০২. সোনার খোঁজে, না গন্ধকের খোঁজে?

সোনার খোঁজে, না গন্ধকের খোঁজে?

বাস স্ট্যান্ডের কাছেই সোহনপালের বিরাট মিষ্টির দোকান। ভেতরে চেয়ার টেবিল পাতা, দেয়ালগুলো সব আয়না দিয়ে মোড়া। খাবারের দোকানের ভেতরে কেন যে আয়না দেওয়া বুঝি না। খাবার খাওয়ার সময় নিজের চেহারা দেখতে কারুর ভাল লাগে নকি? জিলিপিতে কামড় বসাতেই হাত দিয়ে রস গড়িয়ে পড়ল।

অর্ডার দিয়েছেন। এক ঘণ্টা সময় কাটাতে হবে তো! কাশ্মীরে এসে যতই পেট ভরে খাও, একটু বাদেই আবার খিদে পাবে। এখানকার জলে সব কিছু তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়।

কী প্রোফেসার সাহেব, আজ কোনদিকে যাবেন?

তাকিয়ে দেখি আমাদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বিশাল চেহারার মানুষ। চিনি এঁকে, নাম সূচা সিং। প্রায় ছ। ফিট লম্বা, কব্জি দুটো আমার উরুর মতন। চওড়া, মুখে সুবিন্যস্ত দাড়ি। সূচা সিং এখানে অনেকগুলো বাস আর ট্যাক্সির মালিক, খুব জবরদস্ত ধরনের মানুষ। কী কারণে যেন উনি আমার কাকাবাবুকে প্রোফেসার বলে ডাকেন, যদিও কাকাবাবু কোনওদিন কলেজে পড়াননি। কাকাবাবু আগে দিল্লিতে গভর্নমেন্টের কাজ করতেন।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। কাশ্মীরে এসে প্রথম কয়েকদিনই অবাক হয়ে লক্ষ করেছিলুম, এখানে অনেকেই ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারে। বাংলাদেশ থেকে এত দূরে, আশ্চর্য ব্যাপার, না? কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, এর কারণ। কাকাবাবু বলেছিলেন, ভ্রমণকারীদের দেখাশোনা করাই তো। কাশ্মীরের লোকদের প্রধান পেশা। আর ভারতীয় ভ্ৰমণকারীদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি-বাঙালিরা খুব বেড়াতে ভালবাসে-তাই বাঙালিদের কথা শুনে শুনে এরা অনেকেই বাংলা শিখে নিয়েছে। যেমন, সাহেব মেম অনেক আসে বলে এরা ইংরাজিও জানে বেশ ভালই। এখানেই একটা ঘোড়ার সাহসকে দেখেছি, বাইশ তেইশ বছর বয়সে, সে কোনওদিন ইস্কুলে পড়েনি, নিজের নাম সই করতেও জানে না-অথচ ইংরেজি, বাংলা, উরদু বলে জলের মতন।

সূচা সিং ভাঙা ভাঙা উরিদু আর বাংলা কথা মিলিয়ে বলেন। কিন্তু উরদু তো আমি জানি না, তদুরক্তি, তাকালুফ। এই জাতীয় দু চারটে কথার বেশি শিখতে পারিনি।তাই ওর কথাগুলো আমি বাংলাতেই লিখব।

কাকাবাবু সূচা সিংকে পছন্দ করেন না। লোকটির বড় গায়ে পড়া ভাব আছে। কাকাবাবু একটু নির্লিপ্তভাবে বললেন, কোনদিকে যাব ঠিক নেই। দেখি কোথায় যাওয়া যায়।

সূচা সিং চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বললেন, চলুন, কোনদিকে যাবেন বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

কাকাবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন, না, না, তার দরকার নেই। আমরা একটু কাছাকাছি ঘুরে আসব।

আমার তো গাড়ি যাবেই, নামিয়ে দেব আপনাদের।

না, আমরা বাসে যাব।

সোনমার্গের দিকে যাবেন তো বলুন। আমার একটা ভ্যান যাচ্ছে। ওটাতে যাবেন, আবার ফেরার সময় ওটাতেই ফিরে আসবেন।

