হোটেলটির নাম রত্নমঞ্জুষা। একেবারে নতুন। তেমন বড় নয়, দোতলা একতলা মিলিয়ে বারোটি ঘর। সামনে ও পিছনে অনেকখানি বাগান। সামনের বাগানে একটা ফোয়ারা রয়েছে, সন্ধের পর সেখানে অনেকরকম জলের ধারা বেরোয়। সব মিলিয়ে দেখতে বেশ সুন্দর।
কাকাবাবুর একটা মিটিং ছিল বহরমপুরে। সেখানে তাঁর জন্য সার্কিট হাউজের ঘর ঠিক করা ছিল। কিন্তু কাকাবাবু জানিয়ে দিলেন যে, তিনি বহরমপুরের বদলে মুর্শিদাবাদ শহরে থাকবেন। এখানে এলে পুরনো দিনের ইতিহাসের অনেক কথা মনে পড়ে। সন্তু আর জোজো আগে কখনও মুর্শিদাবাদে আসেনি। ওদেরও দেখা হবে অনেক কিছু।
জিয়াগঞ্জে একটা পুকুর খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গেছে তিনখানা অষ্টধাতুর মূর্তি। পুরনো আমলের দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু ঠিক কত পুরনো আর কীসের মূর্তি, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনজন ইতিহাসের পণ্ডিতকে ডাকা হয়েছে মূর্তিগুলো দেখাবার জন্য। এখানকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দ্রজিৎ দত্ত কাকাবাবুর খুব ভক্ত, তিনি কাকাবাবুকেও আনিয়েছেন। এইসব ব্যাপারে কাকাবাবুর মতামতের মূল্য আছে।
এই হোটেলে ঢোকার সময়েই জোজো জিজ্ঞেস করেছিল, মঞ্জুষা মানে কী রে সন্তু?
সন্তু বলল, তুই মঞ্জু মানে জানিস না? রত্ন মানে জানিস তো?
জোজো বলল, ভ্যাট, ইয়ারকি মারবি না। রত্ন মানে সবাই জানে। জুয়েল।
সন্তু বলল, যেমন তুই একখানা রত্ন! আর মঞ্জুষা মানে প্যাটরা।
জোজো বলল, প্যাটরা? সে আবার কী? কখনও শুনিনি!
সন্তু বলল, কখনও শুনিসনি? আলবাত শুনেছিস। লোকে বাক্স-প্যাটরা বলে না? অর্থাৎ রত্নটত্ন যেখানে রাখা হয়। সিন্দুকও বলতে পারিস।
জোজো বলল, হোটেলের নাম সিন্দুক? সর্বনাশ, ঘরগুলোতে আলোহাওয়া নেই?
কাকাবাবু বললেন, তা নয়। মানে হল, এই হোটেলে যারা থাকবে, তারা প্রত্যেকেই এক-একটা রত্ন। নামটা একটু অন্যরকম ঠিকই! মালিকের নাম জানিস? অয়স্কান্ত দাস। অয়স্কান্ত মানে জানিস?
সন্তু চুপ।
জোজো বলল, কী রে, বল! খুব তো তোর বাংলা নলেজ!
সন্তু বলল, এটা জানি না। না জানলে স্বীকার করতে লজ্জা নেই।
কাকাবাবু বললেন, অনেক শব্দ শুধু ডিকশিনারিতেই থাকে, এমনিতে চল নেই। অয়স্কান্ত মানে চুম্বক। ম্যাগনেট। অয় মানে হচ্ছে লোহা। লোহাকে যে টানে, সে অয়স্কান্ত।
জোজো বলল, কাকাবাবু, এবার আমি আপনার একটা ভুল ধরব? আপনি ডিকশিনারি বললেন কেন? উচ্চারণ তো ডিকশনারি?
কাকাবাবু বললেন, ঠিক ধরেছ তো! ছেলেবেলা থেকে আমার এই ভুলটা হয়। উচ্চারণটা আমি বাংলা করে নিয়েছি। সাহেবরা বলে ডিকশন আরি!
দোতলার ঘরের সামনে একটা গোল বারান্দা। সেখানে বেতের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছে সন্ধেবেলা। চায়ের সঙ্গে এরা দিয়েছে গরম গরম খাস্তা কচুরি।
সন্তু বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, হাজারদুয়ারি দেখলাম, বেশ ভাল লাগল। কিন্তু ওটা তো তেমন পুরনো নয়। সিরাজের আমলের কিছুই নেই?
