৩১তম অধ্যায়
সঞ্জয়ের হস্তিনায় গমন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তখন সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুযায়ী কাৰ্য্যজাত সম্পাদন করিয়া যুধিষ্ঠিরের অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক অনতিবিলম্বে হস্তিনাপুরে গমন করিলেন। অনন্তর অন্তঃপুরের দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া দ্বারবানকে কহিলেন, “দৌবারিক! যদি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র জাগরিত থাকেন, তবে তুমি নিবেদন কর, আমি পাণ্ডবগণের নিকট হইতে আগমন করিয়াছি, আমার অত্যন্ত আবশ্যক আছে। আমি তাঁহার জ্ঞাতসারে প্রবেশ করিব, অতএব তুমি বিলম্ব করিও না।” দ্বারপাল সঞ্জয়ের বাক্যানুসারে ধৃতরাষ্ট্রনিকটে গমনপূর্ব্বক কহিল, “মহারাজ! প্ৰণাম, আপনার দূত সঞ্জয় পাণ্ডবগণের নিকট হইতে আগমন করিয়া মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছেন, তিনি কি করিবেন, অনুমতি করুন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “দ্বারপাল! আমার কল্যাণসংবাদ প্রদানপূর্ব্বক স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া সঞ্জয়কে প্রবেশিত কর। আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাহাকে ত’ নিবারণ করি নাই? তবে কি নিমিত্ত দ্বারদেশে রুদ্ধ হইয়াছে?”
অনন্তর দ্বাররক্ষক সঞ্জয়কে রাজনির্দ্দেশ অবগত করিলে তিনি তখন বিশালনিবেশনে [ধৃতরাষ্ট্রের বৃহৎ বাসগৃহ] প্রবেশপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে সিংহাসনে সমাসীন রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “মহারাজ। আমি [ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব বিষয়ে ‘আমি’ উল্লেখ] সঞ্জয়, আপনাকে প্ৰণাম করি, আমি পাণ্ডবগণের নিকট হইতে আগমন করিয়াছি। মহানুভব যুধিষ্ঠির আপনাকে অভিবাদনপূর্ব্বক কুশলজিজ্ঞাসা করিয়াছেন এবং পুত্ৰ, নপ্তা [পৌত্র], সুহৃৎ, মন্ত্রি ও উপজীবিগণ আপনার পুত্রদিগের প্রতি অনুরক্ত আছেন কি না, তাহাও জানিতে ইচ্ছা করিয়াছেন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি অজাতশত্রু কুন্তীকুমারকে সুখে অভিনন্দন করিয়া তোমাকে কহিতেছি, পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠির, তাঁহার ভ্রাতা, পুত্র ও অমাত্যগণ ত’ কুশলে আছেন?”
পাণ্ডবসংবাদপ্রদান-ধৃতরাষ্ট্র তিরস্কার
