৩০তম অধ্যায়
স্বর্ণষ্ঠীবীর বৃত্তান্ত-পর্ব্বত-নারদসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “বাসুদেব! সঞ্জয়ের পুত্র কি নিমিত্ত কাঞ্চনষ্ঠীবী হইয়াছিলেন, পর্ব্বত কি নিমিত্ত সৃঞ্জয়কে ঐ পুত্র প্রদান করিয়াছিলেন, তৎকালে মনুষ্যেরা সহস্র বর্ষ জীবিত থাকিত; তবে সৃঞ্জয়ের পুত্র কি নিমিত্ত অপ্রাপ্তকৌমারাবস্থায় প্রাণত্যাগ করিল? ঐ পুত্র কি কেবল নামেই কাঞ্চনষ্ঠীবী অথবা যথার্থই কাঞ্চন ষ্ঠীবন করিত? এই সমুদয় বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইতে আমার একান্ত অভিলাষ হইতেছে, তুমি উহা কীৰ্ত্তন কর।”
বাসুদেব কহিলেন, “মহারাজ। আমি আপনার অভিলষিত বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পূৰ্ব্বকালে নারদ ও পর্ব্বত নামে দুই মহর্ষি মনুষ্যলোকে শাল্য ও ঘৃত ভোজন করিয়া বিহার করিবার নিমিত্ত দেবলোক হইতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। তপোধন নারদ মহাত্মা পৰ্ব্বতের মাতুল ছিলেন। ঐ তাপসদ্বয় ধরাতলে মনুষ্যভোজ্য দ্রব্যজাত ভোজন করিয়া প্রীতমনে স্বেচ্ছানুসারে পর্য্যটন করিতে করিতে পরস্পর এই প্রতিজ্ঞা করিলেন, ভালই হউক আর মন্দই হউক, যাঁহার মনে যাহা উদয় হইবে, তিনি তৎক্ষণাৎ তাহা প্রকাশ করিবেন। যিনি এই প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন না করিবেন, তাঁহাকে অবশ্যই পাপভাগী হইতে হইবে।
নারদ-পর্বতের পরস্পর অভিশাপ সূচনা
“মহর্ষিদ্বয় পরস্পর এইরূপ প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ হইয়া রাজা সৃঞ্জয়ের সমীপে গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, মহারাজ! আমরা তোমার হিতার্থ কিয়ৎকাল এইস্থানে অবস্থান করিব। তুমি আমাদিগের প্রতি অনুকূল হও।’ মহারাজ সৃঞ্জয় তাপসদ্বয়ের বাক্যশ্রবণে ‘তথাস্তু’ বলিয়া পরমসমাদরে তাঁহাদিগের যথোচিত পরিচর্য্যা করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন অতীত হইলে একদা নরপতি সৃঞ্জয় পরমপ্রীতমনে স্বীয় কন্যাসমভিব্যাহারে নারদ ও পৰ্ব্বতের নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “আমার এই একমাত্র পরম রূপবতী কন্যা আছেন, ইনি অতি সুশীলা, অদ্যাপি ইনিই আপনাদের পরিচর্য্যা করিবেন।’ নরপতি সৃঞ্জয় তাপসদ্বয়কে এই কথা বলিয়া স্বীয় দুহিতাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘বৎসে! তুমি আজ হইতে দেবতা ও পিতার ন্যায় এই বিপ্রদ্বয়ের পরিচর্য্যা কর।’ তখন সেই ধর্ম্মচারিণী কন্যা পিতার বাক্যে অঙ্গীকার করিয়া তাঁহার আদেশানুসারে মহর্ষিয়ের শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। তপোধন নারদ রাজকুমারীর অসামান্য রূপলাবণ্য ও শুশ্রূষা দর্শনে একান্ত মুগ্ধ হইলেন। তাঁহার হৃদয়ানলে শুক্লপক্ষীয় চন্দ্ৰমার ন্যায় দিন দিন কামের বৃদ্ধি হইতে লাগিল। কিন্তু তিনি লজ্জার অনুরোধে ভাগিনেয় পৰ্ব্বতকে স্বীয় হৃদয়বেদনা ব্যক্ত করিতে পারিলেন না।
নারদের বানরবদন-পৰ্ব্বতের স্বর্গগতিরোধ