প্রস্তাবটা এমন কিছু খারাপ নয়। সূচা সিং বেশ আন্তরিকভাবেই বলছেন, কিন্তু পাত্তা দিলেন না। কাকাবাবু। হাতের ভঙ্গি করে সূচা সিং-এর কথাটা উড়িয়ে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, না, কোনও দরকার নেই।

কাকাবাবু যে সূচা সিংকে পছন্দ করছেন না এটা অন্য যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। কিন্তু সূচা সিং-এর সেদিকে কোনও খেয়ালই নেই। চেয়ারটা কাকাবাবুর কাছে টেনে এসে খাতির জমাবার চেষ্টা করে বললেন, আপনার এখানে কোনও অসুবিধা কিংবা কষ্ট হচ্ছে না তো? কিছু দরকার হলে আমাকে বলবেন?

কাকাবাবু বললেন, না না, কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।

চা খাবেন তো? আমার সঙ্গে এক পেয়ালা চা খান।

কাকাবাবু সংক্ষেপে বললেন, আমি চা খেয়েছি, আর খাব না।

কাকাবাবু এবার পকেট থেকে চুরুট বার করলেন। আমি এর মানে জানি। আমি লক্ষ করেছি, সূচা সিং সিগারেট কিংবা চুরুটের ধোঁয়া একেবারে সহা করতে পারেন না। কাকাবাবু ওঁকে সরাবার জন্যই চুরুট ধরলেন। সূচা সিং কিন্তু তবু উঠলেন না-নাকটা একটু কুঁচকে সামনে বসেই রইলেন। তারপর হঠাৎ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, প্রোফেসার সাব, কিছু হদিস পেলেন?

কাকাবাবু বললেন, কী পাব?

যা খুঁজছেন এতদিন ধরে?

কাকাবাবু অপলকভাবে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সূচা সিং-এর দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, না, কিছুই পাইনি। বোধহয় কিছু বোধহয় পাওয়া যাবেও না।

তাহলে আর খোঁড়া পা নিয়ে এত তাকলিফ করছেন কেন?

তবু খুঁজছি, কারণ খোঁজাটাই আমার নেশা।

আপনারা বাঙালিরা বড় অদ্ভুত। আপনি যা খুঁজছেন, সেটা খুঁজে পেলে তা তো গভর্নমেন্টেরই লাভ হবে। আপনার তো কিছু হবে না। তাহলে আপনি গভর্নমেন্টের সাহায্য নিচ্ছেন না কেন? গভর্নমেণ্টকে বলুন, লোক দেবে, গাড়ি দেবে, সব ব্যবস্থা করবে–আপনি শুধু খবরদারি করবেন।

কাকাবাবু হেসে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়লেন সূচা সিং-এর দিকে। তারপর বললেন, এটা আমার খেয়াল ছাড়া আর কিছু তো নয়! গভর্নমেন্ট সব ব্যবস্থা করবে, তারপর যদি কিছুই না পাওয়া যায়, তখন সেটা একটা লজ্জার ব্যাপার হবে না?

লজ্জা কী আছে, গভর্নমেন্টের তো কত টাকারই শ্ৰাদ্ধ হচ্ছে; কম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ডাল!

কাকাবাবু আবার হেসে বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন সিংজী! বাঙালিরা ভারি অদ্ভুত। তারা নিজেদের ভাল মন্দ বোঝে না।

সূচা সিং বললেন, আপনাকে দেখেই বুঝেছি, আপনি ভাল আদমি, কিন্তু একদম চালাক নন।

একটা কথা আগে বলা হয়নি, কাকাবাবু কাশ্মীরে এসেছেন গন্ধকের খনি খুঁজতে। কাকাবাবুর ধারণা, কাশ্মীরের পাহাড়ের নীচে কোথাও প্রচুর গন্ধক জমা আছে। কাশ্মীর সরকারকে জানিয়েছেন সে কথা। সরকারকে না জানিয়ে তো কেউ আর পাহাড় পর্বত মাপামাপি করতে পারে না-বিশেষত কাশ্মীরের মতন সীমান্ত এলাকায়। আমি আর কাকাবাবু তাই গন্ধকের খনি আবিষ্কার করার কাজ করছি।

সূচা সিং বললেন, প্রোফেসারসাব, ওসব গন্ধক-টন্ধক ছাড়ুন। আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এখানে পাহাড়ের নীচে সোনার খনি আছে। সেটা যদি খুঁজে বার করতে পারেন

কাকাবাবু খানিকটা নকল আগ্ৰহ দেখিয়ে বললেন, আপনি জানেন, এখানে সোনা পাওয়া যাবে?