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠির অমাত্যের সহিত কুশলে আছেন। আপনি অনুদূতের পূর্ব্বে যাহা [পাশাখেলায়-সর্ব্বস্ব পরাজয়ের পর প্রদত্ত পঞ্চগ্রাম] তাঁহাকে দান করিয়াছিলেন, তিনি তাহাই গ্ৰহণ করিতে অভিলাষ করিতেছেন। তিনি নির্দোষ, ধর্ম্মার্থসম্পন্ন, উদারপ্রকৃতি, শাস্ত্ৰজ্ঞ ও সুশীল। দয়াই তাঁহার প্রধান ধর্ম্ম, ধনরাশি অপেক্ষা ধর্ম্ম তাঁহার অধিকতর প্রিয়, তাঁহার বুদ্ধি ধর্ম্মানুগত অর্থসংযুক্ত সুখ ও প্রিয়বস্তুর অনুসরণ করে। আমি পাণ্ডবগণের ঈদৃশ নিগ্রহ এবং মহারাজের অনুষ্ঠিত অবক্তব্য পাপানুবন্ধী [অন্যায়কৃত] ভীষণ কর্ম্মদোষ অবলোকন করিয়া বোধ করিতেছি যে, পুরুষ ঈশ্বরপ্রেরিত হইয়া সূত্রগ্রথিত দারুময়ী যোষার [কাষ্ঠপুত্তলিকার] ন্যায় কাৰ্য্য করিয়া থাকে; মনুষ্য অপেক্ষা দৈবকর্ম্ম প্রধান, আর শত্রু যতকাল বিঘ্ন ইচ্ছা না করে, ততকাল পুরুষ প্রশংসা লাভ করিতে পারে। সর্প যেমন অকৰ্মণ্য নির্ম্মোক [ত্বক—খোলস] পরিত্যাগ করে, মহাবীর যুধিষ্ঠির সেইরূপ পাপাচরণ পরিত্যাগ করিয়া নৈসৰ্গিক আচারব্যবহার দ্বারা শোভা পাইতেছেন। আর দেখুন, যাহা ধর্ম্মবিরুদ্ধ, অর্থবিরুদ্ধ ও আৰ্য্যব্যবহারবিরুদ্ধ, তাহাই আপনার কর্ম্ম; অতএব আপনি যেমন ইহলোকে নিন্দাস্পদ হইয়াছেন, সেইরূপ পরলোকেও নিরায়গামী হইবেন। হে ভারতশ্রেষ্ঠ! যেসকল বিষয় পাণ্ডবগণ ব্যতিরেকে অন্য কেহ লাভ করিতে সমর্থ হয় না, আপনি পুত্রের বশীভূত হইয়া সেই সকল বিষয় আত্মসাৎ করিবার নিমিত্ত কল্পনা করিতেছেন, ইহা আপনার উপযুক্ত কর্ম্ম নহে। এরূপ করিলে পৃথিবীমণ্ডলে আপনার মহতী অপকীর্ত্তি হইবে। যে ব্যক্তি প্রজ্ঞাহীন, দুষ্কুলজাত, নিষ্ঠুর, দীর্ঘবৈর [চিরশত্ৰুতাকারী], ক্ষত্রবিদ্যায় অনভিজ্ঞ, বীৰ্য্যহীন ও অশিষ্ট সেই ব্যক্তিই এই প্রকার আপদ্ধর্মের আশ্রয় গ্ৰহণ করুক। যে ব্যক্তি নিয়মানুসারে শরীরধারণ করিয়া আত্মনিষ্ঠ হয়, সে ব্যক্তি ভাগ্যবশতঃ কুলীনত্ব, বলবত্ত্ব, যশস্বিতা, শাস্ত্ৰজ্ঞতা, সুখজীবিত্ব, জিতাত্মত্ব [জিতেন্দ্ৰিয়তা], এই গুণষটুকের অধিকারী হইয়া উঠে। আপনি কুলজাত হইয়াও কেবল অনৃত [মিথ্যা]দোষবশতঃ অন্যান্য গুণে বঞ্চিত হইয়াছেন, নতুবা মন্ত্রণাকুশল ভীষ্মপ্রভৃতির আশ্রয়, আপৎকালে ধর্ম্মার্থের প্রণেতা, সর্ব্বমন্ত্রণাসম্পন্ন, অমূঢ় ও দ্যূতক্ৰীড়া হইতে ভীষ্মাদিকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়াও কোন ব্যক্তি পাণ্ডবগণের নির্ব্বাসনারূপ নৃশংস কর্ম্ম করিতে পারে? হে মহারাজ! কর্ণ-প্রভৃতি মন্ত্রবেত্তাগণ মিলিত হইয়া প্রতিনিয়ত আপনার কর্মে ব্যাপৃত আছেন; তাঁহারা কুরুকুলক্ষয়ের নিমিত্ত ‘পাণ্ডবগণকে রাজ্যপ্ৰদান করিব না’ বলিয়া স্থির নিশ্চয় করিয়াছেন। যদি কদাচিৎ যুধিষ্ঠির আপনার পাপকর্মে উত্তেজিত হইয়া আপনার প্রতি পাপ ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে কৌরবগণ অকস্মাৎ উন্মলিত হইবে। আর তিনি আপনার প্রতি পাপাচরণ পরিত্যাগ করিলে আপনার নিন্দায় এই পৃথিবী পরিপূর্ণ হইয়া উঠিবে।
