স্কুল বাস থেকে নেমে তিষা আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে ধূসর এক ধরণের মেঘ, এটা মেঘ না কুয়াশা ভালো করে বোঝা যায় না। মাঝে মাঝে যখন ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয় তখন বোঝা যায় যে এটা কুয়াশা না, এটা মেঘ। তিষার হঠাৎ করে দেশের কথা মনে পড়ল। আকাশ কালো করে কুচকুচে মেঘে হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে যেতো, বিজলীর ঝলকে সবকিছু কেমন যেন ঝলসে ঝলসে উঠতো, সাথে সাথে কী গম্ভীর গুড় গুড় করে মেঘের ডাক। তারপর বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মনে হতো সারা পৃথিবী বুঝি ভাসিয়ে নেবে। সেই বৃষ্টিতে ভিজতে কী মজা–সবাই মিলে তারা বাইরে নেমে যেতো! আর এখানে সবকিছু অন্যরকম। ধোয়ার মত এক ধরনের বৃষ্টি, ঠাণ্ডা, প্যাঁচপ্যাঁচে মন খারাপ করা বৃষ্টি।
তিষা স্কুল বাসের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হল। এখানে সব কিছু কেমন ছিমছাম, সবকিছু কী চমৎকার নিয়ম দিয়ে বাধা। এই যে সে রাস্তা পার হচ্ছে তার জন্যে রাস্তার দুই পাশে সব গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। স্কুল বাসটা যতোক্ষণ তার বাতি জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণ কোনো গাড়ী চলতে পারবে না, স্কুলের ছেলেমেয়েরা যেন ঠিকমত রাস্তা পার হতে পারে। তিষার ছোট চাচা দেশে গাড়ী একসিডেন্টে মারা গিয়েছিলেন। ছোট চাচা রাস্তা পার পর্যন্ত হচ্ছিলেন না, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন একটা গাড়ী আরেকটা গাড়ীকে ওভারটেক করে যাবার সময় তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। সেই গাড়ীটাকে কোনোদিন ধরা পর্যন্ত যায়নি।
তিষা রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে তাদের এলাকায় ঢুকে গেল। কী সুন্দর ছিমছাম শান্ত পরিবেশ। সামনে সবুজ লন, ছবির মতো একেকটি বাসা, পিছন থেকে ঝাউগাছ উঁকি দিচ্ছে। যেদিন রোদ ঝলমল সুন্দর একটি দিন হয় সেদিন সবকিছুকে রঙিন মনে হয়। মনটা ভালো থাকে তাই মনে হয়, সবকিছুকে মনে হয় আরো বেশী রঙিন দেখায়। আজ আকাশে মন খারাপ করা মেঘ, তাই চারপাশে একটা বিষণভাব।
তিষা হেঁটে হেঁটে তাদের বাসার দিকে যেতে থাকে, কোথাও কোনো মানুষ নেই। প্রথম যখন এদেশে এসেছিল তার মনে হতো মানুষজন সব গেল কোথায়? তার অনেকদিন লেগেছে বুঝতে যে এদেশে মানুষজনই কম। যে এলাকা যত বড়লোকদের সেখানে মানুষ তত কম। তিষার বন্ধুরা বলেছে। নিউইয়র্ক শহরে নাকী অনেক মানুষ। তিষার আব্বু বলেছেন এর পরের বার। ছুটিতে নিউইয়র্কে বেড়াতে যাবেন। নিউইয়র্ক শহর নাকি খুব মজার। একটা শহর কীভাবে মজার হয় তিষা অবশ্যি বুঝতে পারে না। একটা মানুষ মজার হতে পারে, তাই বলে আস্ত একটা শহর?
