০২. সন্ধ্যা হয়ে গেছে

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অমর বাবু স্কুল লাইব্রেরিতে বসে আছেন। হাতে একটা বই। নাম—মৌমাছিদের বিচিত্র জীবন। পড়তে বড় ভালো লাগছে। কত ক্ষুদ্র প্রাণী অথচ কী অসম্ভব বুদ্ধি, কী অসম্ভব জ্ঞান। মৌচাকের ভেতরের তাপমাত্রা তারা একটা নির্দিষ্ট স্থানে স্থির করে রাখে। বাড়তেও দেয় না, কমতেও দেয় না। এই কাজটা তারা করে অতি দ্রুত পাখা কাঁপিয়ে। তাপমাত্রা এক হাজার ভাগের এক ভাগও বেশ-কম হয় না। মানুষের পক্ষেও যা বেশ কঠিন।

তিনি রাত আটটার সময় নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। শরীরটা ভালো লাগছে না। একটু জ্বর জ্বর লাগছে। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দিয়ে গেছে। তিনি কিছু খাবেন না বলে ঠিক করলেন। না খাওয়াই ভালো হবে। অনেক সময় পেটের গণ্ডগোল থেকে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। তাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা ঘটতে পারে। না খেলে তা হবে না। লেবুর সরবত বানিয়ে এক গ্লাস, সরবত খেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়লেন।

কাল শীতশীত লাগছিল, আজ আবার গরম লাগছে। জানালা খোলা, সামান্য বাতাস আসছে। সেই বাতাস মশারির ভেতর ঢুকছে না। তিনি মশারি খুলে ফেললেন। মশা কামড়াবে। কামড়াক। গরমের চেয়ে মশার কামড় খাওয়া ভালো।

মশারি খুলে ফেলে বিছানায় শোয়ামাত্র আবার গত রাতের মতো হল। তিনি ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে যেতে লাগলেন। দেখতে দেখতে তাঁর মাথা ঘরের ছাদ স্পর্শ করল।

তিনি হাত দিয়ে সেই ছাদে ধাক্কা দেয়া মাত্র খানিকটা নিচে নেমে আবার উপরে উঠতে লাগলেন। একি অদ্ভুত কাণ্ড? আবারো কি স্বপ্ন? না, স্বপ্ন না। আজকেরটা স্বপ্ন না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার উপর কাজ করছে না। পৃথিবীর ভর যদি হয় m1, তিনি যদি হন m2 এরং তাঁর ভর m2 যদি হয় শূন্য তাহলে মাধ্যাকর্ষণ বল হবে শূন্য। তাঁর ভর কি এখন শূন্য? তিনি পাশ ফিরলেন, শরীরটা চমৎকারভাবে ঘুরে গেল। সাঁতার কাটার মতো করলেন। তেমন লাভ হল না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন। এটাই স্বাভাবিক, বাতাস অতি হালকা। হালকা বাতাসে সাঁতার কাটা যাবে না।

ব্যাখ্যা কি? এর ব্যাখ্যা কি? একটা মানুষের ভর হঠাৎ শূন্য হয়ে যেতে পারে না। নিচে নামার উপায় কি? মনে মনে আমি যদি চিন্তা করি নিচে নামব তাহলে কি নিচে নামতে পারব? তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন—নেমে যাচ্ছি, দ্রুত নেমে যাচ্ছি। লাভ হল না। যেখানে ছিলেন সেখানেই রইলেন।

আচ্ছা তিনি যদি থুথু ফেলেন তাহলে থুথুটার কি হবে? মাটিতে পড়ে যাবে না শূন্যে ঝুলতে থাকবে? তিনি থুথু ফেললেন। খুব স্বাভাবিকভাবে থুথু মাটিতে পড়ল। গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে ছেড়ে দিলে সেটিও কি শূন্যে ভাসতে থাকবে? নাকি নিচে পড়ে যাবে? অতি সহজেই এই পরীক্ষা করা যায়। তিনি গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেললেন। ছেড়ে দিতেই দ্রুত তা নিচে নেমে গেল। তার মানে এই অদ্ভুত ব্যাপারটির সঙ্গে শুধু তিনিই জড়িত। তাঁর গায়ের পোশাকের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তিনি চোখ বন্ধ করে চিন্তা করছেন মাধ্যাকর্ষণ বল যদি হয় F তাহলে–

