০২. সোমা হচ্ছে শাহনাজের আম্মার

সোমা হচ্ছে শাহনাজের আম্মার ছোটমামার একজন দূর-সম্পর্কের বনের মেয়ে। সম্পর্ক হিসাব করে ডাকাডাকি করলে শাহনাজকে মনে হয় সোমা খালা–টালা–এই ধরণের কিছু একটা ডাকা উচিত কিন্তু এত হিসাব করে তো আর কেউ ডাকাডাকি করে না। সোমার আব্বা শাহনাজের আব্বার খুব ভালো বন্ধু। অফিসের কাজে একবার ঢাকা এসে কয়দিন শাহনাজদের বাসায় ছিলেন। তখন থেকেই পরিচয়। সোমা বয়সে শাহনাজ থেকে একটু বড়, তাই তাকে সোমা আপু বলে ডাকে।

সোমা একেবারে অসাধারণ একজন মেয়ে। কেউ যদি সোমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, সে তা হলে পড়ে গিয়েও খিলখিল করে হেসে উঠে বলবে, ইস্! তুমি কী সুন্দর ল্যাং মারতে পার! কোথায় শিখেছ এত সুন্দর করে ল্যাং মারা? রাস্তায় যদি কোনো ছিনতাইকারী তার গলার হার ছিনিয়ে নিয়ে যায় তা হলেও খুশিতে ঝলমল করে বলে উঠবে, লোকটার নিশ্চয়ই আমার বয়সী একটা মেয়ে আছে, মেয়েটা এই হারটা পেয়ে কী খুশিই না হবে! কেউ যদি সোমার নাকে ঘুসি মেরে বসে তা হলে সোমা ব্যথাটা সহ্য করে হেসে বলবে, কী মজার একটা ব্যাপার হল! ঘুসি খেলে কী রকম লাগে সবসময় আমার জানার কৌতূহল। ছিল, এবারে জেনে গেলাম! যারা সোমাকে চেনে না তারা এ রকম কথাবার্তা শুনে মনে। করতে পারে সে বুঝি বোকাসোকা একটা মেয়ে, কিছুই বোঝে না, আর বুঝলেও না বোঝার ভান করে সারাক্ষণ ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে। কিন্তু একটু ঘনিষ্ঠতা হলেই বোঝা যায় আসলে সোমা একেবারেই বোকা নয়, তার মাঝে এতটুকুও ন্যাকামো নেই। সোমা সত্যি সত্যি পণ করেছে পৃথিবীর সবকিছু থেকে সে আনন্দ খুঁজে বের করবে। একটা ব্যাপারে অন্যেরা যখন রেগেমেগে কেঁদেকেটে একটা অনর্থ করে ফেলে, সোমা ঠিক তখনো তার মাঝখান থেকে আনন্দ পাবার আর খুশি হবার একটি বিষয় খুঁজে বের করে ফেলে।

সোমারা থাকে চট্টগ্রামের একটা পাহাড়ি এলাকায়। তার আব্বা সেখানকার একটা ছবির মতো দেখতে চা–বাগানের ম্যানেজার। চা–বাগানে যারা থাকে তারা মনে হয় একটু একা একা থাকে, তাই কেউ বেড়াতে গেলে তারা ভারি খুশি হয়। সোমা কয়দিন পরে পরেই শাহনাজকে চিঠি লিখে সেখানে বেড়াতে যেতে বলে। শাহনাজেরও খুব ইচ্ছে, কিন্তু পরীক্ষার জন্য সবরকম জল্পনা–কল্পনা বন্ধ করে রাখা ছিল। পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে আব্বা এখন তাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন। আনন্দে শাহনাজের মাটিতে আর পা পড়ে না।