কাকাবাবু বললেন, নদীর ওপারে আছে খোশবাগ। সেখানে আছে আলিবর্দি আর সিরাজের সমাধি। কাল সকালে যাব। ওখানে গেলেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। সিরাজকে যে কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর ভাবে মারা হয়েছিল, সেই কথা মনে পড়ে।… এখানে আরও পুরনো আছে কাটরা মসজিদ।
জোজো বলল, এই জায়গাটা একসময় বাংলার রাজধানী ছিল, এখন দেখলে যেন বিশ্বাসই করা যায় না। কেমন যেন মরামরা ভাব।
কাকাবাবু বললেন, শুধু রাজধানী নয়, একসময় এই মুর্শিদাবাদ শহর যে কী বিরাট আর কত জমাট ছিল, তা এখন দেখলে সত্যিই বিশ্বাস করা যায় না। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ শহর ছিল চব্বিশ মাইল লম্বা আর চোদ্দো মাইল চওড়া। আমাদের কলকাতার চেয়েও বড়। ইলেকট্রিক ছিল না। কিন্তু গঙ্গার দুপারে জ্বলত মশালের আলো। কত সব বড় বড় বাড়ি। লর্ড ক্লাইভ যখন প্রথম মুর্শিদাবাদ শহরে আসে, তখন এখানকার সব বড় বড় বাড়ি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, এ তো লন্ডন শহরেরই মতো। তবে লন্ডনের চেয়েও এখানে বড়লোকদের সংখ্যা বেশি। ভেবে দ্যাখ, তখন লন্ডন পৃথিবীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শহর। তার সঙ্গে বাংলার রাজধানীর তুলনা।
জোজো আবার জিজ্ঞেস করল, এত তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে গেল কী করে?
কাকাবাবু বললেন, মুর্শিদাবাদ কিন্তু খুব পুরনো শহর নয়। যেমন হঠাৎ গজিয়ে উঠেছিল, খুব তাড়াতাড়ি এখানকার চেহারা পালটে যায়। আবার হঠাৎই এখানকার গৌরবের দিন শেষ হয়ে যায়। তখন বেড়ে ওঠে কলকাতা শহর। অনেক ধনী লোক আর বড় বড় ব্যবসায়ীর চলে যায় কলকাতা শহরে। শেষ হয়ে গেল মুর্শিদাবাদের গৌরবের দিন। তার আগে তো কলকাতার প্রায় কিছুই ছিল না।
তখন শুধু ঘোড়ার গাড়ি চলত?
ঘোড়ার গাড়ি, পালকি। অনেক লোক হেঁটেই যাতায়াত করত। মনে করো, কেউ এখান থেকে ঢাকায় যাবে। আটদিন-দশদিন ধরে হাঁটত। এখনও এখানে কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে যায়। তুই দেখিসনি সন্তু?
হ্যাঁ, দেখেছি।
এখনও তো বোধহয় একজন কেউ ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছে, এখান দিয়ে ওই যে খটাখট শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এর মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। সামনের রাস্তায় একটা ঘোড়া ছুটে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল ঠিকই, কিন্তু কিছু দেখা গেল না।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, সেকালের নবাব পরিবারের বংশধররা কি এখনও মুর্শিদাবাদে থাকে?
কাকাবাবু বললেন, না বোধহয়। তারা কে কোথায় সব হারিয়ে গেছে। এখন আর তাদের কেউ খোঁজও রাখে না।
জোজো জিজ্ঞেস করল, নবাব সিরাজদ্দৌল্লার কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না?
সন্তু বলল, যাঃ, সিরাজকে তো খুন করা হয়েছিল মাত্র একুশ না বাইশ বছর বয়সে। ওইটুকু বয়সে কারও ছেলেমেয়ে হয়?
কাকাবাবু হেসে বললেন, সেই সময় ছেলেদের আর মেয়েদের বিয়ে হত খুব কম বয়সে। সিরাজ তো ছিল আলিবর্দির আদুরে নাতি, অল্প বয়স থেকেই নানারকম পাকামি করতে শেখে। তাই তাড়াতাড়ি তার বিয়ে দেওয়া হয়। একটা নয়, সিরাজের দু-তিনটে বউ ছিল। সবচেয়ে প্রিয় বেগম ছিল লুতফুন্নেসা। তার একটা মেয়েও জন্মেছিল।
জোজো বলল, সেই মেয়েটা কোথায় গেল? তাকেও মেরে ফেলেছিল?
কাকাবাবু বললেন, সবটা শুনতে চাও?
জোজো বলল, ইয়েস।
সন্তু বলল, আমাদের ইতিহাস বইয়ে তো একটুখানি লিখেছে মোটে। সিরাজের যে মেয়ে ছিল, তা জানতুমই না।
কাকাবাবু বললেন, তেরো-চোদ্দো বছর বয়সেই সিরাজ বেশ বখাটে হয়ে গিয়েছিল। কারও কথা শুনত না। যা খুশি তাই করত, অনেক খারাপ কাজও করেছে। সেই জন্য অনেকে তাকে পছন্দ করত না। আলিবর্দি অন্যদের বদলে এই বাচ্চা নাতিটাকেই যখন বাংলার সিংহাসনে বসাতে চাইলেন, তা-ও অনেকের পছন্দ হয়নি। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে সিরাজ হল নবাব। তখন কিন্তু তার স্বভাব অনেকটা বদলে গেল, বাংলার উন্নতির জন্য দায়িত্ব নিয়ে রাজ্য শাসন করার চেষ্টা করল। ইংরেজরা নানা বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল, তাদেরও ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বেচারি তো বেশি সময়ই পেল না, নানা ষড়ষন্ত্রে রাজ্য হারাতে হল।
জোজো জিজ্ঞেস করল, কতদিন তিনি নবাব ছিলেন?
