০২. সময়ের অপবলয়

সময়ের অপবলয়

অভ্যাসমতো দরজায় তালা লাগানোর পর হঠাৎ করে রিগার মনে পড়ল আজ আর ঘরে তালা লাগানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সে যেখানে যাচ্ছে, সেখান থেকে সে সম্ভবত আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। ব্যাপারটি চিন্তা করে একটু আবেগে আপত হয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়, কিন্তু রিগার সেই সময়টাও নেই। এখন রাত তিনটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট, আর ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ভোরের আলো ফুটে উঠবে। সে যেটা কতে যাচ্ছে, তার প্রথম অংশটা ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই শেষ করতে হবে।

ছোট ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে রিগা নিচে নেমে এল। বাকি জিনিসগুলো আগেই বড় ভানটিতে তুলে নেয়া হয়েছে। সে গত পাঁচ বছর থেকে এই দিনটির জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, খুঁটিনাটি সবকিছু অসংখ্যবার যাচাই করে দেখা হয়ে গেছে, কোথাও কোনো ভুল হবার অবকাশ নেই, তবে ভাগ্য বলে যদি সত্যি কিছু থাকে এবং সে ভাগ্য যদি বেঁকে বসে, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। ছোট ব্যাগটা পাশে রেখে রিগা তার ভ্যানটির সুইচ স্পর্শ করামাত্র সেটি একটি ছোট ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করে। কোন পথে কোথায় যেতে হবে বহুকাল আগে প্রোগ্রাম করে রেখেছে। ভ্যানটি নিঃশব্দে সেদিকে যাত্রা শুরু করে দেয়। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটি দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু এটি অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখে।

আবাসিক এলাকার ছোট রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে ভ্যানটি হ্রদের তীরের বড় রাস্তায় উঠে পড়ল। রাস্তাটি এরকম সময় নির্জন থাকে। একেবারে মাটি ছুঁয়ে যাওয়া যায়। এ এলাকায় শীতকালে হাড়-কাঁপানো কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস হু-হু করে বইতে থাকে, বসন্তের শুরুতে এতটা খারাপ হবার কথা নয়। রিগা জানালাটা একটু নামিয়ে দেখল, হ্রদের ঠাণ্ডা ভিজে বাতাসের সাথে সাথে সারা শরীর শিউরে ওঠে। রিগা দ্রুত আবার জানালাটা তুলে দেয়। দুহাত একসাথে ঘষে শরীরটা একটু গরম করে সে আকাশের দিকে তাকাল। শুক্লপক্ষের রাত, আকাশে ভাঙা একটা চাঁদ উঠেছে, সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিগার মনটা হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়। পরিচিত এই পৃথিবীটার জন্যে—যেটা কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখে নি, তার বুকটা হঠাৎ টনটন করতে থাকে।

রিগা জোর করে নিজেকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনে। একটু পরেই সে যে জিনিসটি করতে শুরু করবে তার খুঁটিনাটি মনে মনে আরো একবার যাচাই করে দেখা দরকার।

 

ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল এভাবে।

সংবিধানে দুশ বছর আগে একটা সংশোধনী যোগ করা হয়েছিল। সংশোধনীটা এরকম : ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্যাবলী পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী।

সংশোধনীটি বিচিত্র, কিন্তু এই সংশোধনীটির জন্যে যেটা ঘটল, সেটি আরো বিচিত্র। পৃথিবীর তথ্য নিয়ন্ত্রণকারী যাবতীয় কম্পিউটার পৃথিবী থেকে ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত সকল তথ্য সরিয়ে নিতে শুরু করল। এক শ বছর পর পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিপর্যয়ের উপর আর কোনো তথ্য থাকল না। এক শ বছর আগে কোনো-এক এপ্রিল মাসের উনিশ তারিখে পৃথিবীতে কোনো-এক ধরনের বিপর্যয় ঘটেছিল। যেহেতু এ সংক্রান্ত যে-কোনো তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী, কাজেই সংবিধানের এই সংশোধনীটিও হঠাৎ একদিন সরিয়ে নেয়া হল। ব্যাপারটি ঘটেছিল প্রায় পনের বছর আগে, তখন রিগার বয়স তিরিশ।

হঠাৎ করে সংশোধনীটি সরিয়ে নেবার পর ব্যাপারটি নিয়ে অনেকেরই কৌতূহল হয়েছিল। সান্ধ্য খবরের বিশেষ ক্লেম কার্ড বের হল, সেটা নিয়ে সবাই হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। তরুণ অনুসন্ধানীরা কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি করে নানারকম তন্তু দিতে শুরু করে। কেউ বলল, জিনেটিক পরিবর্তন করে একধরনের অতিমানব তৈরি করা হয়েছিল, যারা পৃথিবী ধ্বংস করতে চাইছিল। কেউ বলল, গ্রহান্তরের আগন্তুক পৃথিবীতে হানা দিয়ে তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছিল। আবার কেউ বলল, বায়োকেমেস্ট্রির এক ল্যাবরেটরি থেকে ভয়ংকর এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর জীবজগৎকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হয়েছিল। সবই অবশ্যি উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা, কারণ এইসব তত্ত্বকে সত্যি বা মিথ্যা কোনোটাই প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য পৃথিবীর ডাটা বেসে নেই, সব একেবারে ঝেড়েপুছে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

