তপঃস্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি ক্রিয়াযোগঃ ।।১।।
-তপস্যা, অধ্যাত্মশাস্ত্র-পাঠ ও ঈশ্বরে সমুদয় কর্মফল-সমর্পণকে ‘ক্রিয়াযোগ’ বলে।
পূর্ব অধ্যায়ে যে-সকল সমাধির কথা বলা হইয়াছে, তাহা লাভ করা অতি কঠিন। এইজন্য আমাদিগকে ধীরে ধীরে ঐ-সকল সমাধিলাভের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহার প্রথম সোপানকে ‘ক্রিয়াযোগ’ বলে। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ-কর্মদ্বারা যোগের দিকে অগ্রসর হওয়া। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি যেন অশ্ব, মন তাহার লাগাম, বুদ্ধি সারথি, আত্মা সেই রথের আরোহী আর এই শরীর রথস্বরূপ।১ মানুষের আত্মাই গৃহস্বামী, রাজা-রূপে এই রথে তিনি বসিয়া আছেন। অশ্বগণ যদি অতি প্রবল হয়, রশ্মিদ্বারা সংযত না থাকিতে চায়, আর যদি বুদ্ধিরূপ সারথি ঐ অশ্বগণকে কিরূপে সংযত করিতে হইবে তাহা না জানে, তবে এই রথের পক্ষে মহা বিপদ উপস্থিত হইবে। পক্ষান্তরে যদি ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বগণ সংযত থাকে, আর মনরূপ রশ্মি বুদ্ধিরূপ সারথির হস্তে দৃঢ়ভাবে ধৃত থাকে, তবে ঐ রথ ঠিক উহার গন্তব্য স্থানে পৌঁছিতে পারে। এখন এই তপস্যা-শব্দের অর্থ কি? ‘তপস্যা’ শব্দের অর্থ-এই শরীর ও ইন্দ্রিয়গণকে চালনা করিবার সময় খুব দৃঢ়ভাবে রশ্মি ধরিয়া থাকা, উহাদিগকে ইচ্ছামত কার্য করিতে না দিয়া আত্মবশে রাখা।
পাঠ বা স্বাধ্যায়। এক্ষেত্রে পাঠ অর্থে কি বুঝিতে হইবে? নাটক, উপন্যাস বা গল্পের বই পড়া নয়-যে-সকল গ্রন্থে আত্মার মুক্তিবিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশ আছে, সেই সকল গ্রন্থপাঠ। আবার ‘স্বাধ্যায়’ বলিতে বিতর্কমূলক পুস্তকপাঠ মোটেই বুঝায় না। বুঝিতে হইবে যোগী বিতর্কমূলক পাঠ ও আলোচনা শেষ করিয়াছেন; তিনি তৃপ্ত, উহাতে আর তাঁহার রুচি নাই। তিনি পাঠ করেন শুধু তাঁহার ধারণাগুলি দৃঢ় করিবার জন্য। দুই প্রকার শাস্ত্রীয় জ্ঞান আছেঃ ‘বাদ’ (যাহা তর্ক-যুক্তি ও বিচারাত্মক) ও সিদ্ধান্ত (মীমাংসাত্মক)। অজ্ঞানাবস্থায় মানুষ প্রথমোক্ত প্রকার জ্ঞানানুশীলনে প্রবৃত্ত হয়, উহা তর্কযুদ্ধ-স্বরূপ-প্রত্যেক বিষযের স্বপক্ষ-বিপক্ষ দেখিয়া বিচার করা; এই বিচার শেষ হইলে তিনি কোন এক মীমাংসায়-সমাধানে উপনীত হন। কিন্তু শুধু সিদ্ধান্তে উপনীত হইলে চলিবে না। এই সিদ্ধান্তবিষয়ে মনের ধারণা প্রগাঢ় করিতে হইবে। শাস্ত্র অনন্ত, সময় সংক্ষিপ্ত, অতএব সকল বস্তুর সারভাগ গ্রহণ করা জ্ঞানলাভের গোপন রহস্য। ঐ সারটুকু লইয়া ঐ উপদেশমত জীবনযাপন করিতে চেষ্টা কর। ভারতবর্ষে প্রাচীনকাল হইতে একটি প্রবাদ২ প্রচলিত আছে-যদি তুমি কোন রাজহংসের সন্মুখে একপাত্র জলমিশ্রিত দুগ্ধ ধর, তবে সে দুগ্ধটুকু পান করিবে, জলটুকু পড়িয়া থাকিবে। এইরূপে জ্ঞানের যেটুকু প্রয়োজনীয় অংশ, তাহা গ্রহণ করিয়া অসারটুকু ফেলিয়া দিতে হইবে। প্রথম অবস্থায় এই বুদ্ধির ব্যায়াম আবশ্যক। অন্ধভাবে কিছুই গ্রহণ করিলে চলিবে না। যোগী এই তর্কযুক্তির অবস্থা অতিক্রম করিয়া পর্বতবৎ একটি দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন। তাঁহার তখন একমাত্র উদ্দেশ্য-ঐ সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করা। তিনি বলেন, বিচার করিও না; যদি কেহ জোর করিয়া তোমার সহিত তর্ক করিতে আসে, তুমি তর্ক না করিয়া চুপ করিয়া থাকিবে। কোন তর্কের উত্তর না দিয়া শান্তভাবে সেখান হইতে চলিয়া যাইবে, কারণ তর্ক কেবল মনকে চঞ্চল করে। তর্কের প্রয়োজন ছিল কেবল বুদ্ধির অনুশীলনের জন্য; অযথা বুদ্ধিকে চঞ্চল করিবার প্রয়োজন কি? বুদ্ধি একটি দুর্বল যন্ত্রমাত্র, উহা আমাদিগকে শুধু ইন্দ্রিয়ের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিতে পারে। যোগী চান ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতির রাজ্যে যাইতে, সুতরাং তাঁহার পক্ষে বুদ্ধিচালনার আর কোন প্রয়োজন থাকে না। এই বিষয়ে তিনি দৃঢ়নিশ্চয় হইয়াছেন, সুতরাং আর তর্ক করেন না, মৌন অবলম্বন করেন। তর্ক করিতে গেলে মনের সাম্য নষ্ট হইয়া পড়ে, চিত্তের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য উপস্থিত হয়; ইহা তাঁহার পক্ষে বিঘ্নমাত্র। এই-সব তর্ক ও যুক্তি শুধু প্রসঙ্গতঃ আসিয়া পড়ে। এই তর্কযুক্তির অতীত রাজ্যে উচ্চতর তত্ত্বসমূহ রহিয়াছে। সমগ্র জীবনটা কেবল বিদ্যালয়ের বালকের ন্যায় বিবাদ করিবার বা বিতর্কসমিতি লইয়া কাটাইবার জন্য নয়।
ঈশ্বরে কর্মফল-অর্পণ অর্থে কর্মের জন্য নিজে কোনরূপ প্রশংসা বা নিন্দা দ্বারা প্রভাবিত না হইয়া দুইটিই ঈশ্বরে সমর্পণ করিয়া শান্তিতে অবস্থান করা বুঝায়।
১ তুলনীয়ঃ কঠ উপ.,১।৩।৩-৪
সমাধি-ভাবনার্থঃ ক্লেশতনূকরণার্থশ্চ ।।২।।
-ঐ ক্রিয়াযোগের প্রয়োজন সমাধি-অভ্যাসের সুবিধা করিয়া দেওয়া এবং ক্লেশজনক বিঘ্নসমুদয় ক্ষীণ করা।
আমরা অনেকেই মনকে আদুরে ছেলের মতো করিয়া ফেলিয়াছি। উহা যাহা চায়, তাহাই দিয়া থকি। এই জন্য সর্বদা ক্রিয়াযোগের অভ্যাস আবশ্যক, যাহাতে মনকে সংযত করিয়া নিজের বশীভূত করা যায়। এই সংযমের অভাব হইতেই যোগের বিঘ্ন উপস্থিত হইয়া থাকে ও তাহাতেই ক্লেশের উৎপত্তি। এগুলি দূর করিবার উপায়-ক্রিয়াযোগের দ্বারা মনকে বশীভূত করা, মনকে উহার কার্য করিতে না দেওয়া।
২ অনন্তপারং কিল শব্দশাস্ত্রং স্বল্পং তথায়ুর্বহবশ্চ বিঘ্নাঃ ।
সারং ততো গ্রাহ্যমপাস্য ফল্গু হংসৈর্যথা ক্ষীরমিবাম্বুমধ্যাং।।
-পঞ্চতন্ত্রম্
অবিদ্যাহস্মিতারাগন্বেষাভিনিবেশাঃ পঞ্চক্লেশাঃ।।৩।।
-অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ (জীবনে আসক্তি) এইগুলিই পঞ্চক্লেশ।
ইহারাই পঞ্চ ক্লেশ, ইহারা পঞ্চবন্ধনরূপে আমাদিগকে বদ্ধ করিয়া রাখে। অবশ্য অবিদ্যাই কারণ এবং অন্য চারটি ফল। অবিদ্যাই আমাদের দুঃখের একমাত্র কারণ। আর কাহার শক্তি আছে যে, আমাদিগকে এইরূপ দুঃখ দেয়? আত্মা নিত্য আনন্দস্বরূপ; আত্মার এই সমুদয় দুঃখই কেবল ভ্রমমাত্র।
অবিদ্যা ক্ষেত্রমুত্তরেষাং প্রসুপ্ততনুবিচ্ছিন্নোদারাণাম্ ।।৪।।
-অবিদ্যাই পরবর্তীগুলির উৎপাদক ক্ষেত্র; এগুলি কখন লীন (সুপ্ত) ভাবে, কখন সূক্ষ্মভাবে, কখন অন্য বৃত্তি দ্বারা বিচ্ছিন্ন অর্থাৎ অভিভূত হইয়া থাকে, কখন বা প্রকাশিত (বিস্তারিত) থাকে।
অবিদ্যাই অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশের (জীবনে আসক্তির) কারণ। ঐ সংস্কারগুলি আবার বিভিন্ন লোকের মনে বিভিন্ন অবস্থায় থাকে। কখন ঐগুলি ‘সুপ্ত’ ভাবে থাকে। তোমরা অনেক সময় ‘শিশুতুল্য নিরীহ’ এই বাক্য শুনিয়া থাকো, কিন্তু এই শিশুর ভিতরেই হয়তো দেবতা বা অসুরের ভাব রহিয়াছে। ঐ ভাব ক্রমশঃ প্রকাশ পাইবে। যোগীর হৃদয়ে পূর্বকর্মের ফলস্বরূপ ঐ সংস্কারগুলি ‘তনু’ (সূক্ষ্ম)- ভাবে থাকে। ইহার তাৎপর্য এই, ঐগুলি খুব সূক্ষ্ম অবস্থায় থাকে; যোগী ঐগুলি দমন করিয়া রাখিতে পারেন-যাহাতে উহারা ব্যক্ত হইতে না পায়। ‘বিচ্ছিন্ন’ অবস্থায় কতকগুলি প্রবল সংস্কার অন্য কতকগুলি সংস্কারকে কিছুকালের জন্য অভিভূত বা আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, কিন্তু যখনই ঐ কারণগুলি চলিয়া যায়, তখনই আবার অন্য সংস্কারগুলি প্রকাশিত হইয়া পড়ে। এই শেষ অবস্থাটির নাম ‘উদার’ (বিস্তৃত)। ঐ অবস্থায় সংস্কারগুলি অনুকূল পরিবেশ পাইয়া শুভ বা অশুভরূপে প্রবলভাবে কার্য করিতে থাকে।
অনিত্যাশুচিদুঃখানাত্মসু নিত্য-শুচি-সুখাত্মখ্যাতিরবিদ্যা ।।৫।।
-অনিত্য, অপবিত্র, দুঃখকর ও আত্মা ভিন্ন পদার্থে যে নিত্য, শুচি, সুখকর ও আত্মা বলিয়া ভ্রম হয়, তাহাকে ‘অবিদ্যা’ বলে।
এই সমুদয় সংস্কারের একমাত্র কারণ অবিদ্যা। আমাদের প্রথমে জানিতে হইবে, এই অবিদ্যা কি। আমরা সকলেই মনে করি, ‘আমি শরীর; শুদ্ধ জ্যোতির্ময় নিত্যআনন্দস্বরূপ আত্মা নই’-ইহাই অবিদ্যা। আমরা মানুষকে শরীর বলিয়াই ভাবি এবং সেই ভাবেই দেখি, ইহা মহা ভ্রম।
দৃগ্দর্শনশক্ত্যোরেকাত্মতৈবাহস্মিতা ।।৬।।
-দ্রষ্টা ও দর্শনশক্তির একাত্মতাই অস্মিতা।
আত্মাই যথার্থ ‘দ্রষ্টা’, তিনি শুদ্ধ, নিত্যপবিত্র, অনন্ত ও অমর। আর ‘দর্শনশক্তি’ অর্থাৎ উহার ব্যবহার্য যন্ত্র কি কি? চিত্ত, বুদ্ধি অর্থাৎ নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি মন ও ইন্দ্রিয়গণ-এইগুলি আত্মার যন্ত্র। এইগুলি তাঁহার বাহ্য জগৎ দেখিবার যন্ত্রস্বরূপ, আর আত্মার সহিত ঐগুলির একীভাবকে অস্মিতারূপ অবিদ্যা বলে। আমরা বলিয়া থাকি, ‘আমি চিত্ত’, ‘আমি চিন্তা’, ‘আমি রুষ্ট হইয়াছি’, অথবা ‘আমি সুখী’। কিন্তু কিরূপে আমরা রুষ্ট হইতে পারি বা কাহাকেও ঘৃণা করিতে পারি? আত্মার সহিত নিজেকে অভেদ জানিতে হইবে। আত্মার তো কখন পরিণাম হয় না। আত্মা যদি অপরিণামী হন, তবে তিনি কিরূপে কখনও সুখী, কখনও দুঃখী হইতে পারেন? তিনি নিরাকার, অনন্ত ও সর্বব্যাপী। কে তাঁহাকে পরিবর্তিত করিতে পারে? আত্মা সর্ববিধ নিয়মের অতীত। কে তাঁহাকে বিকৃত করিতে পারে? জগতের কোন কিছুই আত্মার উপর কোন কার্য করিতে পারে না। তথাপি আমরা অজ্ঞতাবশতঃ নিজদিগকে মনোবৃত্তির সহিত একীভূত করিয়া ফেলি এবং সুখ বা দুঃখ অনুভব করিতেছি মনে করি।
সুখানুশয়ী রাগঃ ।।৭।।
-যে মনোবৃত্তি কেবল সুখকর পদার্থের উপর থাকিতে চায়, তাহাকে রাগ বলে।
আমরা কোন কোন বিষয়ে সুখ পাইয়া থকি; যে-সব বিষয়ে আমরা সুখ পাই, সেগুলির দিকে মন একটি প্রবাহের মতো প্রবাহিত হইতে থাকে। সুখ-কেন্দ্রের দিকে ধাবমান আমাদের মনের ঐ প্রবাহকেই ‘রাগ বা আসক্তি’ বলে। আমরা যাহাতে সুখ পাই না, এমন কোন বিষয়ে আমরা কখনই আকৃষ্ট হই না। অনেক সময়ে আমরা নানা প্রকার অদ্ভুত বিষয়ে সুখ পাইয়া থাকি, তাহা হইলেও রাগের যে লক্ষণ দেওয়া গেল, তাহা সর্বত্রই খাটে। আমরা যেখানে সুখ পাই, সেখানেই আকৃষ্ট হই।
দুঃখানুশয়ী দ্বেষঃ ।।৮।।
-দুঃখকর পদার্থর উপর পুনঃপুনঃ স্থিতিশীল অন্তঃকরণবৃত্তিবিশেষকে দ্বেষ বলে।
যাহাতে আমরা দুঃখ পাই, তাহা তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করিবার চেষ্টা পাই।
স্বরসবাহী বিদুষোহপি তথারূঢ়োহভিনিবেশঃ ।।৯।।
-যাহা পূর্ব পূর্ব মরণানুভব হইতে স্বভাবতঃ প্রবাহিত ও যাহা পন্ডিত ব্যক্তিতেও প্রতিষ্ঠিত, তাহাই অভিনিবেশ অর্থাৎ জীবনে মমতা।
এই জীবনের প্রতি মমতা প্রত্যেক জীবেই প্রকাশিত দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার উপর পরজন্ম-সম্বন্ধীয় মত স্থাপন করিবার অনেক চেষ্টা হইয়াছে, মানুষ জীবনকে এত বেশী ভালবাসে বলিয়া ভবিষ্যতেও সে একটি জীবন আকাঙ্ক্ষা করে। অবশ্য ইহা বলা বাহুল্য যে, এই যুক্তির বিশেষ কোন মূল্য নাই। তবে ইহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভূত ব্যাপার এই যে, পাশ্চাত্যদেশসমূহের মতে এই জীবনের প্রতি মমতা হইতে যে ভবিষ্যৎ জীবনের সম্ভাব্যতা সূচিত হয়, তাহা কেবল মানুষের পক্ষেই খাটে, অন্যান্য জন্তুর পক্ষে নয়। ভারতবর্ষে-জীবনের এই মমতাই পূর্বসংস্কার ও পূর্বজীবন প্রমাণ করিবার অন্যতম যুক্তিস্বরূপ হইয়াছে। মনে কর, যদি সমুদয় জ্ঞানই আমাদের প্রত্যক্ষ অনুভূতি হইতে লাভ হইয়া থাকে, তবে ইহা নিশ্চয় যে, আমরা যাহা কখনও প্রত্যক্ষ অনুভব করি নাই, তাহা কখন কল্পনাও করিতে পারি না বা বুঝিতেও পারি না। কুক্কুটশাবকগণ ডিম্ব হইতে ফুটিবামাত্র খাদ্য খুঁটিয়া খাইতে আরম্ভ করে। অনেক সময়ে এরূপ দেখা গিয়াছে যে, যখন কুক্কুটী দ্বারা হংসডিম্ব ফুটানো হইয়াছে, তখন হংসশাবক ডিম্ব হইতে বাহির হইবামাত্র জলের দিকে চলিয়া গিয়াছে; কুক্কুটিমাতা মনে করে, শাবকটি বুঝি জলে ডুবিয়া গেল। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই যদি জ্ঞানের একমাত্র উপায় হয়, তাহা হইলে কুক্কুটশাবকগুলি কোথা হইতে খাদ্য খুঁটিতে শিখিল অথবা ঐ হংসশাবকগুলি কোথায় শিখিল জল তাহাদের স্বাভাবিক স্থান? যদি বলো, ইহা সহজাত জ্ঞান (instinct), তবে তো কিছুই বুঝা গেল না-কেবল একটি শব্দ প্রয়োগ করা হইল, ব্যাখ্যা কিছুই হইল না। এই সহজাত জ্ঞান কি? এইরূপ সহজাত জ্ঞান আমাদেরও অনেক আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আপনাদের মধ্যে অনেক মহিলাই পিয়ানো বাজাইয়া থাকেন; আপনাদের অবশ্য স্মরণ থাকিতে পারে, যখন আপনারা প্রথম শিক্ষা করিতে আরম্ভ করেন, তখন আপনাদিগকে শ্বেত, কৃষ্ণ উভয় প্রকার পর্দায় একটির পর আর একটিতে কত যত্নের সহিত অঙ্গুলি প্রয়োগ করিতে হইত, কিন্তু বহু বৎসরের অভ্যাসের পর এখন আপনারা হয়তো কোন বন্ধুর সহিত কথা কহিতেছেন, সঙ্গে সঙ্গে পায়ানোর উপর আঙ্গুলগুলি আপনা-আপনি চলিতে থাকিবে। উহা এখন আপনাদের সহজাত জ্ঞানে পরিণত হইয়াছে, স্বাভাবিক হইয়া পড়িয়াছে। অন্যান্য যে-সব কাজ আমরা করিয়া থাকি, সেগুলি সম্বন্ধেও ঐরূপ। অভ্যাসের দ্বারা কোন কাজ স্বাভাবিক হইয়া যায়, স্বয়ংক্রিয়া হইয়া যায়। কিন্তু আমরা যতদূর জানি, এখন যে ক্রিয়াগুলিকে স্বভাবজ বলি, সেগুলি পূর্বে বিচার-সহিত করিতে হইত, এখন স্বাভাবিক হইয়া পড়িয়াছে। যোগীদের ভাষায় সহজাত জ্ঞান যুক্তি-বিচারের ক্রমসঙ্কুচিত অবস্থা মাত্র। বিচার-জনিত জ্ঞান সঙ্কুচিত হইয়া স্বাভাবিক সহজাত জ্ঞান বা সংস্কারে পরিণত হয়। অতএব আমরা যাহাকে সহজাত জ্ঞান বলি, তাহা যে বিচারজনিত জ্ঞানের সঙ্কুচিত অবস্থা মাত্র, এরূপ চিন্তা করা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতীত যুক্তিবিচার সম্ভব নয়, সুতরাং সমুদয় সহজাত জ্ঞানই পূর্ব অভিজ্ঞতার ফল। কুক্কুটগণ শ্যেনকে ভয় করে, হংসশাবকগণ জল ভালবাসে, এ-র্দুইটিই পূর্ব অভিজ্ঞতার ফল। এখন প্রশ্নঃ এই অনুভূতি-জীবাত্মার অথবা কেবল শরীরের? হংস এখন
যাহা অনুভব করিতেছে, তাহা কেবল ঐ হংসের পূর্বপুরুষগণের অভিজ্ঞতা হইতে আসিতেছে, না উহা হংসের নিজের অভিজ্ঞতা? আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ বলেন, উহা কেবল তাহার শরীরের ধর্ম। কিন্তু যোগীরা বলেন, উহা মনের অনুভূতি-শরীরের ভিতর দিয়া সঞ্চালিত হইতেছে মাত্র। ইহাকেই পুনর্জন্মবাদ বলে।
আমরা পূর্বে দেখিয়াছি-আমাদের সমুদয় জ্ঞান, যেগুলিকে প্রত্যক্ষ, বিচারজনিত বা সহজাত জ্ঞান বলি, সে-সবই জ্ঞানের একমাত্র প্রণালী অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়াই আসিতে পারে; আর যাহাকে আমরা সহজাত জ্ঞান বলি, তাহা আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার ফল, উহাই এখন নিম্নস্তরে নামিয়া সহজাত জ্ঞানে পরিণত হইয়াছে, সেই সহজাত জ্ঞান আবার বিচারজনিত জ্ঞানে উন্নীত হইয়া থাকে। সমুদয় জগতেই এই ব্যাপার চলিতেছে। ইহার উপরেই ভারতের পুনর্জন্মবাদের অন্যতম প্রধান যুক্তি স্থাপিত হইয়াছে। পুনঃপুনঃ অনুভূত নানাবিধ ভয়ের সংস্কার কালক্রমে জীবনের প্রতি এই মমতায় পরিণত হইয়াছে। এই কারণেই বালক অতি বাল্যকাল হইতেই স্বাভাবিকভাবে ভয় পাইয়া থাকে, কারণ তাহার মনে দুঃখযন্ত্রণার পূর্ব অভিজ্ঞতা রহিয়াছে। অতিশয় বিদ্বান্ ব্যক্তগণের মধ্যে যাঁহারা জানেন, এই শরীর চলিয়া যাইবে, যাঁহারা বলেন, ‘ভয় নাই, চিন্তা নাই; আমাদের শত শত শরীর হইয়া গিয়াছে, আত্মা কখনও মরে না’, তাঁহাদের সমুদয় বিচারজাত ধারণা সত্ত্বেও তাঁহাদের মধ্যে আমরা এই জীবনের প্রতি আসক্তি দেখিতে পাই। কেন এই জীবনের প্রতি আসক্তি? আমরা দেখিয়াছি যে, ইহা আমাদের সহজাত বা স্বাভাবিক হইয়া পড়িয়াছে। যোগীদিগের দার্শনিক ভাষায় উহা ‘সংস্কার’-এ পরিণত হইয়াছে, বলা যায়। এই সংস্কারগুলি সূক্ষ্ম বা গুপ্তভাবে চিত্তের ভিতর যেন নিদ্রিত রহিয়াছে। পূর্বমৃত্যুর এই-সব অভিজ্ঞতা, যেগুলিকে আমরা সহজাত জ্ঞান বলি, সেগুলি অবচেতন-ভূমিতে উপনীত হইয়াছে। ঐগুলি চিত্তেই বাস করে; এগুলি নিষ্ক্রিয় নয়, মনের গভীরতর প্রদেশে থাকিয়া কাজ করিয়া চলে।
এই চিত্তবৃত্তিগুলিকে অর্থাৎ যেগুলি স্থূলভাবে প্রকাশিত, সেগুলিকে আমরা বেশ বুঝিতে পারি ও অনুভব করিতে পারি; ঐগুলিকে দমন করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু এই সূক্ষ্মতর সংস্কারগুলির সম্বন্ধে কি করা যায়? ঐগুলি দমন করা যায় কিরূপে? যখন আমি রুষ্ট হই, তখন আমার সমুদয় মনটি যেন ক্রোধের এক বিরাট তরঙ্গাকার ধারণ করে। আমি উহা অনুভব করিতে পারি, উহাকে যেন হাতে করিয়া নাড়িতে পারি, উহার সহিত সংগ্রাম করিতে পারি, কিন্তু আমি যদি মনের অতি গভীরে উহার কারণে যাইতে না পারি, তবে কখনই আমি উহাকে জয় করিতে সমর্থ হইব না। কোন লোক আমাকে খুব কড়া কথা বলিল, আমারও বোধ হইতে লাগিল যে, আমি উত্তেজিত হইতেছি, সে আরও কড়া কথা বলিতে লাগিল, অবশেষে আমি ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া উঠিলাম, আত্মবিস্মৃত হইলাম, ক্রোধবৃত্তির সহিত যেন নিজেকে মিশাইয়া ফেলিলাম। যখন সে আমাকে প্রথমে কটু বলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তখনও আমার বোধ হইতেছিল
-আমি যেন ক্রুদ্ধ হইতেছি। তখন ক্রোধ একটি ও আমি একটি, পৃথক্ পৃথক্ ছিলাম। কিন্তু যখনই আমি ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলাম, তখন আমিই যেন ক্রোধে পরিণত হইয়া গেলাম। ঐ বৃত্তিগুলিকে মূলে বীজভাবেই সূক্ষ্মাবস্থাতেই সংযত করিতে হইবে। ঐগুলি আমাদের উপর ক্রিয়া করিতেছে-আমরা ইহা বুঝিবার পূর্বেই ঐগুলিকে সংযত করিতে হইবে। জগতের অধিকাংশ লোক এই বৃত্তিগুলির সূক্ষ্মাবস্থার অস্তিত্ব পর্যন্ত অবগত নয়। যে অবস্থায় ঐ বৃত্তিগুলি অবচেতনভূমি হইতে একটু একটু করিয়া উদিত হয়, তাহাকেই বৃত্তির সূক্ষ্মাবস্থা বলা যায়। যখন কোন হ্রদের তলদেশ হইতে একটি বুদ্বুদ উত্থিত হয়, তখন আমরা উহাকে দেখিতে পাই না; শুধু তাই নয়, উপরিভাগের খুব নিকটে আসিলেও আমরা উহা দেখিতে পাই না; যখনই উহা উপরে উঠিয়া মৃদু আলোড়ন সৃষ্টি করে, তখনই আমরা জানিতে পারি-একটি তরঙ্গ উঠিতেছে। যখন আমরা সূক্ষ্মাবস্থাতেই তরঙ্গগুলিকে ধরিতে পারিব, তখনই ঐগুলিকে আয়ত্তে আনিতে সমর্থ হইব। এইরূপে স্থূলভাবে পরিণত হইবার পূর্বেই সূক্ষ্মাবস্থায় ঐ ইন্দ্রিয়বৃত্তিগুলি যত দিন না আমরা সংযত করিতে পারি, ততদিন আমাদের কোন বৃত্তিই পূর্ণভাবে জয় করার আশা নাই। ইন্দ্রিয়বৃত্তিগুলিকে সংযত করিতে হইলে ঐগুলিকে মূলে সংযত করিতে হইবে। কেবল তখনই আমরা বৃত্তিগুলির বীজ পর্যন্ত দগ্ধ করিয়া ফেলিতে পারিব; যেমন ভর্জিত বীজ মৃত্তিকায় ছড়াইয়া দিলে আর অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না, তেমনি এই ইন্দ্রিয়ের বৃত্তিগুলি আর উদিত হইবে না।
তে প্রতিপ্রসবহেয়াঃ সূক্ষ্মা ।।১০।।
-সেই সূক্ষ্ম সংস্কারগুলিকে প্রতিপ্রসব অর্থাৎ প্রতিলোম পরিণাম দ্বারা (কার্যকে কারণে পরিণত করিয়া) নাশ করিতে হয়।
ধ্যানের দ্বারা চিত্তবৃত্তিগুলি নষ্ট হইলে যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাকে সূক্ষ্মসংস্কার বা বাসনা বলে। উহা নাশ করিবার উপায় কি? উহাকে প্রতিপ্রসব অর্থাৎ প্রতিলোমপরিণামের দ্বারা নাশ করিতে হইবে। প্রতিলোম-পরিণাম অর্থ-কার্যের কারণ লয়। চিত্তরূপ কার্য যখন সমাধিদ্বারা অস্মিতা বা অহঙ্কার-রূপ স্বকারণে লীন হইবে তখনই চিত্তের সহিত সূক্ষ্ম সংস্কারগুলিও নষ্ট হইয়া যাইবে। ধ্যানের দ্বারা এগুলি নষ্ট করা যায় না।
ধ্যানহেয়াস্তদ্বৃত্তয়ঃ ।।১১।।
-ধ্যানের দ্বারা উহাদের স্থূলাবস্থা নাশ করিতে হয়।
ধ্যানই এই বৃহৎ তরঙ্গগুলির উৎপত্তি নিবারণ করিবার এক প্রধান উপায়। ধ্যানের দ্বারাই মন বৃত্তিরূপ তরঙ্গগুলি প্রশমিত করিতে পারে। যদি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর এই ধ্যান অভ্যাস কর, যতদিন না উহা তোমার অভ্যাসে
পরিণত হয়, যতদিন না ঐ ধ্যান আপনা হইতেই আসে, ততদিন যদি এরূপ কর, তাহা হইলে ক্রোধ, ঘৃণা প্রভৃতি বৃত্তিগুলি নিয়ন্ত্রিত হইবে, সংযত হইবে।
ক্লেশমূলঃ কর্মাশয়ো দৃষ্টাদৃষ্টজন্মবেদনীয়ঃ ।।১২।।
-কর্মের আশয় বা আধারের মূল এই পূর্বোক্ত ক্লেশগুলি; বর্তমান অথবা পর-জীবনে উহারা ফল প্রসব করে।
কর্মাশয়ের অর্থ এই সংস্কারগুলির সমষ্টি। আমরা যে-কোন কাজ করি না কেন, অমনি মনোহ্রদে একটি তরঙ্গ উত্থিত হয়। আমরা মনে করি কাজটি শেষ হইয়া গেলেই তরঙ্গটিও শেষ হইয়া গেল; কিন্তু বাস্তবিক তাহা নয়। উহা সূক্ষ্ম আকার ধারণ করিয়াছে মাত্র, ঐ স্থানেই রহিয়াছে। যখন আমরা ঐ কার্যের কথা স্মরণ করিবার চেষ্টা করি, তখনই উহা পুনর্বার উদিত হইয়া আবার তরঙ্গাকারে পরিণত হয়। অতএব উহা মনের ভিতরই গূঢ়ভাবে ছিল; যদি না থাকিত, তাহা হইলে স্মৃতি অসম্ভব হইত। সুতরাং প্রত্যেক কার্য, প্রত্যেক চিন্তা, তাহা শুভই হউক আর অশুভই হউক, মনের গভীরতম প্রদেশে গিয়া সূক্ষ্মভাব ধারণ করে এবং ঐ স্থানেই সঞ্চিত থাকে; সুখকর অথবা দুঃখকর-সকল প্রকার চন্তাকেই ‘ক্লেশ’-জনক বাধা বলে, কারণ যোগীদের মতে উভয়েই পরিণামে দুঃখ প্রসব করে। ইন্দ্রিয়সমূহ হইতে যে-সব সুখ পাওয়া যায়, পরিণামে সেগুলি দুঃখ আনিবে। ভোগে ভোগতৃষ্ণা বাড়িতেই থাকে, তাহার ফল দুঃখ। মানুষের বাসনার অন্ত নাই, মানুষ ক্রমাগত বাসনা করিতেছে; বাসনা করিতে করিতে যখন সে এমন স্থানে উপনীত হয় যে, কোনমতে তাহার বাসনা আর পূর্ণ হয় না, তখনই তাহার দুঃখ উৎপন্ন হয়। এই জন্যই যোগীরা শুভ ও অশুভ সংস্কারসমষ্টিকে ‘ক্লেশ’ বলিয়া থাকেন, এগুলি আত্মার মুক্তিপথে বাধা দেয়।
সকল কার্যের সূক্ষ্মমূলস্বরূপ সংস্কারগুলি সম্বন্ধে এইরূপ বুঝিতে হইবে; তাহারা কারণস্বরূপ হইয়া ইহজীবনে বা পরজীবনে ফল প্রসব করিয়া থাকে (দৃষ্ট-বা অদৃষ্ট-জন্ম-বেদনীয়)। বিশেষ বিশেষ স্থলে যখন ঐ সংস্কারগুলি খুব প্রবল হয়, তখন শীঘ্রই ফল দান করে; অত্যুৎকট পুণ্য বা পাপকর্ম ইহজীবনেই ফল উৎপন্ন করে। যোগীরা বলেন যে-সকল ব্যক্তি ইহজীবনেই খুব প্রবল শুভসংস্কার উপার্জন করিতে পারেন, তাঁহাদের মুত্যু হয় না, তাঁহারা ইহজীবনেই এই দেহকে দেবদেহে পরিণত করিতে পারেন। যোগীদের গ্রন্থে এইরূপ কতিপয় দৃষ্টান্তের উল্লেখ আছে। ইঁহারা নিজেদের শরীরের উপাদান পর্যন্ত পরিবর্তন করিয়া ফেলেন, দেহের পরমানুগুলিকে এমন নূতনভাবে সন্নিবেশিত করিয়া লন যে, তাঁহাদের আর কোন পীড়া হয় না এবং আমরা যাহাকে মৃত্যু বলি, তাহাও তাঁহাদের নিকট আসিতে পারে না। এরূপ হইবে না কেন? শারীরবিজ্ঞানে খাদ্যের অর্থ-সূর্য হইতে শক্তিগ্রহন। ঐ শক্তি প্রথমে উদ্ভিদে প্রবেশ করে; সেই উদ্ভিদ আবার কোন পশুতে ভোজন করে, মানুষ আবার সেই পশুমাংস ভোজন করিয়া থাকে। এই ব্যাপারটি বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলিতে
গেলে বলিতে হইবে যে, আমরা সূর্য হইতে কিছু শক্তি গ্রহণ করিয়া নিজের অঙ্গীভূত করিয়া লই। যদি এইরূপ হয়, তবে এই শক্তি আহরণ করিবার একটিমাত্র উপায় থাকিবে কেন? আমরা যেরূপে শক্তি সংগ্রহ করি, উদ্ভিদের শক্তিসংগ্রহের উপায় ঠিক তাহা নয়; আমরা যেরূপে শক্তি সংগ্রহ করি, পৃথিবী সেরূপে করে না, কিন্তু তাহা হইলেও সকলেই কোন না কোনরূপে শক্তি সংগ্রহ করিয়া থাকে। যোগীরা বলেন, তাঁহারা কেবল মনঃশক্তিবলেই শক্তি সংগ্রহ করিতে পারেন। সাধারণ উপায় অবলম্বন না করিয়াও তাঁহারা যত ইচ্ছা শক্তি সংগ্রহ করিতে পারেন। ঊর্ণনাভ যেমন নিজ শরীর হইতে তন্তু বিস্তার করিয়া পরিশেষে এমন বদ্ধ হইয়া পড়ে যে, বাহিরে কোথাও যাইতে হইলে সেই তন্তু অবলম্বন না করিয়া যাইতে পারে না, সেইরূপ আমরাও আমাদের উপাদান পদার্থ হইতে এই স্নায়ুজাল সৃষ্টি করিয়াছি, এখন আর সেই স্নায়ুপ্রণালী অবলম্বন না করিয়া কোন কাজ করিতে পারি না। যোগী বলেন, ইহাতে বদ্ধ থাকিবার প্রয়োজন নাই।
এই তত্ত্বটি আর একটি উদাহরণের দ্বারা বুঝানো যাইতে পারে। আমরা পৃথিবীর যে-কোন দিকে তড়িৎশক্তি প্রেরণ করিতে পারি, কিন্তু আমাদিগকে উহা তারের ভিতর দিয়া পাঠাইতে হয়। প্রকৃতি তো বিনা তারেই বহু পরিমানে বিদ্যুৎশক্তি প্রেরণ করিতেছে। আমরাই বা কেন তাহা করিতে পারিব না? আমরা চতুর্দিকে মানসতড়িৎ প্রেরণ করিতে পারি। আমরা যাহাকে মন বলি, তাহা প্রায় তড়িৎশক্তির মতো। স্নায়ুর মধ্যে যে এক তরল পদার্থ প্রবাহিত হইতেছে, তাহাতে যে কিছু পরিমাণে বিদ্যুৎশক্তি আছে ইহা অতি স্পষ্ট, কারণ তড়িতের ন্যায় উহারও দুই প্রান্তে বিপরীত শক্তিদ্বয় দৃষ্ট হয় এবং তড়িতের ধর্মগুলি উহাতে দেখা যায়। এই তড়িৎশক্তিকে এখন আমরা কেবল স্নায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়াই প্রবাহিত করিতে পারি। কিন্তু স্নায়ুমন্ডলীর সাহায্য না লইয়াই বা কেন ইহা প্রবাহিত করিতে সমর্থ হইব না? যোগী বলেন, ইহা খুবই সম্ভব এবং ইহা কার্যে পরিণত করা যাইতে পারে। আর ইহাতে কৃতকার্য হইলে তুমি সমগ্র জগতে এই শক্তি প্রয়োগ করিতে সমর্থ হইবে। তখন তুমি কোন স্নায়ুযন্ত্রের সাহায্য না লইয়াই যেখানে ইচ্ছা যে-কোন শরীরের দ্বারা কার্য করিতে পারিবে। যখন কোন জীবাত্মা এই স্নায়ুপ্রণালীর ভিতর দিয়া কাজ করে, আমরা তখন বলি মানুষটি জীবিত, এবং যখন এই যন্ত্রগুলির দ্বারা কাজ হয় না, তখন বলি মানুষটি মৃত। কিন্তু যখন কেহ এই-সকল স্নায়ুযন্ত্রের সাহায্যে বা স্নায়ু ব্যতীতই কাজ করিতে পারেন, তাঁহার পক্ষে জন্ম ও মৃত্যু-এই দুই শব্দের আর কোন অর্থই নাই। জগতে সব শরীরই তন্মত্র দ্বারা রচিত, প্রভেদ কেবল বিন্যাসের প্রণালীতে। যদি তুমিই ঐ বিন্যাসের কর্তা হও, তাহা হইলে তুমি যেরূপে ইচ্ছা, ঐ তন্মাত্রগুলির বিন্যাস করিয়া শরীর রচনা করিতে পারো। এই শরীর-তুমি ছাড়া আর কে নির্মাণ করিয়াছে? আহার করে কে? যদি আর একজন তোমার হইয়া আহার করিয়া দিত, তবে তোমাকে আর বেশী দিন বাঁচিতে হইত না। ঐ খাদ্য হইতে রক্তই বা উৎপাদন
করে কে? নিশ্চয় তুমি। ঐ রক্ত বিশুদ্ধ করিয়া ধমনীর মধ্যে প্রবাহিত করিতেছে কে? তুমিই। আমরাই দেহের প্রভু এবং উহাতে বাস করিতেছি। দেহ কিভাবে আবার তরুণ করিয়া তোলা যায়, সেই জ্ঞান আমরা হারাইয়া ফেলিয়াছি। আমরা যন্ত্রতুল্য স্বয়ংক্রিয়-অবনত হইয়া পড়িয়াছি। আমরা দেহের পরমাণুগুলির বিন্যাসপ্রণালী ভূলিয়া গিয়াছি। সুতরাং এখন আমরা যন্ত্রের মতো যাহা করিতেছি, তাহা জ্ঞাতসারে করিতে হইবে। আমরাই দেহের প্রভু, সুতরাং আমাদিগকেই সেই বিন্যাসপ্রণালী নিয়মিত করিতে হইবে। ইহাতে কৃতকার্য হইলেই আমরা ইচ্ছামত দেহকে আবার তরুণ করিয়া তুলিতে সমর্থ হইব; তখন আমাদের জন্ম, ব্যাধি, মৃত্যু-কিছুই থাকিবে না।
সতি মূলে তদ্বিপাকো জাত্যায়ুর্ভোগাঃ ।।১৩।।
-মনে এই সংস্কাররূপ মূল থাকায় তাহার ফলস্বরূপ মনুষ্যাদি জাতি, ভিন্ন ভিন্ন পরমায়ু ও সুখদুঃখাদি ভোগ হয়।
মূল অর্থাৎ সংস্কাররূপ কারণগুলি ভিতরে থাকে, তাহারাই ব্যক্তভাব ধারণ করিয়া ফলরূপে পরিণত হয়। কারণের নাশ হইয়া কার্যের উদয় হয়, আবার কার্য সূক্ষ্মভাব ধারণ করিয়া পরবর্তী কার্যের কারণস্বরূপ হয়। বৃক্ষ বীজ প্রসব করে, বীজ আবার পরবর্তী বৃক্ষের উৎপত্তির কারণ হয়; এইরূপেই কার্যকারণপ্রবাহ চলিতে থাকে। আমাদের এখানকার কাজকর্ম সবই পূর্বসংস্কারের ফলস্বরূপ। এই কার্যগুলি আবার সংস্কারে পরিণত হইয়া ভবিষ্যৎ কার্যের কারণ হইবে; এই ভবেই চলিতে থাকে। এইজন্যই এই সূত্র বলিতেছে, কারণ থাকিলে তাহার ফল বা কার্য অবশ্যই হইবে। এই ফল প্রথমতঃ ‘জাতি’রূপে প্রকাশ পায়; কেহ বা মানুষ হইবে, কেহ দেবতা, কেহ পশু, কেহ বা অসুর হইবে। তারপর এই কার্য আবার আয়ুকেও নিয়মিত করে। একজন হয়তো পঞ্চাশ বৎসর বাঁচে, আর একজন একশত বৎসর, আবার কেহ হয়তো দুই বৎসর বয়সেই মরিয়া যায়; সে আর পূর্ণবষস্ক হয় না। জীবনের এই-সব বিভিন্নতা পূর্বকর্মদ্বারাই নিয়মিত হয়। কেহ যেন সুখভোগের জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছে; যদি সে বনে গিয়া লুকাইয়া থাকে, সুখ তাহাকে অনুসরণ করিবে। আর একজন যেখানেই যায়, দুঃখ তাহাকে অনুসরণ করে, সবই তাহার নিকট দুঃখময়। এই-সবই তাহাদের নিজ নিজ পূর্বকর্মের ফল। যোগীদিগের মতে পুণ্যকর্ম হইতে সুখ, পাপকর্ম হইতে দুঃখ উৎপন্ন হয়। যে ব্যক্তি অসৎ কাজ করে, সে নিশ্চয়ই দুঃখকষ্টরূপে তাহার কৃতকর্মের ফলভোগ করিবে।
তে হ্লাদপরিতাপফলাঃ পূণ্যাপুণ্যহেতুত্বাৎ ।।১৪।।
-পুণ্য ও পাপ উহাদের কারণ বলিয়া উহাদের ফল যথাক্রমে আনন্দ ও দুঃখ।
পরিণামতাপ-সংস্কারদুঃখৈর্গুণবৃত্তিবিরোধাচ্চ
দুঃখমেব সর্বং বিবেকিনঃ ।।১৫।।
-কি পরিণাম-কালে, কি ভোগ-কালে ভোগ-ব্যাঘাতের আশাঙ্কায় অথবা সুখ-সংস্কারজনিত নূতন তৃষ্ণা উৎপন্ন হয় বলিয়া এবং গুণবৃত্তি (অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ) পরস্পরের বিরোধী বলিয়া বিবেকীর নিকট সবই যেন দুঃখ বলিয়া বোধ হয়।
যোগীরা বলেন, যাঁহার বিবেকশক্তি আছে, যাঁহার একটু ভিতরের দিকে দৃষ্টি আছে, তিনি সুখ ও দুঃখ নামধেয় সর্ববিধ বস্তুর অন্তস্তল পর্যন্ত দেখিয়া থাকেন, আর জানিতে পারেন উহারা সর্বদা সর্বত্র সমভাবে রহিয়াছে। একটির সঙ্গে আর একটি যেন জড়াইয়া, একটি যেন আর একটিতে মিশিয়া আছে। সেই বিবেকী পুরুষ দেখিতে পান যে, মানুষ সমগ্র জীবন কেবল এক আলোয়ার অনুসরণ করিতেছে; সে কখনই তাহার বাসনাপূরণে সমর্থ হয় না। এক সময়ে মহারাজ যুধিষ্ঠির বলিয়াছেন, ‘জীবনে সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ঘটনা এই যে, প্রতি মুহূর্তেই প্রাণিগণকে মৃত্যুমুখে পতিত হইতে দেখিয়াও মনে করিতেছি, আমরা কখনই মরিব না।’১ চতুর্দিকে মূর্খদ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া মনে করিতেছি, শুধু আমরাই পন্ডিত-শুধু আমরাই মূর্খশ্রেণী হইতে স্বতন্ত্র। সর্বপ্রকার চঞ্চলতার অভিজ্ঞতা দ্বারা বেষ্টিত হইয়া আমরা মনে করিতেছি, আমাদের ভালবাসাই একমাত্র স্থায়ী ভালবাসা। ইহা কি করিয়া হইতে পারে? ভালবাসাও স্বার্থপরতা-মিশ্রিত। যোগী বলেন, ‘পরিণামে দেখিতে পাইব, এমন কি পতিপত্মীর প্রেম, সন্তানের প্রতি ভালবাসা, বন্ধুদের প্রীতি-সবই অল্পে অল্পে ক্ষীণ হইয়া আসে।’ এই সংসারে ক্ষয় প্রত্যেক বস্তুকেই আক্রমণ করিয়া থাকে। যখনই সংসারের সকল বাসনা, এমন কি ভালবাসা পর্যন্ত বিফল হয়, তখনই যেন চকিতের ন্যায় মানুষ বুঝিতে পারে এই জগৎ কিভাবে ব্যর্থ, কতখানি স্বপ্নসদৃশ! তখনই তাহার চোখে বৈরাগ্যের ক্ষণিক আলো দেখা দেয়, তখনই সে অতীন্দ্রিয় সত্তার যেন একটু আভাস পায়। এই জগৎকে ত্যাগ করিলেই জগদতীত তত্ত্বটি হৃদয়ে উদ্ভাসিত হয়; এই জগতের সুখে আসক্ত থাকিলে ইহা কখনও সম্ভব হইতে পারে না। এমন কোন মহাত্মা জন্মগ্রহণ করেন নাই, যাঁহাকে এই উচ্চাবস্থা লাভের জন্য ইন্দ্রিয়সুখভোগ ত্যাগ করিতে হয় নাই। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিগুলির পরস্পর বিরোধই দুঃখের কারণ। একটি মানুষকে একদিকে অপরটি আর একদিকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে, কাজেই স্থায়ী সুখ অসম্ভব হইয়া পড়ে।
হেয়ং দুঃখমনাগতম্ ।।১৬।।
-যে দুঃখ এখনও আসে নাই, তাহা ত্যাগ করিতে হইবে।
১ অনন্যহনি ভূতানি গচ্ছন্তি ষমমন্দিরম্।
শেষাঃ স্থিরত্বমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্ষমতঃপরম-মহাভারত, বনপর্ব
কর্মের কিঞ্চিদংশ আমাদের ভোগ হইয়া গিয়াছে, কিঞ্চিদংশ আমরা বর্তমানে ভোগ করিতেছি, অবশিষ্টাংশ ভবিষ্যতে ফলপ্রদানোন্মুখ হইয়া আছে। আমাদের যাহা ভোগ হইয়া গিয়াছে, তাহা তো চুকিয়া গিয়াছে। আমরা বর্তমানে যাহা ভোগ করিতেছি, তাহা আমাদিগকে ভোগ করিতেই হইবে, কেবল যে-কার্য ভবিষ্যতে ফলপ্রদানোন্মুখ হইয়া আছে, তাহাই আমরা জয় করিয়া নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিব। এই দিকেই আমাদের সকল শক্তি নিয়োজিত করিতে হইবে। এজন্যই পতঞ্জলি বলিয়াছেন (২।১০)-সংস্কারগুলিকে কারণে লয় করিয়া নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে।
দ্রষ্টৃ দৃশ্যয়োঃ সংযোগো হেয়হেতুঃ ।।১৭।।
-এই যে হেয়, অর্থাৎ যে দুঃখকে ত্যাগ করিতে হইবে, তাহার কারণ দ্রষ্টা ও দৃশ্যের সংয়োগ।
এই দ্রষ্টার অর্থ কি? মানুষের আত্মা-পুরুষ। দৃশ্য কি? মন হইতে আরম্ভ করিয়া স্থূল ভূত পর্যন্ত সমুদয় প্রকৃতি। এই পুরুষ ও (প্রকৃতির) মনের সংযোগ হইতে সমুদয় সুখদুঃখ উৎপন্ন হইয়াছে। তোমাদের অবশ্য স্মরণ আছে, এই যোগশাস্ত্রের মতে পুরুষ শুদ্ধস্বরূপ; যখনই উহা প্রকৃতির সহিত সংযুক্ত হয়, তখনই প্রকৃতিতে প্রতিবিম্বিত হইয়া সুখ বা দুঃখ অনুভব করে বলিয়া মনে হয়।
প্রকাশক্রিয়াস্থিতিশীলং ভূতেন্দ্রিয়াত্মকং ভোগাপবর্গার্থং দৃশ্যম্ ।।১৮।।
-‘দৃশ্য’ বলিতে ভূত ও ইন্দ্রিয়গণকে বুঝায়। উহা প্রকাশ-ক্রিয়া-ও স্থিতিশীল। উহা দ্রষ্টার অর্থাৎ পুরুষের ভোগ ও মুক্তির জন্য।
দৃশ্য অর্থাৎ প্রকৃতি ভূত ও ইন্দ্রিয়সমষ্টি দ্বারা গঠিত; ভূত বলিতে স্থূল, সূক্ষ্ম সর্বপ্রকার ভূতকে বুঝাইবে, আর ইন্দ্রিয় অর্থে চক্ষুরাদি সমুদয় ইন্দ্রিয়, মন প্রভূতিকেও বুঝাইবে। উহাদের ধর্ম বা গুণ আবার তিন প্রকার, যথা-প্রকাশ, কার্য ও জড়তা। ইহাদিগকেই অন্য ভাষায় সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ বলে। সমুদয় প্রকৃতির উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য-যাহাতে পুরুষ সমুদয় ভোগ করিয়া অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে পারেন। পুরুষ যেন আপনার মহান্ ঐশ্বরিক ভাব বিস্মৃত হইয়াছেন; এ-বিষয়ে একটি বড় সুন্দর আখ্যায়িকা আছে। কোন সময়ে দেবরাজ ইন্দ্র শূকর হইয়া কর্দমের ভিতর বাস করিতেন, তাঁহার অবশ্য একটি শূকরী ছিল, সেই শূকরী হইতে তাঁহার অনেকগুলি শাবক হইয়াছিল। দেবতারা তাঁহার দুরবস্থা দর্শন করিয়া তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন, ‘আপনি দেবরাজ, দেবতারা আপনার শাসনে বাস করেন; আপনি এখানে কেন?’ ইন্দ্র উত্তর দিলেন, ‘আমি বেশ আছি, কিছু ভাবিও না; এই শূকরী ও শাবকগুলি যতদিন আছে, ততদিন স্বর্গাদি কিছুই প্রার্থনা করি না।’ তখন সেই দেবগণ কি করিবেন ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কিছুদিন পরে তাঁহারা স্থির করিলেন, একে একে শাবকগুলি সব মারিয়া ফেলিতে হইবে। এইরূপে
একটি একটি করিয়া শাবকগুলি সব নিহত হইলে দেবগণ অবশেষে সেই শূকরীকেও মারিয়া ফেলিলেন। তখন ইন্দ্র কাতর হইয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন; দেবতারা ইন্ত্রের শূকরদেহটি চিরিয়া ফেলিলেন। তখন ইন্দ্র সেই শূকরদেহ হইতে নির্গত হইয়া হাসিতে লাগিলেন এবং ভাবিতে লাগিলেন, ‘কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখিতেছিলাম! আমি দেবরাজ, আমি এই শূকরজন্মকেই একমাত্র জন্ম বলিয়া মনে করিতেছিলাম; শুধু তাই নয়; সমগ্র জগৎ শূকরদেহ ধারণ করুক,-আমি এইরূপ ইচ্ছাও করিতেছিলাম।’ পুরুষও এইভাবে প্রকৃতির সহিত মিলিত হইয়া বিস্মৃত হন যে, তিনি শুদ্ধস্বভাব ও অনন্তস্বরূপ। পুরুষকে ‘অস্তিত্ববান্’ বলিতে পারা যায় না, কারণ পুরুষ স্বয়ং অস্তিত্বস্বরূপ। পুরুষ বা আত্মাকে ‘জ্ঞানী’ বলিতে পারা যায় না, কারণ আত্মা স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ। তাঁহাকে ‘প্রেমসম্পন্ন’ বলিতে পারা যায় না, কারণ তিনি স্বয়ং প্রেমস্বরূপ। আত্মা অস্তিত্ববান্, জ্ঞানযুক্ত অথবা প্রেমময়-এরূপ বলা ভুল। প্রেম, জ্ঞান ও অস্তিত্ব পুরুষের গুণ নয়, ঐগুলি তাঁহার স্বরূপ। যখন ঐগুলি কোন বস্তুর উপর প্রতিবিম্বিত হয়, তখন ঐগুলিকে সেই বস্তুর গুণ বলিতে পারা যায়। কিন্তু এগুলি পুরুষের গুণ নয়, এগুলি সেই মাহান্ আত্মার-অনন্ত পুরুষের স্বরূপ-তাঁহার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, তিনি নিজ মহিমায় বিরাজ করিতেছেন। কিন্তু তিনি স্বরূপ ভুলিয়া এতদূর অধঃপতিত হইয়াছেন যে, যদি তুমি তাঁহার নিকট গিয়া বলো, ‘তুমি শূকর নও’, তিনি চীৎকার করিতে থাকিবেন ও তোমাকে কামড়াইতে আরম্ভ করিবেন।
মায়ার মধ্যে-এই স্বপ্নময় জগতের মধ্যে আমাদেরও সেই দশা হইয়াছে। এখানে কেবল রোদন, কেবল দুঃখ, কেবল হাহাকার-এখানে কয়েকটি সুবর্ণগোলক গড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে আর সমুদয় জগৎ উহা পাইবার জন্য কাড়াকাড়ি করিতেছে। তুমি কোন নিয়মেই কখন বদ্ধ ছিলে না। প্রকৃতির বন্ধন তোমাতে কোন কালেই নাই। যোগী তোমাকে ইহাই শিক্ষা দিয়া থাকেন, ধৈর্যের সহিত ইহা শিক্ষা কর। যোগী তোমাকে বুঝাইয়া দিবেন, কিরূপে-এই প্রকৃতির সহিত যুক্ত হইয়া, মন ও জগতের সহিত এক করিয়া ফেলিয়া পুরুষ নিজেকে দুঃখী ভাবিতেছেন। যোগী আরও বলেন, এই দুঃখময় সংসার হইতে অব্যাহিত পাইবার উপায় অভিজ্ঞতা-অর্জনের মধ্য দিয়া। অভিজ্ঞতা লাভ করিতে হইবে নিশ্চয়ই, তবে যত শীঘ্র উহা শেষ করিয়া ফেলা যায়, ততই মঙ্গল। আমরা নিজেদের এই জালে ফেলিয়াছি, আমাদিগকে ইহার বাহিরে যাইতে হইবে। আমরা নিজেরা এই ফাঁদে পা দিয়াছি, নিজ চেষ্টাতেই আমাদিগকে ইহা হইতে মুক্তি লাভ করিতে হইবে। অতএব এই পতিপত্নীপ্রেম, বন্ধুপীতি ও অন্যান্য যেসকল ছোটখাট স্নেহ-ভালবাসার আকাঙ্ক্ষা আছে, সবই ভোগ করিয়া লও। যদি নিজের স্বরূপ সর্বদা স্মরণ থাকে, তাহা হইলে তুমি শীঘ্রই নির্বিঘ্নে ইহা হইতে উত্তীর্ণ হইয়া যাইবে। কখনও ভুলিও না-এই অবস্থা অতি অল্পক্ষণের জন্য এবং আমাদিগকে ঊহার মধ্য দিয়া যাইতেই হইবে। অভিজ্ঞতাই-আমাদের একমাত্র মহান্ শিক্ষক, কিন্তু ঐ সুখদুঃখগুলিকে কেবল সাময়িক অভিজ্ঞতা বলিয়াই যেন মনে থাকে। এগুলি ধাপে
ধাপে আমাদিগকে এমন এক অবস্থায় লইয়া যাইবে, যেখানে জগতের সমুদয় বস্তু অতি তুচ্ছ হইয়া যাইবে, পুরুষ তখন বিশ্বব্যাপী বিরাটরূপে পরিণত হইবেন, সমুদয় জগৎ তখন যেন সমুদ্রে একবিন্দু জলের মতো মনে হইবে, এবং উহা আপনিই শূন্যে বিলীন হইয়া যাইবে। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া আমাদিগকে যাইতেই হইবে, কিন্তু আমরা যেন আমাদের চরম লক্ষ্য কখনই বিস্মৃত না হই।
বিশেষাবিশেষলিঙ্গমাত্রালিঙ্গানি গুণপর্বাণি ।।১৯।।
-গুণের এই কয়েকটি অবস্থা আছে, যথা-বিশেষ, অবিশেষ, চিহ্নমাত্র (মহৎ) ও চিহ্ন-শূন্য (প্রকৃতি)।
আমি আপনাদিগকে পূর্ব পূর্ব বক্তৃতায় বলিয়াছি, যোগশাস্ত্র সাংখ্যদর্শনের উপর স্থাপিত; এখানেও পুনর্বার সাংখ্যদর্শনের জগৎসৃষ্টি-প্রকরণ আপনাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিব। সাংখ্যমতে প্রকৃতিই জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ-দুই-ই। এই প্রকৃতিতে আবার ত্রিবিধ উপাদান আছে, যথা-সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ। তমঃ উপাদানটি অন্ধকার, যাহা কিছু অজ্ঞানাত্মক ও গুরু পদার্থ সবই তমোময়। রজঃ ক্রিয়াশক্তি। সত্ত্ব শান্তভাব-প্রকাশস্বভাব। সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতি যে অবস্থায় থাকে, তাহাকে বলে ‘অব্যক্ত’-অবশেষ বা অবিভক্ত; ইহার অর্থ-যে অবস্থায় নামরূপের বিভাগ নাই, যে অবস্থায় ঐ তিনটি পদার্থ ঠিক সাম্যভাবে থাকে। তারপর ঐ সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়, এই তিন উপাদান বিবিধভাবে পরস্পর মিশ্রিত হইতে থাকে, তাহার ফল এই জগৎ। প্রত্যেক ব্যক্তিতেও এই তিনটি উপাদান বিরাজমান। যখন সত্ত্ব প্রবল হয়, তখন জ্ঞানের উদয় হয়; রজঃ প্রবল হইলে ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়, আবার তমঃ প্রবল হইলে অন্ধকার, আলস্য ও অজ্ঞান আমাদের আচ্ছন্ন করে। সাংখ্যমতানুসারে ত্রিগুণময়ী প্রকৃতির সর্বোচ্চ প্রকাশ ‘মহৎ’ অথবা বুদ্ধিতত্ত্ব-উহাকে সমষ্টি-বুদ্ধি বলা যায়, ব্যষ্টি মনুষ্যবুদ্ধি উহারই একটি অংশমাত্র। সাংখ্য মনোবিজ্ঞানে ‘মন’ ও ‘বুদ্ধি’র মধ্যে বিশেষ প্রভেদ আছে। মনের কার্য কেবল বিষয়াভিঘাত-জনিত বেদনাগুলিকে সংগ্রহ করিয়া বুদ্ধি অর্থাৎ ব্যষ্টি মহতের সমীপে উপনীত করা। বুদ্ধি ঐ-সকল বিষয় নিশ্চয় করে। মহৎ হইতে অহংতত্ত্ব ও অহংতত্ত্ব হইতে সূক্ষ্মভূতের উৎপত্তি হয়। এই সূক্ষ্মভূতসকল আবার পরস্পর মিলিত হইয়া এই বাহ্য স্থূলভূতরূপে পরিণত হয়; তাহা হইতেই এই স্থূল জগতের উৎপত্তি; সাংখ্যদর্শনের মত-বুদ্ধি হইতে আরম্ভ করিয়া একখন্ড প্রস্তর পর্যন্ত সবই এক উপাদান হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, কেবল সূক্ষ্মতা ও স্থূলতা লইয়াই উহাদের প্রভেদ। সূক্ষ্ম কারণ, স্থূল কার্য। সাংখ্যদর্শনের মতে পুরুষ সমুদয় প্রকৃতির বাহিরে-তিনি জড় নন; বুদ্ধি, মন, তন্মাত্র অথবা স্থূলভূত কোন কিছুর সদৃশ নন। ইনি সম্পূর্ণ পৃথক্, ইঁহার স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইহা হইতে তাঁহারা সিদ্ধান্ত করেন যে, পুরুষ অবশ্যই মৃত্যুরহিত, কারণ তিনি কোন প্রকার মিশ্রণ হইতেই
উৎপন্ন নন। যাহা মিশ্রণ হইতে উৎপন্ন নয়, তাহার কখনও নাশ হইতে পারে না। এই পুরুষ বা আত্মা-সমূহের সংখ্যা অসীম।