পৃথিবীতে অবশ্য কোনো জিনিসই পুরোপুরি পাওয়া যায় না। আম খেলে ভিতরে আঁটি থাকে, চকোলেট খেলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়, পড়াশোনায় বেশি ভালো হলে বন্ধুবান্ধবেরা। ভ্যাবলা বলে ধরে নেয়। ঠিক সেরকম সোমার কাছে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটুকু পুরোপুরি পাওয়া গেল না, কারণ আম্বা ইমতিয়াজের ওপর ভার দিলেন শাহনাজকে সোমাদের বাসায় নিয়ে যেতে। ইমতিয়াজ প্রথমে অবশ্য বলে দিল সে শাহনাজকে নিয়ে যেতে পারবে না, কারণ তার নাকি কবিতা লেখার ওপরে একটা ওয়ার্কশপ আছে। আব্বা যখন একটা ছোটখাটো ধমক দিলেন তখন সে খুব অনিচ্ছার ভান করে রাজি হল। শাহনাজকে নিয়ে যাবার সময় পুরো রাস্তাটুকু ইমতিয়াজ কী রকম যন্ত্রণা দেবে সেটা চিন্তা করে শাহনাজের প্রায় এক শ দুই ডিগ্রি জ্বর উঠে যাবার মতো অবস্থা, কিন্তু একবার পৌঁছে যাবার পর যখন সোমার সাথে দেখা হবে তখন কতরকম মজা হবে চিন্তা করে সে নিজেকে শান্ত করল।

সোমাদের বাসায় যাবার জন্য সে তার ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। বেড়ানোর জন্য জামা–কাপড়, চা–বাগানের টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য টেনিস শু, রোদ থেকে বাচার জন্য বেসবল টুপি এবং কালো চশমা, ছুটিতে পড়ার জন্য জমিয়ে রাখা গল্পের বই, বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখে রাখার জন্য নোটবই এবং কলম, ছবি আঁকার খাতা, ফটো তোলার জন্য আব্বার ক্যামেরা, সোমার জন্য কিছু উপহার, সোমার আব্বার জন্য পড়ে কিছু বোঝা যায় না এরকম জ্ঞানের একটা বই আর সোমার আম্মার জন্য গানের সিডি। ইমতিয়াজ। ভান করল পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে এক ধরনের সময় নষ্ট, তাই মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব। করে রাখল, কিন্তু নিজের ব্যাগ গোছানোর সময় সেখানে রাজ্যের জিনিস এনে হাজির করল।

নির্দিষ্ট দিনে আব্বা–আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহনাজ আর ইমতিয়াজ রওনা দিয়েছে, কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছে সময়মতো। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে শাহনাজের খুব ভালো লাগে, একেবারে সাধারণ জিনিসগুলো তখন একেবারে অসাধারণ বলে মনে হয়। ব্যাগ থেকে সে একটা রগরগে এ্যাডভেঞ্চারের বই বের করে আরাম করে বসল। ইমতিয়াজ মুখ খুব গম্ভীর করে চুলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে সেগুলো এলোমেলো করতে করতে একটা মোটা বই বের করল। বইটার নাম খুব কটমটে, শাহনাজ কয়েকবার চেষ্টা করে পড়ে আন্দাজ করল : মধ্যযুগীয় কাব্যে অতিপ্রাকৃত উপমার নান্দনিক ব্যবহার! এ রকম বই যে কেউ লিখতে পারে সেটা একটা বিস্ময় এবং কেউ যে নিজে থেকে সেটা পড়ার চেষ্টা করতে পারে সেটা তার থেকে বড় বিস্ময়।

ট্রেন ছাড়ার পর শাহনাজ তার সিটে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে তার এ্যাডভেঞ্চারের বইটি পড়তে থাকে। ইমতিয়াজ তার বিশাল জ্ঞানের বইটি নিয়ে খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে, পড়ার ভান করে, কিন্তু শাহনাজ বুঝতে পারল সে এক পৃষ্ঠাও আগাতে পারছে না। কেউ যদি তার দিকে তাকিয়ে থাকত তাহলে মনে হয় আরো খানিকক্ষণ এ রকম চেষ্টা করত কিন্তু ট্রেনের যাত্রীরা সবাই নিজেকে নিয়ে নিজেরাই ব্যস্ত, কাজেই ইমতিয়াজ বেশিক্ষণ এই জ্ঞানের বই পড়ার ভান চালিয়ে রাখতে পারল না। বই বন্ধ করে উসখুস করতে লাগল। খানিকক্ষণ পর যখন একজন হকার কিছু ম্যাগাজিন নিয়ে হাজির হল তার কাছ থেকে সে একটা ম্যাগাজিন কিনল, ম্যাগাজিনটার নাম : খুন জখম সন্ত্রাস, প্রথম পৃষ্ঠায় একজন মানুষের মাথা কেটে ফেলে রাখার ছবি, উপরে বড় বড় করে লেখা : আবার নরমাংসভুক সন্ত্রাসী। ইমতিয়াজ গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যাগাজিনটা গোগ্রাসে গিলতে থাকে।

.