বছরখানেক পর সবার কৌতূহল থিতিয়ে এল। শুধুমাত্র জল্পনা-কল্পনা করে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয়সংক্রান্ত তথ্য পৃথিবীর স্বার্থের পরিপন্থী বলে সেটা নিয়ে প্রকাশ্যে গবেষণা করাও সম্ভব নয়, কোনো কম্পিউটারই সাহায্য করতে পারে না। তার ফলে বছর দুয়েকের মাঝেই পৃথিবীর প্রায় সব মানুষই ১৯শে এপ্রিলের বিপর্যয় অজ্ঞাত থেকে যাবে, এই সত্যটি মোটামুটিভাবে মেনে নিল। একজন ছাড়া, সে হচ্ছে রিগা।

রিগা এমনিতে কম্পিউটারের দ্রোন ভাষার উপর কাজ করে। ভাষাটি সহজ নয়, এই ভাষায় প্রোগ্রাম করার যে কয়টি বাড়তি সুবিধে, তাতে পৃথিবীর মানুষের বেশি উৎসাহ নেই। জেই সে পৃথিবীর প্রথম সারির একজন প্রোগ্রামার হয়েও মোটামুটিভাবে সবার কাছে অপরিচিত। দ্রোন ভাষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সমস্যাকে কখনো সোজাসুজি সমাধান করার চেষ্টা করে না, কাজেই সবাই হাল ছেড়ে দেবার পরও রিগা কম্পিউটারে ১৯শে এপ্রিল বিপর্যয়ের তথ্য খুঁজে বেড়াতে থাকে। কম্পিউটার তাকে সন্দেহ করে না সত্যি, কিন্তু সে কোনো তথ্য খুঁজে বের করতে পারে না। এইভাবে আরো দুই বছর কেটে যায়।

রিগার বয়স যখন চৌত্রিশ, পারিবারিক ব্যাপারে বিশেষ মন দেয় না বলে তখন তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। তাদের একমাত্র ছেলেটিকে নিয়ে তার স্ত্রী একদিন পৃথিবীর অন্য পৃষ্ঠে চলে গেল। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে ছেলেটিকে প্রায় সত্যিকার মানুষের মতোই জীবন্ত দেখায়, কিন্তু মাঝেমাঝে রিগার খুব ইচ্ছে করত ছেলেটিকে খানিকক্ষণ বুকে চেপে রাখে। কিন্তু ছেলেটি ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে। আজকাল হলোগ্রাফিক স্ক্রিলে তার দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এরকম সময়ে রিগা একদিন তার ছেলের সাথে দেখা করতে গেল।

রিগা তার ছেলের কাছে একজন অপরিচিত মানুষের মতো, তাই সঙ্গত কারণেই ছয় বছরের এই শিশুটি তার বাবাকে দেখে খুব বেশি উচ্ছ্বাস দেখাল না। রিগা খানিকক্ষণ কথা বলার চেষ্টা করে খুব সুবিধে করতে পারল না, শিশুদের সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় সে জানে না। ছেলের সাথে ভাব করার আর কোনো উপায় না দেখে রিগা একসময়ে তার পকেট থেকে রেম কার্ডটি বের করে, সেখানে দৈনন্দিন খবর ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক জন্তু-জানোয়ারের উপর একটি দুর্লভ অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত এই শিশুটির মন জয় করতে সক্ষম হয়। ঘরের মাঝখানে সত্যিকার জীবন্ত প্রাণীদের মতো হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবিগুলো দেখে বাচ্চাটি হাততালি দিয়ে লাফাতে থাকে। বাচ্চাদের হাসি থেকে সুন্দর কিছু নেই, কিন্তু রিগার যে জিনিসটি প্রথমে চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে তার ফোকলা দাঁত। ছয় বছর বয়সে শিশুদের দুধদাঁত পড়ে নূতন দাঁত ওঠা শুরু করে। বাচ্চাটির দাঁত সবে পড়েছে, এখনো নূতন দাঁত ওঠে নি, তাই প্রতিবার হাসার সময় ফোকলা দাঁত বের হয়ে পড়ছে।

বাচ্চাটির ফোকলা দাঁতটি দেখে হঠাৎ করে রিগা বুঝতে পারে, ১৯শে এপ্রিলের রহস্য কেমন করে সমাধান করতে হবে। রহস্যটি হচ্ছে বাচ্চাটির ফোকলা দাঁতের মতন, সেটি নেই, কারণ তার সম্পর্কে সব তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কেউ যদি সেটাকে খোঁজে কখনো, কিছু পাবে না। কিন্তু ফোকলা দাঁতের অস্তিত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কারণ প্রত্যেকবার হাসার সময় দেখা যাচ্ছে একটি দাঁত নেই। ১৯শে এপ্রিলের রহস্যও ঠিক সেরকম, সেটি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই, কিন্তু অন্য সব তথ্যগুলোকে খুঁজে দেখলেই দেখা যাবে সেখানে একটা অসম্পূর্ণতা রয়েছে। সেই অসম্পূর্ণতাই হচ্ছে ১৯শে এপ্রিলের রহস্য। যে কাল্পনিক তথ্য সেই অসম্পূর্ণতাকে দৃঢ় করতে পারবে, সেই তথ্যই হবে এই রহস্যের সমাধান।