ডেফিনিটলি। আমি খুব ভালভাবে জানি।

আপনি যখন জানেনই যে এখানে সোনা আছে, তাহলে আপনিই সেটা আবিষ্কার করে ফেলুন না।

আমার যে আপনাদের মতন বিদ্যে নেই। ওসব খুঁজে বার করা আপনাদের কাজ। আমি তো শুনেছি, টাটা কম্পানির যে এত বড় ইস্পাতের কারখানা, সেই ইস্পাতের খনি তো একজন বাঙালিই আবিষ্কার করেছিল?

কাকাবাবু চুরুটের ছাই ফেলতে ফেলতে বললেন, কিন্তু সিংজী, সোনার খনি খুঁজে পেলেও আপনার কী লাভ হবে! সোনার খনির মালিকানা গভর্নমেন্টের হয়। গভর্নমেন্ট নিয়ে নেবে।

সূচা সিং উৎসাহের চোটে টেবিলে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, নিক না। গভর্নমেন্ট! তার আগে আমরাও যদি কিছু নিতে পারি! আমি আপনাকে সাহায্য করব। এখানে মুস্তফা বশীর খান বলে একজন বুড়ো আছে, খুব ইমানন্দার লোক। সে আমাকে বলেছে, মার্তিণ্ডের কাছে তার ঠাকুদা পাহাড় খুঁড়ে সোনা পেয়েছিল।

আপনিও সেখানে পাহাড় খুঁড়তে লেগে যান।

আরো শুনুন, শুনুন, প্রোফেসারসাব–

কাকাবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন, ওঠ সন্তু। আমাদের বাসের সময় হয়ে এসেছে! তোর খাওয়া হয়েছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ। একটু জল খাব।

খেয়ে নে। ফ্লাস্কে জল ভরে নিয়েছিস তো? তারপর কাকাবাবু সূচা সিং-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি ধারণা, মাটির তলায় আস্ত আস্ত সোনার চাই পাওয়া যায়? পাথরের মধ্যে সোনা পাওয়া গেলেও তা গালিয়ে বার করা একটা বিরাট ব্যাপার। তাছাড়া সাধারণ লোক ভাবে সোনাই সবচেয়ে দামি জিনিস। কিন্তু তুমি ব্যবসা করো-তোমার তো বোঝা উচিত, অনেক জিনিসের দাম সোনার চেয়েও বেশি-যেমন ধরে কেউ যদি একটা পেট্রোলের খনির সন্ধান পেয়ে যায়-সেটার দাম সোনার খুনির চেয়েও কম হবে না। তেমনি, গন্ধক শুনে হেলাফেলা করছি, কিন্তু সত্যি সত্যি যদি প্রচুর পরিমাণে সালফার ডিপোজিটর খোঁজ পাওয়া যায়—

সে তো হল গিয়ে যদি-র কথা। যদি গন্ধক থাকে। কিন্তু আমি আপনাকে বলছি, কাশ্মীরে সোনা আছেই!

তাহলে তুমি খুঁজতে লেগে যাও! আয় সন্তু—

সূচা সিং হঠাৎ খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, কী খোকাবাবু, কোনদিকে যাবে আজ?

সূচা সিং-এর বিরাট হাতখানা যেন বাঘের থাবা, তার মধ্যে আমার ছোট্ট হাতটা কোথায় মিলিয়ে গেছে। আমি উত্তর না দিয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকলাম। কাকাবাবু বললেন, আজ আমরা দূরে কোথাও যাব না, কাছাকাছিই ঘুরব।

সূচা সিং আমাকে আদর করার ভঙ্গি করে বললেন, খোকাবাবুকে নিয়ে একদিন আমি বেড়িয়ে আনব। কী খোকাবাবু, কাশ্মীরের কোন কোন জায়গা দেখা হল? আজ যাবে আমার সঙ্গে? একদম শ্ৰীনগর ঘুরিয়ে নিয়ে আসব?

