যুধিষ্ঠির বলে, ভীম কহিলে প্রমাণ।
পীড়িলে আমারে তুমি দিয়া বাক্যবাণ।।
আমা হতে দুঃখেতে পড়িলে তোমা সব।
আমা হেতু সহিলে শত্রুর পরাভব।।
ক্রোধের সমান শত্রু নাহিক সংসারে।
ক্রোধ হৈলে ভাল মন্দ বিচার না করে।।
মায়াবী শকুনি সহ খেলিনু যখন।
যত হারি, ক্রোধ করি তত করি পণ।।
না হৈল আমার শক্তি নিবৃত্ত হইতে।
আগু পাছু বিচার না করিলাম চিতে।।
এত অপকর্ম্ম করিবেক দুর্য্যোধন।
আমার এতেক জ্ঞান না হয় তখন।।
যত অপমান কৈল সাক্ষাতে দেখিলে।
মম হেতু স্থির হৈয়া সকলি সহিলে।।
দ্বাদশ বৎসর বনবাস করি পণ।
অজ্ঞাত বৎসর এক জান ভ্রাতৃগণ।।
হারিয়া কাননে আমি করিনু প্রবেশ।
কোন মুখে পুনর্ব্বার যাব আমি দেশ।।
কুরুসভা মধ্যে যাহা করেছি নির্ণয়।
অন্যথা করিতে তাহা মম শক্তি নয়।।
মম বাক্যে সবে যদি আছ অবস্থিত।
তবে হেন কহিবারে না হয় উচিত।।
রণ সাধ ছিল যদি তোমা সবা মন।
সেই কালে না করিলে কিসের কারণ।।
পাশার সময়ে তবে কেন না করিলে।
তাহে পরাভব হয়ে কি হেতু ক্ষমিলে।।
পুনঃ বনবাস পুনঃ খেলিবার কালে।
তখন আমারে কেন ক্ষান্ত না করিলে।।
সময়ে না করি কর্ম্ম অসময়ে চাহ।
অকারণে বাক্যবাণে আমারে পোড়াহ।।
এইক্ষণে প্রাণ আমি ছাড়িবারে পারি।
তথাপিহ সত্য আমি করিব লঙ্ঘন।
অপযশ অধর্ম্ম ঘুষিবে ত্রিভুবন।।
রাজ্য ধন পুত্র আদি বহু যজ্ঞ দান।
সত্যের নিকটে নহে শতাংশ সমান।।
পুরুষ হইয়া যার বাক্য সত্য নয়।
ইহলোকে তারে কেহ না করে প্রত্যয়।।
অন্তকালে হয় তার নরকেতে গতি।
ইহা জানি ভ্রাতৃগণ স্থির কর মতি।।
কাল কাটি পুনরপি লব রাজ্যভার।
কষ্টেতে সুজন ভ্রষ্ট, নহে সত্যাচার।।
নৃপতির বাক্য শুনি বলে বৃকোদর।
হেন নীতি করে রাজা দীর্ঘজীবী নর।।
নির্ণয় করিয়া যেবা নিজ আয়ু জানে।
সে জন কদাপি বর্ত্তে এই আচরণে।।
নিরন্তর কালচক্র ভ্রমিছে উপর।
জলবিম্ব সম দেখি নর কলেবর।।
বৎসরের প্রায় এক দিবস কাটিয়া।
দ্বাদশ বৎসর রব এ কষ্ট পাইয়া।
বৎসরেক অজ্ঞাত থাকিব কোন মতে।
মহেন্দ্র পর্ব্বতে চাহ তৃণে লুকাইতে।।
আমারে কে নাহি জানে পৃথিবী ভিতর।
বাল বৃদ্ধ যুবা মধ্যে খ্যাত বৃকোদর।।
অর্জ্জুনেরে কিরূপে লুকাবে নৃপবর।
হস্ত দিয়া আচ্ছাদিতে চাহি দিনকর।।
দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণা কিরূপে লুকাবে।
কদাচিৎ ইহা হৈতে যদি পার পাবে।।
সদ্ভাবে কদাপি রাজ্য না দিবে দুরন্ত।
আমি হই হীনবল, সে যে বলবন্ত।।
তখন উপায় রাজা কি করিবে তার।
শক্তি বৃদ্ধি হেতু রাজা বিচার তোমার।।
হীনবল হৈল শত্রু তারে নাহি ক্ষমে।
উপায় করয়ে সদা নিজ পরাক্রমে।।
শক্তিমন্ত হয়ে যদি না করে উপায়।
লোকে কাপুরুষ বলে, বৃথা জন্ম যায়।।
সত্য হেতু মনে যদি করহ নিশ্চয়।
আছয়ে উপায় তার, শাস্ত্রে হেন কয়।।
সোম পূতিকার মত কহে মুনিগণ।
এক মাসে বৎসরেক করিবে গণন।।
ত্রয়োদশ মাস রহি বনের ভিতরে।
উপায় করহ রাজা শত্রু মারিবারে।।
ভীমের বচন শুনি ধর্ম্ম নরপতি।
স্তব্ধ হয়ে ক্ষণকাল চিন্তে মহামতি।।
রাজা বলে, ভীম যাহা করিলে বিচার।
কপট এ ধর্ম্ম, চিত্তে না লয় আমার।।
মেরুসম ধর্ম্ম আমি লঙ্ঘিব কেমনে।
কবু নহে বৈরীজয় পাপ আচরণে।।
কর্ণ সখা তার, যারে যম করে ভয়।
তিন লোক বিজয়ী সে রাধেয় দুর্জ্জয়।।
ভুবন ভিতরে যত জন ধরে ধনু।
অভেদ্য কবচে যার আবরিত তনু।।
মদগর্ব্বে অহঙ্কারী ক্রোধী সদাকাল।
হেন জনে বিধাতা করিল মহীপাল।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য্য এই তিন জন।
তাহার যেমন ভাবে, আমারে তেমন।।
তথাপি সবাই বশ হৈল দুর্য্যোধনে।
বহু মান্য পূজা সদা নিকটে সেবনে।।
আর যত মহারাজ আছে বলবান।
মম স্থান হৈতে প্রীতি পায় তার স্থান।।
সবে প্রাণ দিবে দুর্য্যোধনের কারণে।
কেমনে মারিবে তুমি হেন দুর্য্যোধনে।।
এই চিন্তা সদা মম জাগে রাত্রি দিনে।
কিমতে লইব রাজ্য ভাবিতেছি মনে।।
এই সে কারণে মম হৃদয় চিন্তিত।
বিনা সখা দুর্য্যোধন না হয় বিজিত।।
ধর্ম্ম সখা বিনা নহে সমরে বিজয়।
বেদের লিখন, যথা ধর্ম্ম তথা জয়।।
হেন ধর্ম্ম ত্যজিয়া অধর্ম্ম আচরিলে।
কহ ভীম, শত্রু জয় হইবে কি ভালে।।
ভুজগর্ব্ব বলে তুমি কর অহঙ্কার।
সাহসিক কর্ম্ম সেই, নহে সুবিচার।।
সুমন্ত্রণা সুবিক্রম গুপ্ত রাখি মনে।
দেবতা প্রসন্ন হৈলে, তবে শত্রু জিনে।।
এত শুনি বৃকোদর হইল বিমন।
ক্রোধেতে নিশ্বাস বহেল প্রলয় পবন।।
যুধিষ্ঠির ভীম সহ কথার সময়।
আইলেন তথা সত্যবতীর তনয়।।
মহাভারতের কথা জ্ঞানের প্রকাশ।
শ্রবণে অধর্ম্ম হরে, কহে কাশীদাস।।