৩১তম অধ্যায়
নারীসুলভ দোলায়মানহৃদয়া দ্রৌপদীর প্রতি যুধিষ্ঠিরের প্রবোধদান
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে যজ্ঞসেনি! তুমি যাহা কহিলে, তাহা সুকুমার ও সুবিন্যস্ত বটে, কিন্তু নাস্তিকমতানুমত। আমি ফলাকাঙ্ক্ষী হইয়া কর্ম্মানুষ্ঠান করি না; কিন্তু দাতব্য বলিয়া দান করি, যষ্টব্য বলিয়া যজ্ঞ করিয়া থাকি। ফল থাকুক আর নাই থাকুক, গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়া যে-সকল কর্ম্মকরা কর্ত্তব্য আমি তাহা যথাশক্তি অনুষ্ঠান করি। হে চারুনিতস্বিনি! আমি সাধুজনাচরিত ব্যবহার দৃষ্টি ও শাস্ত্রানুসারে ধর্ম্মাচরণ করি; কোন প্রকারে ফল প্রত্যাশা করি না, আমার মন স্বভাবতঃই কেবল ধর্ম্মানুরাগী। হে কৃষ্ণে! যে ব্যক্তি স্বৰ্গাদি ফললাভলোভে ধর্ম্মাচরণ করে, সে ব্যক্তি ধর্ম্মবণিক, সুতরাং সে মুখ্যফলে অনধিকারী ও ধার্ম্মিকসমাজে জঘন্যরূপে পরিগণিত; সে কদাচ প্রকৃত ধর্ম্মফল ভোগ করিতে সমর্থ হয় না। যে পাপমতি নাস্তিকতাপ্রযুক্ত ধর্ম্মের প্রতি সন্দিহান হয়, তাহারও ধর্ম্মজনিত ফললাভের প্রত্যাশা থাকে না। আমি বেদনির্দ্দিষ্ট প্রমাণানুসারে কহিতেছি, কদাচ ধর্ম্মের প্রতি সন্দেহ করিবে না, যেহেতু, ধর্ম্মভিশন্ধী ব্যক্তি তিৰ্য্যগ্গতি প্রাপ্ত হয় এবং যে বিবেকহীনমতি ধর্ম্মে অবিশ্বাস বা আমর্ষতে অশ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন করে, সে ব্যক্তি বেদবহিষ্কৃত শূদ্রের ন্যায় অজর অমরলোক হইতে অপসারিত হয়। হে পাঞ্চালি! যে ব্যক্তি ভদ্রকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া ধর্ম্মপরায়ণ ও বেদাধ্যায়ী হয়, ধর্ম্মচারীরা সেই রাজর্ষিকে স্থবিরমধ্যে পরিগণিত করেন। যে মূঢ় তিনি উল্লঙ্ঘন করিয়া ধর্ম্মে অশ্রদ্ধা করে, সে ব্যক্তি শূদ্র ও তস্কর হইতেও পাপীয়ান। হে কল্যাণি! তুমি ত’ প্রত্যক্ষ দেখিয়াছ, মহাতপাঃ মার্কণ্ডেয় ধর্ম্মপ্রভাবে চিরজীবিতা লাভ করিয়াছেন। ব্যাস, বশিষ্ঠ, মৈত্ৰেয়, নারদ, লোমশ, শুক ও অন্যান্য বিশুদ্ধচেতাঃ ঋষিগণ ধর্ম্মপ্রভাবে দিব্যযোগসম্পন্ন হইয়া শাপ-প্রদানে ও অনুগ্রহে সমৰ্থ হইয়াছেন এবং দেবতা অপেক্ষাও অধিকতর গৌরবলাভ করিয়াছেন। এই সকল অমরাবদ্বিখ্যাত বেদার্থবেত্তা ঋষিগণ সর্ব্বদা সর্ব্বপ্রথমে কর্ত্তব্য ধর্ম্ম বর্ণনা করিয়া থাকেন; অতএব হে রাজ্ঞি! ভ্ৰান্তচিত্তে ধর্ম্মের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ধাতাকে তিরস্কার করা উচিত নহে। বালকেরা তত্ত্বজ্ঞানীদিগকে উন্মত্ত জ্ঞান করে, তাহারা ধর্ম্মাচরণে সন্দিহান হইয়া অন্যের নিকট প্রমাণ অন্বেষণ করে না; কেবল আত্মবিনিশ্চিত প্রমাণে সাতিশয় গর্ব্বিত হইয়া ধর্ম্মের অবমাননা করে ও কেবল ইন্দ্ৰিয়সুখসম্বন্ধ লৌকিক বিষয়ই অঙ্গীকার করিয়া থাকে; কিন্তু অতীন্দ্ৰিয় বিষয়ে মুগ্ধ হইয়া যায়। যে ব্যক্তি ধর্ম্মের প্রতি সংশয়ান হয়, সে পাপাত্মার প্রায়শ্চিত্ত নাই; সে কেবল অর্থচিন্তায় মগ্ন হইয়া কালব্যাপন করে; কদাচ পুণ্যলোক প্রাপ্ত হয় না; যে মূঢ় প্রমাণপরাঙ্মুখ হইয়া বেদার্থে নিন্দা করে এবং কাম ও লোভের একান্ত বশংবদ হইয়া থাকে, সে ব্যক্তি নিশ্চয়ই নিরয়গামী হয়। হে কল্যাণি! যে প্রশস্তমতি ব্যক্তি নিরন্তর অসন্দিগ্ধচিত্তে ধর্ম্মেরই সেবা করে, সে পরকালে ব্ৰহ্মলোক লাভ করিয়া অনন্ত সুখসম্ভোগ করে। যে ব্যক্তি আর্যপ্রমাণ ও সমুদয় শাস্ত্র অতিক্রম করিয়া ধর্ম্ম-প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হয়, সে মূঢ় জন্মজন্মান্তরেও শুভলাভ করিতে পারে না। হে ভাবিনি! যে ব্যক্তি আর্ষপ্ৰমাণ বা শিষ্টাচারপরম্পরার বশবর্ত্তী না হয়, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই নষ্ট হয়, অতএব হে পাঞ্চালি! সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্বদর্শী ঋষিগণকর্ত্তৃক আচরিত পুরাতন ধর্ম্মে কদাচ অবিশ্বাস করিও না। সাগরপারলিপ্সু বণিকদিগের তরণীর ন্যায় সূরলোকগমনোন্মুখ মানবগণের ধর্ম্মই একমাত্র ভেলা। হে অনিন্দিতে! যদি ধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তিদিগের ধর্ম্মাচরণ বিফল হয়, তাহা হইলে এই জগৎ অসীম তমঃস্তোমে নিমগ্ন হইয়া যায়; কোন ব্যক্তিই নির্ব্বাণপ্ৰাপ্ত হয় না, কেবল পশুর ন্যায় জীবনধারণ করে, বিদ্যাশূন্য হয় ও কোন ফলই লাভ করিতে পারে না। যদি তপ, ব্ৰহ্মচৰ্য্য, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, দান ও ঋজুতা প্রভৃতি ধর্ম্মসকল বিফল হয় ও ফলপ্ৰসবিনী ক্রিয়া প্রতারণায় পৰ্য্যবসান হয়, তাহা হইলে লোকপরম্পরা কদাচ ধর্ম্মপ্ৰতিপালন করিত না এবং ঋষি, দেব, গন্ধর্ব্ব, অসুর ও রাক্ষসগণ প্ৰভুত্বশালী হইয়াও কি নিমিত্ত আদরপূর্ব্বক ধর্ম্মাচরণ করিয়া থাকেন? তাহারা বিধাতা ধর্ম্মের ফলপ্ৰদান করেন জানিয়া ধর্ম্মাচরণ করিয়া থাকেন। ধর্ম্মই সনাতন সুখ। ধর্ম্ম কখন বিফল হয় না ও অধর্ম্মও ফলবান হয় না। তপস্যাও এই প্রকার। হে স্মেরমুখি! তুমি আপনার ও প্রতাপবান। ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্মবৃত্তান্ত অবগত আছ, ধর্ম্মাচরণ করিলে তাহার ফললাভ হয় কি না, তোমরাই তাহার প্রধান দৃষ্টান্ত। ধীরব্যক্তি কর্ম্মের অত্যল্পমাত্ৰ ফলপ্ৰাপ্ত হইলেই সন্তুষ্ট থাকেন; সমধিক ফললাভ করিলেও মূর্খদিগের সন্তোষলাভ হয় না; সুতরাং তাহারা মরণোত্তর জন্মপরিগ্রহ করিয়া কিছুমাত্র ধর্ম্মজনিত সুখপ্রাপ্ত হইতে পারে না। হে ভাবিনি! দেবতারাও পুণ্য ও পাপকর্ম্মের ফলোদয়, জন্ম ও মৃত্যু বিশেষরূপে অবগত নহেন। যে ব্যক্তি এই সকল বিষয়ে অভিজ্ঞ হইয়াও অন্য ব্যক্তিদিগকে মুগ্ধ করিয়া রাখে, সে ব্যক্তি কল্পসহস্ৰেও শ্ৰেয়ঃপ্রাপ্ত হয় না। গৃঢ়মায় দেবসমূহ ঐ সকল ধর্ম্ম-কর্ম্ম রক্ষা করেন; শান্ত ও দান্ত দ্বিজগণ তপঃপ্রভাবে বিগতপাপ ও ধ্যানফলসম্পন্ন হইয়া তাহা দর্শন করেন। ফলদর্শন না হইলেও ধর্ম্ম বা দেবতার প্রতি অশ্রদ্ধা করা উচিত নহে। অসূয়াবর্জ্জিত হইয়া প্ৰযত্নসহকারে যাগ ও দান করা কর্ত্তব্য, যেহেতু ইহাই সনাতন ধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে ও কর্ম্মের ফল ইহলোকেও দৃষ্ট হইতেছে। হে কৃষ্ণে! ব্ৰহ্মা পুত্ৰদিগকে যাহা কহিয়াছেন ও মহর্ষি কশ্যপ যাহা অবগত আছেন, তদ্দ্বরা তোমার সংশয় শিশিরের ন্যায় বিনষ্ট হউক। সকল বিষয়ই রীতিমত শাস্ত্রানুসারে প্রচলিত হইয়া আসিতেছে; তুমি নাস্তিক্যভাব পরিত্যাগ কর; সকল ভূতের ঈশ্বর ধাতাকে তিরস্কার করিও না। তাহাকে বিশেষরূপে জানিতে অভিলাষ কর ও নমস্কার কর, তোমার ঈদৃশী বুদ্ধি যেন আর না হয়। ভক্ত ব্যক্তি মরণশীল হইয়াও যাহার প্রসাদে অমরত্ব প্ৰাপ্ত হয়, সেই পরামদেবতাকে কোন প্রকারে অবমাননা করিও না।”