বিছানায় শুয়ে সুদীপের ঘুম কিন্তু আসে না। অন্ধকারে বালিশে মাথা রেখে সামনের খোলা জানালাটার দিকে চেয়ে থাকে।
সব টাকাটাই অবিশ্যি সে নগদ এখুনি দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাহলে টাকাটার সোর্স নিয়ে গোলমাল বাধবে। ব্যাঙ্কে মাত্র হাজার তিনেক আছে আর ফিক্সড ডিপোজিটে আছে হাজার পাঁচেক হিসাবে মিলাতে পারবে না; বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আর কত সে ধার পেতে পারে, বড়জোর হাজার দু-তিন। অথচ তার অফিসের ড্রয়ারের মধ্যে করকরে চল্লিশ হাজার টাকার নোট রয়েছে। ওই চল্লিশ আর ফিক্সড ডিপোজিটের পাঁচ ব্যাঙ্কের তিন—মাত্র হাজার দুই টাকা বেশী-সে তো অফিস থেকেই লোন পেতে পারে।
কিন্তু হিসাব মেলাতে পারবে না। চল্লিশ হাজার টাকা ধার দেবে কে তাকে? মাত্র তো তিনশো টাকা মাসমাহিনা তার।
না। রমা ঠিকই বলেছে। ফ্ল্যাট কেনার এখন দরকার নেই। ওই সময় আবার মনে পড়লো বিজিত মিত্রর কথা।
কাল একবার অফিসের পর বিজিতের অ্যাডভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করবে। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই যেন বুকের মধ্যে কেমন দুপদুপ করতে থাকে।
সুদীপ শুনেছে ক্রিমিন্যাল সাইডের একজন বাঘা অ্যাডভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ী।
চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে দিয়ে লোকটা যখন তাকায় মনে হয় যেন অপর পক্ষের পেট থেকে কথা টেনে বের করবেন। রোমশ জোড়া ভ্র। বয়েস প্রায় এখন সত্তরের কাছাকাছি। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছে।
বেঁটে-খাটো মানুষটা। কথা বলার সময় ডান হাতে ধরা পেনসিলটা দু আঙুলের সাহায্যে মধ্যে মধ্যে নাচান। ভরাট ভারী গলা।
কথা বললে মনে হয় যেন একটা জালার ভিতর থেকে কথাগুলো গম গম করে বের হয়ে আসছে।
সুদীপের সাক্ষ্য দেবার কথাটা বলতে শুনে মানুষটা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো যেন সুদীপ কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে।
আপনি সাক্ষ্য দেবেন?
আজ্ঞে। মানে-হঠাৎ যেন তোতলাতে শুরু করেছিল সুদীপ সেদিন।
কি নাম আপনার বললেন যেন! রোমশ ভ্র-যুগলের নীচে চশমার পুরু লেন্সের ওধার থেকে তাকালেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
সুদীপ রায়।
নিহত তপন ঘোষকে আপনি চিনতেন? প্রশ্ন এলো যেন তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত বিদ্ধ করলো সুদীপকে।
না। তবে আসামী বিজিত মিত্রকে চিনি।
চেনেন? কতদিনের পরিচয় আপনাদের?
তা বলতে পারেন অনেক দিনের। বিজিত তপন ঘোষকে মারেনি। মানে হত্যা করেনি।
হত্যা করেনি?
না। আমার সব কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন স্যার—ব্যাপারটা সব সাজানো বলেই আমার মনে হয়।
বলতে চান কনককটেড?
হ্যাঁ, মানে—
কি রকম।
সুদীপ তখন আদালতে যা পরে বলেছিল সেই কথাগুলো সোমনাথ ভাদুড়ীকে বলল। মন দিয়ে সুদীপের সব কথা শুনলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
হুঁ। তা এসব কথা আগে পুলিসকে জানাননি কেন?
ভয়ে।
কি বললেন? ভয়ে?
হ্যাঁ–বুঝতেই তো পারছেন খুনের মামলা। এই সব মামলায় কে সেধে জড়িয়ে পড়তে চায় বলুন, স্যার।
তবে আজকেই বা বলতে চান কেন?