“হে মহারাজ! সমুদয়ই দৈবাধীন; যে ধনঞ্জয় পরলোকদর্শনার্থ পৃথিবীলোক অতিক্রম করিয়াছিলেন এবং তিনি উভয়লোকসঞ্চারণযোগ্যতানিবন্ধন সাধুগণসমীপে সম্মান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারও যখন তাদৃশ দুরবস্থা ঘটিয়াছে, তখন মনুষ্যকৃত কর্ম্ম কর্ম্মই নহে। বলিরাজা ধৰ্মজনিত শৌৰ্য্যাদি গুণ ও ক্ষণভঙ্গুর ঐশ্বৰ্য্য এবং অনৈশ্বৰ্য্য পৰ্য্যবেক্ষণ করিয়া পূর্ব্ব পূর্ব্ব কারণপরম্পরার পার প্রাপ্ত না হইয়া স্থির করিয়াছিলেন যে, এ বিষয়ে কাল ভিন্ন অন্য কারণ নাই; অতএব পুরুষ দ্বেষশূন্য ও দুঃখবিহীন হইয়া জ্ঞানায়তন [শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন] চক্ষু, শ্রোত্ৰ, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বাকে স্ব স্ব বিষয় হইতে বিনিবৃত্ত করিয়া বিষয়লালসার সংযমদ্বারা তাহাদিগের প্রীতিসম্পাদনা করিবেন। কিন্তু অন্য কেহ এরূপ কহেন না; তাঁহারা কহেন, পুরুষকৃত কর্ম্ম সুন্দররূপে প্রযুক্ত হইলে সফল হয়, দেখুন, পুরুষ মাতাপিতার অনুষ্ঠিত ক্রিয়াদ্বারা জন্মপরিগ্রহ করিয়া বিধিবৎ ভোজন দ্বারা পরিবর্দ্ধিত হয়।
“হে রাজন! প্রিয় অপ্রিয়, সুখ দুঃখ, নিন্দা ও প্রশংসা মনুষ্যমাত্রেরই ঘটিয়া থাকে। দেখুন, এক ব্যক্তি যাহাকে অপরাধের নিমিত্ত নিন্দা করে, আবার তাহারই সদাচারের নিমিত্ত প্রশংসা করিয়া থাকে। এই নিমিত্ত আমি এক্ষণে ভারতীকুলের বিরোধ-জন্য সমুদয় প্ৰজাক্ষয় হইবে বলিয়া আপনাকে নিন্দা করিতেছি। যদি পাণ্ডবগণকে রাজ্যাংশ প্ৰদান করা আপনার অভিপ্রেত না হয়, তাহা হইলে যেমন হুতাশন কক্ষরাশি [গৃহসমূহ] ভস্মীভূত করে, সেইরূপ আপনার অপরাধে মহাবীর ধনঞ্জয় কুরুকুল নিমূল করিবেন। আপনি একাকী স্বেচ্ছাচারী পুত্রের বশবর্ত্তী ও কৃতাৰ্থম্মন্য হইয়া দূতকালে শান্তি অবলম্বন করেন নাই, এক্ষণে তাহারই পরিণাম অবলোকন করুন। আপনি অনাপ্ত[ভ্রমপ্রমাদযুক্ত]দিগের সংগ্রহ ও আপ্ত[ভ্ৰম প্রমাদশূন্য]দিগের নিগ্রহ জন্য দুর্ব্বল হইয়া এই বিস্তারিত পৃথিবী রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়াছেন। হে রাজন! আমি রথবেগে অভিভূত [রথের দ্রুতগতিতে গাত্ৰবেদনাদিদ্বারা অবসন্ন] ও নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছি; অতএব অনুজ্ঞা করুন, শয়নগৃহে গমন করি, প্ৰাতঃকালে সভামধ্যে কৌরবগণ সকলে একত্ৰ হইয়া যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিবেন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সূতপুত্র! আমি অনুজ্ঞা করিতেছি, গৃহে গমনপূর্ব্বক সুখে শয়ন কর, প্রাতঃকালে কুরুগণ সভামধ্যে একত্ৰ হইয়া অজাতশত্রুর [ব্যবহারগুণে শত্রুহীন যুধিষ্ঠিরের] বাক্য শ্রবণ করিবেন।”
সঞ্জয়যানপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত