৩০তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের পঞ্চগ্রামপ্রার্থনা-প্ৰস্তাব
“হে সঞ্জয়, কি সাধু, কি অসাধু, কি বালক, কি বৃদ্ধ, কি বলবান, কি দুর্ব্বল—ধাতা সকলকেই বশীভূত করেন। তিনি পূর্ব্বকর্ম্মানুসারে বালককে পাণ্ডিত্য ও পণ্ডিতকে বালত্ব প্রদান করিয়া থাকেন, সকলই তাঁহার অধীন। হে সঞ্জয়! এক্ষণে তুমি কুরুরাজ্যে গমন কর; অনন্তর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া প্ৰণিপাতপূর্ব্বক তাঁহার অনাময়জিজ্ঞাসা করিবে। তিনি আমাদের বলের কথা জিজ্ঞাসা করিলে, যাহা দেখিতেছি, ইহাই যথার্থরূপ বর্ণনা করিবে; আর তিনি কুরুকুলে পরিবৃত হইয়া উপবিষ্ট হইলে পর কহিবে যে, আপনার বীৰ্য্যপ্রভাবে পাণ্ডবগণ পরমসুখে কালব্যাপন করিতেছেন; তাঁহারা বালক, আপনার প্রসাদেই রাজ্যলাভ করিয়াছিলেন, অতএব অগ্ৰে তাঁহাদিগকে রাজ্য সংস্থাপিত করিয়া এক্ষণে উপেক্ষা করিয়া বিনষ্ট করা অনুচিত। হে সঞ্জয়! এই সমুদয় ব্ৰহ্মাণ্ড কখন একজনের অধিকৃত হইতে পারে না, আমরা পরস্পর সামঞ্জস্যসহকারে বাস করিতে বাসনা করি। তুমি এক্ষণে শত্রুদিগের বশীভূত হইও না।
“হে গবলগণনন্দন! তুমি ভরতকুলের পিতামহ শান্তনুতনয় ভীষ্মের নিকট গমনপূর্ব্বক আমার নাম কীর্ত্তন করিয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিবে এবং কহিবে যে, আপনি ক্ষয়োন্মুখ শান্তনুর বংশ প্রত্যুদ্ধার করিয়াছেন, অতএব স্বয়ং বিবেচনা করিয়া যাহাতে আপনার পৌত্ৰগণ জীবিত থাকিয়া পরস্পর সৌহার্দ অবলম্বন করে, তদ্বিষয়ে যত্ন করুন। পরে কুরুকুলের মন্ত্রি বিদুরের সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিবে, হে ক্ষত্তঃ! তুমি যুধিষ্ঠিরের পরমহিতৈষী, অতএব যাহাতে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ না হয়, এরূপ পরামর্শ প্রদান কর ।
“অনস্তর কৌরবগণমধ্যে সমাসীন অমর্ষপরায়ণ রাজপুত্ৰ দুৰ্য্যোধনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া পুনঃ পুনঃ অনুনয় করিয়া কহিবে, “হে রাজকুমার! তুমি যে নিরপরাধা দ্রুপদনন্দিনীকে সভামধ্যে আনয়ন করিয়া যথোচিত অবমাননা করিয়াছিলেন এবং তুমি যে পাণ্ডবগণকে অজিন পরিধান করাইয়া বনে নির্ব্বাসিত ও অন্যান্য বহুবিধ দুঃখে পাতিত করিয়াছ, তাঁহারা তৎসমুদয় ক্ষমা করিয়াছেন; আর কুরুকুল নির্ম্মূল করেন নাই। আর দুষ্ট দুঃশাসন তোমার অনুমতিক্ৰমে কুন্তী দেবীর বাক্য অতিক্রম করিয়া যে দ্ৰৌপদীর কেশাকর্ষণ করিয়াছিল, তাহাও তাঁহারা সহ্য করিয়াছেন; অতএব এক্ষণে তুমি পরদ্রব্যগ্রহণাভিলাষ পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাদিগকে তাঁহাদের যথার্থ ভাগ প্ৰদান কর। তাহা হইলেই পরস্পরের শান্তি ও প্রীতিলাভের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তাঁহারা রাজ্যের একদেশমাত্র প্রাপ্ত হইলেই সন্তুষ্ট হইবেন। অতএব তুমি কুশস্থল, বৃকস্থল, মাকান্দী, বারণাবত ও অন্য এক গ্রাম-এই পঞ্চগ্রাম তাঁহাদের পঞ্চভ্ৰাতাকে প্ৰদান কর।
“হে সঞ্জয়! আমার অভিলাষ এই যে, জ্ঞাতিগণের সহিত আমাদের শান্তিলাভ হয়; ভ্রাতা ভ্রাতার সহিত ও পিতা পুত্রের সহিত মিলিত হয়েন, পাঞ্চালগণ হাসিতে হাসিতে কৌরবদিগের নিকট গমন করেন এবং আমি সমুদয় কৌরব ও পঞ্চালগণকে অক্ষত দর্শন করি। আমি সন্ধি ও বিগ্ৰহ উভয় কাৰ্য্যেই সম্মত আছি; মৃদু ও দারুণ উভয়েই পরাঙ্মুখ নহি, এক্ষণে যেরূপ উপস্থিত হইবে, তাহাই করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।”