৩০তম অধ্যায়
সুবলনন্দন বৃষক ও অচল বধ
সঞ্জয় কহিলেন, “এই রূপে মহাবীর অর্জ্জুন দেবরাজ ইন্দ্রের প্রিয় সখা প্রাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্তকে বিনাশ করিয়া প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন। তখন বৃষক ও অচল নামে গান্ধাররাজের তনয়দ্বয় অর্জ্জুনকে একান্ত নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। কেহ সম্মুখে কেই বা পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করিয়া অর্জ্জুনকে মহাবেগ শাণিতসায়কে বিদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। অর্জ্জুন শাণিত শরনিকরে সুবলনন্দন বৃষকের অশ্ব, সারথি, ধনু, ছত্র, ধ্বজ ও রথ তিল তিল করিয়া ছেদন করিলেন এবং নানাবিধ আয়ুধ দ্বারা সৌবল প্রমুখ গান্ধারগণকে বারংবার ব্যাকুল করিতে লাগিলেন। পরে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া উদ্যতাস্ত্র পঞ্চ শত গান্ধারকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। বৃষক সত্বরে হতাশ্ব রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া ভ্রাতার রথে আরোহণ পূর্ব্বক অন্য শরাসন গ্রহণ করিলেন। অর্জ্জুন এক রথারূঢ় বৃষক ও অচলকে বারংবার শরজালে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। যেমন বৃত্র ও বলাসুর সুররাজ ইন্দ্রকে আঘাত করিয়াছিল, তদ্রূপ তাঁহারা অর্জ্জুনকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন এবং যেমন নিদাঘ ও বর্ষাকালীন মাসদ্বয় গ্রীষ্ম ও জলধারা দ্বারা লোককে একান্ত কাতর করিয়া থাকে, তদ্রূপ তাঁহারা আহত না হইয়া অনেকে নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন এক রথারূঢ় সংশ্লিষ্ট কলেবর বৃষক ও অচলকে এক শরে বিনাশ করিলেন। তখন সেই সিংহ সঙ্কাশ লোহিতলোচন একলক্ষণাক্রান্ত বীরদ্বয় গতা হইয়া রথ হইতে নিপতিত হইলেন। তাঁহাদের মৃত কলেবর দশদিকে অতি পবিত্র যশ বিস্তার করিয়া ভূতল প্রাপ্ত হইল।
অর্জ্জুনসহ শকুনির মায়াযুদ্ধ – শকুনি পলায়ন
অনন্তর আপনার আত্মজগণ সমরে অপরাঙ্মুখ বন্ধুজন প্রিয় দুই মাতুলকে ভূতলশায়ী নিরীক্ষণ করিয়া অর্জ্জুনের প্রতি অনবরত শর প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। মায়াবিশারদ শকুনি উভয় ভ্রাতাকে বিনষ্ট দেখিয়া কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে বিমোহিত করিয়া মায়াজাল বিস্তার করিলেন; তখন লগুড়, অয়োগুড়, প্রস্তর, শতঘ্নী, শক্তি, গদা, পরিঘ, খড়্গ, শূল, মুদগর, পট্টিশ, কম্পন, ঋষ্টি, নখর, মুষল, পরশু, ক্ষুর, ক্ষুরপ্র, নালীক, বৎসদন্ত, অস্থিসন্ধি, চক্র, বিশিখ, প্রাস ও অন্যান্য নানাবিধ আয়ুধ সকল দিক্ ও বিদিক্ হইতে অর্জ্জুনের প্রতি নিপতিত হইতে লাগিল। খর, উষ্ট্র, মহিষ, ব্যাঘ্র, সিংহ, সৃমর, চিল্লক, ঋক্ষ, শালাবৃক, গৃধ্র, কপি, সরীসৃপ ও বিবিধ রাক্ষসগণ ক্ষুধার্ত্ত হইয়া ক্রোধভরে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইল। তখন দিব্যাস্ত্রবেত্তা অর্জ্জুন শরজাল বিস্তার পূর্ব্বক তাহাদিগকে প্রহার করিতে প্রবৃত্ত হইলে তাহারা শরতাড়িত হইয়া চীৎকারপূর্ব্বক বিনষ্ট হইতে লাগিল।