কাকাবাবু বললেন, প্রায় পনেরো মাস।
সন্তু বলল, আচ্ছা কাকাবাবু, অত দূর ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে চেপে এসে ইংরেজরা আমাদের দেশটা দখল করে নিল। আমাদের দেশের মানুষ কি যুদ্ধ করতে জানত না?
কাকাবাবু বললেন, জানবে না কেন? পলাশির যুদ্ধে সেনাপতি মিরজাফর যদি তার সৈন্যদের নিয়ে একপাশে পুতুলের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে না থাকত, তা হলে ইংরেজরা হেরে ভূত হয়ে যেত! দলাদলি আর বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই আমাদের অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যায়!
সন্তু বলল, ইস, মিরজাফর যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করত, তা হলে সিরাজকে প্রাণ দিতে হত না!
কাকাবাবু বললেন, মিরজাফর একা কেন, জগৎশেঠরাও সমানভাবে দোষী। এই জগৎশেঠরা ছিল দারুণ ক্ষমতাবান, বলতে গেলে রাজ্যের সব টাকাপয়সা কন্ট্রোল করত তারাই। টাকাপয়সাই তো আসল ক্ষমতা। জগৎশেঠ সিরাজকে একেবারে পছন্দ করত না, সে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে চেয়েছিল সিরাজকে সরিয়ে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসাতে। মিরজাফরও সেই লোভে রাজি হয়ে গিয়েছিল।
জোজো জিজ্ঞেস করল, সিরাজের মেয়ের নাম কী? তার কী হল?
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও, বলছি বলছি! সিরাজ তো মুর্শিদাবাদ থেকে। পালাতে বাধ্য হল, তখন ভয়ে তার সঙ্গে আর কেউ যেতে চায়নি। শুধু বেগম লুতফা বলল, সে যাবেই যাবে, স্বামীকে ছাড়বে না। তাতে তার যা হয় হোক। এই লুতফা মেয়েটি ছিল খুবই ভাল। তার আসল নাম ছিল রাজ কানোয়ার। হিন্দু পরিবারে জন্ম। বাচ্চা বয়েসে কেউ তাকে লুঠ করে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাসী বানিয়ে ফেলে। ক্রীতদাসী হিসেবেই সে সিরাজের মায়ের কাছে আসে সেবা করতে। তখন তার নাম হয় লুতফুন্নেসা বা লুতফা।
জোজো বলল, আগেকার দিনের লোকেরা কী খারাপ ছিল! তারা গোরু-ছাগলের মতো মানুষও বিক্রি করত?
কাকাবাবু বললেন, হু। এখনও খারাপ লোক কম নেই। এখনও… যাই হোক। সেই লুতফাকে দেখতে ছিল অসাধারণ সুন্দরী, আর স্বভাবটাও খুব মধুর। তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়ে সিরাজ তাকে নিজের বেগম করে নিল। সিরাজের সৌভাগ্যের দিনে সে যেমন ছিল পাটরানি, দুর্ভাগ্যের দিনেও স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল, কোলে তার শিশুকন্যা। কিছু দূর যাওয়ার পর বাচ্চা মেয়েটার তো খিদে পাবেই। বড়রা খিদে সহ্য করে অনেকক্ষণ থাকতে পারে। কিন্তু বাচ্চারা পারবে কেন? বাচ্চাটা কাঁদতে লাগল। অথচ কোনও জায়গায় থামলেই বিপদ। কিন্তু বাচ্চার কান্না থামাতে না পারলে কোন মাবাবা চুপ করে থাকতে পারে। নৌকো করে যেতে যেতে এক জায়গায় দেখা গেল এক ফকিরের কুটির। সিরাজ ভাবল, ফকির মানুষ, নিশ্চয়ই দয়ালু হবে। তার নাম দানশাহ ফকির। ছদ্মবেশী বাংলার নবাব তার কাছে মেয়ের জন্য একটু দুধ আর খাবারটাবার ভিক্ষে চাইল। ফকির ঠিক চিনতে পারল নবাবকে। সে চুপিচুপি খবর দিয়ে দিল মিরজাফরের জামাই মিরকাশিমকে। তার সৈন্যরা এদের সবাইকে বন্দি করে নিয়ে গেল মুর্শিদাবাদে!
জোজো জিজ্ঞেস করল, ওই ফকির নবাবকে ধরিয়েছিল কেন? তারও টাকার লোভ ছিল?
