সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ সহসা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
সংক্ষিপ্ত সমাচার : টেরিটি বাজারে নৃশংস খুন। টেরিটি বাজারের এক পাখীওয়ালা ইউসুফ মিঞাকে তার ঘরের মধ্যে গলাকাটা মৃতাবস্থায় রক্তাপুত পাওয়া গিয়েছে।
বর্ষাকাল—এবারে বৃষ্টি বা মনসুন শুরু হয়েছে শ্রাবণের একেবারে শেষে। গতকাল বিকেল থেকে শহরে প্রবল বর্ষণ চলেছে একটানা প্রায় বলতে গেলে।
রাস্তাঘাট প্রায় জলমগ্ন। বৃষ্টি একবার সামান্যক্ষণের জন্য ধরে, আবার প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। বিকেলে গতকাল এসেছিলাম কিরীটীর ওখানে কিন্তু গৃহে ফেরা হয়নি প্রবল বর্ষণের জন্য।
সকালবেলা তখনও আকাশটা যেন স্লেটের মত ধূসর ও ভারি হয়ে আছে। থেকে থেকে বর্ষণ হচ্ছে। কিরীটীর বসবার ঘরে আমি কিরীটী ও কৃষ্ণা চা পান করছিলাম। আমার হাতে
ঐদিনকার সংবাদপত্রটা।
সহসা পাতা ওলটাতে ওলটাতে সংবাদটি আমার চোখে পড়ল।
চমকে উঠলাম।
এ কি!
কি হল? কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকাল।
ইউসুফকে কে যেন তার দোকানঘরে নৃশংসভাবে খুন করে গিয়েছে।
ইউসুফ?
হ্যাঁ রে। সেই টেরিটি বাজারের চিড়িয়াওয়ালা-ইউসুফ মিঞা।
কি লিখেছে?
গতকাল সকালে তার দোকানঘরের মধ্যে তাকে রক্তাক্ত গলাকাটা মৃত পাওয়া গিয়েছে।
তার একটা ছেলে ছিল না—কি যেন নাম? কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে।
সুলতান।
সুলতান ছিল না বুঝি ঐ সময়? সেও তো বাপের কাছেই থাকত?
সে রাত্রে সে দোকানে ছিল না। বরাহনগরে তার এক বন্ধুর ওখানে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল। ভোরাত্রে গিয়ে দেখে দোকানের দরজাটা ভেজানো। দরজা ঠেলে খুলতেই একরাশ পাখী চারদিক থেকে তার চারপাশে ডেকে ডেকে উড়তে থাকে। ঘরের আলোটা নেভানো ছিল।
থতমত খেয়ে প্রথমটায় ব্যাপারটা না বুঝতে পেরে সে অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর এগুতে গিয়ে পায়ে কি বেধে গিয়ে, মেঝের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর কোনমতে উঠে আলো জ্বালতেই চোখে পড়ে তার বাপজান মেঝের উপর পড়ে আছে রক্তাপ্লুত অবস্থায়। তার গলাটা কাটা। সে তখুনি চিৎকার করে আশপাশের সকলকে ডাকে। অতঃপর পুলিস আসে। কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি।
কিরীটী সংবাদটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, লোকটা তো যতদূর মনে পড়ে বেশ নিরীহ শান্তশিষ্ট টাইপের ছিল!
তাই তো ভাবছি, অমন একটা লোককে কে খুন করতে পারে? আর কেনই বা করল অমন করে?
কথা আমার শেষ হল না, জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবু!
কি রে?
একটা লোক দেখা করতে চায়।
এত সকালে বৃষ্টি মাথায় করে আবার কে এল? বললাম আমি।
কিরীটী বলে, কি চায়? কোথা থেকে আসছে?
