৩০তম অধ্যায়
ধার্ম্মিক যুধিষ্ঠিরের দুঃখে দ্ৰৌপদীর বিস্ময়
দ্রৌপদী কহিলেন, “হে নাথ! যাহারা মোহ উৎপাদন করিয়া বলপূর্ব্বক রােজ্যাক্ৰমণস্বরূপ পিতৃপরম্পরাগত কর্ত্তব্যকর্ম্মে আপনার বুদ্ধিভ্রম জন্মাইতেছেন, সেই ধাতা ও বিধাতা উভয়কেই আমার নমস্কার। কর্ম্মই উত্তম, মধ্যম প্রভৃতি পৃথক পৃথক লোকপ্ৰাপ্তির সাধন ও কর্ম্মের ফল অপরিহাৰ্য্য। লোক মোহবশতঃ মোক্ষলাভের অভিলাষ করিয়া থাকে। কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া ধর্ম্ম, দয়া, ক্ষমা, সরলতা ও লোকাপবাদভীরুতা অবলম্বনপূর্ব্বক কেহ কখনও ইহলোকে উন্নতিলাভ করিতে পারে না। হে মহারাজ! আপনি ও আপনার ভ্রাতৃগণ নিতান্ত সুখোচিত হইয়াও ঈদৃশ দুঃসহ দুরবস্থায় নিপতিত, ইহাই তাহার প্রমাণ। কি রাজ্যশাসনকালে, কি বিবাসনসময়ে, কখনই আপনারা ধর্ম্ম অপেক্ষা আর কিছুই প্রিয়তর বলিয়া জানিতেন না, বরং জীবন অপেক্ষাও ধর্ম্মকে সমধিক প্রিয়তর বোধ করিয়া থাকেন। আপনার রাজ্য ও জীবন কেবল ধর্ম্মের নিমিত্ত, ইহা ব্রাহ্মণ, গুরু ও দেবতারা জানেন। আমি বিলক্ষণ জানি, আপনি ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব ও আমাকে পরিত্যাগ করিবেন, তথাপি ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিবেন না। আমি আৰ্য্যগণের সমীপে শ্রবণ করিয়াছি, যে রাজা ধর্ম্ম রক্ষা করেন, ধর্ম্ম তাঁহাকে রক্ষা করিয়া থাকেন; কিন্তু দেখিতেছি, ধর্ম্ম আপনাকে রক্ষা করিতেছেন না। যেমন স্বকীয় ছায়া মানবের অনুগামিনী হয়, তদ্রূপ আপনার অসাধারণ বুদ্ধি নিয়তই ধর্ম্মেরই অনুবর্ত্তিনী হইতেছে। হে নাথ! আপনি সসাগরা ধরার একাধিপত্যলাভ করিয়াও কি সমকক্ষ, কি কনিষ্ঠ, কি শ্রেষ্ঠ কাহারও অবমাননা করেন নাই ও কখন আপনার অভিমান বা দর্পও দৃষ্ট হয় নাই, আপনি সর্ব্বদা স্বাহাকার, স্বধাবাচন ও পূজাদ্বারা দ্বিজ, দেবতা এবং পিতৃগণের সেবা করিয়া থাকেন। সর্ব্বপ্রকার উপভোগদ্বারা ব্রাহ্মণ, যতি, সন্ন্যাসী ও গৃহস্থাদিগকে পরিতৃপ্ত করিয়া স্বর্ণময়পত্রে ভোজন প্রদান করিতেন। আমি তাহাদিগের পরিচর্য্যা করিতাম। আপনি বানপ্ৰস্থাদিগকে স্বর্ণাদিধাতুনির্ম্মিত পাত্ৰসকল প্ৰদান করিতেন। ব্রাহ্মণগণকে আপনার অদেয় কিছুই ছিল না। আপনি শান্তির নিমিত্ত অতিথি ও অন্যান্য প্রাণীগণের তৃপ্তির উদ্দেশ্যে বৈশ্বদেববলি প্ৰদান করিয়া শিষ্টাচারসহকারে সময়াতিপাত করিতেন। এই দাস্যুসমাকীর্ণ জনশূন্য