কাকাবাবু বললেন, কী জানি! নানারকম গল্প শোনা যায় বটে, সেসব থাক, সৈন্যরা ওদের বন্দি করে নিয়ে এল মুর্শিদাবাদে। তারপর তো মহম্মদি বেগ ছুরি বসাল সিরাজের বুকে। শুধু তো একবার ছুরি বসায়নি, তলোয়ার দিয়েও কুপিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিল সিরাজের শরীর। সে শরীরটা একটা হাতির পিঠে শুইয়ে ঘোরানো হল সারা মুর্শিদাবাদ শহর। একসময় সেই ছিন্নভিন্ন শরীর নামিয়ে দেওয়া হল আমিনা বেগমের বাড়ির সামনে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আমিনা বেগম কি সিরাজের মা?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। লোকগুলো কী নিষ্ঠুর। মায়ের কাছে কেউ ছেলের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখাতে আনে? আমিনা বেগম আলুথালুভাবে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই মৃতদেহের উপর। মিরনের চেলারা আমিনা বেগমকে টেনে-হিচড়ে সরিয়ে দিল সেখান থেকে। তারপর সিরাজের মৃতদেহ আবার তুলে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল মুর্শিদাবাদের প্রধান বাজারের কাছে। দেহটাকে সমাধি দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা হল না, ভয়ে কেউ ধারেকাছেও এল না। অনেকক্ষণ এইভাবে পড়ে থাকার পর একজন বুড়ো লোক সাহস করে এসে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের মৃতদেহ সমাধি দিতে নিয়ে গেল নদীর ওপারে খোশবাগে।
সন্তু বলল, সিরাজের বেগম আর তার মেয়ের কী হল?
কাকাবাবু বললেন, মিরনের ইচ্ছে ছিল সবাইকেই মেরে ফেলার। কিন্তু ততদিনে তো ইংরেজরা এসে পড়ে অনেক কিছু দেখাশোনা করছে। ইংরেজদের আর যত দোষই থাক, ওইভাবে মেয়েদের খুন করা পছন্দ করে না। সম্ভবত তাদের নির্দেশেই সিরাজের মা, সিরাজের মাসি ঘষেটি বেগম, সিরাজের দিদিমা আর লুতফা ও শিশুকন্যাটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকায়। মিরন ঢাকার শাসনকর্তাকে চুপিচুপি নির্দেশ পাঠাল, ওখানে সবাইকে খতম করে দিতে হবে। ঢাকার শাসনকর্তা লোকটি খারাপ ছিল না, সে জানিয়ে দিল, আমি এরকম পাপ কাজ করতে পারব না। তখন মিরন নিজের এক
চেলাকে পাঠাল ঢাকায়। সেই লোকটা কে বল তো?
জোজো বলল, আহম্মদি বেগ।
সন্তু বলল, আবার আহম্মদি বলছিস? মহম্মদি বেগ!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক ওকে পাঠানো হয়েছিল কিনা সেকথা ইতিহাসে লেখা নেই। তবে আমরা ধরে নিচ্ছি, মহম্মদি বেগই হবে। মহম্মদি বেগ কাজ সারতে চাইল সকলের চোখের আড়ালে। ঢাকার পাশেই যে-নদী, তার নাম বুড়িগঙ্গা। একদিন আমিনা বেগম আর ঘষেটি বেগমকে এক নৌকোয় চাপিয়ে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে গেল সেই নদীতে। মাঝখানে এসে দুই মহিলাকেই জোর করে ঠেলে ফেলে দিল জলে। সাঁতার জানতেন না, অসহায়ভাবে দুজনে ড়ুবে মরলেন। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় খুব শোরগোল পড়ে গেল ঢাকায়। মহম্মদি বেগ আর বাকিদের খুন করার সুযোগ পেল না, পালিয়ে এল মুর্শিদাবাদে। সিরাজের দিদিমা, লুতফা আর তার মেয়ে সাত বছর বন্দি হয়ে রইল ঢাকায়।
জোজো বলল, মিরন লোকটা মেয়েদেরও খুন করতে চেয়েছিল কেন?