রিগা পরবতী চরিশ ঘণ্টা তার ছেলের সাথে সময় কাটালেও মনে মনে সে পরবর্তী কর্মপন্থা ছকে ফেলল। দ্রোন ভাষায় যে নূতন কম্পিউটার প্রোগ্রামটি লিখতে হবে, সেটির কাঠামোও সে মনে মনে ঠিক করে নিল। বহুদিন পর সে বুকের ভিতরে কৈশোরের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে।

 

কম্পিউটার প্রোগ্রামটি দাঁড় করাতে প্রায় বছরখানেক সময় লেগে গেল, সেটি থেকে ভুলভ্রান্তি সরিয়ে পুরোপুরি কাজের উপযোগী করতে লাগল আরো দুই বছর। তৃতীয় বছরের গোড়ার দিকে রিগা প্রথমবার তার প্রোগ্রামটি পৃথিবীর বড় বড় ডাটা বেসে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিল। সুদীর্ঘ সময় ব্যয় করে সেটি জানাল, পৃথিবীর তথ্যভাণ্ডারে যেসব তথ্যের মাঝে বড় ধরনের অসঙ্গতি রয়েছে, সেগুলো দূর করা যায়, যদি এই কয়টি জিনিস কল্পনা করে নেয়া যায়।

(এক) আজ থেকে প্রায় দু শ বছর আগে পাশাপাশি দুটি শহরে ত্রিনি ও লিক নামে দুজন মানুষের জন্ম হয়েছিল। এ

(দুই) প্রায় সমবয়সী এই দুজন মানুষ ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন।

(তিন) তাঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল সময়ের অপবলয়।

(চার) প্রায় দু শ পনের বছর আগে ত্রিনি ও লিক সময়ের অপবলয়সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন। পরীক্ষাটি ঠিকভাবে শেষ হয় নি।

(পাঁচ) তাঁরা যেখানে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেখানে, সম্ভবত একটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। সম্ভবত সেখানে তাঁরা একটি সুড়ঙ্গের মতো সৃষ্টি করেন, যেটি বিশ্বব্রহ্মায়ে বাইরের সাথে যোগাযোগ করে দেয়।

(ছয়) ত্রিনি ও লিক সেই সুড়ঙ্গপথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে ছিটকে পড়েন, কারণ তাঁদের কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি।

(সাত) এই সুড়ঙ্গের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়, কারণ সমস্ত পৃথিবী এই পথ দিয়ে গলে বের হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

 

বিস্ময়কর এই তথ্য রিগার কৌতূহলকে নিবৃত্ত না করে আরো বাড়িয়ে দেয়। সত্যিই কি ত্রিনি ও লিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরের সাথে একটি সুড়ঙ্গমুখ খুলে দিয়েছেন? সত্যিই কি সেই পথে বেরিয়ে যাওয়া যায়? সত্যিই কি পুরো পৃথিবী এই পথে বের হয়ে যেতে পারে?

এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার একটিমাত্র উপায়—ত্রিনি ও লিক যেখানে পরীক্ষাটি করেছিলেন, সেটি খুঁজে বের করা।

রিগার জন্যে সেটা খুঁজে বের করা খুব কঠিন হল না। দেখা গেল, ত্রিনি ও লিক সেই পরীক্ষাটি করেছিলেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একটি কক্ষে। সেই কক্ষটি পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে তাকে ঘিরে প্রায় চল্লিশ বর্গমাইল এলাকার উপর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পাথর এবং কংক্রিট ঢালা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের হ্রদের তীরে যে ছোট পাহাড়টি বসন্তকালে অসংখ্য ফুলে ঢেকে যায়, সেটি একটি কৃত্রিম পাহাড়, এই তথ্যটি পৃথিবীতে রিগা ছাড়া আর কেউ জানে না। পাহাড়ের প্রায় হাজার দুয়েক ফুট নিচে একটি ছোট বিজ্ঞানাগারে ত্রিনি ও লিক একটি অসাধারণ পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই পরীক্ষাটি কী ধরনের বিপর্যয়ের সূত্রপাত করেছিল আজ রিগা সেই রহস্য ভেদ করতে যাচ্ছে।

এর জন্যে রিগা প্রায় পাঁচ বছর প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রথমত সে তার কাজ বদল করে উত্তরাঞ্চলের সেই শহরে চলে এসেছে। শহরের এক পাশে হ্রদ, অন্য পাশে ছোট পাহাড়টি গ্রীষ্মকালে অনেক ভ্রমণবিলাসী মানুষকে আকর্ষণ করে, কিন্তু এমনিতে সারা বছর বেশ নিরিবিলি। ছোট এই শহরে দ্রোন ভাষায় অভিজ্ঞ কম্পিউটার প্রোগ্রামারের উপযোগী লেননা কাজ নেই বলে সে পাওয়ার সাপ্লাইয়ের একটি কারখানায় কাজ করে। অবসর সময়ে সে শব্দতরঙ্গ দিয়ে ঘনত্ব মাপার একটা যন্ত্র তৈরি করেছে, সেই যন্ত্রটি দিয়ে ধীরে ধীরে সে পুরো পাহাড়টি পর্যবেক্ষণ করেছে। পাহাড়ের নিচে কোথায় সেই রহস্যময় গবেষণাগারটি লুকিয়ে রয়েছে সেটাও খুঁজে বের করেছে। সেই গবেষণাগারে পৌঁছানোর জন্যে পাহাড়ের কোন অংশ দিয়ে যাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ, সেটাও নির্ধারণ করেছে। পাহাড় কেটে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ভিতরে ঢুকে যেতে কী ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন অনুমান করার চেষ্টা করেছে। তারপর সেইসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এই ভ্যানটি তৈরি করেছে। নিরীহদর্শন এই ভ্যানটির ভিতরে রয়েছে চারটি শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন। প্রয়োজনে সামনের অংশটি খুলে সেখান থেকে কার্বন হীরের পাথর কাটার একটা অতিকায় উিল বের হয়ে আসে। শক্তিশালী ইঞ্জিনের প্রচণ্ড ঘূর্ণনে সে ডিল পাথর কেটে পুরো ভ্যানটাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাবে। ভ্যানের মাঝে রয়েছে শক্ত পাম্প, সামনের কাটা পাথর সেটি সরিয়ে আনে পিছনে। পাহাড়ের যে অংশ দিয়ে রিগা ভিতরে ঢুকবে, সে অংশটি লতাগুলা দিয়ে ঢাকা। কেউ সেদিকে যায় না, যাবার রাস্তাও নেই। কেউ সহজে জানতে পারবে না যে রিগা এদিক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। প্রবেশপথ ঢেকে যাবে কাটা পাথরে, বসন্তের বৃষ্টিতে নৃতল গাছগাছালি গজিয়ে ঢেকে ফেলবে সেই জায়গা।

 

হ্রদের তীর দিয়ে ঘুরে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছাতেই রিগা তার ভ্যানের হেড লাইট নিভিয়ে দিল। তার হিসেবমতো চাঁদ ডুবে গিয়ে চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার। রিগা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নেয় যে কেউ তার পিছু নেয় নি। তারপর অন্ধকারেই ভ্যানটিকে চালিয়ে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এনে হাজির করে। আজকের অভিযানের প্রথম অংশ পরিকল্পনামতোই কোনো সমস্যা ছাড়া শেষ হয়েছে।

রিগা সাবধানে ভ্যান থেকে নেমে তার ইনফ্রারেড চশমাটি পরে নেয়, সাথে সাথে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে চারদিকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রিগা সাবধানে চারদিকে তাকায়, কোথাও কিছু নেই, শুধুমাত্র একটি নিশাচর রাকুন খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা গাছের গুড়িতে লুকিয়ে যায়। রিগা কয়েক পা এগিয়ে যায়, অনেক ধরনের যন্ত্রপাতিতে বোঝাই বলে ভ্যানটি মাটির উপরে উঠতে পারে না, সময় সময় চাকার গর্ত রেখে আসে। তাকে এখন সাবধানে এইসব চাকার দাগ মুছে ফেলতে হবে। রিগা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে তার কাজ শুরু করতে এগিয়ে যায়।

হিসেব মতন ভোর পাঁচটা দশ মিনিটে রিগা তার ভ্যানটি চালু করল। ঠিক এই সময়ে শহরের বড় জেনারেটরটি চালু করা হয়। তার শক্তিশালী ভ্যানটি পাথর কেটে ভিতরে ঢুকে যাবার সময় বাড়তি যে কম্পন সৃষ্টি করবে, সেটা কোথাও ধরা পড়বে না। রিগা ঘড়ি দেখে ঠিক সময়ে ভ্যানের কন্ট্রোল প্যানেলের নির্দিষ্ট সুইচটি স্পর্শ করে, সাথে সাথে সামনের অংশটি খুলে অতিকায় ট্রিলটি বের হয়ে আসে, প্রচণ্ড ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়, তারপর সেটি পাথরকে স্পর্শ করে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে ছিলটি পাথর কেটে ছোট একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ফেলল। ভ্যানটি ধীরে ধীরে পাহাড়ের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যাবার সময় রিগা একবার পিছনে তাকাল, ইনফ্রারেড চশমায় অন্ধকার পৃথিবীটিকে তার কাছে অলৌকিক মনে হয়। এই পৃথিবীটিকে সে হয়তো আর কোনো দিন দেখবে না। পৃথিবীর সাথে তার আর কোনো যোগাযোগ রইল না—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রেখে আসা তার ডাইরিটা ছাড়া। সেই ডাইরির খোঁজ কখনো কি কেউ পাবে?