এখন আমরা এই সূত্রটির তাৎপর্য বুঝিতে পারিব। ‘বিশেষ’ অর্থে স্থূলভূত-যেগুলিকে আমরা ইন্দ্রিয়দ্বারা উপলব্ধি করিতে পারি। ‘অবিশেষ’ অর্থে সূক্ষ্মভূত -তন্মাত্র, এই তন্মাত্র সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করিতে পারে না। পতঞ্জলি বলেন, ‘যদি তুমি যোগাভ্যাস কর, কিছুদিন পরে তোমার অনুভব-শক্তি এত সূক্ষ্ম হইবে যে, তুমি তন্মাত্রগুলি বাস্তবিক পত্যক্ষ করিবে।’ তোমরা শুনিয়াছ, প্রত্যেক ব্যক্তির চারিদিকে এক প্রকার জ্যোতিঃ আছে, প্রত্যেক প্রাণীর ভিতর হইতে সর্বদা এক প্রকার আলোক বাহির হইতেছে। পতঞ্জলি বলেন, কেবল যোগীই উহা দেখিতে পান। আমরা সকলে উহা দেখিতে পাই না, কিন্তু যেমন পুষ্প হইতে সর্বদাই সূক্ষ্মকণা নির্গত হয়, যেগুলি দ্বারা আমরা আঘ্রাণ পাই, সেইরূপ আমাদের শরীর হইতেও সর্বদাই এই তন্মাত্রসকল বাহির হইতেছে। প্রত্যহই আমাদের শরীর হইতে শুভ বা অশুভ শক্তি ও ভাবরাশি বাহির হইতছে; এবং আমরা যেখানেই যাই, সেখানেই পরিবেশ এই তন্মাত্রয় পূর্ণ থাকে। ইহার প্রকৃত রহস্য না জানিলেও এইভাবেই অজ্ঞাতসারে মানুষের মনে মন্দির, গির্জাদি করিবার ভাব আসিয়াছে। ভগবানকে উপাসনা করিবার জন্য মন্দিরনির্মাণের কি প্রয়োজন ছিল? যেখানে সেখানে ঈশ্বরের উপাসনা কর না কেন? কারণ না জানিলেও মানুষ বুঝিয়াছিল যে, যেখানে লোকে ঈশ্বরের উপাসনা করে, সে স্থান পবিত্র তন্মাত্রয় পরিপূর্ণ হইয়া যায়। সকলে প্রত্যহ সেখানে যায়, সেখানে যতই বেশী যাতায়াত করে, ততই মানুষ পবিত্র হইতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে স্থানটিও পবিত্রতর হইতে থাকে। যে ব্যক্তির অন্তরে বেশী সত্ত্বগুণ নাই, সে যদি সেখানে যায়, তাহারও সত্ত্বগুণের উদ্রেক হইবে। অতএব মন্দির ও তীর্থাদি কেন পবিত্র বলিয়া গণ্য হয়, তাহার কারণ বুঝা গেল। কিন্তু এটি সর্বদাই স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সাধু লোকের সমাগমের উপরেই সেই স্থানের পরিত্রতা নির্ভর করে। কিন্তু মুশকিল এই যে, মানুষ মূল উদ্দেশ্য ভুলিয়া যায়-অশ্বের সন্মুখে শকট যোজনা করে। প্রথমে মানুষই এই স্থানগুলিকে পবিত্র করিয়াছিল, তারপর সেই স্থানের পবিত্রতা আবার কারণ হইয়া অপরকেও পবিত্র করিত। যদি সে স্থানে সর্বদা অসাধু লোকই যাতায়াত করে, তাহা হইলে সেই স্থান অন্যান্য স্থানের মতোই অপবিত্র হইয়া যাইবে। বাড়িঘরের গুণে নয়, লোকের গুণেই মন্দির পবিত্র বলিয়া গণ্য হয়; কিন্তু এটি আমরা সর্বদা ভুলিয়া যাই। এই কারণেই সমধিক সত্ত্বগুণসম্পন্ন সাধু ও মহাত্মাগণ চতুর্দিকে ঐ সত্ত্বগুণ বিকিরণ করিয়া তাঁহাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ লোকের উপর দিনরাত প্রচন্ড প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন। মানুষ এত পবিত্র হইতে পারে যে, তাহার সেই পবিত্রতা যেন স্পর্শ করা যায়। সাধুর শরীর পবিত্র, তিনি যেখানে বিচরণ করেন, সেখানেই পবিত্রতা বিচ্ছুরিত হয়। যে কেহ তাঁহার সংস্পর্শে আসে, সে-ই পবিত্র হইয়া যায়।
এখন ‘লিঙ্গমাত্র’-এর অর্থ কি, দেখা যাক। ‘লিঙ্গমাত্র’ বলিতে বুদ্ধিকে বুঝায়; উহা প্রকৃতির প্রথম অভিব্যক্তি, উহা হইতেই অন্যান্য সমুদয় বস্তু অভিব্যক্ত হইয়াছে। গুণের শেষ অবস্থাটির নাম ‘অলিঙ্গ’ বা চিহ্নশূন্য। এইখানেই আধুনিক বিজ্ঞান ও ধর্মগুলির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখা যায়। প্রত্যেক ধর্মেই এই ভাবটি দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই জগৎ চৈতন্যশক্তি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ঈশ্বর আমাদের ন্যায় ব্যক্তিবিশেষ কিনা, এ বিচার ছাড়িয়া দিয়া কেবল মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়া ধরিলে ঈশ্বরবাদের তাৎপর্য এই যে, চৈতন্যই সৃষ্টির আদি বস্তু; তাহা হইতেই স্থূলভূতের প্রকাশ হইয়াছে। কিন্তু আধুনিক দার্শনিক পন্ডিতেরা বলেন, চৈতন্য সৃষ্টির শেষ বস্তু। তাঁহাদের মত এই যে, অচেতন জড় বস্তুসকল অল্পে অল্পে জীবজন্তুতে পরিণত হইয়াছে, এই জীবজন্তু ক্রমশঃ উন্নত হইয়া মনুষ্যরূপে বিকশিত হইয়াছে। তাঁহারা বলেন, জগতে সমুদয় বস্তু যে চৈতন্য হইতে প্রসৃত হইয়াছে তাহা নয়, বরং চৈতন্যই সৃষ্টির সর্বশেষ বস্তু। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত আপাতবিরূদ্ধ বলিয়া মনে হইলেও দুইটি সিদ্ধান্তই সত্য। একটি অনন্ত শৃঙ্খল বা শ্রেণী গ্রহণ কর, যেমন ক-খ-ক-খ-ক-খ-ইত্যাদি; প্রশ্ন এই, ইহার মধ্যে ক আদিতে অথবা খ আদিতে? যদি তুমি এই শৃঙ্খলটিকে ক-খ এইরূপে গ্রহণ কর, তাহা হইলে অবশ্য ‘ক’কে প্রথম বলিতে হইবে, কিন্তু যদি তুমি উহাকে খ-ক এইভাবে গ্রহণ কর, তাহা হইলে ‘খ’কেই আদি ধরিতে হইবে। আমরা যে দিক দিয়া দেখিতেছি, তাহার উপর উহা নির্ভর করে। চৈতন্য পরিণামপ্রাপ্ত ইহয়া স্থূলভূতের আকার ধারণ করে, স্থূলভূত আবার চৈতন্যরূপে পরিণত হয়, এইভাবেই চলিতে থাকে। সাংখ্যেরা ও অন্যান্য ধর্মাচার্যগণ চৈতন্যকে অগ্রে স্থাপন করেন। তাহাতে ঐ শৃঙ্খল এই আকার ধারণ করে, যথা-প্রথমে চৈতন্য, পরে জড়। বৈজ্ঞানিক জড়কে গ্রহণ করিয়া বলেন, ‘প্রথমে জড়, পরে চৈতন্য’। উভয়েই একই শৃঙ্খলের কথা বলিতেছেন। ভারতীয় দর্শন কিন্তু এই চৈতন্য ও জড়-উভয়েরই পারে পুরুষ বা আত্মাকে দেখিতে পান। এই আত্মা বুদ্ধির অতীত; বুদ্ধি তাঁহারই প্রতিফলিত আলোক।
দ্রষ্টা দৃশিমাত্রঃ শুদ্ধোহপি প্রত্যয়ানুপশাঃ ।।২০।।
-দ্রষ্টা কেবল চৈতন্য মাত্র; যদিও তিনি স্বয়ং পবিত্রস্বরূপ, তথাপি বুদ্ধির ভিতর দিয়া তিনি দেখিয়া থকেন।
এখানেও সাংখ্যদর্শনের কথা বলা হইয়াছে। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, সাংখ্যদর্শনের এই মত যে, নিম্নতম বিকাশ হইতে বুদ্ধি পর্যন্ত সবই প্রকৃতির অন্তর্গত; পুরুষগণ প্রকৃতির বাহিরে, এই পুরুষগণের কোন গুণ নাই। তবে আত্মা দুঃখী বা সুখী বলিয়া প্রতীয়মান হন কেন? প্রতিফলনের দ্বারা। একখন্ড স্ফটিকের নিকট একটি লাল ফুল রাখিলে ঐ স্ফটিকটিকে লাল দেখাইবে; সেইরূপ আমরা যে সুখ বা দুঃখ বোধ করিতেছি, তাহা বাস্তবিক প্রতিবিম্ব মাত্র, বাস্তবিক আত্মাতে এ-সকল কিছুই নাই। আত্মা প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ বস্তু। প্রকৃতি এক বস্তু, আত্মা এক বস্তু, এই দুই চিরদিন পৃথক্। সাংখ্যেরা বলেন যে, (বুদ্ধিজাত) জ্ঞান একটি মিশ্র পদার্থ, উহার হ্রাসবৃদ্ধি আছে, উহা পরিবর্তনশীল; শরীরের ন্যায় উহাও ক্রমশঃ পরিণামপ্রাপ্ত হয়, শরীরের যে-সকল ধর্ম, উহাতেও প্রায় সে-সকল ধর্ম বিদ্যমান। শরীরের পক্ষে নখ যেমন, এই জ্ঞানের পক্ষে দেহও সেইরূপ। নখ শরীরের একটি অংশ, উহাকে শত শত বার কাটিয়া ফলিলেও শরীর বাঁচিয়া থাকে। সেইরূপ এই শরীর বহুবার পরিত্যক্ত হইলেও (বুদ্ধিজাত) জ্ঞান যুগযুগান্তর ধরিয়া থাকিবে। কিন্তু তাহা হইলেও এই জ্ঞান কখনও অবিনাশী হইতে পারে না, কারণ উহা পরিবর্তনশীল, উহার হ্রাসবৃদ্ধি আছে। আর যাহা কিছু পরিবর্তনশীল, তাহা কখনও অবিনাশী হইতে পারে না। এই জ্ঞান অবশ্যই জন্যপদার্থ। আর ইহা হইতেই বুঝাইতেছে, অন্য আর এক পদার্থ আছে। জন্যপদার্থ কখনও মুক্তস্বভাব হইতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সবকিছুই প্রকৃতির অন্তর্গত, সুতরাং চিরকালের জন্য বদ্ধ। তবে মুক্ত কে? যিনি কার্য-কারণ-সম্বন্ধের অতীত, তিনিই প্রকৃত মুক্ত। তুমি যদি বলো, মুক্তভাবটি ভ্রমাত্মক, আমি বলিব, বন্ধনের ভাবটিও ভ্রমাত্মক। আমাদের জ্ঞানে এই দুই ভাবই সদা বিরাজিত, পরস্পরের আশ্রিত-একটি না থাকিলে অপরটি থাকিতে পারে না। বন্ধন ও মুক্তি সম্বন্ধে ইহাই আমাদের ধারণা। যদি দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাইতে চাই, আমাদের মাথা দেওয়ালে ধাক্কা খায়; তাহা হইলে বুঝিলাম, আমরা ঐ দেওয়ালের দ্বারা সীমাবদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিলাম, আমাদের একটা ইচ্ছাশক্তি আছে। এবং মনে করি, এই ইচ্ছাশক্তিকে আমরা যেখানে ইচ্ছা পরিচালিত করিতে পারি। প্রতিপদে এই বিরোধী ভাব-দুইটি আমাদের সন্মুখে আসিতেছে। আমাদিগকে বিশ্বাস করিতেই হইবে আমরা মুক্ত; কিন্তু প্রতি মুহূর্তে দেখিতেছি, আমরা মুক্ত নই। দুইটি ভাবের মধ্যে একটি যদি ভ্রমাত্মক হয়, তবে অপরটিও ভ্রমাত্মক হইবে, আর একটি যদি সত্য হয় তবে অপরটিও সত্য হইবে, কারণ উভয়েই অনুভবরূপ একই ভিত্তির উপর স্থাপিত। যোগী বলেন, এই দুইটি ভাবই সত্য, বুদ্ধি পর্যন্ত ধরিলে আমরা বদ্ধ। কিন্তু আত্মা হিসাবে আমরা মুক্ত। মানুষের প্রকৃত স্বরূপ-আত্মা বা পুরুষ-কার্যকারণ-শৃঙ্খলের বাহিরে। এই আত্মার মুক্তস্বভাবটি জড়ের ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়া পরিস্রুত হইয়া বুদ্ধি, মন ইত্যাদি নানা আকার ধারণ করিয়াছে। আত্মারই জ্যোতিঃ সবকিছুর ভিতর দিয়া প্রকাশিত হইতেছে। বুদ্ধির নিজের কোন আলো নাই। মস্তিষ্কে প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই এক-একটি কেন্দ্র আছে। সকল ইন্দ্রিয়ের যে একটিমাত্র কেন্দ্র, তাহা নয়, প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্র পৃথক্ পৃথক্। তবে আমাদের এই অনুভূতিগুলি সামঞ্জস্য লাভ করে কিভাবে? কোথায় তাহারা একত্ব লাভ করে? মস্তিষ্কে যদি তাহারা এই একত্ব লাভ করিত, তাহা হইলে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলির একটি মাত্র কেন্দ্র থাকিত। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্র আছে। মানুষ কিন্তু একই সময়ে দেখিতে ও শুনিতে
