৩২তম অধ্যায়
অষ্টম অধ্যায় – অক্ষরব্রহ্মযোগ
“অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! ব্রহ্ম, অধ্যাত্ম ও কর্ম্ম কাহাকে বলে? অধিভূত ও অধিদৈবই বা কি? মনুষ্যদেহে অধিযজ্ঞ কিরূপে অবস্থান করিতেছে? সংযতচিত্ত ব্যক্তিরা মৃত্যুকালে কি প্রকারে ব্রহ্মকে বিদিত হয়েন?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! যিনি পরম, অক্ষয় ও জগতের মূল কারণ, তিনিই ব্রহ্ম। সেই ব্রহ্মের অংশস্বরূপ জীব, দেহ অধিকার করিয়া অবস্থান করিলে তাহাকে অধ্যাত্ম বলা যায়। যাহাতে ভূতগণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা যজ্ঞকর্ম্ম। বিনশ্বর [বিনাশশীল] দেহাদি পদার্থ ভূত-সকলকে অধিকার করিয়া থাকে; এই নিমিত্ত উহাকে অধিভূত বলা যায়। সূর্যমণ্ডলবর্ত্তী বৈরাজ পুরুষ দেবতাদিগের অধিপতি বলিয়া তাঁহকে অধিদৈবত বলা যায়। আর আমিই এই দেহে যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারূপে অবস্থান করিতেছি, এই নিমিত্ত অধিযজ্ঞ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকি। যিনি অন্তকালে আমাকে স্মরণ করিয়া কলেরব পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রয়াণ করেন, তিনি নিঃসন্দেহ আমার স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েন। হে অর্জ্জুন! যে ব্যক্তি একান্তমনে অন্তকালে যে যে বস্তু স্মরণ করিয়া দেহত্যাগ করে, সে সেই বস্তুর স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া থাকে; অতএব তুমি সকল সময়ে আমাকে স্মরণ কর ও সমরে প্রবৃত্ত হও। আমাতে মন ও বুদ্ধি সমর্পণ করিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে অর্জ্জুন! অভ্যাসরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া অনন্যমনে সেই দিব্য পরমপুরুষকে চিন্তা করিলে তাঁহাতেই লীন হয়। যে ব্যক্তি মৃত্যুকালে অবিচলিত-চিত্তে ভক্তি ও যোগবলে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণবায়ু সমাবেশিত করিয়া পুরাতন, বিশ্বনিয়ন্তা [ব্রহ্মাণ্ডপরিচালক], সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্ম, সকলের বিধাতা, অচিন্তরূপ, আদিত্যের ন্যায় স্বপ্রকাশ, অজ্ঞানান্ধকারের উপর [অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত অবস্থা] বর্ত্তমান, দিব্য পরমপুরুষকে চিন্তা করে, সে তাঁহাকে প্রাপ্ত হয়। হে অর্জ্জুন! বেদবেত্তারা যাঁহাকে অক্ষয় বলিয়া থাকেন এবং বিষয়াসক্তিশূন্য যতিগণ যাঁহাতে প্রবেশ করেন ও যাঁহাকে বিদিত হইবার নিমিত্ত ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠানের প্রবৃত্ত হয়েন, আমি সেই প্রাপ্য বস্তুলাভের উপায় সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর :–
“যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়দ্বার-সমুদয় সংযত, হৃদয়কমলে মনকে নিরুদ্ধ ও ভ্রুমধ্যে প্রাণবায়ু সন্নিবেশিত করিয়া যোগজনিত ধৈর্য অবলম্বন এবং ব্রহ্মের অভিধান [১] ওঁ এই একাক্ষর উচ্চারণ ও আমাকে স্মরণ করিয়া কলেরব পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রয়াণ করেন, তিনি পরম গতি লাভ করিয়া থাকেন। যিনি অনন্যমনে সতত আমাকে স্মরণ করেন, সেই সমাহিত যোগী আমাকে অনায়াসে লাভ করিতে সমর্থ হয়েন; মহাত্ম্রারা আমাকে প্রাপ্ত হইয়াও মোক্ষরূপ পরম সিদ্ধি লাভ করিয়া দুঃখের আলয় অনিত্য পুনর্জ্জন্ম প্রাপ্ত হয়েন না। প্রাণিগণ ব্রহ্মলোক অবধি সমুদয় লোক হইতেই পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হয়; কিন্তু আমাকে প্রাপ্ত হইলে আর জন্মগ্রহণ করিয়ে হয় না। সহস্র দৈব যুগে ব্রহ্মার এক দিন এবং ঐরূপ সহস্র যুগে এক রাত্রি হয়। যাঁহারা ইহা বিদিত হইয়াছেন, সেই সর্ব্বজ্ঞ ব্যক্তিরাই অহোরাত্রবেত্তা [দিবারাত্রির পরিমাণ বিষয়ে বিজ্ঞ]। ব্রহ্মার দিবস হইতে ব্যক্ত চরাচর ভূত-সকল প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে; আর রাত্রি উপস্থিত হইলে সেই কারণরূপ অব্যক্ত পদার্থে সমস্ত বস্তু বিলীন হইয়া যায়। সেই ভূতসমূহ ব্রহ্মার দিবসাগমে বার বার জন্মগ্রহণ করিয়া রাত্রিসমাগমে বিলীন হয় এবং পুনরায় দিবসাগমে কর্ম্মাদিপরতন্ত্র ও সমুৎপন্ন হইয়া পুনরায় রাত্রিসমাগমে বিলীন হইয়া থাকে। সেই চরাচরের কারণরূপ অব্যক্তি অপেক্ষাও পরতর [নিগূঢ়] অতিশয় অব্যক্তি সনাতন আর একটি ভাব আছে; উহা সমস্ত ভূত বিনষ্ট হইলেও কদাচ বিনষ্ট হয় না। অতীন্দ্রিয় ও অক্ষয় ভাবকেই পরমপুরুষার্থ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিয়া থাকেন; উহাই আমার স্বরূপ; উহা প্রাপ্ত হইলে মনুষ্যের আর বিনিবর্ত্তন হয় না [ফিরিয়া আসে না–ব্রহ্মেই লীন হইয়া থাকে]। হে অর্জ্জুন! সেই পরম-পুরুষকে একান্ত ভক্তি দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়; ভূতসকল তাঁহার অভ্যন্তরে অবস্থান করিতেছে এবং তিনিই এই বিশ্বে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। যোগীরা যে কালে গমন করিলে আবৃত্তি [জন্মবন্ধন] ও যে কালে গমন করিলে অনাবৃত্তি [সংসারনিবৃত্তি–মোক্ষ] প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, আমি সেই কালের বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর;–যে স্থানে দিবস শুক্লবর্ণ [সত্ত্বময়] ও অগ্নির ন্যায় প্রভাসম্পন্ন এবং ছয় মাছ উত্তরায়ণ [মাঘ মাস হইতে আষাঢ় মাস পর্যন্ত], ব্রহ্মবেত্তারা তথায় গমন করিয়া ব্রহ্ম প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। আর যে স্থানে রাত্রি, ধূম ও কৃষ্ণবর্ণ [রজঃ ও তমোময়] এবং ছয় মাস দক্ষিণায়ণ [শ্রাবণ হইতে পৌষ মাস পর্যন্ত]; কর্ম্মযোগীরা তথায় চন্দ্রপ্রভাশালী স্বর্গ-লাভ [পিতৃলোক] কইয়া নিবৃত্ত হয়েন। জগতের শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ দুইটা শাশ্বত গতি আছে; তন্মধ্যে একতর দ্বারা অনাবৃত্তি ও অন্যতর দ্বারা আবৃত্তি হইয়া থাকে। হে পার্থ! যোগী ব্যক্তি এই দুইটি গতি অবগত হইয়া কদাচ বিমোহিত হয়েন না; অতএব তুমি সকল কালে যোগানুষ্ঠানপরায়ণ হও। শাস্ত্রে বেদ, যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে যে ফল নির্দ্দিষ্ট আছে, জ্ঞানীরা সেই নির্ণীত তত্ত্ব অবগত হইয়া তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন এবং জগতের মূল বিষ্ণুপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।’ ”