কাকাবাবু বললেন, ও চেয়েছিল, সিরাজকে একেবারে নির্বংশ করে দেবে। ওই ফ্যামিলিতে আর কেউ বেঁচে থাকবে না। যাতে আর কেউ কখনও বাংলার সিংহাসনের দাবি করতে না পারে। ও তো ধরেই নিয়েছিল, বৃদ্ধ মিরজাফরের পর ও-ই নবাব হবে। তা হতে পারেনি অবশ্য। শোনা যায়, আমিনা বেগম অভিশাপ দিয়েছিলেন বলে মিরন বজ্রাঘাতে মারা যায়। আর মিরজাফর সিরাজের সামনে কোরান ছুঁয়ে মিথ্যে কথা বলেছিল, সেই পাপে তার হাতে কুষ্ঠ রোগ হয়। এসব অনেক পরে বানানো গল্প। খুব সম্ভবত সত্যি নয়। একালে অভিশাপ টভিশাপ ফলে না। তা হলে তো কত লোককেই ওইভাবে শাস্তি দেওয়া যেত। পাপ করলেও কুষ্ঠ রোগ হয় না, কত পাপী চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি কিন্তু এখনও সিরাজের মেয়ের নাম বলোনি।
কাকাবাবু বললেন, পরপর সব আসতে হবে তো। ঢাকায় বুড়ি দিদিমা আর ছোট মেয়েকে নিয়ে সাত বছর বন্দিনী হয়ে রইল লুতফা। তারপর যখন মিরজাফর, মিরন টিরন সকলে মারা গেছে, তখন ক্লাইভেরই দয়ায় তাদের আবার ফিরিয়ে আনা হল ঢাকায়। মেয়ের তখন প্রায় দশ বছর বয়স, তার নাম উম্মত জহুরা। সিরাজদ্দৌল্লার বিপুল ধনসম্পত্তি ছিল, সবই তো লুটপাট হয়ে গেছে। ওদের খাওয়াপরার খরচ আসবে কোথা থেকে? ইংরেজ কোম্পানি তখন লুতফাকে একটা চাকরি দেয়। খোশবাগে যে আলিবর্দি ও সিরাজের সমাধিস্থান, সেই জায়গাটা দেখাশোনার কাজ। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লুতফা ওই কাজ করে গেছে। প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা সে স্বামীর সমাধির পাশে একটা দীপ জ্বেলে দিত। এই কাজের জন্য তার মাইনে ছিল তিনশো পাঁচ টাকা। আর মেয়ের জন্য মাসোহারা একশো টাকা। অল্প বয়সেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয় লুতফা। কিন্তু সিরাজের মেয়ের ভাগ্যটাই খারাপ। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই মারা যায় তার স্বামী। এর মধ্যে উম্মত জহুরার পরপর চারটি মেয়ে জন্মে গিয়েছে। তাদের নামও শুনতে চাস?
সন্তু বলল, হ্যাঁ।
কাকাবাবু বললেন, শরফুন্নেসা, আসমতুন্নেসা, সাকিনা আর আমাতুলসার্দি। এই চারটে ছোট ছোট মেয়ের ভার মায়ের উপর চাপিয়ে উম্মত জহুরাও একদিন চোখ বুজল। সেই মেয়েরা একটু বড় হতে না-হতেই লুতফা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিল। দুজনের বিয়ে হয়েও গেল। তৃতীয় মেয়ে সাকিনার বিয়ের সময় টাকাপয়সায় আর কুলোয় না। তখন লুতফা আবার কোম্পানির কাছে। সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখল। সে চিঠির কোনও উত্তর আসেনি।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, সাকিনার বিয়ে হল না?
কাকাবাবু বললেন, বিয়ে হয়েছিল হয়তো কোনওরকমে। আমি আর কিছু জানি না। কোনও বইয়ে আর ওদের কথা লেখেনি। সিরাজের বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। চল, এবারে আমরা একটু গঙ্গার ধার থেকে ঘুরে আসি। অনেক ইতিহাসের কথা হয়েছে। এখন একটু টাটকা হাওয়া খাওয়া দরকার।
জোজো বলল, আজ হোটেলে পেঁয়াজকলি দিয়ে মাংস রান্না হবে বলেছে। খিদে বাড়াতে হবে।
সন্তু বলল, তুই বুঝি রান্নাঘরে গিয়ে খবর নিয়ে এসেছিস? কখন গেলি রে?
জোজো বলল, রান্নাঘরে যেতে হবে কেন? নোটিশ বোর্ডে লিখে দিয়েছে আজকের মেনু, শুধু পেঁয়াজকলি দিয়ে কষা মাংস আর ভাপা ইলিশ।
আমি দুটোই খাব!
হোটেলের বাইরে সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে আছে।
কাকাবাবু বললেন, চল, হেঁটেই যাই। গঙ্গা তো বেশি দূর নয়।
কাকাবাবু ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারেন না। তবু তিনি হাঁটার অভ্যেসটা রেখে দিয়েছেন। যদি বেশি সিঁড়িটিড়ি না থাকে কিংবা পাহাড়ি জায়গা না হয়, তা হলে তিনি অনায়াসে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে পারেন।
এখানে গঙ্গার ধারে টানা রাস্তা নেই। তবে মাঝেমাঝে কিছু বেড়াবার জায়গা আছে। মোটামুটি একটা ফাঁকা জায়গা দেখে কাকাবাবু দাঁড়ালেন। নদীর দিকটা রেলিং দেওয়া, কয়েকটা বসবার বেঞ্চও আছে।
জোজো একঠোঙা চিনেবাদাম কিনে নিয়ে এল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এই যে বললি খিদে বাড়াবি? বাদাম খেলে পেট ভরে যাবে না?