পায়। ইহাতেই বোধ হইতেছে যে, এই বুদ্ধির পশ্চাতে অবশ্যই একটি একত্ব আছে। বুদ্ধি মস্তিষ্কের সহিত সম্বন্ধ-কিন্তু এই বুদ্ধিরও পশ্চাতে পুরুষ রহিয়াছেন। তিনিই একত্বস্বরূপ। তাঁহার নিকট গিয়াই সমুদয় বেদনা ও অনুভূতি মিলিত হয় ও একীভাব ধারণ করে। আত্মাই সেই কেন্দ্র, যেখানে সমুদয় ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতি মিলিত ও একীভূত হয়। সেই আত্মা মুক্তস্বভাব। এই আত্মার মুক্ত স্বাভাবই তোমাকে প্রতি মুহূর্তে বলিতেছে, তুমি মুক্ত। কিন্তু তুমি ভুল করিতেছ। সেই মুক্ত স্বভাবকে প্রতি মুহূর্তে বুদ্ধি ও মনের সহিত মিশ্রিত করিয়া ফেলিতেছ। তুমি সেই মুক্ত স্বভাব বুদ্ধিতে আরোপ করিবার চেষ্টা করিতেছ। আবার তৎক্ষণাৎ দেখিতে পাইতেছ যে, বুদ্ধি মুক্তস্বভাব নয়। তুমি তখন সেই মুক্ত স্বভাব দেহে আরোপ করিয়া থাকো, কিন্তু প্রকৃতি তোমাকে তৎক্ষণাৎ বলিয়া দেন, তুমি আবার ভুল করিয়াছ। এই জন্যই একই সময়ে আমাদের মুক্তি ও বন্ধনের মিশ্রিত অনুভূতি দেখিতে পাওয়া যায়। যোগী মুক্ত ও বদ্ধ, উভয় অবস্থারই বিশ্লেষণ করেন; এবং তাঁহার অজ্ঞানান্ধকার দূর হয়। তিনি বুঝিতে পারেন যে, পুরুষই মুক্ত, জ্ঞানঘন; বুদ্ধিরূপ উপাধির মধ্য দিয়া তিনিই এই সান্ত (সীমাবদ্ধ) জ্ঞানরূপে প্রকাশ পাইতেছেন, সেই হিসাবেই তিনি বদ্ধ।
তদর্থ এব দৃশ্যস্যাত্মা ।।২১।।
-দৃশ্যের (অর্থাৎ প্রকৃতির) আত্মা (স্বভাব, প্রকৃতি ও তাহার বিভিন্ন আকারে পরিণাম) চিন্ময় পুরুষেরই (ভোগ ও মুক্তির) জন্য।
প্রকৃতির নিজের কোন শক্তি নাই। যতক্ষণ পুরুষ উপস্থিত থাকেন, ততক্ষণই তাহার শক্তি প্রতীয়মান হয়। চন্দ্রের আলোক যেমন তাহার নিজের নয়, প্রতিফলিত -প্রকৃতির শক্তিও তদ্রূপ। যোগীদের মতে প্রকৃতির সমুদয় অভিব্যক্তি প্রকৃতি হইতেই উৎপন্ন; কিন্তু পুরুষকে মুক্ত করা ছাড়া প্রকৃতির নিজের কোন উদ্দেশ্য নাই।
কৃতার্থং প্রতি নষ্টমপ্যনষ্টং তদন্যসাধারণত্বাৎ ।।২২।।
-যিনি সেই পরম পদ লাভ করিয়াছেন, তাঁহার পক্ষে প্রকৃতি (বা অজ্ঞান) নষ্ট হইলেও উহা নষ্ট হয় না, কারণ অপরের পক্ষে উহা থাকে।
আত্মা যে প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, ইহা জানানোই প্রকৃতির সব কাজের একমাত্র লক্ষ্য। যখন আত্মা ইহা জানিতে পারেন, তখন প্রকৃতি আর তাঁহাকে কিছুতেই আকর্ষণ করিতে পারে না। যিনি মুক্ত হইয়াছেন, তাঁহার পক্ষেই সমুদয় প্রকৃতি লয় পায়। কিন্তু অনন্ত কোটি আত্মা বা পুরুষ চিরকালই থাকিবে, তাহাদের জন্য প্রকৃতি কার্য করিয়াই যাইবে।
স্বস্বামিশক্ত্যোঃ স্বরূপোপলব্ধিহেতুঃ সংযোগঃ ।।২৩।।
-দৃশ্য ও উহার প্রভু দ্রষ্টার শক্তিদ্বয়ের (ভোগ্যত্ব ও ভোক্তৃত্বরূপ) স্বরূপ উপলব্ধির হেতু সংযোগ।
এই সূত্রানুসারে-আত্মা ও প্রকৃতি যখন সংযুক্ত হন, তখনই (এই সংযোগবশতঃ) উভয়ের (যথাক্রমে দ্রষ্টৃত্ব ও দৃশ্যত্ব) দুই শক্তি প্রকাশিত হইয়া থাকে। তখনই এই জগৎপ্রপঞ্চ ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যক্ত হইতে থাকে। অজ্ঞানই এই সংযোগের হেতু। আমরা প্রতিদিনই দেখিতে পাইতেছি যে, আমাদের দুঃখ বা সুখের কারণ-শরীরের সহিত সংযোগ। যদি আমার এই নিশ্চয় জ্ঞান থাকিত যে, আমি শরীর নই, তবে আমার শীতগ্রীষ্ম বা অন্য কিছুরই খেয়াল থাকিত না। এই শরীর একটি সংহতি মাত্র। আমার একটি দেহ আছে, তোমার অন্য একটি দেহ আছে, সূর্যের আবার একটি পৃথক্ দেহ-এরূপ বলা কেবল রূপকথা-মাত্র। সমগ্র জগৎ জড়ের এক মহাসমুদ্র। সেই মহাসমুদ্রের এক বিন্দুর নাম ‘তুমি’, এক বিন্দুর নাম ‘আমি’ ও আর এক বিন্দুর নাম ‘সূর্য’। আমরা জানি, এই জড়রাশি সর্বদাই স্থান পরিবর্তন করিতেছে। আজ যাহা সূর্যের উপাদানভূত, কাল তাহা আমাদের শরীরের উপাদানে পরিণত হইতে পারে।
তস্য হেতুরবিদ্যা ।।২৪।।
-এই সংযোগের কারণ অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞান।
আমরা অজ্ঞানবশতঃ এক নির্দিষ্ট শরীরে নিজেদের আবদ্ধ করিয়া দুঃখের পথ উন্মুক্ত রাখিয়াছি। ‘আমি শরীর’ এই ধারণা একটি কুসংস্কার মাত্র। এই কুসংস্কারই আমাদিগকে সুখী বা দুঃখী করিতেছে। অজ্ঞান-প্রসূত এই কুসংস্কার হইতে আমরা শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ-এই সব বোধ করিতেছি। আমাদের কর্তব্য, এই সংস্কারকে অতিক্রম করা। কি করিয়া ইহা কার্যে পরিণত করিতে হইবে, যোগী তাহা দেখাইয়া দেন। ইহা প্রমাণিত হইয়াছে যে, মনের কোন বিশেষ অবস্থায় শরীর দগ্ধ হইলেও মানুষ কোন যন্ত্রণা বোধ করিবে না। তবে মনের এইরূপ আকস্মিক উচ্চাবস্থা হয়তো এক নিমিষের জন্য ঘূর্ণাবর্তের মতো আসে, আবার পরক্ষণেই চলিয়া যায়। কিন্তু যদি আমরা এই অবস্থা যোগের দ্বারা বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে লাভ করি, তাহা হইলে আমরা স্থায়িভাবে অনুভব করিব-শরীর হইতে আত্মা পৃথক্।
তদভাবাৎ সংযোগাভাবো হানং তদ্দৃশেঃ কৈবল্যম্ ।।২৫।।
-এই অজ্ঞানের অভাব হইলেই পুরুষ-প্রকৃতির সংযোগ নষ্ট হইয়া যায়। ইহাই হান (অজ্ঞানের পরিত্যাগ), ইহাই দ্রষ্টার কৈবল্যপদে অবস্থিতি বা মুক্তি।
যোগদর্শনের মতে আত্মা অবিদ্যাবশতঃ প্রকৃতির সহিত সংযুক্ত হইয়াছেন; প্রকৃতির প্রভাব হইতে মুক্ত হওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। ইহাই সকল ধর্মের একমাত্র লক্ষ্য।
আত্মামাত্রেই অব্যক্ত ব্রহ্ম। বাহ্য ও অন্তঃপ্রকৃতি বশীভূত করিয়া আত্মার এই ব্রহ্মভাব ব্যক্ত করাই জীবনের চরম লক্ষ্য। কর্ম, উপাসনা, মনঃসংযম অথবা জ্ঞান, এগুলির মধ্যে এক, একাধিক বা সকল উপায় দ্বারা এই ব্রহ্মভাব ব্যক্ত কর ও মুক্ত হও। ইহাই ধর্মের পূর্ণাঙ্গ। মত, অনুষ্ঠান-পদ্ধতি, শাস্ত্র, মন্দির বা বাহ্য ক্রিয়াকলাপ ধর্মের গৌণ অঙ্গ মাত্র। যোগী মনঃসংযমের দ্বারা এই চরম লক্ষ্যে উপনীত হইতে চেষ্টা করেন। যতদিন না আমরা প্রকৃতির প্রভাব হইতে নিজদিগকে মুক্ত করিতে পারি, ততদিন তো আমরা ক্রীতদাস; প্রকৃতি যেমন নির্দেশ দেয়, আমরা সেইভাবে চলিতে বাধ্য হই। যোগী বলেন, যিনি মনকে বশীভূত করিতে পারেন, তিনি জড়কেও বশীভূত করিতে পারেন। অন্তঃপ্রকৃতি বাহ্যপ্রকৃতি অপেক্ষা অনেক উচ্চতর, সুতরাং উহার সহিত সংগ্রাম করা-উহাকে জয় করা-অপেক্ষাকৃত কঠিন। এই কারণে যিনি অন্তঃপ্রকৃতি জয় করিয়াছেন, সমুদয় জগৎ তাঁহার বশীভূত, তাঁহার দাসস্বরূপ। প্রকৃতিকে এইরূপে বশীভূত করিবার উপায় রাজযোগে উপস্থাপিত হইয়াছে। আমরা বাহ্যজগতে যে-সকল শক্তির সহিত পরিচিত, তদপেক্ষা উচ্চতর শক্তিসমূহকে বশে আনিতে হইবে। এই শরীর মনের একটি বাহ্য আবরণ মাত্র। শরীর ও মন যে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বস্তু তাহা নয়, উহারা শুক্তি ও তাহার কঠিন আবরণের মতো। উহারা এক বস্তুরই দুইটি বিভিন্ন অবস্থা। শুক্তির অভ্যন্তরীণ পদার্থটি বাহির হইতে নানাপ্রকার উপাদান গ্রহন করিয়া ঐ বাহ্য আবরণ প্রস্তুত করে। এইভাবেই মনোনামধেয় এই অভ্যন্তরীণ সূক্ষ্ম-শক্তিসমূহও বাহির হইতে স্থূল পদার্থ লইয়া তাহা হইতে এই শরীররূপ বাহ্য আবরণ প্রস্তুত করিতেছে। সুতরাং যদি আমরা অন্তর্জগৎ জয় করিতে পারি, তবে বাহ্যজগৎ জয় করা খুব সহজ হইয়া পড়ে। আবার এই দুই শক্তি যে পরস্পর বিভিন্ন, তাহা নয়। কতকগুলি শক্তি শারীরিক ও কতকগুলি মানসিক, তাহা নয়। যেমন এই দৃশ্যমান জগৎ সূক্ষ্মজগতের স্থূল প্রকাশ মাত্র, তেমনি বাহ্য শক্তিগুলিও সূক্ষ্ম-শক্তির স্থূল প্রকাশ মাত্র।
সাধন পাদ
বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপয়ঃ ।।২৬।।
-নিরন্তর এই বিবেকের অভ্যাসই অজ্ঞান-নাশের উপায়।
সমুদয় সাধনের প্রকৃত লক্ষ্য এই সদসদ্বিবেক-একটি বিশেষরূপে জানা যে, পুরুষ প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র, পুরুষ জড়ও নন, মনও নন; আর উনি প্রকৃতি নন বলিয়া উঁহার কোনরূপ পরিবর্তনও সম্ভব নয়। কেবল প্রকৃতিই সর্বদা পরিণত হইতেছে, সর্বদাই উহার সংশ্লেষ, বিশ্লেষ ও পুনঃসংশ্লেষ ঘটিতেছে। যখন নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা আমরা এই বিবেকজ্ঞান লাভ করিব, তখনই অজ্ঞান চলিয়া যাইবে। তখনই পুরুষ স্ব-স্বরূপে অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান্ ও সর্বব্যাপিরূপে প্রতিভাত হইবেন।
তস্য সপ্তধা প্রান্তভূমিঃ প্রজ্ঞা ।।২৭।।
-তাঁহার (জ্ঞানীর) বিবেকজ্ঞানের সাতটি উচ্চতম স্তর আছে।
যখন এই জ্ঞান লাভ হইতে থাকে, তখন যেন উহা একটির পর আর একটি করিয়া সপ্তস্তরে আসিতে থাকে। যখন উহাদের মধ্যে একটি অবস্থা আরম্ভ হয়, আমরা তখন বুঝিতে পারি যে, আমরা জ্ঞানলাভ করিতেছি। প্রথমে এইরূপ অবস্থা আসিবে, মনে হইবে-‘যাহা জানিবার তাহা জানিয়াছি’; মনে তখন আর কোনরূপ অসন্তোষ থাকিবে না। যতক্ষণ আমাদের জ্ঞানপিপাসা থাকে, ততক্ষণ আমরা ইতস্ততঃ জ্ঞানের অনুসন্ধান করি। যেখানেই কিছু সত্য পাইব বলিয়া মনে হয়, অমনি সেদিকে ধাবিত হই। সেখানে উহা না পাইলে মনে অশান্তি আসে, আবার অন্য একদিকে সন্ধান করি। যতদিন না অনুভব করিতে পারি যে, সমুদয় জ্ঞান আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে, যতদিন না বোধ করি, কেহই আমাদিগকে সত্যলাভে সাহায্য করিতে পারে না, আমাদের নিজেদের নিজেকে সাহায্য করিতে হইবে, ততদিন সমুদয় সত্যান্বেষণই বৃথা। বিবেক অভ্যাস করিতে আরম্ভ করিলে আমরা যে সত্যের নিকটবর্তী হইতেছি, তাহার প্রথম এই লক্ষণ প্রকাশ পাইবে যে, ঐ অসন্তোষের ভাব চলিয়া যাইবে। আমাদের নিশ্চিত ধারণা হইবে, আমরা সত্য পাইয়াছি এবং ইহা সত্য ব্যতীত আর কিছুই হইতে পারে না। তখন আমরা জানিতে পারিব যে, সত্যস্বরূপ সূর্য উদিত হইতেছেন, আমাদের অজ্ঞান-রজনী প্রভাত হইতেছে। তখন সাহসে বুক বাঁধিয়া অধ্যবসায় অবলম্বন করিতে হইবে-যতদিন না সেই পরমপদ লাভ হয়। দ্বিতীয় অবস্থায় সমস্ত দুঃখ চলিয়া যাইবে। বাহ্য বা আভ্যন্তর কোন বিষয়ই তখন আমাদিগকে দুঃখ দিতে পারিবে না। তৃতীয় অবস্থায় আমরা পূর্ণ জ্ঞানলাভ করিব, অর্থাৎ সর্বজ্ঞ হইব। চতুর্থ অবস্থায় বিবেকসহায়ে সমুদয় কর্তব্যের অবসান হইবে। তারপর ‘চিত্তবিমুক্তি’ অবস্থা আসিবে। আমরা বুঝিতে পারিব, আমাদের বিঘ্নবিপত্তি সব চলিয়া গিয়াছে। যেমন কোন পর্বতের চূড়া হইতে একটি প্রস্তরখন্ড নিম্নে উপত্যকায় পতিত হইলে আর কখন উপরে উঠিতে পারে না, সেইরূপ মনের সংগ্রাম ও চঞ্চলতা সব নীচে পড়িয়া যাইবে, আর মনে উঠিবে না। পরবর্তী অবস্থায়-চিত্ত বুঝিতে পারিবে, ইচ্ছামাত্রেই উহা স্বকারণে লীন হইয়া যাইতেছে। অবশেষে দেখিতে পাইব, আমরা স্ব-স্বরূপে অবস্থিত আছি; দেখিব, এতদিন জগতে একাকী আত্মারূপে কেবল আমরাই ছিলাম। মন বা শরীরের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। উহারা তো আমাদিগের সহিত কখনই যুক্ত ছিল না। উহারা আপন আপন কাজ করিতেছিল, আমরা অজ্ঞানবশতঃ নিজদিগকে উহাদের সহিত যুক্ত করিয়াছিলাম। কিন্তু আমরা একাকী, নিঃসঙ্গ, কেবল, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী ও সদানন্দ। আমাদের আত্মা এত পবিত্র ও পূর্ণ যে, আমাদের আর কিছুরই আবশ্যক ছিল না। আমাদিগকে সুখী করিবার জন্য আর কাহাকেও প্রয়োজন ছিল না, কারণ আমরাই সুখস্বরূপ। আমরা দেখিতে পাইব, এই জ্ঞান অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে
না। জগতে এমন কিছুই নাই, যাহা আমাদের জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত না হইবে। ইহাই যোগীর চরম অবস্থা; যোগী তখন ধীর ও শান্ত হইয়া যান, আর কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করেন না, আর কখনও অজ্ঞান-মোহে ভ্রান্ত হন না এবং দুঃখ আর তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। তিনি জানিতে পারেন, ‘আমি নিত্যানন্দস্বরূপ, নিত্যপূর্ণস্বরূপ ও সর্বশক্তিমান্।’
যোগাঙ্গানুষ্ঠানাদশুদ্ধিক্ষয়ে জ্ঞানদীপ্তিরাবিবেকখ্যাতেঃ ।।২৮।।
-যোগের বিভিন্ন অঙ্গগুলি অনুষ্ঠান করিতে করিতে মনের মলিনতা দূর হইয়া গেলে জ্ঞান উদ্ভাসিত হইয়া উঠে; উহার শেষ সীমা বিবেক-খ্যাতি।
এখন সাধনের কথা বলা হইতেছে। এতক্ষণ যাহা বলা হইতেছিল, তাহা অনেক উচ্চতর ব্যাপার। উহা অনেক দূরে, অনেক ঊর্দ্ধ্বে, কিন্তু উহাই আমাদের আদর্শ। প্রথমতঃ শরীর ও মন সংযত করা আবশ্যক। তখনই পূর্বোক্ত আদর্শের উপলব্ধি স্থায়ী হইতে পারে। আদর্শ কি, তাহা আমরা জানিয়াছি; এখন উহা লাভের জন্য সাধন করিতে হইবে।
যম-নিয়মাসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধয়োহষ্টাবঙ্গানি ।।২৯।।
-যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি-এই আটটি যোগের অঙ্গস্বরূপ।
অহিংসা-সত্যাস্তেয়-ব্রহ্মচর্যাপরিগ্রহা যমাঃ ।।৩০।।
-অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ-এইগুলিকে ‘যম’ বলে।
পূর্ণ যোগী হইতে গেলে সাধককে স্ত্রী-পুরুষ-লিঙ্গভিমান ত্যাগ করিতে হইবে। আত্মার কোন লিঙ্গ নাই; তবে লিঙ্গভিমান দ্বারা নিজেকে অবনমিত করিবে কেন? পরে আমরা আরও স্পষ্ট বুঝিতে পারিব, কেন এই-সকল ভাব একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে। চৌর্য যেমন অসৎকার্য, পরিগ্রহ অর্থাৎ অপরের নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করাও সেইরূপ অসৎ কর্ম। যিনি অপরের নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করেন, তাঁহার মন দাতার মন দ্বারা প্রভাবিত হয়, সুতরাং যিনি দান গ্রহণ করেন, তাঁহার পতিত হইবার সম্ভাবনা। অপরের নিকট হইতে দান গ্রহণ করিলে মনের স্বাধীনতা নষ্ট হইতে পারে, আমরা ক্রীতদাসতুল্য হইয়া পড়িতে পারি। অতএব কোন দান গ্রহণ করিও না।১
এতে জাতি-দেশ-কাল-সময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্বভৌমা মহাব্রতম্ ।।৩১।।
-এইগুলি জাতি, দেশ, কাল ও সময় (অর্থাৎ সাময়িক কর্তব্য বা উদ্দেশ্য) দ্বারা
১ ‘যম’-এর প্রথম তিনটি সাধনের জন্য ‘সংক্ষেপে রাজযোগ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
অবচ্ছিন্ন বা সীমাবদ্ধ না হইলে সার্বভৌম (অর্থাৎ সর্বজনীন) মহাব্রত বলিয়া কথিত হয়।
এই সাধনগুলি অর্থাৎ অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ প্রত্যেক পুরুষ, স্ত্রী ও বালকের পক্ষে জাতি, দেশ অথবা অবস্থা-নির্বিশেষে অনুষ্ঠেয়।
শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ ।।৩২।।
-বাহ্য ও অন্তঃশৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (মন্ত্রজপ বা অধ্যাত্ম-শাস্ত্রপাঠ) ও ঈশ্বরোপাসনা এইগুলি ‘নিয়ম’।
বাহ্যশৌচ অর্থে শরীরকে পবিত্র রাখা; অশুচি ব্যক্তি কখনও যোগী হইতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃশৌচও আবশ্যক। পূর্বে সমাধিপাদ, ৩৩শ সূত্রে যে ধর্মগুলির কথা বলা হইয়াছে, তাহা হইতেই এই অন্তঃশৌচ আসে। অবশ্য বাহ্যশৌচ অপেক্ষা অন্তঃশৌচ অধিকতর প্রয়োজন, কিন্তু উভয়টিরই প্রয়োজনীয়তা আছে; আর অন্তঃশৌচ ব্যতীত কেবল বাহ্যশৌচ কোন কাজে আসে না।
বিতর্কবাধনে প্রতিপক্ষভাবনম্ ।।৩৩।।
-যোগের প্রতিবন্ধক ভাবসমূহ উপস্থিত হইলে ঐগুলির বিপরীত চিন্তা করিতে হইবে।
পূর্বে যে-সকল ধর্মের কথা বলা হইল সেগুলি অভ্যাস করিবার উপায়-মনে বিপরীত প্রকারে চিন্তাস্রোত প্রবাহিত করা; অন্তরে চৌর্যের ভাব আসিলে অচৌর্যের চিন্তা করিতে হইবে। দান গ্রহণ করিবার ইচ্ছা হইলে উহার বিপরীত চিন্তা করিতে হইবে।
বিতর্কা হিংসাদয়ঃ কৃতকারিতানুমোদিতা লোভক্রোধমোহপূর্বকা মৃদুমধ্যাধিমাত্রা
দুঃখাজ্ঞানানন্তফলা ইতি প্রতিপক্ষভাবনম্ ।।৩৪।।
-পূর্বসূত্রে যে প্রতিপক্ষ-ভাবনার কথা বলা হইয়াছে, তাহার প্রণালী এইরূপঃ বিতর্ক অর্থাৎ যোগের প্রতিবন্ধক হিংসাদি-কৃত, কারিত অথবা অনুমোদিত; উহাদের কারণ লোভ, ক্রোধ বা মোহ অর্থাৎ অজ্ঞান, তাহা অল্পই হউক আর মধ্যম পরিমাণই হউক, অথবা অধিক পরিমানই হউক; উহাদের ফল অনন্ত অজ্ঞান ও ক্লেশ; এইরূপ ভাবনাকেই প্রতিপক্ষ-ভাবনা বলে।
আমি নিজে মিথ্যা কথা বলিলে যে পাপ হয়, যদি আমি অপরকে মিথ্যা কথা বলিতে প্রবৃত্ত করি, অথবা অপরে মিথ্যা বলিলে তাহা অনুমোদন করি, তাহাতেও তুল্য পরিমাণ পাপ হয়। মিথ্যা সামান্য হইলেও উহা মিথ্যা। পর্বতগুহায় বসিয়াও যদি তুমি পাপ চিন্তা করিয়া থাকো, যদি কাহারও প্রতি অন্তরে ঘৃণা প্রকাশ করিয়া থাকো, তাহা
হইলে তাহাও সঞ্চিত থাকিবে, কালে আবার তাহা তোমার উপর প্রতিঘাত করিবে, একদিন না একদিন কোন না কোন প্রকার দুঃখের আকারে উহা প্রবলবেগে তোমাকে আক্রমণ করিবে। তুমি যদি ঈর্ষা ও ঘৃণার ভাব পোষণ কর এবং ঐ ভাব চতুর্দিকে প্রেরণ কর, তবে বর্ধিতভাবে উহা তোমার নিকট ফিরিয়া আসিবে। জগতের কোন শক্তিই উহা নিবারণ করিতে পারিবে না। তুমি যখন একবার ঐ শক্তি প্রেরণ করিয়াছ, তখন অবশ্য তোমাকে উহার প্রতিঘাত সহ্য করিতে হইবে। এইটি স্মরণ করিলে তুমি অসৎকার্য হইতে নিবৃত্ত হইবে।
অহিংসাপ্রতিষ্ঠায়াং তৎসন্নিধৌ বৈরত্যাগঃ ।।৩৫।।
-যাহার অন্তরে অহিংসা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তাহার সমীপে অপরের স্বাভাবিক বৈরিতাও পরিত্যক্ত হয়।
যদি কোন ব্যক্তি অহিংসার আদর্শ পূর্ণভাবে উপলব্ধি করেন, তবে তাহার সন্মুখে যে-সকল প্রাণী স্বভাবতই হিংস্র, তাহারাও শান্তভাব ধারণ করে। সেই যোগীর সন্মুখে ব্যাঘ্র ও মেষ-শাবক একত্র ক্রীড়া করিবে, পরস্পরকে হিংসা করিবে না। এই অবস্থা লাভ হইলে তবে বুঝিতে পারিবে যে, তুমি অহিংসভাবে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইয়াছ।
সত্যপ্রতিষ্ঠায়াং ক্রিয়াফলাশ্রয়ত্বম্ ।।৩৬।।
-হৃদয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হইলে কোন কর্ম না করিয়াই যোগী নিজের জন্য বা অপরের জন্য সেই কর্মের ফল লাভ করিবার শক্তি অর্জন করেন।
যখন এই সত্যের শক্তি তোমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইবে, যখন স্বপ্নেও তুমি মিথ্যা কথা কহিবে না, যখন কায়মনোবাক্যে সত্য আচরণ করিবে, তখন তুমি যাহা বলিবে, তাহাই সত্য হইয়া যাইবে। তখন তুমি যদি কাহাকেও বলো, ‘তুমি কৃতার্থ হও’, সে তৎক্ষণাৎ কৃতার্থ হইয়া যাইবে। কোন পীড়িত ব্যক্তিকে যদি বলো, ‘রোগমুক্ত হও’, সে তৎক্ষণাৎ রোগমুক্ত হইয়া যাইবে।
অস্তেয়প্রতিষ্ঠায়াং সর্বরত্নোপস্থানম্ ।।৩৭।।
-অচৌর্য প্রতিষ্ঠিত হইলে যোগীর নিকট সমুদয় ধনরত্নাদি আসিয়া থাকে।
তুমি যতই প্রকৃতি হইতে পলায়নের চেষ্টা করিবে, প্রকৃতি ততই তোমার অনুসরণ করিবে; আর তুমি যদি সেই প্রকৃতির প্রতি কিছুমাত্র লক্ষ্য না কর, তবে সে তোমার দাসী হইয়া থাকিবে।
ব্রহ্মচর্যপ্রতিষ্ঠায়াং বীর্যলাভঃ ।।৩৮।।
-ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠিত হইলে বীর্য বা শক্তি লাভ হয়।
ব্রহ্মচর্যবান্ ব্যক্তির মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি-মহতী ইচ্ছাশক্তি সঞ্চিত থাকে। পবিত্রতা
ব্যতীত আধ্যাত্মিক শক্তি সম্ভন নয়। ব্রহ্মচর্য দ্বারা মানুষের উপর আশ্চর্য ক্ষমতা লাভ করা যায়। মানবসমাজের ধর্ম-নেতাগণ সকলেই ব্রহ্মচর্যবান্ ছিলেন, এই ব্রহ্মচর্য হইতেই তাঁহারা শক্তি লাভ করিয়াছিলেন; অতএব যোগী অবশ্যই ব্রক্ষচর্যবান্ হইবেন।
অপরিগ্রহস্থৈর্যে জন্মকথন্তাসংবোধঃ ।।৩৯।।
-অপরিগ্রহ দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইলে পূর্বজন্ম স্মৃতিপথে উদিত হইবে।
যখন কেহ অপরের নিকট হইতে কোন বস্তু গ্রহণ করেন না, তখন তাঁহার অপরের সহিত বাধ্যবাধকতা হয় না, তিনি স্বাধীন ও মুক্তিই থাকেন। তাঁহার মন শুদ্ধ হইয়া যায়। প্রতিটি দানের সহিত দাতার মন্দ ভাবগুলিও গ্রহণ করিতে হইতে পারে। এই পরিগ্রহ ত্যাগ করিলে মন শুদ্ধ হইয়া যায়, আর ইহা হইতে যে-সকল শক্তি লাভ হয়, তন্মধ্যে প্রথম-পূর্বজন্মকথা মনে করিতে পারা। তখনই সেই যোগী সম্পূর্ণরূপে তাঁহার নিজ আদর্শে দৃঢ় হইয়া থাকিতে পারেন। কারণ তিনি দেখিতে পান, বহুবার তিনি কেবল যাওয়া-আসা করিতেছেন। সুতরাং তিনি তখন হইতে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞারূঢ় হন যে, এইবার আমি মুক্ত হইব, আর যাওযা-আসা করিব না, আর প্রকৃতির দাস হইব না।
শৌচাৎ স্বাঙ্গজুগুপ্সা পরৈরসংসর্গঃ ।।৪০।।
-শৌচ প্রতিষ্ঠিত হইলে নিজের শরীরের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়, অন্যের সঙ্গ করিতেও আর প্রবৃত্তি থাকে না।
যখন বাস্তবিক বাহ্য ও আন্তর-উভয় প্রকার শৌচ সিদ্ধ হয়, তখন শরীরের প্রতি অযত্ন আসে; কিসে উহা ভাল থাকিবে, কিসেই বা উহা সুন্দর দেখাইবে, এ-সকল ভাব একেবারে চলিয়া যায়। অপরে যে মুখ অতি সুন্দর বলিবে, তাহাতে জ্ঞানের কোন চিহ্ন না থাকিলে যোগীর নিকট তাহা পশুর মুখ বলিয়া প্রতীয়মান হইবে। জগতের লোক যে মুখে কোন বিশেষত্ব দেখে না, তাহার পশ্চাতে চৈতন্যের প্রকাশ থাকিলে তিনি তাহাকে স্বর্গীয় মনে করিবেন। এই দেহতৃষ্ণা মানুষ্যজীবনে সর্বনাশের কারণ। সুতরাং শৌচ-প্রতিষ্ঠার প্রথম লক্ষণ এই যে, তুমি নিজে একটি শরীর বলিয়া ভাবিতে চাহিবে না। আমাদের মধ্যে যখন এই শৌচ বা পবিত্রতা আসে, তখনই আমরা এই দেহভাব অতিক্রম করিতে পারি।