রিগা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকে। ভ্যানটি প্রচণ্ড গর্জন করে একটি অতিকায় শুঁয়োপোকার মতো পাথরে গর্ত করে নির্দিষ্ট দিকে এগুতে থাকে।

 

ল্যাবরেটরি ঘরের সামনে ভ্যানটি দাঁড় করিয়ে রিগা মাস স্পেকট্রোমিটারটি চালু করে। বাতাসে নিঃশাস নেবার উপযোগী যথেষ্ট অক্সিজেন রয়েছে। কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস রয়েছে কী না জানা দরকার। তার কাছে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করতে না হলে কাজকর্মে সুবিধে হয়। রিগা স্পেকটোমিটারটির স্ক্রিনে ভালো করে তাকায়, বিচিত্র কিছু গ্যাস রয়েছে, রেডনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি, কিন্তু বিষাক্ত কোনো গ্যাস নেই। রিগা জানালা অল্প একটু খুলে নিঃশ্বাস নেয়, একটু ভ্যাপসা গন্ধ বাতাসে, কিন্তু খানিকক্ষণেই অভ্যাস হয়ে যাবার কথা।

ল্যাবরেটরির সামনে দু শ বছরের ভারি পুরানো ওক কাঠের দরজা। সম্ভবত সে সময়ে এ রকম দরজার প্রচলন ছিল। দরজার উপর ধুলায় ধূসর একটি সাইনবোর্ড, সেখানে বড় বড় করে লেখা, প্রবেশ নিষেধ, আইন অমান্যকারীকে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড।

রিগা চারদিকে তাকায়, একসময় নিশ্চয়ই আশেপাশে কড়া পাহারা ছিল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে প্রহরীরা তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্যে অপেক্ষা করত। দু শ পনের বছর পর সেই প্রহরীরা নেই, কিন্তু অন্য কোনো ধরনের সাবধানতা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে কী না কে জানে? রিগা সাবধানে পরীক্ষা করে কিছু না পেয়ে হাতের রাস্তার দিয়ে দরজাটি খুলে ফেলল।

ভিতরে একটা লম্বা করিডোর। হাতের আলোটা উপরে তুলে রিগা চারদিকে তাকাল। দূরে একটা দরজা। করিডোরের দেয়ালে কিছু ছবি, কিছু পুরানো কম্পিউটারের মনিটর। ধুলায় সব কিছু ঢেকে আছে। রিগা সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায়। সমস্ত ল্যাবরেটরিতে সমাধিক্ষেত্রের নীরবতা।

করিডোরের শেষ মাথার দরজাটিও বন্ধ। বাইরে আরেকটা সাইনবোর্ড, সেখানে আবার বড় বড় করে সাবধান বাণী লেখা। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ এবং প্রবেশ করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড পাশে একটি নোটিশ বোড়, রিগা সাবধানে ধুলা ঝেড়ে ভিতরে তাকাল। ভিতরে একটা ছবি। চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দুজন হাসিখুশি মানুষ একটি চতুষ্কোণ বাক্সের মতো জিনিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে লেখা, প্রফেসর ত্রিনি ও প্রফেসর লিক তাদের সময় অপবলয় ক্ষেত্রের সামনে। দুজনই নিরীহ এবং হাসিখুশি চেহারার মানুষ, প্রফেসর ত্রিনির সামনের চুল হালকা হয়ে এসেছে, প্রফেসর লিকের মুখে বেমানান গোঁফ।

রিগা দীর্ঘ সময় ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দুজন সেই রহস্যময় বিজ্ঞানী, যাঁরা নিজেদের অগোচরে সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন, যাঁরা বিস্ময়কর এক সুড়ঙ্গপথে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে ছিটকে পড়েছেন। রিগা আজ আবার পরীক্ষা করবে সেই বিস্ময়কর সুড়ঙ্গপথ। সে নিজেও কি ছিটকে পড়বে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে? সেও কি সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাবে নিজের অগোচরে?

করিডোরের দরজাটি ভালো করে পরীক্ষা করে রিগা খুব সহজেই তার ব্লাস্টারটি দিয়ে খুলে ফেলল। ভিতরে বিশাল একটা হলঘরের মতো, চারদিকে অসংখ্য অতিকায় যন্ত্রপাতি, আবছা আলোতে ভুতুড়ে এক জায়গার মতো লাগছে। রিগা সাবধানে পা ফেলে ভিতরে এগিয়ে যায়। হলঘরের মাঝামাঝি চতুষ্কোণ বাক্সের মতো ছোট একটা ঘর। চারদিক থেকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানারকম তার এবং কেবল এই ঘরের মাঝামাঝি এসে জমা হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এটাই হচ্ছে সময়ের অপবলয় ক্ষেত্র। ঘরটা ঘুরে ঘুরে রিগা খুব ভালো করে পরীক্ষা করল। এক পাশে গোলাকার একটা দরজা, অসংখ্য স্ক্রু দিয়ে সেটি শক্ত করে লাগানো। দেখে মনে হয় এই স্ক্রুগুলো পরে লাগানো হয়েছে। রিগা ভালো করে দরজাটি পরীক্ষা করল। মাঝামাঝি জায়গায় বিভিন্ন ভাষায় ছোট একটি ঘোষণাপত্র লাগানো হয়েছে, তাতে লেখা এই দরজার অন্য পাশে যা রয়েছে সেটি এ পাশের কারো জানার কথা নয়। অন্য পাশের একটি পরমাণও যদি পৃথিবীর এই অংশে উপস্থিত হয় সমস্ত পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাবনা রয়েছে। আপনি যে ই হয়ে থাকুন এই দরজা স্পর্শ না করে ফিরে যান।

