একত্রিংশ অধ্যায়
গরুড়ের জন্মরহস্য
শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! ইন্দ্রের কি অপরাধ ও তাঁহার অনবধানতাই বা কিরূপ? বালখিলা ঋষিগণের তপঃপ্রভাবে গরুড়ের সম্ভব ও মহর্ষি কশ্যপের পক্ষিরূপী পুৎত্র, ইহারই বা কারণ কি? ঐ পক্ষিরাজ কিরূপে সর্ব্বভূতের অবধ্য, অনভিভবনীয়, কামবীর্য্য ও কামচারী হইলেন? আমার এই সকল বিষয় শ্রবণ করিতে নিতান্ত কৌতূহল জন্মিয়াছে, যদি পুরাণে বর্ণিত থাকে, কীর্ত্তন কর।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মহাশয়! আপনি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, পুরাণে এই সমস্ত বর্ণিত আছে, আমি সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। কোন সময়ে প্রজাপতি কশ্যপ পুৎত্রবাসনায় এক মহাযজ্ঞ আরম্ভ করেন। তাঁহার যজ্ঞানুষ্ঠানকালে ঋষিগণ, দেবগণ ও গন্ধর্ব্বগণ সাহায্যদান করিবার নিমিত্ত তথায় সমাগত হইয়াছিলেন। মহর্ষিকশ্যপ দেবরাজ ইন্দ্রকে এবং বাললিখ্য মুনগণ ও অন্যান্য দেবতাদিগকে যজ্ঞীয় কাষ্ঠভার আহরণ করিতে নিয়োগ করিলেন। ইন্দ্র আপন বীর্য্যানুরূপ প্রচুর কাষ্ঠভার আনয়নকালে পথিমধ্যে দেখিলেন, অঙ্গুষ্ঠ-প্রমাণ বালখিল্যগণ সকলে সমবেত হইয়া বহুকষ্টে একটি পত্রবৃন্ত আহরণ করিতেছেন। তাঁহারা অতি খর্ব্বাকৃতি, দুর্ব্বল ও নিরাহার; সুতরাং জলপূর্ণ এক গোষ্পদে মগ্ন হইয়া ক্লেশ পাইতেছিলেন। বলদৃপ্ত পুরন্দব্রতদ্দর্শনে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া তাঁহাদিগকে উপহাস ও অবমাননা করিলেন এবং লঙ্ঘন করিয়া অতি সত্বর-পদে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। ঋষিগণ এইরূপে অবমানিত হইয়া সাতিশয় রোষাবিষ্ট হইলেন এবং ইন্দ্রের ভয়াবহ এক অতি মহৎ যজ্ঞ আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা ঐ যজ্ঞে এই কামনায় আহুতি প্রদান করিতে লাগিলেন যে, আমাদিগের তপঃপ্রস্তাবে ইন্দ্র হইতে অধিকতর শৌর্য্যবীর্য্য-সম্পন্ন, কামরূপী, কামবীর্য্য, কামগামী, সর্ব্বদেবের অধিপতি অন্য এক দারুণ ইন্দ্র উৎপন্ন হউন।
দেবরাজ ইন্দ্র তাহা জানিতে পারিয়া প্রজাপতি কশ্যপের শরণাগত হইলেন। কশ্যপ ইন্দ্রেমুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হইয়া বালখিল্য মুনিগণের নিকট গমন করিয়া কার্য্যসিদ্ধির প্রার্থনা করিলেন। সত্যবাদী বালখিল্য মুনিগণ তৎক্ষণাৎ “অভীষ্টসিদ্ধি হইবে” এই কথা বলিলেন। তখন প্রজাপতি কশ্যপ তাঁহাদিগকে মধুর-সম্ভাষণে পরিতৃপ্ত করিয়া সাদর বচনে কহিতে লাগিলেন, “দেখ, ব্রহ্মার নিয়োগক্রমে ইনি ত্রিভুবনের ইন্দ্র হইয়াছেন, তোমরা আবার ইন্দ্রান্তর প্রার্থনা করিতেছ, তাহা করিলে ব্রহ্মার নিয়ম অন্যথা করা হইবে, কিন্তু তোমাদিগের সঙ্কল্প মিথ্যা হয়, ইহাও আমার অভিপ্রেত নহে; অতএব তোমরা যে ইন্দ্রের নিমিত্ত কামনা করিতেছ, তিনি পতগেন্দ্র হউন। হে ঋষিগণ! দেবরাজ প্রার্থনা করিতেছেন, তোমরা তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হও।” এইরূপ অভিহিত হইয়া বালখিল্যগণ কশ্যপকে যথাবিধি পূজা করিয়া প্রত্যুত্তর করিলেন, “হে প্রজাপতে! আমরা ইন্দ্রার্থে এবং তোমার পুৎত্রার্থে এই মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতেছি, এক্ষণে এই কর্ম্মের ভার তোমার প্রতি অর্পিত হইল, তুমিই ইহা প্রতিগ্রহ করিয়া যাহা শ্রেয়স্কর হয়, করি।”
ঐকালে কল্যাণবতী, কীর্ত্তিমতী, ব্রতপরায়ণা, দক্ষসুতা বিনতা দীর্ঘকাল তপোনুষ্ঠান করণানন্তর ঋতুস্নান করিয়া পুৎত্র বাসনায় স্বামিসন্নিধানে আগমন করিলেন। মহর্ষি কশ্যপ বিনতাকে সন্নিহিতা দেখিয়া কহিলেন, “দেবি! অদ্য তোমার মনোরথ পূর্ণ হইবে, বালখিল্য মুনিগণের তপঃপ্রভাবে ও আমার সঙ্কল্পবলে তোমার গর্ভে মহাভাগ ও ভুবনবিজয়ী দুই বীর পুৎত্র জন্মিবে। তাহারা ত্রিভুবন-পূজিত ও ত্রিলোকীর অধীশ্বর হইবে। তুমি প্রমাদশূন্য হইয়া এই সুমহোদয় গর্ভধারণ কর। সর্ব্বলোক সৎকৃত কামরূপী ঐ দুই বিহঙ্গম সমস্ত পক্ষিজাতির উপর ইন্দ্রত্ব করিবে।” অনন্তর মহর্ষি কশ্যপ অতিপ্রীতমনে ইন্দ্রকে কহিলেন, “সেই দুই মহাবীর্য্য বিহঙ্গম তোমার ভ্রাতা ও সহায় হইবে এবং তাহারা তোমার কখন কোন অপচয় করিবে না। তোমার সকল সন্তাপ দূর হউক, তুমিই ইন্দ্র থাকিবে, কিন্তু হে বৎস! তুমি অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া যেন আর কদাচ ব্রহ্মবাদী ঋষিদিগকে পরিহাস বা অবমাননা করিও না। তাঁহাদিগের বাক্য বজ্রস্বরূপ এবং তাঁহারা অতিশয় কোপনস্বভাব।”
দেবরাজ ইন্দ্র মহর্ষি কশ্যপ কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া নিঃশঙ্কচিত্তে সুরলোকে প্রস্থান করিলেন। বিনতাও চরিতার্থ হইয়া পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন। পরে কশ্যপ-বনিতা বিনতা যথাকালে অরুণ ও গরুড় নামে দুই পুৎত্র প্রসব করিলেন। অরুণ অঙ্গবৈকল্য-প্রযুক্ত সূর্য্যের সারথি হইয়াছেন, তদীয় ভ্রাতা গরুড় পক্ষিগণের ইন্দ্রত্বপদে অভিষিক্ত হইয়াছেন। হে ভৃগুনন্দন! সেই বিনতানন্দন গরুড়ের অতি বিচিত্র চরিত্র কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।