অনন্তর ঘোরতর অন্ধকার প্রাদুর্ভূত হইয়া অর্জ্জুনের রথ সমাচ্ছন্ন করিলে সেই অন্ধকার হইতে অতি কঠোর বাক্য অর্জ্জুনকে ভৎসনা করিতে লাগিল। অর্জ্জুন জ্যোতিষ্ক অস্ত্রে তৎক্ষণাৎ সেই ভয়প্রদ গাঢ়ান্ধকার নিরাশ করিলেন। পরে ভয়ঙ্কর জল প্রবাহ প্রাদুর্ভূত হইল। অর্জ্জুন জলশোষণা করিবার নিমিত্ত আদিত্যাস্ত্র প্রয়োগ করিলেন। উহা প্রযুক্ত হইবামাত্র প্রায় সমস্ত জলই শুদ্ধ হইয়া গেল। এইরূপে মহাবীর অর্জ্জুন হাসিতে হাসিতে অস্ত্র বলে সৌবল বিহিত বিবিধ মায়া বিনাশ করিলেন। তখন শকুনি অর্জ্জুন শরতাড়িত ও নিতান্ত ভীত হইয়া অতি বেগগামী তুরঙ্গমে আরো হণ পূর্ব্বক নীচ লোকের ন্যায় পলায়ন করিলেন। অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন আপনার হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক কৌরব সৈন্যগণের প্রতি শর প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। যেমন ভাগীরথী প্রবাহ পর্ব্বতে সংলগ্ন হইয়া দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া যায়, তদ্রূপ সেই সমস্ত সৈন্য অর্জ্জুনশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া দুইভাগে বিভক্ত হইল; এবং কতকগুলি দ্রোণের নিকট ও কতকগুলি দুর্য্যোধনের নিকট গমন করিল। পরে সৈন্য সকল ধূলিজালে সমাচ্ছন্ন হইলে আমরা আর অর্জ্জুনকে দেখিতে পাইলাম না; কেবল দক্ষিণ দিকে অনবরত গাণ্ডীব-নির্ঘোষ শ্রবণ করিতে লাগিলাম। ঐ গাণ্ডীব নির্ঘোষ শঙ্খ, দুন্দুভি ও অন্যান্য বাদ্যধ্বনি অভিভূত করিয়া নভোমণ্ডল স্পর্শ করিতে লাগিল।
অনন্তর দক্ষিণদিকে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। আমি দ্রোণাচার্য্যের অনুসরণ করিলাম। রাজা যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণ কৌরব সেনাগণকে বিনাশ করিতে লাগিল। যেমন বর্ষাকালে বায়ু মেঘ সকল অপৰাহিত করিয়া থাকে তদ্রূপ, অর্জ্জুন কৌরব সৈন্যদিগকে তাড়িত করিতে লাগিলেন। কোন ব্যক্তিই ভূরিবর্ষণশীল ত্রিদশাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় শরনিকরবর্ষা অর্জ্জুনকে আগমন করিতে দেখিয়া নিরাপণ করিতে
সমর্থ হইলেন না। কৌরবগণ পার্থশরাহত ও নিতান্ত ব্যথিত হইয়া ইতস্তত পলায়ন করিবার সময় স্বপক্ষদিগকে বিনাশ করিলেন। অ
র্জ্জুন বিনির্মুক্ত কঙ্কপত্রবিভূষিত তনুচ্ছেদী শর সকল শলভের ন্যায় দশদিক্ সমাচ্ছন্ন করিয়া নিপতিত হইতে লাগিল। যেমন পন্নগগণ বাল্লীকমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই সমস্ত শর তুরঙ্গম, নাগ, পদাতি ও রথিগণকে ভেদ করিয়া ভূগর্ভে প্রবেশ করিল। অর্জ্জুন হস্তী ও মনুষ্যের প্রতি দ্বিতীয় শর পরিত্যাগ করেন নাই; তাহারা প্রত্যেকেই এক মাত্র শরে নিতান্ত নিপীড়িত ও গতাসু হইয়া নিপতিত হইয়া ছিল। নিহত মনুষ্য, হস্তী ও অশ্বে রণস্থল পরিপূর্ণ হইল; শৃগাল ও কুকুরেরা কোলাহল করিতে লাগিল; এইরূপে রণক্ষেত্র সাতিশয় বিচিত্র হইয়া উঠিল। পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে ও সুহৃৎ সুহৃৎকে পরিত্যাগ করিয়া আত্ম রক্ষায় যত্নবান্ হইলেন; অধিক কি, তৎকালে অনেকেই পার্থশরতাড়িত হইয়া স্ব স্ব বাহনদিগকেও পরিত্যাগ করিতে লাগিল।”