F= mlm2 / r²

m1 পৃথিবীর ভর। m2 তাঁর নিজের ভর। r হচ্ছে তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব। m2 যদি 0 হয়, F হবে শূন্য। কিংবা r যদি হয় অসীম হলেও F হবে 0, কোনো বিচিত্র কারণে কি তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব অসীম হয়ে যাচ্ছে? ভাবতে ভাবতে অমর বাবুর ঘুম পেয়ে গেল। এক সময় মাটি থেকে ছফুট উঁচুতে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর ঘুম। তার নাকও ডাকতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই তিনি পাশ ফিরে খুলেন। কোনো রকম অসুবিধা হল না।

ঘুম ভাঙল ভোরবেলা।

অনেক বেলা হয়েছে। ঘরে রোদ ঢুকেছে। তিনি পড়ে আছেন মেঝেতে। কখন মাটিতে নেমে এসেছেন তিনি জানেন না। গায়ে কোনো ব্যথা বোধ নেই, কাজেই ধপ করে পড়েন নি—আস্তে আস্তে নেমে এসেছেন।

অমর বাবু স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত-মুখ ধুলেন। মুড়ি গুড় দিয়ে সকালের নাশতা সারলেন। পুকুর থেকে গোসল শেষ করে যথাসময়ে স্কুলে গেলেন। আজ প্রথম পিরিয়ডেই তার ক্লাস। তিনি ক্লাস না নিয়ে নিজের চেয়ারে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন। মনে হল ঘুমুচ্ছেন। আসলে ঘুমুচ্ছিলেন না, ভাবার চেষ্টা করছিলেন তার জীবনে এসব কি ঘটছে?

ব্যাপারটা শুধু রাতেই ঘটছে। দিনে ঘটছে না। আচ্ছা তিনি যদি তাঁর নিজের ঘরে না ঘুমিয়ে অন্য কোথাও থাকেন তাহলেও কি এই ব্যাপার ঘটবে? রাতে খোলা মাঠে যদি ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে কি ভাসতে ভাসতে মহাশূন্যে চলে যাবেন? মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি বা সূর্যের কাছাকাছি? কিংবা আরো দূরে এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ…সুদূর কোনো ছায়াপথে…?

স্যার!

অমর বাবু চমকে তাকালেন। দপ্তরি কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে।

হেড স্যার, আপনাকে বুলায়।

হেড স্যার তাঁকে কেন ডেকে পাঠালেন তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। ইদরিস সাহেব কি হেড স্যারকে কিছু বলেছেন? বলতেও পারেন। পেট পাতলা মানুষ বলাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা ব্যাপারটা কি তিনি নিজে গুছিয়ে হেড স্যারকে বলবেন? বলা যেতে পারে। মানুষটা ভালো। শুরুতেই অবিশ্বাসের হাসি হাসবেন না।

হেড স্যার বললেন, কেমন আছেন অমর বাবু?

জ্বি ভালো।

দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে না। চা খাবেন?

চা তো স্যার আমি খাই না।

এক-আধবার খেলে কিছু হয় না। খান কালিপদকে চা দিতে বলেছি।

কালিপদ চা দিয়ে থার্ড পিরিয়ডের ঘণ্টা দিতে গেল। হেড স্যার বললেন, শুনলাম গতকাল ক্লাস নেননি। আজও ফাস্ট পিরিয়ড মিস গেছে।

ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে স্যার।

ও আচ্ছা। আপনার তো সব ঘড়ি-ধরা। ঘুম ভাঙতে দেরি হল কেন?

অমর বাবু চুপ করে রইলেন।

পারিবারিক কোনো সমস্যা যাচ্ছে না-কি?

জ্বি-না।

আপনার মেয়ে গতকাল আমার কাছে এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করল। আপনি বাড়িতে থাকেন না। এই নিয়ে বেচারির মনে খুব দুঃখ। দুঃখ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আমি একা থাকতেই পছন্দ করি।

নিজের পছন্দকে সব সময় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। অন্যদের কথাও ভাবতে হয়। আমরা সামাজিক জীব…

স্যার উঠি?