শ্ৰীনগরের নাম শুনে আমার একটু একটু লোভ হচ্ছিল, তবু আমি বললাম,  না।

সূচা সিং-এর হাত ছাড়িয়ে আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। সূচা সিং-ও এলেন পেছনে পেছনে। আমরা তখন বাস স্ট্যান্ডের দিকে না গিয়ে হটিতে লাগলাম। অন্যদিকে।

কাকাবাবু সূচা সিংকে মিথ্যে কথা বলেছেন। আমরা যে আজ সোনমার্গে যাব, তা তো সকাল থেকেই ঠিক আছে। কাকাবাবু সূচা সিংকে বললেন না সে কথা। গুরুজনরা যে কখনও মিথ্যে কথা বলেন না, তা মোটেই ঠিক নয়, মাঝে মাঝে বলেন। যেমন, আর একটা কথা, কাকাবাবু অনেককে বলেছেন বটে যে তিনি এখানে গন্ধকের খনি আবিষ্কার করতে এসেছেন-কিন্তু আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। কাকাবাবু হয়তো ভেবেছেন, ছেলেমানুষ বলে আমি সব কিছু বিশ্বাস করব। কিন্তু আমি তো ততটা ছেলেমানুষ নই। আমি এখন ইংরিজি গল্পের বইও পড়তে পারি। কাকাবাবু অন্য কিছু খুঁজছেন। সেটা যে কী তা অবশ্য আমি জানি না। সূচা সিংও কাকাবাবুকে ঠিক বিশ্বাস করেননি। সূচা সিং-এর সরকারি মহলের অনেকের সঙ্গে জানাশোনা, সেখান থেকে কিছু শুনেই বোধহয় সূচা সিং সুযোগ পেলেই কাকাবাবুর সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করেন। সূচা সিং-এর কি ধারণা, কাকাবাবু গন্ধকের নাম করে আসলে সোনার খনিরই খোঁজ করছেন? আমরা কি সত্যিই সোনার সন্ধানে ঘুরছি?

সূচা সিং-এর দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা চলে এসেছি খানিকটা দূরে। রোদ উঠেছে। বেশ, পথে এখন অনেক বেশি মানুষ। আজ শীতটা একটু বেশি পড়েছে। আজ সুন্দর বেড়াবার দিন।

বাসের এখনও বেশ খানিকটা দেরি আছে। সূচা সিং-এর জন্য আমরা রাস ডিপোতে যেতেও পারছি না। আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলাম উদ্দেশ্যহীন ভাবে। কাকাবাবু আপনমনে চুরুট টেনে যাচ্ছেন। আমি একটা পাথরের টুকরোকে ফুটবল বানিয়ে সুট্‌ দিচ্ছিলাম—-

হঠাৎ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, আরেঃ, স্নিগ্ধাদি যাচ্ছে না? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তো, স্নিগ্ধাদি, সিদ্ধাৰ্থদা, রিণি-

জিজ্ঞেস করলেন, কে ওরা?

উত্তর না দিয়ে আমি চিৎকার করে ডাকলাম, এই স্নিগ্ধাদি!

এক ডাকেই শুনতে পেল। ওরাও আমাকে দেখে অবাক। এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। আমি কাকাবাবুকে বললাম— কাকাবাবু, তুমি ছোড়দির বন্ধু স্নিগ্ধাদিকে দেখোনি?

উৎসাহে আমার মুখ জ্বলজ্বল করছে। এতে দূরে হঠাৎ কোনও চেনা মানুষকে দেখলে কী আনন্দই যে লাগে। কলকাতায় থাকতেই অনেকদিন গিন্ধাদিদের সঙ্গে দেখা হয়নি।আর আজ হঠাৎ এই কাশ্মীরে! বিশ্বাসই হয় না! কাকাবাবু কিন্তু খুব একটা উৎসাহিত হলেন না। আড়চোখে ঘড়িতে সময় দেখলেন।