মহারণ্যেও আপনার যাগ, পশুবন্ধন, কাম্য ও নৈমিত্তিক ক্রিয়া, পাকযজ্ঞ ও যজ্ঞকর্ম্মসকল নিরন্তর বর্ত্তমান রহিয়াছে। রাজ্য হইতে বিবাসিত হইয়াও আপনার কর্ম্ম অবসন্ন হয় নাই। আপনি অশ্বমেধ, গোমেধ, রাজসূয়, পুণ্ডরীক প্রভৃতি ভূরিদক্ষিণ যজ্ঞসকল অনুষ্ঠান করিয়া নিরন্তর ইষ্ট-সাধন করিতেন, তথাপি বিষম অক্ষপরাজয়ে এরূপ বিপরীতবুদ্ধি হইয়াছিল যে, বিপক্ষগণ পণে পরাজয় করিয়া রাজ্য, ধন, আয়ুধ, ভ্রাতৃগণ ও আমাকে অনায়াসে গ্রহণ করিল; হে রাজন! আপনি ঋজুতা, মৃদুতা, বদান্যতা, লজ্জাশীলতা ও সত্যবাদিতার পরাকাষ্ঠা প্ৰদৰ্শন করিয়াছেন, তথাপি দ্যূতব্যসনজনিত বিপরীতবুদ্ধি কি প্রকারে উপস্থিত হইল, আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। এক্ষণে আপনার ঈদৃশ দুঃখ ও অপ্রতিকাৰ্য্য [প্ৰতিকারের অযোগ্য-সহজে যাহার প্রতিকার হয় না] আপদ অবলোকন করিয়া নিতান্ত মোহপাশে বদ্ধ হইতেছি; আর শোকবেগ-সংবরণ করিতে পারি না।”
পুরাতত্ত্বস্মরণে দ্রৌপদীর আত্মপ্রসাদ
“হে ধর্ম্মরাজ! এ স্থলে সকলে এই পুরাতন ইতিহাস উদাহরণস্বরূপে কহিয়া থাকেন যে, সমুদয় লোক ঈশ্বরের বশীভূত হইয়া চলে, তিনি সমস্ত প্রাণীর প্রিয়াপ্রিয় ও সুখ-দুঃখের বিধাতা; তিনি পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত কর্ম্মানুসারে সমুদয় বিধান করেন। যেমন সূত্ৰধর দারুময়ী নারী নির্ম্মাণ করিয়া তাহাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সকল যোজনা করে, সেইরূপ বিধাতা এই সমুদয় জীবের অবয়ব সৃষ্টি করেন। তিনি আকাশের ন্যায় সর্ব্বভূতে ব্যাপ্ত হইয়া ইহসংসারে শুভাশুভ বিধান করিতেছেন। সকলই তন্তুবদ্ধ শকুনির ন্যায় পরাধীন; কেহই আপনার বা অন্যের প্রতি প্ৰভুত্ব করিতে পারে না। লোকসকল সূত্রগ্রথিত [সূতায় বাঁধা] মণির ন্যায় ও নস্যসংযত [ভিন্ন নাসায় সূত্রবদ্ধ—নোক ফোড়াইয়া তাহাতে দড়ি লাগান] বৃষের ন্যায় নিয়ন্ত্রিত হইয়া ঈশ্বরের শাসনেই চলিতেছে, কারণ, এই পরিদৃশ্যমান জগৎ তন্ময়। যেমন বৃক্ষ কুল হইতে প্রবাহে পতিত হইয়া মুহুর্ত্তমাত্রও স্থির হয় না, তদ্রূপ মনুষ্যবৰ্গ স্বতন্ত্র হইয়া ক্ষণমাত্রও অতিবাহিত করিতে পারে না। অজ্ঞান তিমিরাবৃত জন্তুগণ স্বীয় সুখদুঃখের ঈশ্বর হইতে পারে না; তাহারা ঈশ্বরপ্রেরিত হইয়া স্বৰ্গ ও নরকে গমন করে। হে পাণ্ডবরাজ! যেমন তৃণের অগ্রভাগ প্রবল বায়ুর বশবর্ত্তী হয়, তদ্রূপ সমস্ত চরাচর