বসুন খানিকক্ষণ। গল্প করি।-অমর বাবু আমি বলি কি যদি অসুবিধা না থাকে তা হলে, আপনার সমস্যাটা আমাকে বলুন। ইরিস সাহেব স্বপ্নের কথা কি সব বলছিলেন–

অমর বাবু ইতস্তত করে বললেন, বিজ্ঞানের সূত্র মিলছে না স্যার। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন সূত্র মিলছে না?

স্যার আইজাক নিউটনের সূত্রমাধ্যাকর্ষণ সূত্র।

আপনার ধারণা সূত্রটা ভুল?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেডমাস্টার সাহেব বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় বললেন, আচ্ছা আপনি বরং বাড়িতে চলে যান। আপনাকে দশ দিনের ছুটি দিয়ে দিলাম। বিশ্রাম করুন। বিশ্রাম দরকার। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মাঝে মাঝে মানুষের কথা এলোমেলো হয়ে যায়।

স্যার, আমার মাথা ঠিকই আছে।

অবশ্যই ঠিক আছে। কথার কথা বললাম। যান, বাসায় চলে যান…বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে।

অমর বাবু বাড়ি গেলেন না। কমন রুমে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। হাতে একটা ফুল স্ক্যাপ কাগজ। সেই কাগজে নিউটনের সূত্র নতুনভাবে লিখলেন

F=k.( mlm2 / r²)

এখানে k-এর মান ১ তবে মাঝে মাঝে k এর মান হচ্ছে শূন্য। যেমন তাঁর ক্ষেত্রে হচ্ছে। এক সময় কলম দিয়ে নির্মমভাবে সব কেটেও ফেললেন। নিউটন যে সূত্র দিয়ে গেছেন—তাঁর মতো সামান্য মানুষ সেই সূত্র পাল্টাতে পারেন না।

অমর বাবু টিফিন পিরিয়ডে অনেক সময় নিয়ে ইংরেজিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির বাংলা অনুবাদ অনেকটা এই রকম–

জনাব,

আমি রূপেশ্বর হাইস্কুলের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক। নিতান্ত অনন্যোপায় হইয়া আপনাকে পত্র দিতেছি। সম্প্রতি আমার জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটিতেছে যাহার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি খুঁজিয়া না পাইয়া আপনার দ্বারস্থ হইলাম। আমি শূন্যে ভাসিতে পারি। আপনার নিকট খুব অদ্ভুত মনে হইলেও ইহা সত্য। আমি ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়া বলিতেছি আপনাকে যাহা বলিলা সবই সত্য। কোনো রকম চেষ্টা ছাড়াই আমি শূন্যে উঠিতে পারি এবং ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটাইতে পারি। জনাব, বিষয়টি কি বুঝিবার ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন তাহা হইলে এই অধম আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিবে। আপনি বললেই ঢাকায় আসিয়া আমি আপনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটি চাক্ষুষ দেখাইব। জনাব, আপনি আমার প্রতি দয়া করুন বিষয়টি বুঝিতে আমাকে সাহায্য করুন।

বিনীত
অমর দাস পাল
B. Sc. (Hons)

দশ দিনের পুরোটাই তিনি নিজের ঘরে কাটালেন-বাড়িতে গেলেন না। তাঁকে নিতে তাঁর ছোট মেয়ে অতসী এসেছিল। তাকে ধমকে বিয়ে করলেন। এই মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল—তাকে এত করে বললেন সায়েন্স পড়তে, সে ভর্তি হল আর্টস-এ। কোনো মানে হয়? তাকে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র কি জিজ্ঞেস করলে সে হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। কী দুঃখের কথা।

অতসীকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দিলেও সে গেল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। তিনি বাইরে এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কদছিস কেন?

সে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তোমার শরীর খারাপ বাবা। তুমি বাড়িতে চল।

শরীর খারাপ তোকে কে বলল?

সবাই বলাবলি করছে। তুমি না-কি কি সব স্বপ্ন-টপ্ন দেখ।

কোনো স্বপ্ন দেখি না। আমি ভালো আছি। নির্জনে একটা পরীক্ষা করছি। পরীক্ষা শেষ হোক তোদর সঙ্গে এসে কয়েকদিন থাকব।

কীসের পরীক্ষা?