স্নিগ্ধাদি আমার ছোড়দির ছেলেবেলা থেকে বন্ধু। কতদিন এসেছে আমাদের বাড়িতে। ছোড়াদির বিয়ে হবার ঠিক এক মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল স্নিগ্ধাদির। স্নিগ্ধাদির বিয়েতে আমি ধুতি পরে গিয়েছিলাম। আমার জীবনে সেই প্রথম ধুতি পরা। সিদ্ধাৰ্থদাকেও আমরা আগে থেকে চিনি, ছোড়দিদের কলেজের প্রফেসার ছিলেন, আমাদের পাড়ার ফাংশনে রবীন্দ্ৰনাথের আফ্রিকা কবিতাটা আবৃত্তি করেছিলেন। স্নিগ্ধাদির সঙ্গে সিদ্ধাৰ্থদার বিয়ে হবার পর একটা মুস্কিল হল। স্নিগ্ধাদিকে স্নিগ্ধা বৌদি বলে ডাকতে হয়, কিংবা সিদ্ধাৰ্থদাকে জামাইবাবু। আমি কিন্তু তা পারি না। এখনও সিদ্ধাৰ্থদা-ই বলি! আর রিণি হচ্ছে স্নিগ্ধাদির বোন আমারই সমান, ক্লাস এইট-এ পড়ে। পড়াশুনোয় এমনিতে ভালই, কিন্তু অঙ্কে খুব কাঁচা। কঠিন অ্যালজেব্ৰা তো পারেই না, জিওমেট্রি এত সোজা-তাও পারে না। তবে রিণি বেশ ভাল ছবি আঁকে।

স্নিগ্ধাদি কাছে এসে এক মুখ হেসে বললেন, কী রে সন্তু, তোরা কবে এলি, আর কে এসেছে? মাসীমা আসেননি? বনানীও আসেনি?

আমি বললাম, ওঁরা কেউ আসেনি। আমি কাকাবাবুর সঙ্গে এসেছি।

কাকাবাবুর কথা শুনে ওরা তিনজনেই পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করল। কাকাবাবুকে। চাকরি থেকে রিটায়ার করার আগে কাকাবাবু তো দিল্লিতেই থাকতেন বেশির ভাগ–তাই স্নিগ্ধাদি দেখেননি আগে।

সিদ্ধাৰ্থদা কাকাবাবুকে বললেন, আমি আপনার নাম অনেক শুনেছি। আপনি তো আরকিওলজিক্যাল সারভে-তে ডাইরেকটর ছিলেন? আমার এক মামার সঙ্গে আপনার-

কাকাবাবুর কথাবার্তা বলার যেন কোনও উৎসোহই নেই। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করো?

সিদ্ধার্থদা বললেন, আমি কলকাতায় একটা কলেজে ইতিহাস পড়াই।

কাকাবাবু সিদ্ধার্থদার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ইতিহাস পড়াও? তোমার সাবজেক্ট কী ছিল? ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি?

সিদ্ধাৰ্থদা বিনীতভাবে বললেন, হ্যাঁ। আমি বৌদ্ধ আমল নিয়ে কিছু রিসার্চ করেছি।

কাকাবাবু বললেন, ও, বেশ ভাল। আচ্ছা, তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই লাগল। এবার আমাদের যেতে হবে। চল সন্তু-

সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, আপনারা কোনদিকে যাবেন? চলুন না, এক সঙ্গেই যাওয়া যাক।

আমি অধীর আগ্রহে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকালাম। কাকাবাবু যদি রাজী হয়ে যান, তাহলে কী ভালই যে হয়! রোজই তো পাথর মাপামাপি করি, আজ একটা দিন যদি সবাই মিলে বেড়ানো যায়! তা ছাড়া, হঠাৎ স্নিগ্ধাদিদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

কাকাবাবু একটু ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বললেন, নাঃ, তোমরাই ঘুরে টুরে দ্যাখো। পহলগ্ৰাম বেশ ভাল জায়গা। আমরা অন্য জায়গায় যাব, আমাদের কাজ আছে।

সিদ্ধাৰ্থদা বললেন, তা হলে সন্তু থাক আমাদের সঙ্গে!

সিন্ধাদি বললেন, সন্তু, তুই তো এখানে কয়েকদিন ধরে আছিস। তুই তা হলে আমাদের গাইড হয়ে ঘুরে টুরে দ্যাখা। আমরা তো উঠেছি। শ্ৰীনগরে, এখানে একদিন থাকব-

আমি উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, স্নিগ্ধাদি, শ্ৰীনগর কী রকম জায়গা?