জোজো বলল, বাদামে পেট ভরে না। আগেকার দিনে রাজা-মহারাজারা দুপুরে খেতে বসার আগে পেস্তাবাদামের শরবত খেতেন। একবার উদয়পুরের মহারাজা আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন, দুপুরবেলা খাবার টেবিলে গিয়ে বসতেই প্রথমে মস্ত বড় একটা শ্বেতপাথরের গেলাস ভরতি কী একটা শরবত এনে দিল। টেবিলটা জানিস তো, সোনার, আর থালা-বাটিটাটি সব রুপোর, শুধু গেলাসগুলো পাথরের। আমি ভাবছি, টেবিলে কত ভাল ভাল খাবার সাজানো রয়েছে, শুধু শুধু শরবত খেতে যাব কেন? তখন মহারাজ বললেন, খাও খাও, জোজোমাস্টার, এ শরবত খেলে পেটে আগুন জ্বলবে।
সত্যিই তাই রে, যেই শরবতটা শেষ করলাম, অমনিই পেটের মধ্যে দাউদাউ করে খিদের আগুন জ্বলে উঠল, বুঝলি!
সন্তু বলল, কী করে বুঝব। আমাদের তো কখনও রাজা-মহারাজাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন জুটবে না!
কপকপ শব্দ শুনে সকলে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। একজন কেউ ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। ঘোড়াটার রং সাদা, যে চালাচ্ছে সেও সাদা পোশাক পরে আছে। হাতে তার একটা ছপটি।
লোকজন সরে গেল, ঘোড়াটা ছুটে গেল তিরের বেগে।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বেশ দেখতে লাগল। এইরকম একটা ঐতিহাসিক শহরে ঘোড়াই ভাল মানায়।
সন্তু বলল, আমি ঘোড়ায় চড়াটা ভাল করে শিখব। একটু একটু জানি!
জোজো বলল, আমি বাবা ওসবের মধ্যে নেই। আমার ঘোড়ার চেয়ে মোটরসাইকেল বেশি ভাল লাগে।
আজ আকাশে বেশ জ্যোৎস্না আছে। হাওয়া দিচ্ছে ফিনফিনে। নদীর বুকে একটা নৌকোয় ক্যাসেট প্লেয়ারে সিনেমার গান বাজছে।
কাকাবাবু হেসে বললেন, আগে নৌকোর মাঝিরা নিজেরাই গান গাইত। এখন ক্যাসেট বাজে।
জোজো বলল, আগে ক্যাসেট কিংবা রেকর্ড ছিল না। তাই মাঝিরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আজেবাজে গান গাইত।
সন্তু বলল, আজেবাজে গান? তুই ভাটিয়ালি শুনিসনি?
জোজো বলল, আমার ওসব গান ভাল লাগে না। আমি শুধু মডার্ন গান শুনি!
সন্তু বলল, তুই আসলে গান কিছুই বুঝিস না।
জোজো বলল, তুই একটা মডার্ন গান শুনবি? লেটেস্ট। পা পোঁ পোঁ পা পা—
ওদের দুজনের এরকম খুনসুটির সময় কাকাবাবু মজা পেয়ে হাসতে থাকেন।
একটা টাকমাথা লোক কাকাবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হাতে একটা সিগারেট।
সে বলল, আপনার কাছে দেশলাই আছে স্যার!
কাকাবাবু বললেন, না, দুঃখিত। আমি বিড়ি-সিগারেট খাই না! লোকটি কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু চমকে উঠে বলল, ও আপনি, সরি, সরি স্যার!
সে সরে গেল সামনে থেকে। পকেট থেকে বার করল একটা মোবাইল ফোন।
সন্তু বলল, তোমায় চিনতে পেরেছে।
কাকাবাবু বললেন, সেই তো মুশকিল। এবার ভাবছি দাড়ি রাখব।
জোজো বলল, দাড়িতে আরও বেশি চেনা যায়! বরং গোঁফটা কেটে ফেলুন?
কাকাবাবু বললেন, গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা! নাঃ, গোঁফ কামাচ্ছি না। কোনও কিছু চিন্তা করার সময় গোঁফে হাত বুলোলে বেশ সুবিধে হয়!
একটু পরে কাকাবাবু বললেন, চল, এবার ফেরা যাক। একটু শীতশীত লাগছে।
সন্তু বলল, আর-একটু থাকি।
জোজো বলল, না, না চল। এতক্ষণে মাংস রান্না হয়ে গেছে।
আবার শোনা গেল ঘোড়ার খুরের কপকপ শব্দ।
সন্তু বলল, আর-একটা ঘোড়া!
খানিকটা কাছে আসার পর দেখা গেল, এটা সেই আগের ঘোড়াটাই, সাদা রঙের, তার সওয়ারেরও সাদা পোশাক।
লোকজন সরে যেতেই ঘোড়াটা হঠাৎ কাকাবাবুদের দিকে মুখ ফেরাল।
প্রথমে মনে হল, সওয়ারটি বুঝি কাকাবাবুর সঙ্গে কথা বলতে আসছে। কিন্তু ঘোড়াটার গতি কমল না। এগিয়ে আসছে খুব জোরে। কাকাবাবু বলে উঠলেন, আরে!