রিগা তার ব্যাগ নিচে রেখে কাছাকাছি একটা জায়গায় পা মুড়ে বসে পড়ে। সে কি দরজায় স্পর্শ না করে ফিরে যাবে? সেটি তো হতে পারে না, এত কষ্ট করে এতদূর এসে সে তো রহস্য ভেদ না করে যেতে পারে না। পৃথিবী ধ্বংস হোক সেটা সে চায় না, কিন্তু প্রফেসর ত্রিনি এবং লিক তত পৃথিবী ধ্বংস না করেই এই রহস্যের সৃষ্টি করেছেন, সে কেন পারবে না?

রিগা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দরজাটি লক্ষ করে। ছোট ছোট করে অনেক কিছু লেখা রয়েছে, গোলাকার দরজাটি দেখেও কিছু আশা করা যায়। এই দরজাটি কয়েকটা স্তরে ভাগ করা রয়েছে। ভিতরের একটি পরমাণুকেও বাইরে আসতে না দিয়ে একজন মানুষের ভিতরে ঢোকা সম্ভব—তার জন্যে সে রকম প্রস্তুতি নিতে হবে। অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ কাজটি শুরু করার আগে রিগা একটু বিশ্রাম নিয়ে নেবে ঠিক করল।

ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার বের করে খেয়ে নিয়ে রিগা দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজলে।

পাহাড়ের নিচে দুই হাজার ফুট পাথরের আড়ালে সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এত বড় একটা রহস্যের মুখোমুখি এসে চট করে চোখে ঘুম আসতে চায় না, কিন্তু সমস্ত দিনের পরিশ্রমে শরীর এত ক্লান্ত হয়েছিল যে সত্যি একসময় তার চোখ বুজে এল।

তার ঘুম হল ছাড়াছাড়াভাবে, সারাক্ষণই স্নায়ু ছিল সজাগ, তাই একটুতেই ঘুম ভেঙে সে পুরোপুরি জেগে উঠছিল। তবুও ঘণ্টা দুয়েক পর সে খানিকটা সতেজ অনুভব করে। উঠে বসে সে দরজার কাছে এগিয়ে যায়। এই দরজার অন্য পাশে রয়েছে সেই রহস্যময় জগৎ, সাবধানে তাকে সেই রহস্যের উন্মোচন করতে হবে। যন্ত্রপাতি নামিয়ে সে কাজ শুরু করে।

দরজাটি অনেকটা মহাকাশযানের দরজার মতো, মহাকাশের পুরোপুরি বায়ুশূন্য পরিবেশে যাবার আগে যেরকম একটা ছোট কুঠুরিতে ঢুকে সেটাকে সবকিছু থেকে আলাদা করে ফেলতে হয়, সেরকম। প্রথম দরজাটি খুলে সে একটা ছোট কুঠুরিতে ঢুকে বাইরের দরজা বন্ধ করে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি কেটে দেবার পরই শুধু পরবর্তী দরজাটি খোলা সম্ভব। এর ফলে বাইরের জগৎ থেকে কোনোকিছু ভিতরে আসতে পারলেও, ভিতর থেকে কিছু বাইরে যেতে পারবে না। বাইরে সেটা নিয়েই বড় সাবধান বাণী লেখা রয়েছে–ভিতর থেকে যেন একটি পরমাণুও বাইরে আসতে না পারে।

দরজার পরবর্তী স্তরটি আরো জটিল। বিদ্যুৎপ্রবাহ ছিল না বলে সেটা সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু রিগার ব্যাগের হোট একটা জেনারেটর তাকে উদ্ধার করল। দ্বিতীয় স্তরটি থেকে তৃতীয় স্তরে যেতে তার পুরো তিন ঘণ্টা সময় বের হয়ে গেল। তৃতীয় স্তরের কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ। স্ক্রুগুলো খুলে হাতলে চাপ দিতেই দরজাটি খুব সহজে খুলে গেল। ভিতরে আলো জ্বলছে। রিগা দরজাটি উন্মুক্ত করে ভিতরে উঁকি দিল।

ঘরের ঠিক মাঝামাঝি অংশে কিছু জটিল যন্ত্রপাতির সামনে উবু হয়ে বসে আছে দুজন মানুষ, দরজা খোলার শব্দ শুনে মাথা ঘুরে তাকিয়েছে দুজন রিগার দিকে। রিগা চিনতে পারল দুজনকেই, একজন প্রফেসর ত্রিনি, আরেকজন প্রফেসর লিক। গত দু শ পনের বছরে তাঁদের চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় নি। প্রফেসর ত্রিনি ভুরু কুঁচকে রয়েছেন, মনে হচ্ছে কোনো কারণে খুব বিরক্ত হয়েছেন, এগিয়ে এসে বললেন, ভিতরে আসতে কাউকে নিষেধ করেছি, তুমি জান না?