স্নিগ্ধাদি বললেন, কী চমৎকার, তোকে কি বলব। এত ফুল, আর আপেল কী শস্তা? তোরা এখনও যাসনি ওদিকে?

না!

এত সুন্দর যে মনে হয়, ওখানেই সারা জীবন থেকে যাই।

আমি একটু অহংকারের সঙ্গে বললাম, পহলগ্ৰামও শ্ৰীনগরের চেয়ে মোটেই খারাপ নয়। এখানে কাছাকাছি আরও কত ভাল জায়গা আছে!

রিণি বলল, এই সন্তু, তুই একটু রোগ হয়ে গেছিস কেন রে? অসুখ করেছিল?

আমি বললাম, না তো!

তা হলে তোর মুখটা শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

ভ্যাট! মোটেই না।

নদীটার দিকে আঙুল দেখিয়ে রিণি জিজ্ঞেস করল, এই নদীটার নাম কি রে?

আমি বললাম, এটার নাম হচ্ছে লীদার নদী। আগেকার দিনে এর সংস্কৃত নাম ছিল লম্বোদরী। লম্বোদরী থেকেই লোকের মুখে মুখে লীদার হয়ে গেছে। আবার অমরনাথের রাস্তায় এই নদীটিাকেই বলে নীল গঙ্গা।

স্নিগ্ধাদি হাসতে হাসতে বললেন, সন্তুটা কী রকম বিজ্ঞের মতন কথা বলছে! ঠিক পাকা গাইডদের মতন…

আমি বললাম, বাঃ, আমরা তো এখানে দুঃ সপ্তাহ ধরে আছি। সব চিনে গেছি। আমি এক একা তোমাদের সব জায়গায় নিয়ে যেতে পারি।

কাকাবাবু আবার ঘড়ি দেখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, তুমি কি তাহলে এদের সঙ্গে থাকবে? তাই থাকো না হয়-

আমি চমকে কাকাবাবুর দিকে তাকলাম। কাকাবাবুর গলার আওয়াজটা যেন একটু অন্য রকম। হঠাৎ আমার বুকের মধ্যে একটা কান্নাকান্না ভাব এসে গেল। কাকাবাবু নিশ্চয়ই আমার ওপরে অভিমান করেছেন। তাই আমাকে থাকতে বললেন। আমি তো জানি, খোঁড়া পা নিয়ে কাকাবাবু একলা একলা কোনও কাজই করতে পারবেন না। সাহায্যও নেবেন না। অন্য কারুর।

আমি বললাম, কাকাবাবু, আমি তোমার সঙ্গেই যাব।

কাকাবাবু তবু বললেন, না, তুমি থাকো না। আজ একটু বেড়াও ওদের সঙ্গে। আমি একলাই ঘুরে আসি।

আমি জোর দিয়ে বললাম, না, আমি তোমার সঙ্গেই যাব।

কাকাবাবুর মুখখানা পরিষ্কার হয়ে গেল। বললেন, চলো তাহলে। আর দেরি করা যায় না।

আমি সিদ্ধাৰ্থদাকে বললাম, আপনারা এখানে কয়েকদিন থাকুন না। আমরা তো আজ সন্ধেবেলাতেই ফিরে আসছি।

সিদ্ধার্থদা বললেন, আমরা কাল সকালবেলা অমরনাথের দিকে যাব—

সেই অমরনাথ মন্দির পর্যন্ত যাবেন? সে তো অনেকদিন লাগবে!

স্নিগ্ধাদি বললেন, ঐ রাস্তায় যাব, যতটা যাওয়া যায়-খুব বেশি কষ্ট হলে যাব না বেশিদূর। ফিরে এসে তোদের সঙ্গে দেখা হবে। তোরা কি এখানেই থাকছিস?

সিদ্ধাৰ্থদা কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা এখানে কতদিন থাকবেন?

কাকাবাবু বললেন, ঠিক নেই।

বাস এসে গেছে। আমি আর কাকাবাবু বাসে উঠে পড়লাম। চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে দেখলাম, সিদ্ধাৰ্থদা, স্নিগ্ধাদি আর রিণি হেঁটে যাচ্ছে লীদার নদীর দিকে। রিণি তরতরিয়ে এগিয়ে গিয়ে নদীটিার জলে পা ডোবাল।