একজন নির্দোষীর ফাঁসি হবে–
রোমশ ভ্রর তলায় পুরু লেন্সের ওধার থেকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অতঃপর সোমনাথ ভাদুড়ী সুদীপের মুখের দিকে।
সুদীপের ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল সেই দৃষ্টির মধ্যে যেন সন্দেহ-অবিশ্বাস তার আপাদ-মস্তককে জরীপ করে চলেছে।
পাবলিক প্রসিকিউটার অম্বিকা সান্যাল-তার জেরার মুখে দাঁড়াতে পারবেন তো? তিনি আপনাকে পোস্টমর্টেম করবেন। বাঘা বাঘা সাক্ষীও তার জেরার মুখে নার্ভ হারায়।
যা সত্যি তা বলবোভয় পাবো কেন, আপনিই বলুন না স্যার।
ঠিক আছে, আদালতে একটা এফিডেবিট করতে হবে। যা করবার আমিই করবো। আপনার ঠিকানাটা রেখে যান। সময়মত সমন পাবেন।
সমন!
হ্যাঁ, সাক্ষীর সমন যাবে আদালত থেকে আপনার ঠিকানাটা বলুন।
সুদীপ তার অফিসের ঠিকানাই দিয়ে এসেছিল।
চলে আসবার আগে সোেমনাথ আবার শুধিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবেন না তো?
না, না।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান সুদীপ রায়কে সরকারপক্ষের কৌসুলী অম্বিকা সান্যাল রীতিমত প্রশ্নে প্রশ্নে পর্যদস্ত করেছিলেন।
অম্বিকা সান্যাল প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন, বিজিত মিত্র আসামীর মাথায় পশ্চাৎ দিক ঘেঁষে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান আর আপনি ছুটে পালান?
হ্যাঁ।
ছুটে কত দূরে পালিয়েছিলেন?
সামনেই একটা গলির মধ্যে।
সেটা ঘটনাস্থল থেকে কত দূরে?
হাত আট-দশ হবে সেই গলি থেকেই আত্মগোপন করে দেখি ব্যাপারটা পরে ওরা বিজিতকে একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়।
অত রাত্রে আপনারা কোথা থেকে ফিরছিলেন? আপনি আগে বলেছেন রাত তখন দুটো হবে।
অফিসের ইয়ার-এনডিংয়ের সময় অনেক রাত পর্যন্ত তখন কাজ করতে হতো আমাদের কাজ সারতে সারতে প্রায় দেড়টা হয়ে যায়—ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি তখন কিছুই ছিল না; তাই হেঁটে ফিরছিলাম দুজনে।
আপনি জানেন কি তপন ঘোষের সঙ্গে বিজিত মিত্র চোরাকারবারে লিপ্ত ছিল?
না।
আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে। আপনারা এক অফিসে একই ডিপার্টমেন্টে এতদিন কাজ করছেন, এত পরিচয় ছিল তার সঙ্গে আপনার, অথচ ওই কথাটা জানতেন না? জানতেন—সবই জানতেন—প্রকাশ করেননি কখনো।
ওই সময় সোমনাথ ভাদুড়ী বলে উঠেছিলেন, অবজেকশন, ইয়োর অনার।
জজ সাহেব কিন্তু অবজেকশন নাকচ করে বলেছিলেন, প্রসিড মিঃ সান্যাল।
তারপরই প্রশ্ন করেছিলেন অম্বিকা সান্যাল, যে পথ দিয়ে অত রাত্রে ফিরছিলেন সেদিন আপনারা দুই বন্ধু—নিশ্চয়ই জানতেন তার কাছাকাছি একটা কুখ্যাত পল্লী এবং সেখানে মৃণাল নামে বারবনিতা থাকতো। সেখানে বিজিতবাবুর রীতিমত যাওয়া-আসা ছিল।
না, আমি জানতাম না।
জানতেন না?
না।
ওই পথ দিয়ে আপনি আগে আর কখনো যাতায়াত করেছেন?
ঠিক মনে করতে পারছি না! বোধ হয় আগে কখনও যাইনি।
ওই রাত্রেই প্রথম তাহলে?
বলতে পারেন তাই। বিজিতবাবু বলেছিল ওই পথটা শর্টকাট হবে শেয়ালদহে যেতে, তাই ওই পথে যাচ্ছিলাম।
অত রাত্রে তাহলে ঠিক ঠিক ভাবে রাস্তার নামটা বললেন কি করে যদি ওই পথে কখনো আগে না গিয়ে থাকেন?,
বিজিত বলেছিল।
তা অত রাত্রে শেয়ালদহের দিকে যাচ্ছিলেন কেন?