বাচনভঙ্গি ভিন্ন ধরনের। গত দু শ বছরে ভাষার বেশি পরিবর্তন হয় নি, কিন্তু বাচনভঙ্গি অনেকটুকু পাল্টেছে। পরিবর্তনটুক খুব সহজে রিগার কানে ধরা পড়ল।

প্রফেসর ত্রিনি আবার বললেন, তোমাকে তো আগে কখনো দেখি নি, কার সাথে তুমি কাজ কর?

রিগা কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, যন্ত্রপাতির মাঝে উবু হয়ে বসে থেকে প্রফেসর লিক বললেন, ত্রিনি, দেখবে এস, ট্রনোট্রনে কোনো পাওয়ার নেই।

পাওয়ার নেই? কী বলছ তুমি। প্রফেসর ত্রিনি দ্রুত লিকের কাছে এগিয়ে গেলেন, বললেন, একটু আগেই তো ছিল।

তোমাকে আমি বলেছিলাম না, এই পাওয়ার সাপ্লাইগুলো একেবারে যাচ্ছেতাই। একট লোড বেশি হলেই ধসে যায়। এখন দেখ কী যন্ত্রণা–

প্রফেসর ত্রিনি মাথা চুলকে বললেন, তাই তো দেখছি। ভাবলাম পাওয়ার সাপ্লাইয়ে পয়সা নষ্ট করে লাভ কি।

এখন বোঝ ঠ্যালা, পুরোটা খুলে ওটা বের করে আনতে জানটা বের হয়ে যাবে না?

আমাকে দাও, আমি করছি। প্রফেসর ত্রিনি বড় একটা পাওয়ার কু-ড্রাইভার নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। রিগা যে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, সেটা মনে হচ্ছে দুজনেই পুরোপুরি ভুলে গেছেন।

রিগা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডারে বড় বড় করে লেখা-১৯শে এপ্রিল, মঙ্গলবার। উপরে বড় একটা ঘড়িতে সময় দেখানো হচ্ছে, সকাল সাড়ে এগারটা—এই চতুষ্কোণ ঘরটিতে সময় স্থির হয়ে আছে এবং এই দু জন বিজ্ঞানী সেটা জানেন না। রিগা তার ঘড়ির দিকে তাকাল, এই ঘরটিতে পা দিয়েছে মিনিটখানেক পার হয়েছে, পৃথিবীতে এর মাঝে কত সময় পার হয়ে গেছে?

প্রফেসর ত্রিনি এবং লিক চতুষ্কোণ একটা বাক্সের মতো কি-একটা জিনিস খুলে টেনে বের করার চেষ্টা করতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলেন, এবারে একটু বিরক্ত হয়ে রিগাকে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে জখছ কী, একটু হাত লাগাও না।

রিগা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, প্রফেসর ত্রিনি এবং প্রফেসর লিক, আপনাদের দুজনকে আমার খুব একটা জরুরি জিনিস বলার রয়েছে।

তার গলার স্বরের জন্যেই হোক বা দু শ পনের বছরের পরিবর্তিত বাচনভঙ্গির জন্যেই হোক, দুজনেই কেমন জানি একটু চমকে উঠলেন। তাঁদের চোখে হঠাৎ কেমন একটি আশঙ্কা ফুটে উঠল। ভালো করে রিগার দিকে তাকালেন প্রথমবারের মতো—কিছু-একটা অসঙ্গতি আঁচ করতে পারলেন দুজনেই। প্রফেসর লিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি কে? কেন এসেছ এখানে?

আমার নাম রিগা। আমি এখানে এসেছি একটা কৌতূহল মেটানোর জন্যে—

কী কৌতূহল? তোমার কথা এরকম কেন? কোন অঞ্চল থেকে এসেছ তুমি?

তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আপনারা কতক্ষণ আগে এই ঘরে ঢুকেছেন?

কেন?

আমি জানতে চাই–

এই আধা ঘণ্টার মতো হবে, প্রফেসর ত্রিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন, এগারটার সময় ঢুকেছি, এখন সাড়ে এগারটা। কেন, কী হয়েছে?

বাইরে, এই আধা ঘণ্টা সময়ে অনেক কিছু হয়ে গেছে।

কী হয়েছে? কি?

দু শ পনের বছর সময় পার হয়ে গেছে।

কথাটি তারা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল না, অবাক হয়ে দুজনে বিস্ফারিত চোখে রিগার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁদের চোখে প্রথমে অবিশ্বাস, তারপর হঠাৎ করে যোবা আতঙ্ক এসে ভর করে। প্রফেসর ত্রিনি ছুটে এসে রিগার কলার চেপে ধরেন, চিৎকার করে বলেন, তুমি মিথ্যা কথা বলছ, মিথ্যা কথা—

রিগা নিজেকে মুক্ত করে বলল, না প্রফেসর ত্রিনি। আমার কাছে আজকের খবরের বুলেটিন আছে। দেখবেন?

