সাহার গৃহে রেবেকা কেবল সেক্রেটারীই নয়, বাড়ির কেয়ারটেকার হিসাবেও ছিল। আর ছিল একজন, সাধন মিত্র।
সাধন ছিল সাহার অফিসে তাঁর পাসোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। একই গ্রামে ছিল সাধনের বাড়ি।
গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা শহরে ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল সাধন। এবং কোথাও অনেক চেষ্টা করে, কোন সুবিধা করতে না পেরে অবশেষে একদিন ব্রজদুলালের শরণাপন্ন হয়।
কি জানি কেন যে ব্রজদুলাল কোন আত্মীয়স্বজনকে তো নয়ই, এমন কি গ্রামের পরিচিত বা অন্যান্য ভাবে পরিচিত কাউকেই কখনও সাহায্য করতেন না। বলতেন, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত জন কাউকেই আমি কোন সাহায্যই করতে চাই না—
কারণ হয়ত তার একটা ছিল কিন্তু সেটা কেউ জানত না, অথচ ব্রজদুলালের ভাইপো ভাইঝি ছিল। তাদের কখনও নিজের গৃহে প্রবেশ তো দূরের কথা, তাদের কখনও কোন খোঁজখবর নিতেন না। সেই ব্রজদুলাল সাহাই সাধনকে শুধু পড়ার ব্যবস্থাই যে করে দিলেন তা নয়। নিজের গৃহে স্থানও দিলেন। এবং সেই থেকে সাধন ব্রজদুলালের গৃহেই থেকে যায়।
সেও আজ থেকে বছর বারো-তেরো আগেকার কথা।
ব্রজদুলালের ব্যবসাও তখন আজকের মত বিরাট ফলাও হয়ে ওঠেনি। অবস্থাও এমনি শাঁসালো হয়ে ওঠেনি। ছোটখাটো একটা লোহার কারবার মাত্র এবং থাকেন তিনি তখন গড়িয়ার দিকে ছোট বাসা-বাড়ি নিয়ে।
কিছুদিন আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। একটিমাত্র ভৃত্য নিয়ে তাঁর সংসার।
তারপরই লাগলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ একদিন এবং মাত্র বছর চারেকের মধ্যে কোথা দিয়ে কোন্ পথে যে চঞ্চলা লক্ষ্মী তাঁর সোনার ঝাঁপটি হাতে নিয়ে ব্রজদুলালের গৃহে অচঞ্চলা হয়ে বসলেন—ফলে দেখতে দেখতে চার বছরের মধ্যেই দেখা গেল ব্রজদুলাল তিনটি খনির মালিক ও সাহা অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টার! কথায় বলে পুরুষস্য ভাগ্যম। সেটার প্রকৃষ্ট প্রমাণ যেন ঐ ব্রজদুলাল সাহা।
সাধনেরও আপনার বলতে ত্রিসংসারে কেউ ছিল না। ছোটবেলায় একই দিনে কলেরায় মা-বাপ হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল সে গাঁয়ে দূরসম্পকীয় এক দিদির বাড়িতে।
গ্রামের স্কুল থেকে ম্যাট্রিকটা পাস করবার পর দিদির আশ্রয়ে আর ভার-বোঝা না হয়ে থেকে একদিন সামান্য একটি সুটকেসে খান দুই জামা-কাপড় নিয়ে কলকাতায় এসে উপস্থিত হল। পাইস হোটেলে খেয়ে এখান-ওখানে অনেক ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কোন সুরাহাই হয় না। অবশেষে একদিন ব্রজদুলালের অফিসে গিয়ে সাহসে ভর করে দেখা করল। গ্রামের কৃতী পুরুষ ব্রজদুলাল যদি একটা হিল্লে করে দেন এই আশায়। ব্রজদুলাল ছেলেটির চেহারায় ও তার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হলেন। স্থান দিলেন নিজের গৃহে। ব্রজদুলালের আশ্রয়ে মাথা খুঁজতে পেরে সে যেন বেঁচে গিয়েছিল। যেমন সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা তেমনি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। ব্রজদুলালের কাছে সাধন একটা চাকরিই চেয়েছিল কিন্তু ব্রজদুলাল বললেন, চাকরি দেখা যাবে পরে, এখন পড়াশুনা কর।
পড়ব, কিন্তু……
কিন্তু দিয়ে দরকার নেই—কালই কলেজে ভর্তি হয়ে যাও।
.
সাধন কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। ক্রমে সে কৃতিত্বের সঙ্গে অর্থনীতিতে এম. এ. পাস করবার পর ব্রজদুলাল তাঁর নিজের অফিসেই সাধনকে ঢুকিয়ে দিলেন।
সত্যিই ঐ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিদীপ্ত অথচ বিনয়ী, নম্র ছেলেটিকে পুত্ৰাধিক ভালবেসেছিলেন ব্রজদুলাল। এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল—নিজের ভাইপো-ভাইঝিদের বঞ্চিত করে হয়ত ব্রজদুলাল তাঁর সব কিছুই একদিন ঐ সাধনকেই দিয়ে যাবেন।
ইদানীং এমন হয়েছিল সাধন না হলে ব্রজদুলালের কোন কাজই হত না। সকল ব্যাপারের পরামর্শদাতা ছিল ঐ সাধন মিত্র। সাধন একতলায় থাকত অফিস-ঘরের পাশের ঘরটিতেই—অর্থাৎ ব্রজদুলালের গচা লেনের বাড়িতেই।