মধ্যে মধ্যে ফিরতে বেশী রাত হলে ট্রেন থাকত না। ট্রেনের লাইন ধরে আমি হেঁটে চলে যেতুম বাড়ি। তাই–
কিন্তু বিজিতবাবু বাগবাজারে থাকতেন। তিনি ওই পথে যাচ্ছিলেন কেন?
আমাকে শেয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।
আসলে সোমনাথ ভাদুড়ী বেশ করে তালিম দিয়েছিলেন সুদীপকে কয়েক দিন-নচেৎ সুদীপ নিঃসন্দেহে গোলমাল করে বসত জেরার মুখে।
বিজিতের সঠিক সংবাদ পেতে হলে তাকে একবার ওই সোমনাথ ভাদুড়ীর কাছেই যেতে হবে। একবার জানা দরকার কোর্টের রায় বের হয়েছে কিনা—আর না বের হলে কবে বেরুবে বা বেরুতে পারে জানা প্রয়োজন।
মৃণালের কথাও মনে পড়ে ঐ সঙ্গে সুদীপের। মৃণালের ঘরে যে বিজিতের যাতায়াত ছিল সেটা সুদীপ জানত। একদিন সেও গিয়েছিল মৃণালের ঘরেই বিজিতের সঙ্গেই। মৃণালকে সেও চিনত। অবিশ্যি কথাটা সে বরাবর চেপে গিয়েছে জটিলতা এড়াবার জন্যই। বস্তুত আদালতে গিয়ে বিজিতের হয়ে সাক্ষ্য দেবার কথা কখনো তার মনেও হয়নি। মামলায় জড়িয়ে পড়বার ভয়ে আদালতের ধার-কাছ দিয়েও প্রথমটা সে যায়নি।
নাঃ, ঘুম বোধ হয় আজ আর আসবে না।
সুদীপ শয্যার উপর উঠে বসল।
কপালের পাশে শিরা দুটো দপ দপ করছে।
পাশের ছোট টুলটার উপর থেকে সিগ্রেটের প্যাকেটটা ও লাইটারটা তুলে নিল সুদীপ। প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট বের করে লাইটারের সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করল।
সিগ্রেট টানতে টানতে সুদীপের মনের মধ্যে নানা কথা আনাগোনা করতে থাকে। আদালতে হলফ করে বলে এসেছে যে তপন ঘোেষকে সে চিনত না।
কথাটার সত্য-মিথ্যা আজ আর অবিশ্যি প্রমাণিত হবার কোন আশা নেই।
তপন ঘোষ আজ মৃত। পোস্টমর্টেমের পর তার মৃতদেহটা কেওড়াতলায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
রাত হয়ে গিয়েছিল মৃতদেহটা শ্মশানে নিয়ে যেতে। তপনের পাড়াপ্রতিবেশীরাই মৃতদেহটা শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে গিয়েছিল।
সন্ধ্যা থেকে সেদিন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছিল, প্রবল বৃষ্টি। কেউ জানে না, সুদীপ সর্বাঙ্গে একটা চাদর জড়িয়ে শ্মশানে গিয়েছিল—বাইরে একটা গাছের নীচে অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল। কেউ তাকে দেখতে পায়নি।
হঠাৎ কে একজন তার পাশে এসে দাঁড়াল। একটি স্ত্রীলোক, মাথায় দীর্ঘ গুণ্ঠন। প্রথমটায় সে জানতে পারেনি তার উপস্থিতি। জানতে পেরে কথা বলবার চেষ্টা করতেই স্ত্রীলোকটি সরে গিয়েছিল।
চকিতে যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পরে ব্যাপারটা নিয়ে সুদীপ কোনরকম মাথা ঘামায়নি।
সুদীপ সিগ্রেট টানতে টানতে সেই রাত্রের কথাটাই ভাবতে থাকে।
পরের দিন অফিস-ফেরতা সুদীপ সোমনাথ ভাদুড়ীর ওখানে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বিরাট টেবিলটার উপর একরাশ কাগজপত্র ও মোটা মোটা আইনের বই ছড়ানো। ঠিক তার উল্টোদিকে একটা চেয়ারে বসে ছিল আর একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি। চশমার আড়াল থেকে বুদ্ধিদীপ্ত অনুসন্ধানী চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর বিদ্ধ করে।
মাথার চুলে বেশ পাক ধরেছে। মুখে একটা জ্বলন্ত সিগার। পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি, গায়ে একটা শাল জড়ানো। দুজনে মধ্যে মধ্যে কথা বলছিল।
ভৃত্য এসে ঘরে ঢুকলো, বাবু—
কি?
একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।
কোথা থেকে আসছেন–কি নাম?
নাম বললেন সুদীপ রায়।
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সোমনাথ ভাদুড়ীর চোখের দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বললেন, যা, পাঠিয়ে দে।
এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুদীপ এসে ঘরে ঢুকল।
আসুন-বসুন। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।
স্যার, একটা সংবাদ নিতে এসেছিলাম।
কি সংবাদ?
বিজিতের মামলার রায় কি—
আজই বের হয়েছে রায়। বেকসুর খালাস পেয়েছেন আপনার বন্ধু।
পেয়েছে?
হ্যাঁ।
সুদীপবাবু!
বলুন।
বিজিতবাবু যে অপরাধী আমি জানতাম—হঠাৎ বললেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
আজ্ঞে? থতমত খেয়ে যায় সুদীপ।
আপনি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে।
না, না। আমি—
আপনার স্টোরিটা আগাগোড়াই কনককটেড। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন সব বুঝেও আপনাকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ালাম কেন, তাই না?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তখন সুদীপ সোমনাথ ভাদুড়ীর মুখের দিকে। বোবা, অসহায় দৃষ্টি।
আপনি বলেছেন তপন ঘোষকে আপনি চিনতেন না। বাট আই অ্যাম শিয়োর, আপনি তাকে চিনতেন; ভাল করেই চিনতেন।
সুদীপ বোবা।
আপনাকে আমি তবু সব জেনেশুনেও কেন আদালতে সাক্ষী দেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম জানেন? নট ফর ইউ। একটি নিরাপরাধিনী মেয়ে আমাকে বাবা বলে আমার পায়ের উপর কেঁদে পড়ে তার স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে বলেছিল বলে-শুধু সেই মেয়েটির জন্যই। যান—আর কখনো আমার ঘরের দরজা মাড়াবেন না—যান–
সুদীপ উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
বুকটার মধ্যে তখন তার যেন হিম হয়ে গিয়েছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ।
যান।
সুদীপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ সোমনাথ, ভাদুড়ী। তারপর এক সময় ফিরে তাকালেন সোমনাথ ভাদুড়ী তার সামনে উপবিষ্ট ভদ্রলোকটির দিকে এবং বললেন, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন রায় মশাই, এই সেই লোক যার মিথ্যা সাক্ষ্যের জোরে শেষ পর্যন্ত মেয়েটির স্বামীকে আমি কঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে পেরেছি—নচেৎ আইন তাকে এমনভাবে কোণঠাসা করেছিল যে আমিও প্রায় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিই যদি জানতে পারতাম–
কে সে রাত্রে তপন ঘোষকে হত্যা করেছিল সেটাই তো? কিরীটী বলল।
হ্যাঁ রায় মশাই।
আপনার কি মনে হয় বলুন আগে শুনি। আপনি নিশ্চয়ই একটা কিছু ভেবেছেন— কিরীটী বলল।
আমার মনে হয়—
বলুন।
সে-রাত্রে তপন ঘোষকে কে হত্যা করেছিল সম্ভবত সেটা ওই সুদীপ জানে।
কেন কথাটা মনে হলো আপনার মিঃ ভাদুড়ী? কিরীটী বলল।
দেখুন রায় মশাই, সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন, জীবনের অনেকগুলো বছর এই ক্রিমিন্যালদের নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছি। ক্রিমিন্যালদের চরিত্রের নানাদিক দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছে—অনেক ক্রিমিন্যালকে আদালতে জেরা করে আইনের মারপ্যাচে জেলখানা ও ফাঁসির দড়ি থেকেও বাঁচিয়ে দিয়েছি। মিথ্যা বলব না, তাতে করে এক ধরনের ভ্যানিটিরও আস্বাদ হয়ত পেয়েছি অনেক সময়। কিন্তু–