শাহনাজ আর ইমতিয়াজ ট্রেন থেকে নামল দুপুরবেলার দিকে। সেখান থেকে বাসে করে তিন ঘণ্টা যেতে হল পাহাড়ি রাস্তা ধরে। সবশেষে স্কুটারে করে কয়েক মাইল। সোমাদের বাসায় যখন পৌঁছাল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।

শাহনাজকে দেখে সোমা যেভাবে ছুটে আসবে ভেবেছিল সোমা ঠিক সেভাবে ছুটে এল না, এল একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাছে এসে অবশ্য জাপটে ধরে খুশিতে চিৎকার করে উঠে বলল, তুই এসেছিস? আমি ভাবলাম তুই বুঝি ভুলেই গেছিস আমাকে।

শাহনাজও সমান জোরে চিৎকার করে বলল, তুমি ভালো আছ সোমা আপু?

হ্যা ভালো আছি বলেই সোমা আপু থেমে গেল, হাসার চেষ্টা করে বলল, আসলে বেশি ভালো নেইরে।

শাহনাজ দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কেন? কী হয়েছে?

জানি না। বুকের ভিতর হঠাৎ অসম্ভব ব্যথা হয়। তখন হাত–পা অবশ হয়ে যায়, মাঝে মাঝে একেবারে সেন্সলেস হয়ে যাই।

শাহনাজের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভয়–পাওয়া গলায় বলল, ডাক্তার দেখাও নি?

দেখিয়েছি।

ডাক্তার কী বলে?

ঠিক ধরতে পারছে না। কখনো বলে হার্টের সমস্যা, কখনো বলে নার্ভাস সিস্টেম, কখনো বলে নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। সোমা কিছুক্ষণ ম্লানমুখে বসে থাকে এবং হঠাৎ করে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বুঝলি শাহনাজ, সবসময় আমার জানার কৌতূহল ছিল সেন্সলেস হলে কেমন লাগে! এখন জেনে গেছি!

শাহনাজ অবাক হয়ে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সোমার আম্মা বললেন, শাহনাজ মা, ভিতরে আস। ভালোই হয়েছে তুমি এসেছ, সোমার একজন সঙ্গী হল। কী যে হল মেয়েটার! 

শাহনাজ তার ব্যাগ হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভালো হয়ে যাবে চাচি।

দোয়া কোরো না।

ইমতিয়াজ পিছনে পিছনে এসে ঢুকল, মুখে সবজান্তার মতো একটা ভান করে বলল, আমার কী মনে হয় জানেন চাচি?

কী?

সোমার সমস্যাটা হচ্ছে সাইকোসোমেটিক।

সোমার আম্মা ভয়ার্ত মুখে বললেন, সেটা আবার কী?

এক ধরনের মানসিক রোগ।

সোমা চোখ বড় বড় করে বলল, মানসিক রোগ? তার মানে আমি পাগলী? তারপর হি হি করে হেসে বলল, আমি সবসময় জানতে চেয়েছিলাম পাগলীরা কী করে। এখন আমি জানতে পারব।

ইমতিয়াজ আরো কী একটা জ্ঞানের কথা বলতে যাচ্ছিল, শাহনাজ বাধা দিয়ে বলল, সোমা আপু, তুমি ভাইয়ার সব কথা বিশ্বাস কোরো না।

কেন?

কারণ সবকিছু নিয়ে একটা কথা বলে দেওয়া হচ্ছে ভাইয়ার হবি। অমর্ত্য সেনের সাথে দেখা হলেও তাকে একটা কিছু উপদেশ দিয়ে দেবে।

ইমতিয়াজ চোখ পাকিয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, শাহনাজ সেই দৃষ্টি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বলল, ভাইয়ার সাথে যদি কোনোদিন বিল গেটসের দেখা হয় তা হলে সে বিল গেটসকেও কীভাবে কম্পিউটারের ব্যবসা করতে হয় সেটার ওপরে লেকচার দিয়ে দিত।

