ত্রিংশ অধ্যায়
গরুড়ের অমৃতহরণ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, মহাবল-পরাক্রান্ত গরুড় পাদস্পর্শ মাত্রেই তরুশাখা ভগ্ন হইল দেখিয়া তৎক্ষণাৎ তাহা ধারণ করিলেন। বিহঙ্গমরাজ শাখাভঙ্গ করিয়া বিস্ময়বিস্ফারিত লোচন ইতস্ততঃ অবলোকন করিতেছেন, ইত্যবসরে দেখিতে পাইলেন, তপঃপরায়ণ বালখিল্য ঋষিগণ অধঃশিরা হইয়া বৃক্ষশাখায় লম্বমান রহিয়াছেন। গরুড় তদ্দর্শনে অতিমাত্র ভীত হইয়া মনে করিলেন, শাখা ভূতলে পতিত হইলে নিশ্চয়ই ঋষিদিগের প্রাণনাশ হইবে; অতত্রব গজ ও কচ্ছপকে নখ দ্বারা দৃঢ়রূপে ধারণ করিয়া ঋষিগণের প্রাণরক্ষার্থে ঐ অতি বিশাল বৃক্ষশাখা চঞ্চুপুট দ্বারা গ্রহণ করিলেন। মহর্ষিগণ গরুড়ের অলৌকিক কর্ম্ম দর্শনে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কারণ নির্দ্দেশপূর্ব্বক তাঁহার এই নাম রাখিলেন, “যেহেতু, এই বিহঙ্গম অতি গুরুভার গ্রহণ করিয়া অবিচলিতচিত্তে গগনমার্গে উড্ডীন হইল, অতএব অদ্যাবধি ইহার নাম গরুড় বলিয়া প্রসিদ্ধ হইবে।” অনন্তর গরুড় পক্ষ-পবন দ্বারা পার্শ্বস্থ সমস্ত পর্ব্বত বিচালিত করিয়া বায়ুবেগে গমন করিতে লাগিলেন।
গরুড় গজ-কচ্ছপ লইয়া বালখিল্য ঋষিগণের প্রাণরক্ষার্থে এইরূপে নানাদেশ ভ্রমণ করিলেন; কিন্তু কুত্রাপি উপবেশনের উপযুক্ত স্থান পাইলেন না। পরিশেষে গন্ধমাদন পর্ব্বতে উপনীত হইয়া স্বীয় পিতা মহর্ষি কশ্যপকে তপস্যায় অভিনিবিষ্ট দেখিলেন। ভগবান্ কশ্যপ সেই বলবীর্য্যতেজঃ সম্পন্ন, মন ও বায়ুসম বেগবান্, অচিন্তনীয়, অনভিভবনীয়, সর্ব্বভূতভয়ঙ্কর, প্রদীপ্ত অগ্নিশিখার ন্যায় সমুজ্জ্বল, অধৃষ্য, দুর্জ্জয়, সর্ব্বপর্ব্বতবিদারণক্ষম, সমুদ্রশোষণে সমর্থ, সর্ব্বলোকসংহারে পটু, কৃতান্তসম ভীমদর্শন, উত্তুঙ্গ [অতূ্যচ্চ] গিরিশৃঙ্গাকার, দিব্যরূপী, বিহঙ্গমরাজ গরুড়কে অভ্যাগত দেখিয়া এবং তাঁহার অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “হে পুৎত্র! তুমি সহসা সাহসের কর্ম্ম করিও না, তাহাতে অশেষবিধ ক্লেশ পাইবার সম্ভাবনা। সূর্য্যমরীচিমাত্রপায়ী [সূর্যকিরণমাত্রসেবী] বালখিল্যগণ রোষপরবশ হইলে তোমাকে এইদণ্ডে ভস্মসাৎ করিবেন।” এই কথা বলিয়া মহর্ষি কশ্যপ পুৎত্রবাৎসল্যপ্রযুক্ত মহাভাগ বালখিল্য ঋষিদিগকে প্রসন্ন করিতে লাগিলেন। হে মহর্ষিগণ! প্রজাদিগের হিতোদ্দেশে গরুড় এই মহৎ কর্ম্ম সাধন করিতে অধ্যবসায় করিয়াছে, তোমরা অনুজ্ঞা কর।” বালখিল্যগণ মহর্ষি কশ্যপের অভ্যর্থনায় সেই বৃক্ষশাখা পরিত্যাগপূর্ব্বক তপশ্চরণার্থ পর্ব্বতশ্রেষ্ঠ পবিত্র হিমালয়ে প্রস্থান করিলেন।
বালখিল্য গমন করিলে বিনতানন্দন নিজ পিতা কশ্যপকে নিবেদন করিলেন, “ভগবন্! আমি এখন এই বিশাল বৃক্ষশাখা কোথায় নিক্ষেপ করি, আমাকে কোন নির্ম্মানুষ দেশ নির্দ্দেশ করিয়া দিন।” তখন কশ্যপ মানুষশূন্য নিরবচ্ছিন্ন তুষাররাশিসমাকীর্ণ এক পর্ব্বত কহিয়া দিলেন। পক্ষিরাজ শাখা ও গজ-কচ্ছপ লইয়া বায়ুবেগে সেই পর্ব্বত অভিমুখে যাত্রা করিলেন। গরুড় যে শাখা লইয়া গমন করিলেন, উহা এমত স্থুল যে, শতগোচর্ম্মনির্ম্মিত রজ্জু দ্বারাও বন্ধন বা বেষ্টন করা যায় না। পতগেশ্বর গরুড় অনতিবিলম্বে শতসহস্র যোজনান্তরে স্থির সেই মহাপর্ব্বতে উপনীত হইয়া পিতার আদেশানুসারে তদুপরি প্রকাণ্ড বৃক্ষশাখা নিক্ষেপ করিলেন। তদীয় পক্ষপবনে আহত হইয়া গিরিরাজ কম্পিত হইল, তরুগণ পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিল এবং যে-সকল মণিকাঞ্চনময় শৈলশৃঙ্গ পর্ব্বতের শোভা সম্পাদন করিত, তাহারা বিশীর্ণ হইয়া ইতস্ততঃ পতিত হইতে লাগিল। বৃক্ষশ্রেণী পরস্পরের শাখাঘাতে অভিহত হইয়া সৌদামিনীমণ্ডিত নবীন নীরদের ন্যায় কাঞ্চনময় কুসুমসমূহে সুশোভিত হইল। গৈরিকরাগরঞ্জিত পাদপ-সকল অবিরল ভূতলে পতিত হইয়া অপূর্ব্ব শোভাধারণ করিল। তৎপরে গরুড় সেই গিরিশৃঙ্গে উপবিষ্ট হইয়া গজ-কচ্ছপ ভক্ষণ করিলেন। খগরাজ এইরূপে সেই কূর্ম্ম ও কুঞ্জরকে উপযোগ করিয়া তথা হইতে মহাবেগে উড্ডীন হইলেন।