সত্ত্বশুদ্ধি-সৌমনস্যৈকাগ্র্যেন্দ্রিয়জয়াত্মদর্শনযোগ্যত্বানি চ ।।৪১।।
-এই শৌচ হইতে সত্ত্ব-শুদ্ধি, সৌমনস্য অর্থাৎ মনের প্রফুল্ল ভাব, একাগ্রতা, ইন্দ্রিয় জয় ও আত্মদর্শনের যোগ্যতা লাভ হইয়া থাকে।
এই শৌচ-অভ্যাসের দ্বারা সত্ত্বগুণ বর্ধিত হইবে, সুতরাং মনও একাগ্র ও প্রফুল্ল হইবে। তুমি যে ধর্মপথে অগ্রসর হইতেছ, তাহার প্রথম লক্ষণ এই যে, তুমি বেশ
প্রফুল্ল হইতেছ। বিষাদপূর্ণ ভাব অবশ্য আজীর্ণ রোগের ফল হইতে পারে, কিন্তু তাহা ধর্ম নয়। সুখই সত্ত্বের স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম; সাত্ত্বিক ব্যক্তির পক্ষে সবই সুখময় বলিয়া বোধ হয়; সুতরাং যখন তোমার এই আনন্দের ভাব আসিতে থাকিবে, তখন তুমি বুঝিবে, তুমি যোগসাধনায় উন্নতি করিতেছ। যাবতীয় দুঃখযন্ত্রণা তমোগুণপ্রসূত, সুতরাং উহা হইতে অব্যাহতি লাভ করিতে হইবে। বিষণ্ণতা তমোগুণের একটি লক্ষণ। সবল, দৃঢ়, সুস্থকায়, যুবা ও সাহসী ব্যক্তিরাই যোগী হইবার উপযুক্ত। যোগীর দৃষ্টিতে সবই সুখময়। যে-কোন মনুষ্যমুখ তিনি দেখেন, তাহাতেই তাহার আনন্দ হয়। ইহাই ধার্মিক লোকের লক্ষণ। পাপই কষ্টের কারণ, আর অন্য কিছু নয়। বিষাদমেঘাচ্ছন্ন মুখ লইয়া কি হইবে? উহা ভয়ঙ্কর! এইরূপ মেঘাচ্ছন্ন মুখ লইয়া বাহিরে যাইও না, কখন এইরূপ হইলে দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া সারাদিন ঘরে কাটাইয়া দাও। সমাজে, সংসারে এই ব্যাধি সংক্রামিত করিবার তোমার কি অধিকার আছে? যখন তোমার মন সংযত হইবে, তখন তুমি সমুদয় শরীরও বশে রাখিতে পারিবে। তখন আর তুমি এই যন্ত্রের ক্রীতদাস থাকিবে না; এই দেহযন্ত্রই তোমার ভৃত্য হইয়া থাকিবে। দেহযন্ত্র আত্মাকে নিম্নদিকে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যাইবে না, বরং উহাই মুক্তিপথে শ্রেষ্ঠ সহায় হইবে।
সন্তোষাদনুত্তমঃ সুখলাভঃ ।।৪২।।
-সন্তোষ হইতে পরম সুখলাভ হয়।
কায়েন্দ্রিয়সিদ্ধিরশুদ্ধিক্ষয়াত্তপসঃ ।।৪৩।।
-অশুদ্ধি-ক্ষয়-নিবন্ধন তপস্যা হইতে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের নানাপ্রকার শক্তি আসে।
তপস্যার ফল কখন কখন সহসা দূরদর্শন, দূরশ্রবণ ইত্যাদি রূপে প্রকাশ পায়।
স্বাধ্যায়াদিষ্টদেবতাসম্প্রয়োগঃ ।।৪৪।।
-মন্ত্রাদির পুনঃপুনঃ উচ্চারণ বা অভ্যাস দ্বারা ইষ্টদেবতার দর্শনলাভ হইয়া থাকে।
যে পরিমাণে উচ্চ প্রাণী (দেবতা, ঋষি, সিদ্ধ) দেখিবার ইচ্ছা করিবে, সাধনাও সেই পরিমাণে কঠোর করিতে হইবে।
সমাধিসিদ্ধিরীশ্বরপ্রণিধানাৎ ।।৪৫।।
-ঈশ্বরে সমুদয় অর্পণ করিলে সমাধিলাভ হইয়া থাকে।
ঈশ্বরে নির্ভরের দ্বারা সমাধি ঠিক পূর্ণা হয়।
স্থিরসুখামাসনম্ ।।৪৬।।
-যেভাবে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে সুখে বসিয়া থাকা যায়, তাহার নাম আসন।
এখন আসনের কথা বলা হইবে। যতক্ষণ তুমি স্থিরভাবে অনেকক্ষণ বসিয়া
থাকিতে না পারিতেছ, ততক্ষণ তুমি প্রাণায়াম ও অন্যান্য সাধনে কিছুতেই কৃতকার্য হইবে না। আসন দৃঢ় হওয়ার অর্থ এই যে, তুমি শরীরের অস্তিত্ব মোটেই অনুভব করিবে না। এইরূপ হইলে বাস্তবিক আসন দৃঢ় হইয়াছে, বলা যায়। কিন্তু সাধারণভাবে তুমি যদি কিয়ৎক্ষণের জন্য বসিতে চেষ্টা কর, শরীরে নানাপ্রকার বাধাবিঘ্ন আসিতে থাকিবে, কিন্তু যখনই তুমি এই স্থূলদেহভাব অতিক্রম করিবে, তখন শরীরবোধ হারাইয়া ফেলিবে। তখন আর তুমি সুখ বা দুঃখ কিছুই অনুভব করিবে না। আবার যখন তোমার শরীরে জ্ঞান ফিরিয়া আসিবে, তখন অনুভব করিবে, যেন অনেকক্ষণ বিশ্রাম করিয়াছ। যদি শরীরকে পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া সম্ভব হয়, তবে উহা এইরূপেই হইতে পারে। যখন তুমি এইরূপে শরীরকে জয় করিয়া উহাকে দৃঢ় রাখিতে পারিবে, তখন তোমার সাধনাও দৃঢ় হইবে। কিন্তু যতক্ষণ তোমার শারীরিক বিঘ্নবাধাগুলি আসিতে থাকিবে, ততক্ষণ তোমার স্নায়ুমন্ডলী চঞ্চল থাকিবে এবং তুমি কোনরূপে মনকে একাগ্র করিয়া রাখিতে পারিবে না।
প্রযত্নশৈথিল্যানন্তসমাপত্তিভ্যাম্ ।।৪৭।।
-শরীরে যে এক প্রকার অভিমানাত্মক প্রযত্ন আছে, তাহা শিথিল করিয়া দিয়া ও অনন্তের চিন্তা দ্বারা আসন স্থির ও সুখকর হইতে পারে।
অনন্তের চিন্তা দ্বারা আসন অবিচলিত হইতে পারে। অবশ্য আমরা সেই নিরপেক্ষ অনন্ত (ব্রহ্ম) সম্বন্ধে (সহজে) চিন্তা করিতে পারি না, কিন্তু আমরা অনন্ত আকাশের বিষয় চিন্তা করিতে পারি।
ততো দ্বন্দ্বানভিঘাতঃ ।।৪৮।।
-এইরূপে আসন-জয় হইলে দ্বন্দ্ব-পরম্পরা আর কিছু বিঘ্ন উৎপাদন করিতে পারে না।
দ্বন্দ্ব অর্থে শুভ-অশুভ, শীত-উষ্ণ, আলোক-অন্ধকার, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি বিপরীতধর্মী দুই দুই পদার্থ। এগুলি আর তোমাকে চঞ্চল করিতে পারিবে না।
তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ।।৪৯।।
-এই আসন-জয়ের পর শ্বাস ও প্রশ্বাস উভয়ের গতি সংযত করাকে ‘প্রাণায়াম’ বলে।
যখন এই আসন-জয় সমাপ্ত হইয়াছে, তখন শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ভঙ্গ করিয়া দিয়া উহাকে নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে, এখান হইতে প্রাণায়ামের বিষয় আরম্ভ হইল। প্রাণায়াম কি? শরীরস্থিত জীবনীশক্তিকে বশে আনা। যদিও ‘প্রাণ’ শব্দ সচরাচর শ্বাসপ্রশ্বাস অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, কিন্তু বাস্তবিক উহা শ্বাসপ্রশ্বাস নয়। ‘প্রাণ’ অর্থে জাগতিক শক্তিসমষ্টি। উহা প্রত্যেক দেহে অবস্থিত শক্তি, এবং উহার বাহ্যপ্রকাশ-এই ফুসফুসের গতি। প্রাণ যখন শ্বাসকে ভিতর দিকে আকর্ষণ করে, তখনই এই গতি
আরম্ভ হয়; ‘প্রাণায়াম’-এ আমরা উহাকেই নিয়ন্ত্রিত করিতে চাই। এই প্রাণের উপর শক্তিলাভ করিবার সহজতম উপায়রূপে আমরা প্রথমে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত করিতে আরম্ভ করি।
বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তিঃ দেশকালসংখ্যাভিঃ পরিদৃষ্টো দীর্ঘসূক্ষ্মঃ ।।৫০।।
-বাহ্যবৃত্তি, আভ্যন্তরবৃত্তি ও স্তম্ভবৃত্তি ভেদে এই প্রাণায়াম ত্রিবিধ; দেশ, কাল, সংখ্যার দ্বারা নিয়মিত এবং দীর্ঘ বা সূক্ষ্ম হওয়াতে উহাদেরও আবার নানাপ্রকার ভেদ আছে।
এই প্রাণায়াম তিন প্রকার ক্রিয়ায় বিভক্ত। প্রথম-যখন আমরা শ্বাসকে অভ্যন্তরে আকর্ষণ করি; দ্বিতীয়-যখন আমরা উহা বাহিরে নিক্ষেপ করি; তৃতীয়-যখন শ্বাস ফুসফুসের মধ্যেই ধৃত হয় বা বাহির হইতে শ্বাসগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। উহারা আবার দেশ, কাল ও সংখ্যা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে। ‘দেশ’ অর্থে-প্রাণকে শরীরের কোন অংশবিশেষে আবদ্ধ রাখা। ‘সময়’ অর্থে-প্রাণ কোন্ স্থানে কতক্ষণ রাখিতে হইবে, এবং ‘সংখ্যা’ অর্থে-কতবার ঐরূপ করিতে হইবে, তাহা বুঝিতে হইবে। এইজন্য কোথায়, কতক্ষণ ও কতবার রেচকাদি করিতে হইবে, ইত্যাদি কথিত হইয়া থাকে। এই প্রাণায়ামের ফল ‘উদ্ঘাত’ অর্থাৎ কুন্ডলিনীর জাগরণ।
বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়াক্ষেপী চতুর্থঃ ।।৫১।।
-চতুর্থ প্রকার প্রাণায়ামে বাহ্য বা আন্তর বিষয় চিন্তা দ্বারা প্রাণ নিরূদ্ধ করা হয়।
ইহা চতুর্থ প্রকার প্রাণায়াম। ইহাতে পূর্বোক্ত চিন্তাসহ দীর্ঘকাল অভ্যাসের দ্বারা স্বাভাবিক কুম্ভক (স্তম্ভবৃত্তি) হইয়া থাকে। অন্য প্রাণায়ামগুলিতে চিন্তার সংস্রব নাই।
ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশাবরণম্ ।।৫২।।
-তাহা হইতেই চিত্তের প্রকাশের আবরণ ক্ষয় হইয়া যায়।
চিত্তে স্বভাবতই সমুদয় জ্ঞান রহিয়াছে, উহা সত্ত্বপদার্থ দ্বারা নির্মিত, কিন্তু উহা রজঃ ও তমোদ্বারা আবৃত্ত রহিয়াছে। প্রাণায়াম দ্বারা চিত্তের এই আবরণ দূরীভূত হয়।
ধারণাসু চ যোগ্যতা মনসঃ ।।৫৩।।
-(তাহা হইতেই) ‘ধারণা’ বিষয়ে মনের যোগ্যতা হয়।
এই আবরণ চলিয়া গেলে আমরা মনকে একাগ্র করিতে সমর্থ হই।
স্বস্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্ত-স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ ।।৫৪।।
-যখন ইন্দ্রিয়গণ তাহাদের নিজ নিজ বিষয় পরিত্যাগ করিয়া যেন চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে, তখন তাহাকে ‘প্রত্যাহার’ বলা যায়।
এই ইন্দ্রিয়গুলি মনেরই বিভিন্ন অবস্থা মাত্র। মনে কর, আমি একখানি পুস্তক দেখিতেছি। বাস্তবিক ঐ পুস্তকাকৃতি বাহিরে নাই, উহা মনেই অবস্থিত বাহিরের কোন কিছু ঐ আকৃতি জাগাইয়া দেয় মাত্র; বাস্তবিক রূপ বা আকৃতি চিত্তেই আছে। এই ইন্দ্রিয়গুলি, তাহাদের সন্মুখে যাহা আসিতেছে, তাহারই সহিত মিশিয়া গিয়া তাহারই আকার গ্রহণ করিতেছে। যদি তুমি মনের এই-সকল ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি-ধারণ নিবারণ করিতে পারো, তবে তোমার মন শান্ত হইবে এবং ইন্দ্রিয়গুলিও শান্ত হইবে। ইহাকেই ‘প্রত্যাহার’ বলে।
ততঃ পরমা বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম্ ।।৫৫।।
-তাহা (প্রত্যাহার) হইতেই ইন্দ্রিয়গণ সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হইয়া থাকে।
যখন যোগী ইন্দ্রিয়গণের এইরূপ বহির্বস্তুর আকৃতি-ধারণ নিবারণ করিতে পারেন ও মনের সহিত উহাদিগকে এক করিয়া ধারণ করিতে কৃতকার্য হন, তখনই ইন্দ্রিয়গণ সম্পূর্ণরূপে জিত হইয়া থাকে। আর যখন ইন্দ্রিয়গণ সর্বতোভাবে বশীভূত হয়, তখনই প্রত্যেকটি স্নায়ু ও মাংসপেশী বশে আসিয়া থাকে, কারণ ইন্দ্রিয়গণই সর্বপ্রকার অনুভূতি ও কার্যের কেন্দ্রস্বরূপ। এই ইন্দ্রিয়গণ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়-এই দুই ভাগে বিভক্ত। সুতরাং যখন ইন্দ্রিয়গণ সংযত হইবে, তখন যোগী সর্বপ্রকার ভাব ও কার্যকে জয় করিতে পারিবেন; সমগ্র শরীরটিই তাঁহার বশীভূত হইবে। এইরূপ অবস্থা লাভ হইলেই মানুষ দেহধারণের আনন্দ অনুভব করে। তখনই সে ঠিক ঠিক বলিতে পারে, ‘জন্মিয়াছিলাম বলিয়া আমি সুখী।’ যখন ইন্দ্রিয়গণের উপর এইরূপ শক্তিলাভ হয়, তখনই বুঝিতে পারা যায, বাস্তবিক এই শরীর অতি আশ্চর্য পদার্থ।