আরেকটু হলে ইমতিয়াজ খপ করে শাহনাজের চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দিত কিন্তু শাহনাজ সময়মতো সরে গেল। নেহায়েত সোমা, তার আব্বা–আম্মা কাছে ছিলেন তাই ইমতিয়াজ ছেড়ে দিল। তবে কাজটা শাহনাজের জন্য ভালো হল না, ইমতিয়াজ যে তার ওপর একটা শোধ নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শাহনাজ অবশ্য ব্যাপারটি নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তিত হল না। এখন সে সোমাদের বাসায় আছে, ইমতিয়াজ তাকে কোনোরকম জ্বালাতন করতে পারবে না।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সোমা শাহনাজকে নিয়ে কী কী করবে তার একটা বিশাল লিস্ট তৈরি করল। সেই লিস্টের সব কাজ শেষ করতে হলে অবশ্য শাহনাজকে তার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে, কিন্তু সেটা নিয়ে সোমা কিংবা শাহনাজ কারো খুব মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না।

.

পরদিন ভোরে অবশ্য হঠাৎ করে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল–সকালবেলা নাশতা করতে করতে হঠাৎ করে সোমার মুখ কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শাহনাজ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, সোমা আপু, কী হয়েছে?

সোমা কোনো কথা বলল না, সে তার বুকে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে। শাহনাজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, সোমা আপু!

সোমা কিছু একটা কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু বলতে পারল না, তার সারা মুখে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। শাহনাজ উঠে গিয়ে সোমাকে ধরে চিৎকার করে ডাকল, চাচি!

সোমার আম্মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন, দুজনে মিলে সোমাকে ধরে কাছাকাছি একটা সোফায় শুইয়ে দিল। শাহনাজ সোমার হাত ধরে রাখল। সোমা রক্তহীন মুখে ফিসফিস করে বলল, তোমরা কোনো ভয় পেয়ো না, দেখবে এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।

শাহনাজ কাঁদো–কাঁদো গলায় বলল তোমার কেমন লাগছে সোমা আপু? ব্যথা। সোমা অনেক কষ্ট করে বলল, বুকের মাঝে ভয়ানক ব্যথা।

শাহনাজ কী করবে বুঝতে না পেরে কাঁদতে শুরু করল। সোমা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কাদিস না বোকা মেয়ে বেশি ব্যথা হলেই আমি সেন্সলেস হয়ে যাব তখন আর ব্যথা করবে না।

সত্যি সত্যি একটু পর সোমা অচেতন হয়ে পড়ল। চা–বাগানের অফিস থেকে ডাক্তারকে নিয়ে সোমার আব্বা ছুটে এলেন। সোমাকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হল এবং ঠিক করা হল তাকে এক্ষুনি শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

কিছুক্ষণের মাঝে একটা জিপ এনে হাজির করা হল, সেখানে সোমাকে নিয়ে তার আব্বা–আম্মা আর চা–বাগানের ডাক্তার রওনা দিয়ে দিলেন। জিপ স্টার্ট করার আগে সোমা চোখ খুলে শাহনাজকে ফিসফিস করে বলল, একটা অভিজ্ঞতা হবে, কী বলিস? কখনো আমি হাসপাতালে যাই নি!

সোমাকে নিয়ে চলে যাবার পর শাহনাজ আবিষ্কার করল পুরো বাসাটা একেবারে একটা মৃতপুরীর মতো নীরব হয়ে গেছে। বাসায় দেখাশোনা করার জন্য অনেক লোকজন রয়েছে, এখানে থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না, কিন্তু হঠাৎ করে শাহনাজের বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কত আশা করে সে এখানে বেড়াতে এসেছে, সোমার সাথে তার কতকিছু করার পরিকল্পনা, কিন্তু এখন সবই একটা বিশাল দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।

এর মাঝে ইমতিয়াজ পুরো ব্যাপারটা আরো খারাপ করে ফেলল। সোমাকে হাসপাতালে নেবার পর ইমতিয়াজ একটা বড় হাই তুলে বাসার কাজের মানুষটিকে বলল, আমার জন্য ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে আনন। চা–বাগানে বেড়াতে এসেছি, আমাদের ভালো চা খাওয়াবে না? কী রকম আজেবাজে চা বানাচ্ছ?

কাজের মানুষটি অপ্রস্তুত হয়ে ইমতিয়াজের জন্য নতুন করে চা তৈরি করতে যাচ্ছিল তখন ইমতিয়াজ তাকে থামাল, বলল, ভালো চা তৈরি করতে দরকার ভালো পানি। এখানে স্প্রিং ওয়াটার নাই?