অনন্তর দেবতাদিগের উপর অতি ভয়ঙ্কর উৎপাত আরম্ভ হইল। ইন্দ্রের বজ্র ভয়ে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। অন্তরীক্ষ হইতে ধূম ও অগ্নিশিখার সহিত উল্কাপাত হইতে লাগিল। বসু, রুদ্র, আদিত্য, সাধ্য, মরুৎ ও অন্যান্য দেবগণের অস্ত্র সকল পরস্পর বিক্রম প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। দেবাসুর-সংগ্রামেও এরূপ অভূতপূর্ব্ব দুর্ঘটনা কদাচ ঘটে নাই। বায়ু প্রবলবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল, শত সহস্র উল্কাপাত হইতে লাগিল এবং মেঘশূন্য নভোণ্ডল অতি গভীররবে গর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিল। অধিক কি বলিব, যিনি দেবাদিদেব [পর্জ্জন্যদেব] তিনিও অনবরত শোণিতবর্ষণ করিতে লাগিলেন। দেবতাদিগের গলদেশের মাল্য ম্লান ও তেজোরাশি ক্রমশঃ হ্রাস হইয়া গেল। প্রলয়কালীন অতিভীষণ মেঘের ন্যায় ঘনাবলী মুষলধারে রক্তবৃষ্টি করিতে লাগিল। ধূলিজাল গগনমার্গে উড্ডীন হইয়া দেবগণের মুকুটসকল প্রভাহীন করিল।
অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র ও সমস্ত দেবগণ এইরূপ অতি নিদারুণ উৎপাত দর্শনে ভীত ও বিস্মিত হইয়া বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবন্! যুদ্ধে আমাদিগকে আক্রমণ করে, এরূপ শত্রু ত’ লক্ষ্য হয় না। তবে কোথা হইতে এতাদৃশ ঘোরতর উৎপাত সহসা উপস্থিত হইল?” বৃহস্পতি কহিলেন, “হে দেবেন্দ্র! তোমারই অপরাধ ও প্রমাদবশতঃ মহাত্মা বালখিল্যগণের তপোবলে বিনতাগর্ভে মহর্ষি কশ্যপের পক্ষিরূপী এক পুৎত্র জন্মিয়াছে। সেই কামরূপী মহাবল বিনতানন্দন অমৃতহরণে সমর্থ। তাহাতে সকলই সম্ভব হয়। সে অনায়াসে অসাধ্য সাধন করিতে পারে।”
ইন্দ্র তদীয় বাক্য শ্রবণ করিয়া অমৃতরক্ষকদিগকে আদেশ করিলেন, “মহাবীর্য্য মহাবল এক পক্ষী অমৃতহরণে উদ্যত হইয়াছে, আমি তোমাদিগকে সতর্ক করিয়া দিতেছি, দেখিও, যেন সে বলপূর্ব্বক অমৃত হরণ করিতে না পারে। বৃহস্পতি কহিয়াছেন, সে অতুল-বলশালী” তাহা শুনিয়া দেবতারা বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া অতি সাবধানে অমৃত বেষ্টন করিয়া রহিলেন এবং ইন্দ্রও বজ্রহস্ত হইয়া তথায় অবস্থান করিলেন। বিচিত্র বসন-ভূষণে বিভূষিত, পাপস্পর্শরহিত, নিরুপম, বলবীর্য্যসম্পন্ন, অসুরপুরবিদারণে পটু সুরগণ; কাঞ্চনময়, বৈদূর্য্যমণিময় ও চর্ম্মাত্মক, মহামূল্য প্রভাভাস্বর [তেজধারা দীপ্ত], সুদৃঢ় কবচ; তীক্ষ্ণধার ভয়ঙ্কর বিবিধ অস্ত্র-শস্ত্র; ধূম অগ্নি ও স্ফুলিঙ্গ [অগ্নিকণা] সহিত চক্র; পরিঘ, ত্রিশূল, পরশু, বহুবিধ সুতীক্ষ্ণ শক্তি; নির্ম্মল করবাল [তরোয়াল] এবং উগ্রদর্শন গদা এই সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র লইয়া অমৃতরক্ষার্থে সেইস্থানে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তাঁহারা এইরূপে স্ব স্ব অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক যুদ্ধার্থে সুসজ্জিত হইয়া সূর্য্যকিরণ বিকাশিত বিগলিতান্ধকার আকাশমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইয়াছিলেন।