প্রফেসর ত্রিনির উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই রিগা হাতের রেম কার্ডটির সুইচ অন করে দিল, সাথে সাথে ঘরের মাঝখানে মিষ্টি চেহারার একজন মেয়ের জীবন্ত ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে ওঠে। দিন তারিখ সন বলে খবর বলা শুরু হয়ে যায়।

প্রফেসর ত্রিনি এবং লিকের বিস্ফারিত চোখের সামনে রিগা সুইচ টিপে রেম কার্ডটি বন্ধ করে দিল। খবরের বিষয়বস্তু, নাকি ত্রিমাত্রিক ছবির এই বৈপ্লবিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি—কোনটি তাদের বাক্যহারা করে দিয়েছে বোঝা গেল না। খুব সাবধানে প্রফেসর লিক একটা গোলাকার আসনে বসে পড়ে প্রফেসর ত্রিনির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ত্রিনি, মনে আছে, আমরা আরেকটা সলিউশান পেয়েছিলাম, বিশ্বাস করি নি তখন। সেটাই কি সত্যি? কিন্তু সেটা তো অসম্ভব–

প্রফেসর ত্রিনি ফ্যাকাসে মুখে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে ছিলেন, আস্তে আস্তে বললেন, আজ বিকেলে আমার মেয়ের জন্মদিন। আমার কেক কিনে নিয়ে যাবার কথা ছিল—দু শ বছর আগে ছিল সেটা? দুশ বছর?

তিনি হঠাৎ নিজের মুখ ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠলেন।

রিগা খুব ধীরে ধীরে শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর ত্রিনি। খুবই দুঃখিত।

প্রফেসর ত্রিনি হঠাৎ মুখ তুলে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর কঠোর মুখে বললেন, আমি বিশ্বাস করি না। আমি বাইরে যাব–

প্রফেসর লিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন ত্রিনির দিকে। তারপর বললেন, ত্রিনি, তুমি তো জান, যদি দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তুমি বাইরে যেতে পারবে না

কে বলেছে পারব না, এক শ বার পারব।

কিন্তু তাহলে সময় সমাপনী নীতির লংঘন হবে।

হোক।

তার মানে তুমি জান বস্তু আর অবস্থানের অবলুপ্তি ঘটবে। তুমি থাকবে কিন্তু তোমার চারপাশের পৃথিবী উড়ে যাবে।

যাক—আমার কিছু আসে যায় না। আমি বাইরে যাব।

প্রফেসর ত্রিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, রিগা পিছন থেকে তাঁকে ডাকল, প্রফেসর ত্রিনি, আমার ধারণা, আপনি বাইরে যেতে পারবেন না। আপনি চাইলেও পারবেন না।

কেন?

আমি এখানে এসেছি প্রায় সাত মিনিটের মতো হয়ে গেছে। তার মানে জানেন?

কি?

পৃথিবীতে আরো পঞ্চাশ বছর সময় পার হয়ে গেছে।

প্রফেসর ত্রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, তাতে কী হয়েছে?

আমি এখানে এসেছি গোপনে, কেউ জানে না। কিন্তু আমার ডাইরিটা আমি রেখে এসেছি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভন্টে। সেটা এতদিনে পৃথিবীর মানুষ পেয়েছে।

পেলে কী হবে?

তারা জানবে আমি এই ল্যাবরেটরির সবগুলো দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকেছি, আপনারা এখন ইচ্ছে করলে বের হয়ে যেতে পারবেন। পৃথিবীর মানুষ সময়ের অপবলয়ের সূত্রের সমাধান করেছে, তারাও জানে দ্বিতীয় সমাধানটি সত্যি। তারাও এখন জেনে গেছে এই ছোট ঘরে আমরা তিনজন স্থির সময়ের ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি, আমরা বের হয়ে গেলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তারা সেটা হতে দেবে না। কিছুতেই হতে দেবে না।

কী করবে তারা?

কাউকে পাঠাবে এখানে। যারা আমাদের তিনজনকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে পৃথিবীকে রক্ষা করবে।

কাকে পাঠাবে? প্রফেসর ত্রিনির গলা কেঁপে গেল হঠাৎ।

আমার ধারণা, সেগুরি-৪৯ ধরনের রবোটকে। অত্যন্ত নিঁখুত রবোট, অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ করতে সক্ষম। আমার ধারণা যে-কোনো মুহূর্তে তারা এসে ঢুকবে এখানে।

বিশ্বাস করি না তোমার কথা। বিশ্বাস করি না–

রিগা কী-একটা বলতে চাইছিল, তার আগেই হঠাৎ সশব্দে দরজা খুলে যায়। দরজায় চারটি ধাতবমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে নিষ্পলক দৃষ্টি, হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মূর্তিগুলো মাথা ঘুরিয়ে তাদের তিনজনকে একনজর দেখে নেয়। তারপর খুব ধীরে ধীরে হাতের অস্ত্র তাদের দিকে উদ্যত করে। রিগা চিনতে পারে—সেঞ্চুরি-৪১ রবোট।

ছোট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিগা। তার অনুমান তাহলে ভুল হয় নি। কখনো হয় না।