ঘোড়াটা হুড়মুড়িয়ে এসে গায়ে পড়বে! কাকাবাবুদের সরে যাওয়ার উপায় নেই, পিছনে রেলিং। অনেক লোক চেঁচিয়ে উঠল ভয়ে।
ঘোড়াটা একেবারে কাছে চলে এসেছে। কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, জোজো, সন্তু, শুয়ে পড়, শুয়ে পড়!
সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভার বের করে ফায়ার করলেন দুবার!
সেই আওয়াজে ঘোড়াটা থমকে গিয়ে, সামনের দুপা উপরে তুলে চি-হি- হি-হি করে ডেকে উঠল।
আচমকা থেমে যাওয়ায় ঘোড়ার আরোহীও তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে।
বহু লোক ছুটে এল এদিকে। অনেকেরই ধারণা হল, কাকাবাবু বুঝি গুলি করেছেন ঘোড়াটাকে। তা কিন্তু নয়, কাকাবাবু গুলি করেছেন শূন্যে। তবে এখনও রিভলভারটা তাক করে রেখেছেন মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকটির দিকে।
লোকটির বোধহয় বেশ লেগেছে, উঠে দাঁড়াতে পারছে না।
ভিড়ের মধ্য থেকে একজন লোক ছুটে এসে সেই লোকটিকে তুলে ধরতে ধরতে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনার কোথায় লেগেছে? বেশি লাগেনি তো?
লোকটি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে সকলেরই চমক লাগে। এমন সুন্দর চেহারার মানুষ খুব কম দ্যাখা যায়। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স, নিখুঁত শরীরের গড়ন, দুধের মতো ফরসা রং, টানাটানা চোখ। কথায় বলে, ঠিক যেন রাজপুত্র। কিন্তু আজকাল তো রাজপুত্রটুত্র নেই, সিনেমার নায়কদের এরকম চেহারা হয়। ঠিক যেন ফিল্ম স্টার। সে পরে আছে সিল্কের কুর্তা শেরওয়ানি।
অন্য লোকটি তার পোশাকের ধুলো ঝেড়ে দিতে দিতে বলল, লাগেনি তো! আপনার লাগেনি তো?
যুবকটির মুখে কেমন যেন গর্বিত ভাব। সে গম্ভীরভাবে বলল, না, লাগেনি। ঠিক আছে।
সে কাকাবাবুর কাছে ক্ষমা চাইল না।
কাকাবাবুই জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, ঘোড়াটাকে সামলাতে পারেননি?
সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, ঘোড়াটা হঠাৎ খেপে গিয়েছিল।
ঘোড়াটা এখন চুপ করে দাঁড়িয়ে ফ-র-র ফ-র-র করে নিশ্বাস ফেলছে। জোরে জোরে।
কাকাবাবু এগিয়ে গিয়ে ঘোড়াটার গলায় আদরের চাপড় মারলেন। তিনি কুকুর আর ঘোড়া খুব ভালবাসেন। এইসব জন্তুও তো বুঝতে পারে, তার ছোঁয়া পেলে এরা খুশি হয়। ঘোড়াটি দুবার মাথা নাড়ল।
কাকাবাবু বললেন, এই তো ও বেশ শান্ত হয়ে গিয়েছে। চমৎকার ঘোড়াটি!
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল একজন পুলিশ। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে গুলি চালাল কে?
কাকাবাবু বললেন, আমি।
পুলিশটি কাকাবাবুর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বলল, আপনার হাতে রিভলভার? দিন, ওটা আমাকে দিন।
কাকাবাবু বললেন, না। আপনাকে কেন দেব?
পুলিশটি এবার কড়া গলায় বলল, দেবেন না মানে? ওরকম অস্ত্র সঙ্গে রাখা বেআইনি, তা জানেন না?
কাকাবাবু বললেন, লাইসেন্স থাকলে মোটেই বেআইনি নয়। আমার লাইসেন্স আছে। আত্মরক্ষার জন্য আমি সবসময় এটা সঙ্গে রাখি।
পুলিশটি বলল, আপনি শুধু শুধু গুলি ছুড়েছেন, কার গায়ে লেগেছে?
