৩১তম অধ্যায়
দ্রোণাচার্য্যের অভিযান – ভীষণ যুদ্ধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয়! যখন কৌরবসেনা সকল ছিন্ন ভিন্ন হইলে তোমরা দ্রুতপদসঞ্চারে প্রস্থান করিতে লাগিলে, তৎকালে তোমাদের মন কি রূপ হইল? ছিন্ন ভিন্ন ও আশ্রয়লাভের নিমিত্ত নিতান্ত ব্যাকুল সৈন্যগণকে একত্র করা নিতান্ত দুষ্কর; তাহাই বা কিরূপে সম্পাদিত হইল? তুমি আমার সমক্ষে এই সমস্ত কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সৈন্যসকল এই রূপ বিশৃঙ্খল হইলেও রাজা দুর্য্যোধনের হিতাভিলাষী বীরপুরুষেরা যশোরক্ষা করিবার নিমিত্ত দ্রোণাচার্য্যের অনুগমন করিলেন এবং অস্ত্র সমুদায় সমুদ্যত, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সম্ভ্রান্ত ও রণস্থল নিতান্ত ভীষণ হইলে নির্ভীকের ন্যায় সাধুসম্মত কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। অনন্তর তাঁহারা মহাবীর ভীমসেন, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সম্মুখে নিপতিত হইলে ক্রুরস্বভাব পাঞ্চালগণ, দ্রোণকে আক্রমণ কর, দ্রোণকে আক্রমণ কর, বলিয়া সৈন্যগণকে প্রেরণ করিল এবং আপনার পুত্রগণ, দ্রোণাচাৰ্য্যকে যেন বধ করে না, দ্রোণাচাৰ্য্যকে যেন বধ করে না, এই বলিয়া কৌরবগণকে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ কহিতে লাগিলেন, দ্রোণকে বিনাশ কর; কৌরবগণ কহিতে লাগিল, ‘দ্রোণকে যেন বিনষ্ট করে না।’ এইরূপে কৌরব ও পাণ্ডবগণ দ্রোণকে লইয়া যেন দ্যূত ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। মহাবীর দ্ৰোণ পাঞ্চালগণের যে যে রথীকে মথিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই সেই রথীর নিকট উপস্থিত হইতে লাগিলেন। এইরূপে, নির্দ্দিষ্ট ভাগের বিপর্য্যয় ও রণস্থল সাতিশয় ভীষণ হইয়া উঠিল; বীরগণ ভৈরব রব পরিত্যাগপূর্ব্বক বিপক্ষ বীরগণকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন।
পাণ্ডবগণ শত্রুপক্ষদিগের নিতান্ত দুরাক্রম্য হইয়া উঠিলেন এবং আপনাদিগের ক্লেশপরম্পরা স্মরণপূর্ব্বক শত্রুদিগের সৈন্য বিকম্পিত করিতে লাগিলেন। অনন্তর তাঁহার রোষপরবশ হইয়া দ্রোণাচার্য্যকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ যুদ্ধ লৌহশিলা-সম্পাতের ন্যায় একান্ত তুমুল হইয়া উঠিল। এরূপ যুদ্ধ বৃদ্ধদিগেরও স্মৃতিপথে উদিত হয় না এবং কেহ কখন দর্শন বা শ্রবণও করে নাই। সেই বীর বিনাশন সংগ্রামে পৃথিবী বলভরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া বিকম্পিত হইতে লাগিল। ইতস্তত ঘূর্ণায়মান কৌরব সেনাগণের অতি ভীষণ কলরব নভোমণ্ডল স্তব্ধ করিয়া পাণ্ডব সৈন্য মধ্যে প্রবেশ করিল তখন দ্রোণাচাৰ্য্য সহস্র সহস্র পাণ্ডব সৈন্য প্রাপ্ত হইয়া শাণিত শরনিকরে ছিন্ন ভিন্ন করিতে প্রবৃত্ত হইলে পাণ্ডব সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া স্বয়ং দ্রোণকে নিবারণ করিলেন। আমরা দ্রোণ ও পাঞ্চাল রাজের অতি অদ্ভুত যুদ্ধ নিরীক্ষণ করিয়া নিশ্চয় বোধ করিলাম যে, এই সংগ্রামের উপমা নাই।
অশ্বত্থামার হস্তে নীল নিহত
অনন্তর অনলসঙ্কাশ, শরস্ফুলিঙ্গসম্পন্ন, কার্ম্মুকজ্বালাকরাল, মহাবীর নীল হুতাশনের তৃণরাশি দহনের ন্যায় কৌরব সেনাগণকে দগ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন প্রবল প্রতাপশালী অশ্বত্থামা সর্ব্বাগ্রে সহাস্য মুখে কহিলেন, হে নীল! যোদ্ধাদিগকে শরানলে দগ্ধ করিলে তোমার কি হইবে? তুমি আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও এবং রোষপরবশ হইয়া শীঘ্র আমাকে প্রহার কর।
তখন মহাবীর নীল পদ্মনিকরাকার, পদ্মপলাশলোচন, প্রফুল্লকমলানন অশ্বত্থামাকে শরজালে বিদ্ধ করিলে অশ্বত্থামা শাণিত তিন ভল্লাস্ত্রে নীলের ধনু, ধ্বজ ও ছত্র খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর নীল রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া বিহঙ্গমের ন্যায় অশ্বত্থামার কলেবর হইতে মস্তক উৎপাটনের অভিলাষ করিলে অশ্বত্থামা হাসিতে হাসিতে নীলের সুন্দর নাসা-সুশোভিত, কুণ্ডলালঙ্কৃত মন্তক ভল্লাস্ত্রে তৎক্ষণাৎ ছেদন করিলেন। সেই পূর্ণচন্দ্রনিভানন, কমললোচন নীল ভূতলে নিপতিত হইবামাত্র পাণ্ডব সেনাগণ নিতান্ত ব্যথিত ও একান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথ-সকল চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, অর্জ্জুন অবশিষ্ট সংশপ্তকগণ ও নারায়নী সেনার সহিত দক্ষিণ দিকে যুদ্ধ করিতেছেন; সুতরাং তিনি এক্ষণে কি প্রকারে আমাদিগকে পরিত্রাণ করিবেন।