কীসের পরীক্ষা বললে তো তুই বুঝবি না। হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকবি। এত করে বললাম সায়েন্স পড়তে।

অঙ্ক পারি না যে।

অঙ্ক না পারার কি আছে? যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ-অঙ্ক তো এর বাইরে না। কাঁদিস না। বাসায় যা। আমি ভালো আছি।

তিনি যে ভালো আছেন তা কিন্তু না।

রোজ রাতে একই ব্যাপার ঘটছে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমুতে যানমাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেশেন শূন্যে ভাসছেন। তখন আতঙ্কে অস্থির হওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তিনি ইচ্ছে করলেই নিচে নামতে পারেন না।

নিচে কীভাবে নামেন তাও জানেন না। রাতটা তার অঘুমেই কাটে। তিনি ঘুমুতে যান দিনে। এমন যদি হত তিনি দিনরাত সারাক্ষণই শূন্যে ভাসছেন তাহলেও একটা কথা ছিল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতেন যে, কোনো-এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তাঁর ভর শূন্য হয়ে গেছে। ব্যাপারটা সে রকম না। এমন কেউ এখানে নেই যে তিনি সাহায্যের জন্যে তাঁর কাছে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার চেয়ারম্যান সাহেবও কিছু লিখছেন না। হয়তো ভেবেছেন পাগলের চিঠি। কে আর কষ্ট করে পাগলের চিঠির জবাব দেয়?

নদিনের মাথায় অমর বাবু চিঠির জবাব পেলেন। অতি ভদ্র চিঠি। চেয়ারম্যান সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে লিখেছেন–

জনাব,

আপনার চিঠি কৌতূহল নিয়ে পড়লাম। আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। কাজেই বুঝতে পারছেন আপনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা বিজ্ঞান স্বীকার করে না। আপনি যদি আমার অফিসে এসে শূন্যে ভাসতে থাকেন তাহলেও আমি বিশ্বাস করব না। ভাবব এর পেছনে ম্যাজিকের কোনো কৌশল কাজ করছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন জাদুকররা শূন্যে ভাসার খেলা সব সময়ই দেখায়।

যাই হোক, আপনার চিঠি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে আপনার সমস্যাটি মানসিক। আপনি মনে মনে ভাবছেন-শূন্যে ভাসছেন। আসলে ভাসছেন না। সবচে ভালো হয় যদি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। একমাত্র তিনিই আপনাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি আপনাকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে শেষ করছি।

বিনীত
এস. আলি
M. Sc., Ph. D. F.R.S.

অমর বাবু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কারণ তিনি জানেন বিষয়টা সত্যি। তিনি দুএকটা ছোটখাটো পরীক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। যেমন স্কুল থেকে লাল রঙের চক নিয়ে এসেছিলেন। শূন্যে উঠে যাবার পর সেই লাল রঙের চক দিয়ে ছাদে বড় বড় করে লিখলেন,

হে পরম পিতা ঈশ্বর, তুমি আমাকে দয়া কর।

তোমার অপার রহস্যের খানিকটা আমাকে দেখতে দাও।

আমি অন্ধ, তুমি আমাকে পথ দেখাও। জ্ঞানের আলো আমার হৃদয়ে প্ৰজ্বলিত কর। পথ দেখাও পরম পিতা।

আরো অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, চক ফুরিয়ে যাওয়ায় লেখা হল না। এই লেখাটা ছাদে আছে। তিনি তাকালেই দেখতে পান। এমন যদি হত লেখাটা তিনি একা দেখতে পাচ্ছেন তাহলেও বোঝা যেত সমস্যাটা মনে। কিন্তু তা তো না। অন্যরাও লেখা পড়তে পারছে। গতকাল বিকেলে হেড মাস্টার সাহেব তাঁকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই বিস্মিত গলায় বললেন, ছাদে এই সব কি লেখা?

অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, প্রার্থনা সংগীত।

প্রার্থনা সংগীত ছাদে লিখলেন কেন?

শুয়ে শুয়ে যাতে পড়তে পারি এই জন্যে।

লিখলেন কীভাবে? মই দিয়ে উঠেছিলেন না-কি?

অমর বাবু জবাব দিলেন না। হেড মাস্টার সাহেব জবাবের জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, আপনার ছুটি তো শেষ হয়ে গেল, আপনি কি ছুটি আরো বাড়াতে চান?