কাজের মানুষটি ইমতিয়াজের কথা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ইমতিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, স্প্রিং ওয়াটার মানে বোঝ না? পাহাড়ি ঝরনার পানি। নাই?

কাজের মানুষটা ভয়ে ভয়ে বলল, কাছে নাই। দুই মাইল দূরে একটা ঝরনা আছে।

গুড। আজ বিকালে সেখানে যাবে, বালতি করে ঝরনার পানি আনবে। সেই পানিতে চা হবে।

মানুষটি মাথা নেড়ে শুকনো মুখে চলে গেল। শাহনাজ একেবারে হতভম্ব হয়ে ইমতিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একজন মানুষ কেমন করে এ রকম হৃদয়হীন হয়? এইমাত্র সোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার কী হবে কে জানে, আর ইমতিয়াজ কীভাবে ঝরনার পানি দিয়ে তার জন্য চা তৈরি করা হবে সেটা নিয়ে হম্বিতম্বি করছে! শাহনাজের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল, কোনোমতে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ভাইয়া, তোমার ভিতরে কোনো মায়াদয়া নাই?

ইমতিয়াজ কেনো আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, কেন? কী হয়েছে?

সোমাকে এইমাত্র হাসপাতালে নিয়েছে আর তুমি ঝরনার পানিতে চা খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?

ইমতিয়াজ যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি সেরকম একটা মুখের ভাব করে বলল, সোমাকে হাসপাতালে নিলে আমি চা খেতে পারব না?

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। কিছুতেই ইমতিয়াজের সামনে কাঁদবে না ঠিক করে রাখায় সে কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রাখল। ইমতিয়াজ মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব মজা পেয়ে গেল, মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, এখন তুই ফিচ ফিচ করে কাঁদতে শুরু করবি নাকি?

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গভীর জ্ঞানের কথা বলছে এ রকম একটা ভাব করে বলল, আমি সবসময়েই বিশ্বাস করতে চাই যে মেয়ে এবং ছেলের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। একটা ছেলে যেটা করতে পারে, একটা মেয়েও নিশ্চয়ই সেটা করতে পারে। কিন্তু তোদের দেখে এখন আমার মত পাল্টাতে হবে। ছোট একটা বিষয় নিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবি।

শাহনাজ আর পারল না, চিৎকার করে রাগে ফেটে পড়ল, এইটা ছোট বিষয়? সোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, এইটা ছোট বিষয়?

ইমতিয়াজ ঠোঁট উন্টে বলল, পরিষ্কার সাইকোসোমেটিক কেন্স। নিউজ উইকে এর ওপরে আমি একটা আর্টিক্যাল পড়েছি, হুবহু এই কেস। দুই গ্রুপ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হল। এক গ্রুপকে দিল ড্রাগস, অন্য গ্রুপকে প্লাসিবু

শাহনাজ চিৎকার করে বলল, চুপ করবে তুমি? তোমার বড় বড় কথা বন্ধ করবে?

ছোটবোনের মুখে এ রকম কথা শুনে ইমতিয়াজ এবারে খেপে গেল। চোখ ছোট ছোট করে হিন্দি সিনেমার ভিলেনের মতো মুখ করে বলল, আমার সাথে ঘিড়িংগবাজি? একেবারে কানে ধরে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব।

পারলে নিয়ে যাও না!

ভাবছিস পারব না? আমাকে চিনিস না তুই?

তোমাকে চিনি দেখেই বলছি। শাহনাজ হিংস্র মুখ করে বলল, তোমার হচ্ছে শুধু কথা। বড় বড় কথা। বড় বড় কথা যদি বাজারে বিক্রি করা যেত তা হলে এতদিনে তুমি আরেকটা বিল গেটস হয়ে যেতে।

ইমতিয়াজ শাহনাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে কিছু একটা করে ফেলত কিন্তু ঠিক তখন বাসার কাজের মানুষটি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল বলে সে কিছু করল না। তার হাত থেকে কাপটা নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে মুখে পরিতৃপ্তির একটা ভাব নিয়ে আসে। শাহনাজের পক্ষে ইমতিয়াজের এইসব ভান আর সহ্য করা সম্ভব হল না, সে পা দাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