কি? সহাস্যে কিরীটী তাকাল সোমনাথ ভাদুড়ীর দিকে প্রশ্নটা করে।
মানুষের বিবেক বলে যে বস্তুটি মনের মধ্যে আছে, তার কাছে আমাকে জবাবদিহি দিতে হয়েছে। কিন্তু এই কেসটা যেন অন্য ধরনের। বিজিত মিত্র যে নিরপরাধ, মনে মনে। কথাটা আমি হয়ত বিশ্বাস করেছিলাম—কিন্তু কেসের প্রমাণাদি তাকে এমনি কোণঠাসা করে দিয়েছিল যে আমি যেন আমার সামনে কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আইনের সাহায্যে কোন্ পথ ধরে লোকটাকে মুক্ত করে আনতে পারি, ওই সঙ্গে বিজিত মিত্রের স্ত্রীর চোখের জল আর কাকুতি আমাকে যেন অস্থির করে তুলেছিল। এমন সময় ওই স্কাউনড্রেলটা এলোবাধ্য হয়েই কতকটা ওকে আমি গ্রহণ করলাম বিজিত মিত্রকে বাঁচাবার জন্যই। কিন্তু মনের কাছে কিছুতেই যেন সহজ হতে পারলাম না।
ভাদুড়ী মশাই, কিরীটী বললে, সব সময়ই আমাদের মন কি সত্য কথা বলে! এমনও তো হতে পারে আপনি যা ভাবছেন তা সত্য নয়। সত্য হয়ত বিজিত মিত্র হত্যাকারী নয়।
কিন্তু কিরীটী বলতে লাগল, ওই সুদীপ রায় লোকটি সত্যিই তার বন্ধুকে বাঁচাবার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ফাঁসির দড়ি থেকে?
ভেবেছি, আমি অনেক ভেবেছি কথাটা রায় মশাই-কিন্তু তবু আপনি যা বলছেন সেটা মেনে নিতে যেন পারিনি।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ঠিক আছে। যদিও অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে, আমাদের একটিবার চেষ্টা করে দেখতে কোন ক্ষতি নেই। মামলার সমস্ত রিপোর্টই তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে আছে।
হ্যাঁ আছে—সম্পূর্ণ মামলার নথিটা আমি একটা ফাইল করে রেখেছি আপনার এখানে আসবার পূর্বে। এই সেই নথি—বলে একটা বিরাট ফাইল এগিয়ে দিলেন সোমনাথ ভাদুড়ী কিরীটীর দিকে।
কিরীটী হাত বাড়িয়ে ফাইলটা টেনে নিল।
ভাদুড়ী আবার বললেন, আমি জানি ওই ফাইলটা খুঁটিয়ে পড়লেই হয়ত আসল সত্যটা আপনার দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
কিরীটী বললে, রাত হলো, তাহলে উঠি ভাদুড়ী মশাই।
উঠবেন?
হ্যাঁ।
কিরীটী উঠে দাঁড়াল।—একপক্ষে ভালই হলো। ঘটনাচক্রে লোকটিও আজ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তবে এটুকু অস্পষ্ট নেই আমার কাছে যে, বিজিত মিত্র ছাড়া পেল কিনা কেবল সে কথাটুকু আপনার মুখ থেকে শোেনবার জন্যই আজ লোকটি এখানে আসেনি।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ মামলার রায় যে এখনো বের হয়নি সেটা অনুমান করতে পেরেছিল, আর রায় বেরুলে সেটাও সে খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ থেকেই একদিন-না-একদিন জানতে পারত। লোকটা কেন এসেছিল জানেন ভাদুড়ী মশাই?।
কেন?
আপনি নিজে তার সাক্ষ্যদানের ব্যাপারটা কি ভাবে নিয়েছেন সেটাই জানবার জন্য।
সত্যি বলছেন?
মনে তো হয় তাই। আচ্ছা চলি—
কিরীটী গাড়িতে উঠে বসল। সর্দারজী গাড়ি ছেড়ে দিল।
সোমনাথ ভাদুড়ী কিন্তু আরো কিছুক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই রইলেন।