বাসার সামনে এসে তিষা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। সামনে কোনো গাড়ী নেই, যার অর্থ তার আব্বু কিংবা আম্মু কেউ আসেননি। আব্বু অবশ্যি কখনোই আগে চলে আসেন না। আম্মু মাঝে মাঝে চলে আসেন। তখন তাকে আর খালি বাসায় ঢুকতে হয় না। খালি বাসায় ঢোকার মাঝে কেমন জানি খুব একটা মন খারাপের বিষয় আছে। দুই বছর আগে তারা যখন প্রথম এই দেশে এসেছিল তখন দেশের অনেক কিছুর জন্যে মন খা খা করতো। আস্তে আস্তে সবকিছুতে অভ্যাস হয়ে গেছে, শুধু এই একটা বিষয় তার অভ্যাস হয়নি। এখনো তার খালি একটা বাসায় ঢুকতে মন খারাপ হয়ে যায়। দেশে তার চাচা ফুপুরা সবাই মিলে একটা বিল্ডিংয়ে থাকতো তাদের সবার বাচ্চা কাচ্চারা মিলে তাদের একটা বিশাল পরিবার ছিল, বাসায় ঢোকার আগেই অনেক দূর থেকে সব বাচ্চা কাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যেতোকী মজার একটা সময় ছিল! তিষা ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার ব্যাগ থেকে বাসার চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। ছিমছাম সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স, তার ঘরটা, দোতলায়। তিষা তার স্কুল ব্যাগটা কার্পেটে রেখে নিচে সোফায় বসে পড়ল। রাস্তার জুতো পরে বাসার কার্পেটের উপর চলে এসেছে, মা দেখলে নিশ্চয়ই রাগ করবেন, কিন্তু মা বাসায় নেই রাগ করবেন কীভাবে?
তিষা কফি টেবিলে পা তুলে চুপচাপ বসে থাকে। তার বয়স তেরো, এখন সে আনুষ্ঠানকিভাবে টিন এজার হয়েছে। দেশে থাকতে সে যখন আমেরিকায় গল্প শুনেছে তার বেশীর ভাগ ছিল টিন এজারদের গল্প। সে এখন এই আমেরিকার টিন এজার, এখন তার অনেক আনন্দ হওয়ার কথা। তার কী আনন্দ হচ্ছে? স্কুলে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ অনেক মজা হয় সেটি সত্যি। রাত্রি বেলা যখন আব্বু আম্মু থাকে তখনও সময়টা কেটে যায়, তারপরেও বিশাল একটা সময় সে একা থাকে। কম্পিউটারের সামনে বসে মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায় কিন্তু সেটা কেমন জানি কৃত্রিম। একজন মানুষকে সামনাসামনি না দেখলে তার সাথে কী কথা বলা যায়? অনেকেই পারে। তিষা পারে না।
তিষার খিদে পেয়েছে। ফ্রীজ খুললেই দেখবে আম্মু তার জন্যে খাবার রেডি করে রেখেছেন। মাইক্রোওয়েভে গরম করে সে খেতে পারবে। টিভিটা চালিয়ে দিলেই কোথাও না কোথাও একটা সিটকম খুঁজে পাওয়া যাবে, দর্শকদের কৃত্রিম হাসি শুনতে শুনতে এক সময় সে নিজেও একজন কৃত্রিম দর্শক হয়ে টেলিভিশনের চরিত্রগুলোকে দেখে হাসতে থাকবে। কিন্তু তিষার সোফা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সে কফি টেবিলে পা তুলে দিয়ে জানালার ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ধূসর মন খারাপ করা একটি আকাশ। একটু পর মনে হয় টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হবে, তখন মনে হয় আরো বেশী মন খারাপ হয়ে যাবে।
.
সোফায় বসে থাকতে থাকতে তিষা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। সন্ধেবেলা আম্মু কাজ থেকে ফিরে এসে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন তিষা সোফায় ঘুমিয়ে আছে, পা থেকে জুতো পর্যন্ত খুলেনি। আম্মু একটু ভয় পেয়ে তিষাকে ধরে একটা ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন,”তিষা মা, এখানে ঘুমাচ্ছিস?”
তিশা ধড়মড় করে উঠে বসল, একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “হায় খোদা! আমি ঘুমিয়ে পড়েছি!”
“জুতো পর্যন্ত খুলিস নি? শরীর ভালো থাছে তো?”
“হ্যাঁ আম্মু শরীর ভালো আছে। যা খিদে পেয়েছে–”
“স্কুল থেকে এসে কিছু খাসনি।”
“আলসেমি লাগছিল।” বলে তিষা অপরাধীর মত হাসল।
“যা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আয়। কী খাবি বল।”
তিশা তার আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “যা দিবে তাই খাব আম্মু। একা একা খেতে ইচ্ছা করে না।”
আম্মু তিষার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেললেন, মেয়েটি এই কথাটি একটুও ভুল বলেনি। একা বসে বসে খাওয়ার চাইতে বড় বিড়ম্বনা আর কিছু হতে পারে না।
.
রাত্রে তিনজন খেতে বসেছে, তিষা তার স্প্যাগোটির উপর ঘন লাল রংয়ের একটা সস ঢালতে ঢালতে বলল, “আম্মু তোমাদের এই কাজটা ঠিক হয়নি।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কোন কাজটা?”
“এই যে আমি একা। আমার কোনো ভাইবোন নেই।”
আলু খেতে খেতে বললেন, “তাতে তোর সমস্যা কী? তুই একা তোর আদর যত্নে কেউ ভাগ বসাচ্ছে না।”
তিষা বলল, “আমার আদর যত্নে ভাগ বসালেও একটুও কম পড়বে আব্বু। তোমার এটা ঠিক যুক্তি না।”
“তাহলে কোনটা ঠিক যুক্তি।”
“একটা ছেলে কিংবা মেয়ে যদি একা বড় হয় তাহলে সে স্বার্থপর হয়ে বড় হয়। আমি নিশ্চয়ই স্বার্থপর হয়ে বড় হচ্ছি।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “হচ্ছিস নাকী?”
তিষা বলল “সেটা তো আর আমি বুঝতে পারব না, তোমরা বুঝবে।”
আব্বু বললেন, “আমরা যখন বুড়ো হব তখন যদি ওল্ড হোমে আমাদের দেখতে না আসিস তাহলে বুঝব স্বার্থপর হয়েছিস।”
“তোমাদের আরো ছেলেমেয়ে হওয়া উচিৎ ছিল আম্মু।”
“একটা নিয়েই পারি না আরো ছেলে মেয়ে!”
তিষা বলল, “কী বলছ আম্মু? আমি তোমাকে কখনো জ্বালাতন করেছি?”
“এখন করিস না। কিন্তু তুই যখন ছোট ছিলি” আব্বু বললেন, “বাপরে বাপ! এমন কোনো অসুখ নাই যে তোর হয় নাই। তোর মেজাজ ছিল গরম, সারা রাত চিৎকার করতি, বাসার কারো ঘুম নাই খাওয়া নাই–”
“আমি বিশ্বাস করি না।”
“তুই বিশ্বাস করিস কী না করিস তাতে কিছু আসে যায় না। সত্য হচ্ছে সত্য।”
তিষা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, আমার বয়স তেরো। তোমার বয়স যখন পঁচিশ তখন আমার জন্ম হয়েছে। তার অর্থ তোমার বয়স এখন আটত্রিশ। আটত্রিশ বছরে আমেরিকার মহিলাদের ধুমাধুম বাচ্চা হচ্ছে।”
আম্মু চোখ ছোট করে বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস?”
“আমি বলতে চাচ্ছি যে তোমার এখনো বাচ্চা নেয়ার বয়স আছে। একটা বাচ্চা নিয়ে নাও। মেয়ে হলে খুবই ভালো ছেলে হলেও চলবে।”
আম্মু খপ করে তিষার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বেশী মাতবর হয়েছিস, মাকে পরামর্শ দিস কীভাবে বাচ্চা নিতে হবে?”
তিষা “আউ আউ” করে প্রয়োজন থেকে অনেক জোরে চিৎকার করে মাথাটা সরিয়ে নিতে নিতে বলল, “আমার ভালো মন্দ নিয়ে আমি পরামর্শ দিতে পারব না? আমার একা একা বাসায় ঢুকতে কতো খারাপ লাগে তুমি
জানো? ছোট একটা বোন না হয়ে ভাই হলে কতো মজা হতো!”
আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “নো। ভাই বোনের জন্যে দেরী হয়ে গেছে। খুব বেশী হলে তোকে একটা কুকুরের বাচ্চা কিনে দিতে পারি।”
আম্মু চোখ কপালে তুললেন, “কুকুর? ঘরের মাঝে একটা দামড়া কুকুর ঘুরে বেড়াবে? ছিঃ!”
তিষা বলল, “কেন মা? কুকুর তো থাকেই। আমার স্কুলের সব বন্ধুর কুকুর আছে!”
“থাকুক। তাই বলে আমার বাসার ভিতরে একটা কুকুর ঘুরে বেড়াতে পারবে না।”
“কেন মা? দেশে আমাদের বাসায় একটা বিড়াল ছিল মনে নাই? যদি বাসায় বিড়াল থাকতে পারে তাহলে কুকুর থাকলে দোষ কী?”
“বিড়াল কত ছোট, কুকুর কতো বড়”
আব্বু বললেন, “ছোট ব্রীডের কুকুরও আছে। বিড়ালের সাইজ!”
আম্মু বললেন, “বাসায় পোষাপাখী রাখা খুব সোজা ব্যাপার না। এটাকে খাওয়াতে হয় বাথরুম করাতে হয় সব দায়িত্ব নিতে হয়।”
তিষা সোজা হয়ে বসে মুখ শক্ত করে বলল, “আম্মু, তুমি যদি বিশ্বাস করে আমাকে একটা ছোট ভাই কিংবা বোন দিতে আমি তাকে পর্যন্ত দেখে শুনে রাখতাম। আর ছোট একটা কুকুরের বাচ্চাকে দেখে শুনে রাখতে পারব না?”
কাজেই পরের উইক এন্ডেই তিষা তার আব্বুকে নিয়ে একটা পেট স্টোর থেকে ছোট একটা কুকুরের বাচ্চা আর কুকুর পালার উপর একটা বই কিনে আনল। দোকানে অনেক ধরণের কুকুর, তাদের দামও অনেক, তিষা তার মাঝে বেছে বেছে ছোট একটা বাদামীর মাঝে সাদা আর কালো রংয়ের কুকুর বেছে নিল। এটাকে এখানে বলে বিগল, বড় বড় চোখ, ঝোলা কান। দেখলেই আদর করার ইচ্ছে করে।
কুকুরটার এমন মায়া কড়া চেহারা যে বাসায় আনার পর তাকে দেখে আম্মুর মুখে পর্যন্ত হাসি ফুটে উঠল। রান্না ঘরের মেঝেতে ছেড়ে দেবার পর। সেটা কুঁই কুঁই শব্দ করে মেঝে শুকতে শুকতে এদিকে সেদিক ঘুরতে থাকে। নূতন জায়গায় এসে তার মাঝে এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভাব, কোথায় যাবে কার কাছে একটুখানি আদর পাবে সেটা নিয়ে এক ধরনের দুর্ভাবনা। কিছুক্ষণের মাঝেই অবশ্যি বুঝে গেল তিষা হচ্ছে তার আসল মালিক তাই সে গুটিশুটি মেরে তার কোলে এসে বসে পড়ল। তিষা আদর করে বুকে চেপে ধরে বলল, “সোনামনি আমার। টুই টুই টুই।”
আব্বু হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম দিবি তোর কুকুরের?”
তিষা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, “টুইটি।”
“টুইটি একটা পাখীর বাচ্চার নাম।”
“হোক। আমার এই টুনটুনির নাম টুইটি।”
আম্মা বললেন, “টুনটুনি একটা পাখী। কুকুরের বাচ্চা কবে থেকে পাখী হল।”
তিষা বলল, “আমি এতো কিছু বুঝি না।” তারপর কুকুরের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি টুনটুনি? আজ থেকে তোর নাম টুইটি। টু-ই টি।”
কুকুরের বাচ্চাটা কী বুঝল কে জানে, মাথা তুলে ভৌ ভৌ করে একবার ডাকল। তিষা তার আলু আর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ, টুইটি তার নামটাকে পছন্দ করেছে!”
.
এক সপ্তাহ পর তিষা তার স্কুল বাস থেকে নামল, তারপর রাস্তা পার হয়ে সে হেঁটে হেঁটে তাদের এলাকায় ঢুকে পড়ে। অন্যান্য দিনের মত আকাশে মেঘ, পথে কোনো মানুষজন নেই। ছবির মত একটি একটি বাসা পার হয়ে সে তার বাসায় এল, সামনে কোনো গাড়ী নেই। তার অর্থ আম্মু এখনো আসেননি। আজকে কিন্তু তার মন খারাপ হল না, তিষা জানে সে একা নয়। বাসায় তার জন্যে টুইটি অপেক্ষা করছে। দরজার তালায় চাবিটা স্পর্শ করা মাত্রই ভেতরে সে টুইটির উত্তেজনা টের পেল, সে ঘরের ভেতর ছোটাচ্চুটি শুরু করেছে। দরজা খুলতেই টুইটি তার ছেলেমানুষী গলায় ভেউ ভেউ করে ডাকতে ডাকতে তিষাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারপর আবার ছুটে ঘরের আরেক মাথায় চলে যায় আবার ছুটে আসে। দেখে বোঝা যায় আনন্দে সে কী করবে বুঝতে পারছে না।
তিষা স্কুলের ব্যাগটা নিচে রেখে বলল, “আস্তে টুইটি, আস্তে! তোর তো উত্তেজনায় স্ট্রোক হয়ে যাবে!”
টুইটি তিষার কথা কিছু বুঝল কীনা কে জানে কিন্তু তার উত্তেজনা বিন্দুমাত্র কমল না। সে ছোটাচ্চুটি করতে লাগল, তিষাকে ঘিরে ঘূরতে লাগল, তার উপর লাফিয়ে পড়তে লাগল এবং চিকন গলায় ভেউ ভেউ করে ডাকতে লাগল। তিষা টুইটিকে জাপটে ধরে আদর করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার উত্তেজনা কমে আসে। তিষা তখন তার ঘরে গিয়ে ব্যাগটা রাখে, স্কুলের পোষাক পাল্টে নেয় এবং সারাক্ষণ টুইটি তাকে ঘিরে লাফ ঝাঁপ দিতে থাকে। তারপর নিচে নেমে তিষা ফ্রীজ থেকে একটা পিৎজার টুকরো বের করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেয়। একটা প্লেটে পিজার টুকরোটা নিয়ে সে পিছনের দরজা খুলে বের হয়ে আসে। তিষা বের হবার আগেই টুইটি লাফিয়ে বের হয়ে যায়। ঘরের ভেতর সবকিছু সে এতোদিনে চিনে গেছে বাইরে সবকিছু তার কাছে রহস্যময়। সে সতর্কভাবে এদিকে সেদিকে তাকায়। গাছে একটা রবিন পাখীকে দেখে গরগর করে একটা গর্জনের মত ভঙ্গী করে। একটা কাঠবেড়ালীকে দেখে তাকে ধাওয়া করে এবং হঠাৎ করে থেমে গিয়ে মাটি শুকতে শুকতে এগিয়ে যায়।
তিষা এক ধরণের স্নেহ নিয়ে এই অবুঝ পশুটির দিকে তাকিয়ে থেকে তার পিৎজাটি খেতে থাকে। একটা ছোট অবুঝ পশু একজন মানুষের জীবন এভাবে পাল্টে দিতে পারে তিষা আগে কখনো কল্পনা করেনি।
. ঠিক এরকম সময় তিষার বাসা থেকে দুই হাজার তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটা ছয়তলা দালানে লিডিয়া এপসিলোন কোম্পানীতে যোগ দিতে গিয়েছি।