০২. সাত নম্বর সুইনহো স্ট্রিট

॥ ২ ॥

সাত নম্বর সুইনহো স্ট্রীট ডাক্তারের বাড়ি বলে মনেই হয় না; তার সদর দরজা দিয়ে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ে একটা দাঁড়ানো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আর তার পিছনের দেয়ালে উপর দিকে একটা বাইসনের মাথা।

শঙ্করবাবু নিচেই অপেক্ষা করছিলেন, আমরা তাঁর সঙ্গে দোতলায় গিয়ে বৈঠকখানায় বসলাম। এঘরেও চতুর্দিকে শিকারের চিহ্ন। ভদ্রলোক ডাক্তারি করে এত জানোয়ার মারার সময় কী করে পেলেন তাই ভাবছিলাম।

মিনিট খানেকের মধ্যেই ডাঃ মুনসী এসে পড়লেন। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে, তবে এখনো যে বেশ শক্ত সমর্থ সেটা দেখলেই বোঝ যায়। ভদ্রলোক ফেলুদার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘আপনার তো ব্যায়াম করা শরীর বলে মনে হচ্ছে। ভেরি গুড। আপনার কাজ প্রধানত মাথার হলেও আপনি যে শরীরের প্রতি দৃষ্টি রেখেছেন সেটা দেখে ভালো লাগল।’

এবার ভদ্রলোক জটায়ু ও আমার দিকে চাইতে ফেলুদা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল।

‘এঁরা ট্রাস্টওয়র্দি কি?’ ডাঃ মুনসী প্রশ্ন করলেন।

‘সম্পূর্ণ’, বলল ফেলুদা, ‘তপেশ আমার খুড়তুতো ভাই এবং আমার সহকারী, আর মিঃ গাঙ্গুলী আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’

‘এই জন্যে জিগ্যেস করছি কারণ আজ সেই তিন ব্যক্তির আসল পরিচয় আমাকে দিতে হবে, না হলে আপনি কাজ করতে পারবেন না। এই পরিচয় শুধু আপনারা তিনজনই জানবেন, আর কেউ জানে না, আর কাউকে বলিনি।’

‘আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন, ডাঃ মুনসী’, বললেন জটায়ু। ‘আমি অন্তত আর কাউকে বলব না।’

‘ভেরি ওয়েল।’

‘তাহলে বলুন কী করতে পারি। হুম্‌কি চিঠির কথা আপনার ছেলে বলেছেন।’

‘শুধু হুম্‌কি চিঠি নয়’, বললেন ডাঃ মুনসী, ‘হুম্‌কি টেলিফোনও বটে। এটা কাল রাত্রের ঘটনা। তখন সাড়ে এগারোটা। বোঝাই যায় মত্ত অবস্থায় ফোন করছে। হিগিন্‌স। জর্জ হিগিন্‌স।’

‘আপনার ডায়রির “জি”?’

‘ইয়েস। বলে কী—“সেদিন টেলিফোনে আমি অত্যন্ত বোকার মতো কথা বলেছি। যখন তোমার কাছে ট্রীটমেন্টের জন্য যাই, তখন আমার যে ব্যবসা ছিল, এখনও সেই ব্যবসাই রয়েছে। একচেটিয়া ব্যবসা আমার, সুতরাং ‘জি’ থেকে অনেকেই আমার আসল পরিচয় অনুমান করতে পারবে। সো কাট মি আউট।” মাতালকে তো আর যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝানো যায় না। ফলে ফোন রেখে দিতে হল। বুঝতেই পারছেন, আমি রুগী নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে এদের বাড়ি গিয়ে সামনাসামনি কথা বলে যে কিছু বোঝাবো তার সময় বা সামর্থ্য আমার নেই। এ কাজের ভারটা আমি আপনাকে দিতে চাই। “এ” এবং “জি”। “আর”-কে নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কারণ তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি যে নামের আদ্যক্ষর থেকে তাকে কেউ চিনে ফেলবে এ আশঙ্কা তার নেই।’

‘কিন্তু এই তিনজনের আসল পরিচয়টা—!’

‘কাগজ পেনসিল আছে?’