ধাতার বশীভূত হইয়া চলিতেছে। ঈশ্বর মানবগণকে পুণ্যকর্ম্মে অথবা পাপাচারে অনুরক্ত করিয়া সমুদয় চরাচরে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন, কিন্তু ‘এই পরমেশ্বর’ ইহা বলিয়া কেহই লক্ষ্য করিতে সমর্থ হয় না। মহাভূত ও অহঙ্কারাদিরূপ তদীয় স্থূল ও সূক্ষ্ম দেহই চিদাত্মার আভাসম্বরূপ বীজনিবাপস্থান [জীববুদ্ধির উন্মেষক বীজ বপনক্ষেত্র] সংজ্ঞিত হইয়া কর্ত্তা হইতেছে, তিনি তদ্দ্বারাই শুভাশুভ ফলোৎপাদক কর্ম্ম করাইতেছেন। দেখুন, ঈশ্বর কি আশ্চৰ্য্য মায়া-প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। তিতি আত্মমায়ায় মোহিত করিয়া ভূতদ্বারা ভূতগণকে বিনষ্ট করিতেছেন। তত্ত্বদর্শী মুনিগণ এই ভূত-সৃষ্টিসকল স্বপ্ন ও ইন্দ্ৰজালের ন্যায় দর্শন করেন, কিন্তু বায়ুবেগের ন্যায় ভিন্নপ্রকারে পরিবর্ত্তিত হইতে থাকে। মানবগণ ভূতজাতকে নিত্যশুচি ও সুখস্বরূপ বিবেচনা করেন, কিন্তু ঈশ্বর সেই সকলকে অহঙ্কারাদিদ্বারা উৎপন্ন ও জরাজীর্ণত্বাদিদ্বারা বিকৃত করিতে থাকেন। যেমন কাষ্ঠদ্বারা কাষ্ঠ, পাষাণদ্বারা পাষাণ ও লৌহদ্বারা লৌহ ছিন্ন হয়, সেই প্রকার ভগবান স্বয়ম্ভু মায়াসহকারে ভূতদ্বারা ভূতগণকে বিনষ্ট করেন। যেমন বালক ক্রীড়নক লইয়া ক্রীড়া করে, তদ্রূপ স্বতন্ত্রেচ্ছু ভগবান প্ৰভু কখন সংযোগ কখন বা বিয়োগ করিয়া ভূতগণদ্বারা ক্রীড়া করিতেছেন। হে রাজন! ধাতা ভূতগণের প্রতি পিতামাতার ন্যায় স্নেহপর নহেন। তিনি রোষাবিষ্ট হইয়া ইতরজনের ন্যায় ব্যবহার করিয়া থাকেন। সুশীল, লজ্জাশালী আৰ্য্যগণ কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন করেন, আর পাপাত্মারা বিষয়বাসনায় বিহ্বল হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে বাস করিতেছে; ইহাই কি পরমেশ্বরের অপক্ষপাতিতা! হে মহারাজ! আপনার বিপদ এবং দুৰ্য্যোধনের সম্পদ অবলোকন করিয়া সেই বিষমদৰ্শী বিধাতাকে তিরস্কার করি। তিনি আৰ্য্যশাস্ত্রলঙ্ঘী, ক্রুর, লোভাপরবশ, অধার্ম্মিক দুৰ্য্যোধনকে রাজ্যধন প্রদান করিয়া কি ফলভোগ করিতেছেন? যদি অনুষ্ঠিত কর্ম্মের ফল কেবল কর্ত্তাকেই ভোগ করিতে হয়, তাহা হইলে নিয়োগকর্ত্তা ঈশ্বরও তজ্জন্য পাপে লিপ্ত হয়েন, সন্দেহ নাই। যদ্যপি ঈশ্বর প্রয়োজনকর্ত্তা হইয়াও কর্ম্মজনিত পাপভোগ না করেন, বলই তাহার কারণ বলিতে হইবে; অতএব হে মহারাজ! দুর্ব্বল জনেরাই একান্ত অধীন ও নিতান্ত শোচনীয়।”