বাইরে এসে বারান্দায় বসে শাহনাজ নিজের চোখ মুছে নেয়, তার এত মন–খারাপ লাগছে যে সেটি আর বলার মতো নয়। পরীক্ষা শেষ হবার পর এখানে বেড়াতে এসে সে কত আনন্দ করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল অথচ এখন আনন্দ দূরে থাকুক, পুরো সময়টা যেন একটা বিভীষিকার মতো হয়ে যাচ্ছে। ইমতিয়াজ মনে হয় তার জীবনটাকে একেবারে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। মানুষেরা তাদের ছোটবোনকে কত ভালবাসে কিন্তু ইমতিয়াজকে দেখলে মনে হয়। শাহনাজ যেন ছোটবোন না, সে যেন রাজনৈতিক দলের বিপক্ষ পার্টির নেতা!

শাহনাজ একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আজ সকালে কাছাকাছি একটা টিলাতে সোমাকে নিয়ে হেঁটে যাবার কথা ছিল। সোমা এখন নেই সে একাই হেঁটে আসবে। সোমা বলেছে পুরো এলাকাটা খুব নিরাপদ, একা একা ঘুরে বেড়াতে কোনো ভয় নেই। শাহনাজ গেট খুলে বের হবার সময় দারোয়ার্ম জানতে চাইল সে কোথায় যাচ্ছে, সঙ্গে কাউকে দেবে কি না। শাহনাজ বলল কোনো প্রয়োজন নেই, সে একাই হেঁটে আসবে।

সোমাদের বাসা থেকে খোয়া–বাঁধানো একটা রাস্তা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় মেহগনি গাছ। গাছে নানারকম পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। শাহনাজ রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে নিচে নেমে আসে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবির মতো বাসা। তার পাশ দিয়ে হেঁটে সে পিছনে টিলার দিকে হাঁটতে থাকে। চা বাগানের শ্রমিক পুরুষ আর মেয়েরা গল্প করতে করতে কাজে যাচ্ছে, শাহনাজ তাদের পিছু পিছু যেতে থাকে। খানিকদূর যাবার পর পায়েচলা পথ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সবাই একদিকে চলে যায়, শাহনাজ অন্যদিকে হাঁটতে থাকে। তার মনটি খুব বিক্ষিপ্ত, কোনোকিছুতেই মন দিতে পারছে না। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা জংলা জায়গায় হাজির হল, শুকনো পাতা মাড়িয়ে সে একটা বড় গাছের দিকে হেঁটে যেতে থাকে, গাছের গুঁড়িতে বসে বসে সে খানিকক্ষণ নিজের আর সোমার ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করবে।

গাছটার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে প্রায় সাইরেনের মতো তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেজে ওঠে। শাহনাজ চমকে উঠে একলাফে পিছনে সরে যায়, কিন্তু পো পো শব্দে সেই তীক্ষ্ণ শব্দের মতো সাইরেন বাজতেই থাকে। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাতে থাকে, ঠিক তখন বাচ্চার গলায় কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, খবরদার, কাছে আসবে না।

কথাটি কে বলছে দেখার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। শাহনাজ তখন ভয়ে ভয়ে বলল, কে?

আমি।

গলার স্বরটি এল গাছের উপর থেকে এবং শাহনাজ তখন উপরের দিকে তাকাল। দেখল গাছের মাঝামাঝি জায়গায় তিনটি ডাল বের হয়ে এসেছে, সেখানে একটা ছোট ঘরের মতন। সেই ঘরের উপর থেকে দশ–বারো বছরের একটা বাচ্চার মাথা উঁকি দিচ্ছে। বাচ্চাটির বড় বড় চোখ, ভারী চশমা দিয়েও চোখ দুটোকে ছোট করা যায় নি, খরগোশের মতো বড় বড় কান। মাথায় এলোমেলো চুল। বাচ্চাটি সাবধানে আরো একটু বের হয়ে এল। শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি গাছের উপরে কী করছ?

সাইরেনের মতো কর্কশ পো পো শব্দের কারণে ছেলেটি শাহনাজের কথা শুনতে পেল না, সে ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ?

শাহনাজ আরো গলা উঁচিয়ে বলল, তুমি গাছের উপরে কী করছ?