ফেলুদা পকেট থেকে নোটবুক আর ডট পেন বার করল।

‘লিখুন, “এ” হল অরুণ সেনগুপ্ত। ম্যাকনীল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার, রোটারি ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাসস্থান এগারো নম্বর রোল্যান্ড রোড। ফোন নম্বর ডিরেক্টরিতে দেখে নেবেন।’

ফেলুদা চটপট ব্যাপারটা লিখে নিল।

‘এবার লিখুন’, বলে চললেন ডাঃ মুনসী, “জি” হল জর্জ হিগিন্‌স। টেলিভিশনের জন্য বিদেশে জানোয়ার চালান দেবার ব্যবসা এঁর। বাড়ির নম্বর নব্বুই রিপন স্ট্রীট। রাস্তার নাম থেকে বুঝতে পারবেন উনি পুরো সাহেব নন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তৃতীয় ব্যক্তির আসল পরিচয় প্রয়োজন হলে দেব, নচেৎ নয়।’

‘এদের অপরাধগুলো?’

‘শুনুন, আমার পাণ্ডুলিপি আজ আপনি নিয়ে যাবেন। মন দিয়ে পড়ে আপনার বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে আমাকে বলবেন এতে আপত্তিকর কিছু আছে কিনা যার ফলে বইটা বাজারে বেরোলে আমার ক্ষতি হতে পারে।’

‘ঠিক আছে। তাহলে—’

ফেলুদাকে থামতে হল, কারণ ঘরে তিনজন লোকের প্রবেশ ঘটেছে। ডাঃ মুনসী তাদের দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি আসছেন শুনে এঁরা সকলেই আপনাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমার স্ত্রী ছাড়া এই কজন এবং আমার ছেলেই এখন আমার বাড়ির বাসিন্দা। আলাপ করিয়ে দিই, এ হচ্ছে সুখময় আমার সেক্রেটারি।’

একজন চশমা-পরা বছর চল্লিশেকের ভদ্রলোকের দিকে দেখালেন ডাঃ মুনসী।

‘আর ইনি হচ্ছেন আমার শ্যালক চন্দ্রনাথ।’

এঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। দেখে কেন জানি মনে হয় ইনি বিশেষ কিছু করেন-টরেন না, এ বাড়িতে আশ্রিত হয়ে রয়েছেন।

‘আর ইনি আমার পেশেন্ট রাধাকান্ত মল্লিক। এঁর চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখানেই আছেন।’

এঁকে দেখে মনে হয় এঁর অসুখ এখনো সারেনি। হাত কচলাচ্ছেন, চোখ পিট পিট করছেন, আর একটানা সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। বয়স আন্দাজ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ।

পরিচয়ের পরে একমাত্র সুখময়বাবু ছাড়া আর সকলেই চলে গেলেন। ডাঃ মুনসী সেক্রেটারির দিকে ফিরে বললেন, ‘সুখময়, যাও, আমার লেখাটা এনে প্রদোষবাবুকে দাও।’

ভদ্রলোক দু মিনিটের মধ্যে একটা বড়, মোটা খাম এনে ফেলুদাকে দিলেন।

‘ওর কিন্তু আর কপি নেই’, বললেন ডাঃ মুনসী। ‘পাবলিশারকে দেবার আগে ওটা সুখময় টাইপ করে দেবে।’

‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না’, বলল ফেলুদা, ‘আমি এটার মূল্য খুব ভালোভাবেই জানি।’

আমরা উঠে পড়লাম। শঙ্করবাবু পাশের ঘরেই অপেক্ষা করছিলেন। এবার এসে আমাদের সদর দরজা অবধি পৌঁছে দিলেন। তারপর লালমোহনবাবুর সবুজ অ্যাম্বাসাডরে চড়ে আমরা বাড়িমুখো রওনা দিলাম।

‘একটা রিকুয়েস্ট আছে মশাই’, লালমোহনবাবু হঠাৎ বললেন।

‘কী?’

‘আপনার পড়া হলে পর আমি একবার দু দিনের জন্য পাণ্ডুলিপিটা নেবো। এটা রিফিউজ করবেন না, প্লীজ!’

‘আপনার না পড়লেই নয়?’

‘না-পড়লেই নয়। বিশেষ করে শিকার কাহিনী পড়তে আমার দুর্দান্ত লাগে।’

‘বেশ, দেবো। তবে দু দিন নয়; আপনি যে সকালে নেবেন, তার পরের দিন সকালেই ফেরত দিতে হবে। তার মধ্যে শিকারের অংশ আপনার নিশ্চয়ই পড়া হয়ে যাবে। কারণ ১৯৬৫-এর পর তো আর ভদ্রলোক শিকার করেননি।’

‘তাই সই।’