আজ্ঞে বললে, বিশেষ দরকার নাকি আছে আপনার সঙ্গে।
যা, কোথা থেকে আসছে, কি নাম-জিজ্ঞাসা করে আয়।
আজ্ঞে বললে, টেরিটিবাজার থেকে আসছে।
টেরিটিবাজার! চমকে উঠি।
হ্যাঁ-ইউসুফ মিঞার ছেলে সুলতান।
যা, এই ঘরে নিয়ে আয়। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দেয়।
জংলী চলে গেল।
একটু পরেই জংলীর পিছনে পিছনে যে যুবকটি এসে ঘরে ঢুকল তার বয়স বাইশতেইশের মধ্যে।
যুবকটি সুলতানই। বেশ কয়েক বছর পরে হলেও তাকে আমাদের কারোর চিনতে কষ্ট হয় না, কারণ বার-দুই ওকে ইউসুফের দোকানে দেখেছিলাম, তবে অন্য বেশভূষায়। তখন পরনে ছিল চেককাটা এক লুঙ্গি আর সাদা ময়লা পাঞ্জাবি। চুলের বাহারও বিশেষ ছিল না সে-সময়।
সাদামাটা চেহারা ও বেশ। আজ কিন্তু চেহারা ও বেশভূষায় অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল। মাথায় টেরি, কেয়ারী করে ছাঁট চুল ও ঠোটের উপরে বাটারফ্লাই গোঁফ, মেহেদী রাঙানো নুর দাড়ি। রংটা মাজা-মাজা। পেশল বলিষ্ঠ দেহের গড়ন। পরনে পায়জামা ও লক্ষ্ণৌ চিকনের পাঞ্জাবি।
চিড়িয়াওয়ালা ইউসুফ মিঞার বেটা বলে আজ যেন চিনবারই উপায় নেই সুলতানকে। যেন কোন খানদানী মুসলমানের ঘরের ছেলে। বেশ সৌখীন, চেহারায় ও বেশভূষায়।
বাবুজী, আপনারা দুজনেই আছেন ভালই হল, সেলামালেকুম বাবুজী। আমাকে চিনতে পারছেন?
কিরীটী বললে, বস সুলতান।
কিরীটীর আহ্বানে কোনরকম সংকোচ না করে পায়ের জুতো খুলে ঘরের পুরু দামী কাপেট মাড়িয়ে এসে একটা সোফার উপর আমাদের মুখোমুখি বসল, আপনারা যে গরীবকে চিনতে পারবেন বুঝিনি। বাবুজী, একটা বিশেষ কারণে আপনার কাছে এসেছি। সুলতান কিরীটীর মুখের দিকেই তাকিয়ে বলে কথাটা।
খবরের কাগজে একটু আগেই পড়ছিলাম, তোমার আব্বাজান–
হ্যাঁ বাবুজী, আমার আব্বাজানকে পরশু রাত্রে আমার অবর্তমানে কারা যেন শেষ করে রেখে গিয়েছে।
তুমি ছিলে না?
না বাবুজী, বরাহনগরে এক দোস্তের ওখানে গিয়েছিলাম। খানাপিনা শেষ হতে হতে অনেক রাত হল, তারপর কোন বাস বা গাড়ি পেলাম না, হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এসেছি।
কত রাতে পৌঁচেছিলে?
রওনা হয়েছিলামই তো রাত তিনটের পর, পৌঁছতে পৌঁছতে সেই প্রায় সাড়ে চারটে। আশেপাশে কোন জনমনিষি নেই, দরজা ঠেলে আব্বাজানকে ডাকতে যাব, হঠাৎ দেখি দরজা খুলে গেল-হাতের ঠেকা লেগেই।
আমি শুধালাম তারপর। চমকে গিয়েছিলাম। আব্বাজান তো কখনো দরজা খুলে শোয় না, খুব সতর্ক মানুষ! শোবার আগে দরজা ঠিক বন্ধ হল কিনা ভাল করে পরীক্ষা না করে কখনো শুতে যায় না। সেই মানুষ দরজা খুলে রেখেছে—কেমন যেন খটকা লাগল।
দরজা খুলে যেতে প্রথমে তোমার চোখে কি পড়েছিল সুলতান? প্রশ্ন করে কিরীটীই এবারে।
অন্ধকার-পাখার ঝটপট শব্দ। মনে হল যেন অন্ধকার ঘরটার সধ্যে সব পাখীগুলো খাচা থেকে বের হয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে। প্রথমটায় কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলাম, অন্ধকারেই বোধহয় কয়েক পা এগিয়েছিলাম, হঠাৎ বাধা পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম অন্ধকারে।
কিসে বাধা পেলে?
তখন বুঝতে পারিনি, পকেটে টর্চ ছিল না, তাই কোনমতে অন্ধকারেই উঠে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দেওয়ালে আলোর সুইচটা টিপে দিতেই সব কিছু নজরে পড়ল। মেঝের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে আমার আব্বাজান, ঘরের মেঝেতে চাপচাপ রক্ত আর ঘরের সব পাখীর খাঁচার দরজাই বলতে গেলে খোলা। উড়ছে, বসছে, ডানা ঝাপটাচ্ছে-সব যেন ওলটপালট তছনছ। কিন্তু সে-সব কিছু দেখবারও আমার সময় হয়নি। ছুটে গিয়ে আব্বাজানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, আব্বাজান! আব্বাজান!
সেই সময় নজরে পড়ল আব্বাজানের গলাটা একেবারে দু-ফাঁক করে কাটা।
তারপর—তুমি কি করলে সুলতান?