জ্বি-না।

আপনি বরং আরো কিছুদিন ছুটি নিন। শরীরটা এখনো সেরেছে বলে মনে হয় না। আপনাকে খুব দুর্বল লাগছে।

আমার শরীর যা আছে তাই থাকবে স্যার। আর ভালো হবে না।

এইসব কি ধরনের কথা? কোনো ডাক্তারকে কি দেখিয়েছেন?

জ্বি-না।

ডাক্তার দেখাতে হবে। ডাক্তার না দেখালে কিভাবে হবে? বিধু বাবুকে দেখান। বিধু বাবু এল.এম. এফ. হলেও ভালো ডাক্তার। যে কোনো বড় ডাক্তারের কান টেনে নিতে পারে। বিধু বাবুকে দেখানোর কথা মনে থাকবে?

জ্বি স্যার, থাকবে।

না আপনার মনে থাকবে না। আমি বরং নিয়ে আসব। আমার ছোট মেয়েটার জ্বর। বিধু বাবুকে বাসায় আসতে বলেছি। এলে, আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব।

জ্বি আচ্ছা।

এখন তাহলে উঠি অমর বাবু?

একটু বসুন স্যার।

হেড মাস্টার সাহেব উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন। তিনি খানিকটা বিস্মিত, কারণ অমর বাবু এক দৃষ্টিতে ছাদের লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। অমর বাবু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি স্যার—যদি কিছু মনে না করেন।

বলুন কি বলবেন। মনে করাকরির কি আছে?

অমর বাবু প্রায় ফিসফিস করে বললেন, আমি শূন্যে ভাসতে পারি।

বুঝতে পারলাম না কি বলছেন। আমি আপনা-আপনি শূন্যে উঠে যেতে পারি।

ও আচ্ছা।

হেড মাস্টার সাহেব ও আচ্ছা এমন ভঙ্গিতে বললেন, যেন শূন্যে ভেসে থাকবার ব্যাপারটা রোজই ঘটছে। তবে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব চিন্তিত বোধ করছেন।

ছাদের লেখাগুলি শূন্যে ভাসতে ভাসতে লেখা।

ও আচ্ছা।

আপনার কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?

হেড মাস্টার সাহেব জবাব দিলেন না। অমর বাবু বললেন, আমি স্যার এই জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলিনি। ছেলেবেলায় হয়তো বলেছি, জ্ঞান হবার পর থেকে বলিনি।

আমি বিধু বাবুকে পাঠিয়ে দেব।

জি আচ্ছা।

হেড মাস্টার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, উনাকে শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা বলার দরকার নেই। জানাজানি হবে-ইয়ে মানে—লোকজন হাসাহাসি করতে পারে।

আমি আপনাকেই খোলাখুলি বলেছি। আর কাউকে বলিনি।

ভালো করেছেন। খুব ভালো করেছেন।

বিধু বাবু এসে খানিকক্ষণ গল্পটল্প করে যাবার সময় ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলেন। বললেন, দুঃস্বপ্ন না দেখার একটাই পথ। গভীর নিদ্রা। দ্রিা পাতলা হলেই মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখে। আমি ফোনোবারবিটন ট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। শোবার আগে দুটা করে খাবেন।

অমর বাবু দুটো ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। তবে ঘুমুতে যাবার আগে এক কাণ্ড করলেন-কালিপদকে বললেন, লম্বা একাছি দড়ি নিয়ে তাঁকে খুব ভালো করে চৌকির সঙ্গে বেঁধে রাখতে।

কালিপদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

অমর বাবু বিরক্ত মুখে বললেন, আমার মাথা খারাপ হয়নি। মাথা ঠিক আছে। তোমাকে যা করতে বলেছি কর। ব্যাপারটা কি পরে বুঝিয়ে বলব। লম্বা দেখে একগাছি দড়ি আন। শক্ত করে আমাকে চৌকির সঙ্গে বাঁধ।

কালিপদ তাই করল। তবে করল খুব অনিচ্ছার সঙ্গে।

অমর বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের ট্যাবলেটের কারণে তাঁর গাঢ় দ্রিা হল। ঘুম ভাঙল বেলা উঠার পর। তিনি দেখলেন—এখনো চৌকির সঙ্গে বাঁধা আছেন তবে চৌকি আগের জায়গায় নেই, ঘরের মাঝামাঝি চলে এসেছে। তার একটিই মানে—চৌকি নিয়েই তিনি শূন্যে ভেসেছেন। নামার সময় চৌকি আগের জায়গায় নামেনি। স্থান পরিবর্তন হয়েছে।

তিনি সেদিনই বিছানাপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে এলেন। অতসী তাঁকে দেখে কেঁদে ফেলল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, নাকে কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?

অতসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল, তোমার শরীর এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা? কী ভয়ংকর রোগা হয়ে গেছে।

ভালো ঘুম হচ্ছে না, এই জন্যে শরীর খারাপ হয়েছে, এতে নাকে কাদার কি হল?

সবাই বলাবলি করছে তোমার না-কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কালিপদ নাকি রোজ রাতে দড়ি দিয়ে তোমাকে বেঁধে রাখে।

কী যন্ত্রণা! একবারই বাঁধতে বলেছিলাম—এর মধ্যে এই গল্প ছড়িয়ে গেছে?

তোমার কী হয়েছে বাবা বল?

কিছু হয়নি।

অমর বাবু ছদিন বাড়িতে থাকলেন। এই ছদিনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করলেন। শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা তিনি একা একা থাকার সময়ই ঘটে। অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে ঘুমুলে ঘটে না। যে কত তাঁর স্ত্রী তাঁর সঙ্গে ঘুমিয়েছেন সে করাত তিনি শূন্যে ভাসেননি। দুরাত ছিলেন একা একা, দুরাতেই শূন্যে উঠে গেছেন।

পূজার ছুটির পর স্কুল নিয়মিত শুরু হল। তিনি স্কুলে গেলেন না। লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলেন। আবার বাড়ি ছেড়ে বাস করতে শুরু করলেন স্কুলের ঘরে। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকতে তার ভালো লাগে না।

শূন্যে ভাসার ব্যাপারটা রোজ ঘটতে লাগল। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে লাগল। এখন বিছানায় শোয়ামাত্র শূন্যে উঠে যান। সারারাত সেখানেই কাটে। শেষ রাতের দিকে নিচে নেমে আসেন। ব্যাপারটা ঘটে শুধু রাতে, দিনে ঘটে না। কখনো না। এবং অন্য কোনো ব্যক্তির সামনেও ঘটে না।

হেড স্যার এবং ইদরিস স্যার পর পর দুরাত অমর বাবুর ঘরে জেগে বসে ছিলেন। দেখার জন্যে ব্যাপারটা কি। তাঁরা মুহুর্তের জন্যেও চোখের পাতা এক করেননি। লাভ হয়নি, কিছুই দেখেননি। হেড স্যার বললেন, ব্যাপারটা পুরোপুরি মানসিক।

অমর বাবু দুঃখিত গলায় বললেন, আপনার কি ধারণা আমি পাগল হয়ে গেছি?

না, তা না। পাগল হবেন কেন? তবু আমার ধারণা ব্যাপারটা আপনার মনে ঘটছে। একবার ঢাকায় চলুন না, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি।

না।

ক্ষতি তো কিছু নেই। চলুন না।

আমি যেতে চাচ্ছি না স্যার, কারণ আমি জানি ব্যাপারটা সত্যি। সত্যি না হলে ছাদে এই লেখাগুলি আমি কীভাবে লিখলাম? দেখছেন তো ঘরে কোনো মই নেই।

হেড স্যার চুপ করে রইলেন। অমর বাবু বললেন, আপনারা ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান, আমি আবার শূন্যে উঠে ছাদে একটা লেখা লিখব।

হেড স্যার বললেন, তার দরকার নেই; কিন্তু কথা হচ্ছে আপনি আমাদের সামনে ব্যাপারটা পারছেন না কেন?

আমি জানি না। জানলে বলতাম। জানার চেষ্টা করছি, দিন-রাত এটা নিয়েই ভাবছি।

এত ভাবাভাবির দরকার নেই, আপনি আমার সঙ্গে ঢাকা চলুন। দুদিনের ব্যাপার। যাব, ডাক্তার দেখাব, চলে আসব। আমার একটা অনুরোধ রাখুন। প্লিজ। আপনার হয়তো লাভ হবে না কিন্তু ক্ষতি তো কিছু হবে না।