ্জিত হইয়া দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, হে মহারাজ! আমি তোমার প্রিয় কাৰ্য্য সাধনার্থ নিরন্তর যত্নবান্ রহিয়াছি; আমাকে কদাচ ঐরূপ জ্ঞান করিও না। দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও উরগগণও অর্জ্জুন রক্ষিত রাজা যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিতে সমর্থ হন না। যে স্থানে বিশ্বস্রষ্টা জনার্দ্দন বিরাজমান আছেন এবং অর্জ্জুন সেনাপতি হইয়াছেন, সে স্থলে ভগবান শূলপাণি ব্যতিরেকে আর কাহার বল ফলোপধায়ক হইতে পারে? আজি আমি সত্যই কহিতেছি, পাণ্ডবদিগের মধ্যে বীর প্রবর এক মহারথকে নিপাতিত এবং দেবগণেরও দুর্ভেদ্য এক ব্যূহ প্রস্তুত করিব; কখনই ইহার অন্যথা হইবে না। এক্ষণে কোন উপায় দ্বারা অর্জ্জুনকে ধর্ম্মরাজের নিকট হইতে অপনীত কর। যুদ্ধে তাহার অজ্ঞাত বা অসাধ্য কিছুই নাই; সে নানা স্থান হইতে সকল বিষয়ই অবগত হইয়াছে।
আচাৰ্য্য দ্রোণ এইরূপ আদেশ করিলে সংশপ্তকগণ পুনরায় অর্জ্জুনকে যুদ্ধার্থ দক্ষিণ দিকে আহ্বান করিতে লাগিল। সুতরাং সংশপ্তকদিগের সহিত অর্জ্জুনের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। তাদৃশ যুদ্ধ কখন কাহার শ্রবণ বা নয়নগোচর হয় নাই। এ দিকে আচার্য্য দ্রোণ চক্ৰ ব্যূহ রচনা করিলেন। উহা তপনশীল মধ্যাহ্নকালীন দিনকরের ন্যায় নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হইয়া উঠিল। অভিমন্যু জ্যেষ্ঠতাত যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে সঞ্চরণ করিতে করিতে সেই দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহ বারংবার ভেদ করিলেন। পরে তিনি অতি দুষ্কর কাৰ্য্য সংসাধন ও সহস্র সহস্র বীর নিপাতন পূর্ব্বক ছয় বীরের সহিত সমরে ব্যাপৃত ও দুঃশাসনপুত্রের বশবর্তী হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিলেন। আমরা অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। পাণ্ডবগণ শোকে নিতান্ত কাতর হইলেন। অনন্তর অবহার করিলাম।
অভিমন্যু বধ শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্রের দুঃখপ্রকাশ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! পুরুষসিংহ অর্জ্জুনের আত্মজ অপ্রাপ্তষৌবন অভিমন্যু বিনষ্ট হইয়াছে, ইহা শ্রবণ করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। যে ধৰ্ম্মানুসারে রাজ্য লোলুপ বীরেরা বালকের উপর অস্ত্রাঘাত করিয়াছে, ধৰ্ম্ম কর্তারা সেই ক্ষত্র ধর্ম্ম কি নিদারুণ করিয়াই সৃষ্টি করিয়াছেন। আমার পক্ষীয় বীরেরা নিতান্ত সুখী, নির্ভীকের ন্যায় বিচরণশীল, বালক অভিমন্যুকে কি প্রকারে বিনাশ করিল? আর অভিমন্যু রথ সৈন্য সংহার করিবার বাসনায় যেরূপ রণস্থলে সঞ্চরণ করিয়াছিল, তাহাও কীর্ত্তন কর।
সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! আপনি আমাকে যে সমস্ত বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন, তাহা সম্যক্ কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। কুমার অভিমন্যু সৈন্য সংহারাৰ্থ যেরূপে রণস্থলে সঞ্চরণ করিয়াছিলেন, জয়লাভাভিলাষী দুর্নিবার বীর সমুদায় যে রূপে ছিন্ন ভিন্ন হইয়াছিলেন এবং তৃণ, গুল্ম ও পাদপ সমাচ্ছন্ন অরণ্যমধ্যে দাবানল পরিবেষ্টিত বনবাসীদিগের ন্যায় আপনার পক্ষীয় বীরগণের অন্তঃকরণে ভয় সঞ্চার হইয়াছিল; এক্ষণে তাহা শ্ৰবণ করুন।