দাঁড়াও শুনতে পাচ্ছি না বলে বড় বড় কান এবং বড় বড় চোখের ছেলেটা তার হাতে ধরে রাখা জুতার বাক্সের মতো একটা বাক্সের গায়ে লাগানো একটা সুইচ অফ করে দিল, সাথে সাথে কর্কশ এবং তীক্ষ্ণ সাইরেনের মতো পোঁ পোঁ শব্দটি থেমে যায়। ছেলেটি এবারে একটু এগিয়ে এসে বলল, কী বলছ?

শাহনাজ খানিকক্ষণ এই বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বলছি তুমি এই গাছের উপর বসে কী করছ?

ছেলেটা ঘাড়টা বাঁকা করে বলল, সেটা বলা যাবে না।

কেন?

কারণ এইটা টপ সিক্রেট। এইটা আমার গোপন ল্যাবরেটরি– বলেই ছেলেটা জিভে কামড় দিল, তার এই তথ্যটাও নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার কথা ছিল না।

শাহনাজ খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি তা বলেই দিলে।

ছেলেটাকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, শঙ্কিতমুখে বলল, তুমি কাউকে বলে দেবে না তো?

শাহনাজ মাথা নাড়ল, বলল, না।

ঠিক তো?

ঠিক।

তা হলে তুমি উপরে আস।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে গাছের উপরে তাকাল, বলল, কেমন করে আসব?

ছেলেটা তার ছোট ঘরটার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পরের মুহূর্তে একপাশ থেকে দড়ির একটা মই নামিয়ে দিল। ক্যাটক্যাটে গোলাপি হাওয়াই মিঠাই রঙের দুটি নাইলনের দড়ির সাথে বাঁশের কঞ্চি বেঁধে চমৎকার একটা মই তৈরি করা হয়েছে। ছেলেটা গাছের উপরে বসেই মইয়ের নিচের অংশটুকু গাছের নিচে লাগানো একটা আংটায় বাধিয়ে নিল, যেন উপরে ওঠার সময় সেটা দুলতে না থাকে।

শাহনাজ মইয়ে পা দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, ছিড়ে যাবে না তো?

নাইলন এত সহজে ছেড়ে না। ছেলেটা বড় মানুষের মতো বলল, তোমার ওজন দুইটা দড়িতে ভাগ হয়ে যাবে, এক একটা দড়ি কমপক্ষে দুই শ কিলোগ্রাম নিতে পারবে। আমি টেস্ট করেছি।

শাহনাজ আর তর্ক করল না, দড়ির মইয়ে পা দিয়ে বেশ সহজেই উপরে উঠে আসে। ছেলেটা শেষ অংশে হাত ধরে তাকে সাহায্য করল। উপরে বেশ চমৎকার একটা ঘরের মতো, বাইরে থেকে কাঠকুটো এবং গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে বলে হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। ভিতরে অনেকখানি জায়গা এবং সেখানে রাজ্যের যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। ছেলেটি বলে না দিলেও একবার দেখলে এটা যে একটা গোপন ল্যাবরেটরি সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকবে না।

ছেলেটা তার জুতোর বাক্স তুলে একটা সুইচ টিপে বলল, আমার সিকিউরিটি আবার অন করে দিলাম।

কী হয় সিকিউরিটি অন করলে?

কেউ ল্যাবরেটরির কাছে এলেই আমি বুঝতে পারি।

কীভাবে তৈরি করেছ সিকিউরিটি?

ছেলেটার মুখে এইবারে স্পষ্ট একটা গর্বের ছাপ ফুটে উঠল, লেজার লাইট দিয়ে। ঐ দেখ রেইনট্রি গাছে লেজার ডায়োড লাগানো আলোটা আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে গাছকে ঘিরে রেখেছে। একটা ফটো–ডায়োড আছে, সার্কিট ব্রেক হলেই আমার সাইরেন চালু হয়ে যায়। এফ, এম, সার্কিট।

শাহনাজ একটু চমকৃত হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল, ইতস্তত করে বলল, কোথায় পেয়েছ এই সিকিউরিটি সার্কিট?

আমি তৈরি করেছি।

শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি তৈরি করেছ!

হ্যাঁ।

তুমি দেখি বড় সায়েন্টিস্ট।

ছেলেটি খুব আপত্তি করল না, মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল। শাহনাজ একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু।

ক্যাপ্টেন কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু। ইউ ভি ডাবলু। সেই ডাবলু।