“অনন্তর একদা মহাত্মা পৰ্ব্বত স্বীয় তপোবল ও নারদের ইঙ্গিত দ্বারা তাঁহাকে কামার্ত্ত বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, ‘মাতুল! পুর্বে আমরা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে, যখন যাহার মনে যে ভাবের উদয় হইবে, তাহা ভালই হউক বা মন্দই হউক, তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করিব। কিন্তু এক্ষণে এই সুকুমারীর রূপলাবণ্যনিরীক্ষণে আপনার যেরূপ মনোবিকার উপস্থিত হইয়াছে, তাহা আপনি আমার নিকট ব্যক্ত করেন নাই। আপনি ব্রহ্মচারী, তপস্বী ও ব্রাহ্মণ। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা কি আপনার কর্ত্তব্য হইয়াছে? আমি আপনার প্রতিজ্ঞালঙ্ঘননিবন্ধন নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছি। এক্ষণে আপনাকে শাপ প্রদান করিতেছি। এই সুকুমারীর সহিত আপনার বিবাহকাৰ্য্য সমাধান হইলে ঐ কন্যা এবং অন্যান্য লোক আপনাকে বানরের ন্যায় অবলোকন করিবে।’ তখন মহাত্মা নারদ পৰ্ব্বতের বাক্য শ্রবণে কোপপূর্ণ ও তাঁহাকে শাপ প্রদানে কৃতনিশ্চয় হইয়া কহিলেন, তুমি ধৰ্ম্মপরায়ণ, তপস্যানিরত, ব্রহ্মচারী, সত্যবাদী ও দমগুণান্বিত হইয়াও স্বর্গে গমন করিতে পারিবে না।’
“হে মহারাজ! এইরূপে সেই তাপসদ্বয় পরস্পরকে শাপ প্রদানপূর্ব্বক ক্রুদ্ধ মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর সৌহার্দ্দ্যে বিরত হইলেন। মহামতি পর্ব্বত তথা হইতে বহির্গমনপূৰ্ব্বক স্বীয় তেজঃপ্রভাবে সকলের পুজিত হইয়া সমুদয় পৃথিবী পর্য্যটন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন পরে মহাত্মা নারদ ধৰ্ম্মানুসারে সৃঞ্জয়কুমারী সুকুমারীর পাণিগ্রহণ করিলেন। বিবাহের মন্ত্র শেষ হইবামাত্র সুকুমারী পৰ্ব্বতের শাপপ্রভাবে নারদের মুখমণ্ডল বানরবদনের ন্যায় বিকৃত দেখিতে লাগিলেন। রাজকুমার ভর্তাকে এইরূপ কুৎসিত দেখিয়া তাঁহার অবমাননা করিলেন না, প্রত্যুত পরম প্রীতিসহকারে তাঁহার শুশ্রূষা করিতে লাগিলেন। দেবতা, যক্ষ বা অন্য কোন মুনির সহিত প্রণয়ের বিষয় একবার মনেও করিলেন না।
নারদ-পর্ব্বতের পরম্পর শাপ প্রত্যাহার
“কিয়দ্দিন পরে একদা ভগবান্ পর্ব্বত নানা স্থান পর্য্যটন করিতে করিতে এক অরণ্যমধ্যে উপনীত হইলেন এবং তথায় দেবর্ষি নারদকে অবলোকন করিয়া অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্। আপনি প্রসন্ন হইয়া আমাকে স্বর্গগমনে অনুমতি করুন।’ মহাত্মা নারদ পৰ্ব্বতকে দীনভাবে অবস্থান করিতে দেখিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘ভাগিনেয়! তুমি প্রথমে আমাকে অভিসম্পাতপূৰ্ব্বক বানরত্ব প্রদান করিয়াছ, আমি পশ্চাৎ তোমাকে শাপ প্রদান করিয়াছি। যাহা হউক, তুমি আমার পুত্ৰতুল্য, তোমার সহিত এরূপ ব্যবহার করা কর্ত্তব্য নহে।’ তাপসদ্বয় এইরূপ কথোপকথন করিয়া পরিশেষে পরস্পরকে শাপ হইতে মুক্ত করিলেন। তখন রাজকুমারী সুকুমারী নারদের পরম সুন্দর দেবরূপ নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক তাঁহাকে পরপুরুষ আশঙ্কা করিয়া তথা হইতে ধাবমান হইলেন। মহাত্মা পর্ব্বত তদ্দর্শনে রাজকন্যাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘পতিব্রতে! পলায়ন করিও না; ইনি তোমারই ভর্তা, ইনিই সেই ধর্ম্মপরায়ণ ভগবান্ নারদ। এ বিষয়ে তোমার কিছুমাত্র সন্দেহ করিবার আবশ্যক নাই।’ রাজকুমারী সুকুমারী মহাত্মা পর্ব্বতকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ভর্তার শাপবৃত্তান্ত শ্রবণপূৰ্ব্বক প্রকৃতিস্থ হইলেন। তখন মহাত্মা পর্ব্বত স্বর্গারোহণ ও মহর্ষি নারদ আপনার নিবাসে গমন করিলেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! এই সেই ভগবান নারদ আপনার নিকটেই অবস্থান করিতেছেন, ইঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সৃঞ্জয়রাজ ও তাঁহার পুত্রের বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবেন।”