আমার চেঁচামেচিতে আশপাশের দোকান থেকে সবাই ছুটে এল। তারাই তখন পুলিসে খবর দেয়। পুলিস এল, সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, কিন্তু কেউ কোন হদিস দিতে পারল না। কেউ কিছু বলতে পারল না। কেউ কিছুই নাকি জানে না—জানতেও পারেনি।
.
সুলতানের মুখে সব কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল কিরীটী।
তারপর একসময় প্রশ্ন করল, কিন্তু তুমি আমাদের কাছে এসেছ কেন?
বাবুজী, আমার আব্বাজানের কাছেই আপনার কথা শুনেছিলাম। আপনি খুব বড় একজন গোয়েন্দা, আব্বাজানই একদিন আমাকে বলেছিল। হঠাৎ কাল রাত্রে আপনাদের কথা আমার মনে পড়ল বাবুজী। কালই আসতাম, কিন্তু বৃষ্টির জন্য আসতে পারিনি। জানি না আমার আব্বাজানকে অমন করে কে খুন করেছে। কিন্তু যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কথা জানতে পারছি আমার মনের দুঃখ যাবে না। কেবলই মনে হচ্ছে সে-রাতে যদি আমি বরাহনগরে না যেতাম তবে হয়ত ঐ ঘটনা ঘটত না। আমার আব্বাজানকে অমন করে প্রাণ দিতে হত না। মনে হচ্ছে তাই আমিই দায়ী-আমার আব্বাজানের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। বলতে বলতে গলাটা যেন কান্নায় বুজে এল সুলতানের।
চোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
একটু থেমে হাতের পাতায় চোখের অশ্রু মুছে সুলতান বললে, জানেন বাবুজী, আব্বাজান সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে যেতে দিতে চায়নি—বলেছিল আজ বরাহনগরে নাই গেলি বেটা, কিন্তু শুনিনি তার কথা। দোস্ত মুসুদ নিমন্ত্রণ করেছে—অনেককালের দোস্তী আমাদের–তাছাড়া অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ ছিল না—তাই আব্বাজানের কথায় কান দিইনি।
সুলতানের দু চোখের কোল আবার অশ্রুতে ভরে ওঠে।
বাইরে আবার বৃষ্টি নামল বেশ জোরে।
বাবুজী, আপনার যোগ্য পারিশ্রমিক হয়ত আমি দিতে পারবো না-তবে সাধ্যমত দেবো-কিছু টাকা আমি সঙ্গেই এনেছি। বলে একশো টাকার খান তিনেক নোট জামার পকেট থেকে বের করল সুলতান!
টাকা তুমি রাখ সুলতান। কিরীটী বললে।
বাবুজী, আপনি কি তাহলে আমাকে কৃপা করবেন না!
আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার আব্বাজানের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে। আমার পারিশ্রমিকের জন্য তুমি ভেবো না, আগে কাজটা হোক তারপর যা খুশি তোমার তুমি দিও।
বাবুজী!
এখন কয়েকটা প্রশ্নের আমার জবাব দাও সুলতান!
বলুন?
তোমাদের কি কোন দুশমন বা শত্রু ছিল?
দুশমন!
হ্যাঁ, তোমার বা তোমার আব্বাজানের?
আমরা ঐখানে আজ বিশ সালেরও উপরে আছি। আব্বাজানকে সবাই ওখানে খুব ভালবাসত-কারণ দায়ে অদায়ে আব্বাজান সকলকেই অর্থ বা তাগদ দিয়ে সাহায্য করত। আমার সঙ্গে অবিশ্যি কখনও কখনও কারও ঝগড়াঝাঁটি মারামারিও হয়েছে, কিন্তু–
আচ্ছা ঐ ব্যবসায় তোমাদের লাভ হত কি রকম সুলতান?
মিথ্যে বলব না বাবুজী, আব্বাজান ঐ ব্যবসা করে বেশ কিছু জমিয়েছিল।
কত টাকা হবে?
তা দশ বারো হাজার তো হবেই।
সে টাকা কোথায় সে রাখত?
ঘরে একটা হাঁড়ির মধ্যে।
সে টাকাগুলো আছে তো?
হাঁড়িটা যেমন ছিল তেমনই আছে, সে আমি ঐদিনই দেখেছি।
তাহলে টাকার জন্য নয়!
কি বললেন বাবুজী?
না, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সুলতান, কেউ টাকা-পয়সার লোভে তোমার আব্বাজানকে খুন করেনি। আচ্ছা সুলতান!
বলুন বাবুজী?