কাকাবাবু বললেন, শুধু শুধু গুলি ছুড়িনি। অবশ্য কারও গায়েও লাগেনি।
পুলিশটি বলল, তবু আপনাকে একবার থানায় যেতে হবে।
জোজো ফস করে বলে উঠতে গেল, এখানকার ডিস্ট্রিক্ট…
সন্তু তাড়াতাড়ি তার মুখ চাপা দিল। পুলিশের বড়কর্তা আমার বন্ধু, কিংবা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আমার ভক্ত, এই ধরনের কথা লোকজনের সামনে বলা কাকাবাবু একেবারেই পছন্দ করেন না।
কাকাবাবু হাসিমুখে বললেন, না, আমি এখন থানায় যাব না। হোটেলে ভাল ভাল রান্না হয়েছে। আমাদের খিদেও পেয়েছে। আমাদের হোটেলের নাম রত্নমঞ্জুষা। সেখানে আমার খোঁজ করবেন। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। আমি এখানে টুরিস্ট হিসেবে এসেছি।
সিনেমা স্টারের মতো যুবকটি এর মধ্যে ঘোড়ায় চেপে বসেছে। ঘোড়াটা চলতে শুরু করল উলটো দিকে। ভিড় ফাঁক হয়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, চল সন্তু, আমরা হোটেলে ফিরি।
পুলিশটি ভ্যাবাচ্যাকার মতো দাঁড়িয়ে রইল।
খানিকটা যাওয়ার পর জোজো জিজ্ঞেস করল, ওই লোকটা ঘোড়া চালিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসছিল কেন? গুলির আওয়াজ না শুনলে ঘোড়াটা আপনার গায়ের উপর এসে পড়ত ঠিক।
কাকাবাবু বললেন, হয়তো ইচ্ছে করে তেড়ে আসেনি। সামলাতে পারেনি বোধহয়। এমনও হতে পারে, নতুন ঘোড়া চালানো শিখছে।
জোজো বলল, একই দিনে দুবার অ্যাক্সিডেন্ট? হাজারদুয়ারির সামনে সেই লোকটা গায়ের উপর এসে পড়ল।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, একই দিনে দুবার। একটু আশ্চর্য ব্যাপারই বটে!
সন্তু বলল, ভিড়ের মধ্য থেকে যে-লোকটা এসে ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়া সিনেমার হিরোকে মাটি থেকে তুলল, তাকে আমি চিনতে পেরেছি। সে-ই একটু আগে কাকাবাবুর কাছে দেশলাই চাইতে এসে বলেছিল, ও, আপনি!
জোজো বলল, ঠিক তো! সেই টাকমাথা লোকটা। কাকাবাবুকে চেনে। সিনেমার হিরোর সঙ্গেও ওর আগে থেকে পরিচয় আছে।
সন্তু বলল, সত্যিই এখানে কোনও সিনেমার শুটিং হচ্ছে নাকি? ক্যামেরা তো দেখলাম না!
কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। তবে আমরা তো এখানে কোনও রহস্যের তদন্ত করতে আসিনি। বহরমপুরে আসার কাজটাও মিটে গেছে। এখন শুধু বেড়ানো। এখানে তো কারও সঙ্গে আমাদের শত্রুতা থাকার কথা নয়। এই সুন্দরমতো ছেলেটাকে আমি জীবনে আগে কখনও দেখিনি। ও শুধু শুধু আমার গায়ের উপর ঘোড়া চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে কেন?
জোজো বলল, ছেলেটাকে দেখতে সুন্দর হলেও বেশ অভদ্র! ওরকম একটা অ্যাক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার জন্য ক্ষমাটমাও চাইল না।
কাকাবাবু বললেন, হয়তো খুব লজ্জা পেয়েছে। তা ছাড়া লোকের সামনে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে মানসম্মান থাকে না। তাই মুখ দিয়ে কথা বেরোয়নি। আর সত্যিকারের ফিল্ম স্টার যদি হয়, তারা তো বাইরের লোকের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না।
জোজো বলল, অমিতাভ বচ্চন আর শাহরুখ খান, এদের চেয়ে বেশি নামকরা ফিল্ম স্টার তো এখন আর কেউ নেই। এরা দুজনেই দেখা করতে এসেছিল আমার বাবার সঙ্গে। কয়েকটা মন্ত্রপড়া ফুল নেওয়ার জন্য। পুরো একবেলা কাটিয়ে গেল আমাদের বাড়িতে। অমিতাভ বচ্চন তোদিব্যি বাংলা বলতে পারে। একসময় কলকাতায় চাকরি করত তো। আমার দিদির ছোট ছেলেটার সঙ্গে লুডো খেলল আর খুব মজা করতে লাগল। আর শাহরুখ খান নারকোল কোরা দিয়ে চিড়েভাজা খেয়ে এত খুশি যে, তিন বাটি খেয়ে ফেলল!
সন্তু বলল, আবার ঘোড়ার আওয়াজ! শোনো শোনো!
খটাখট শব্দটা আসছে পিছন দিক থেকে। একসময় দেখা গেল, সেই সাদা ঘোড়া ও তার আরোহীকে।
জোজো বলল, চলুন, চলুন, আমরা একটা বাড়ির বারান্দায় উঠে পড়ি।
কাকাবাবু বললেন, তার দরকার হবে না। এবারে ঘোড়াটা আমাকে দেখতে পেলে কাছাকাছি এসে নিজেই থেমে যাবে!