০২. শ্ৰীনগর উপত্যকার এক রূপ

॥ ২ ॥

আকাশ থেকে শ্রীনগর উপত্যকার এক রূপ, আর মাটিতে নেমে আরেক রূপ। চোখ জুড়িয়ে যায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এও ঠিক যে এজায়গার সঙ্গে দার্জিলিং-সিমলার কোনো মিল নেই। শ্রীনগরের দৃশ্য একেবারে অনন্য। সেটা আরো বেশি করে বুঝতে পারলাম ট্যাক্সিতে করে শহরে আসার সময়। শহর থেকে এয়ারপোর্ট সাত মাইল। একবার মনে হয়েছিল উপত্যকা বলে বুঝি অনেকটা কাঠমাণ্ডুর মতো হবে, কিন্তু তারপর লেক আর ঝিলাম নদী দেখে সে ধারণা একদম পাল্টে গেল।

আমাদের যেতে হবে ডাল লেকের দক্ষিণে শহরের রাস্তা বুলেভার্ডে। আধ ঘণ্টায় বুলেভার্ডে পৌঁছে গেলাম। লেকের এদিকটা পাকা গাঁথুনি দিয়ে ঘেরা। ঘাট থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছোট নৌকোয় গিয়ে উঠতে হয়। এই নৌকোকে এখানে বলে শিকারা! ভেনিসে যেমন জলপথে যাতায়াতের জন্য গণ্ডোলা, এখানে তেমনি শিকারা। আমাদের হাউসবোটের নাম ‘ওয়াটার লিলি।’ ‘ওয়াটার লিলি’র শিকারাও ঘাটেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা মালসমেত তাতে গিয়ে উঠলাম। তারপর পঞ্চাশ হাত খানেক গেলেই পাশাপাশি সারবাঁধা হাউসবোট। এই সারি কিছুদূর যাবার পর লেক চওড়া হয়ে গেছে, তারপর আর হাউসবোট নেই। যা আছে সবই লেকের পশ্চিম অংশে।

শিকারা থেকে বোটে উঠতে কোনো কসরতের দরকার হয় না, খুবই সহজ ব্যবস্থা। বোটের সামনের দিকে খানিকটা খোলা জায়গা, সেখানে ইচ্ছা করলে বসা যায়, আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরের ডেকে ওঠার বন্দোবস্ত আছে, সেখানে চেয়ারে বসে চারিদিকের দৃশ্য উপভোগ করা যায়, চা খাওয়া যায়, আর স্রেফ আড্ডাও মারা যায়।

ভিতরে ঢুকলে প্রথমেই বসবার ঘর, তাতে সোফা, চেয়ার, কার্পেট ইত্যাদি বৈঠকখানার যাবতীয় সরঞ্জাম রয়েছে, দেয়ালে ছবি রয়েছে, ফুলদানিতে ফুল রয়েছে, আবার একটা ছোট লাইব্রেরিও রয়েছে। বসবার ঘরের পরে খাবার ঘর, দুটো বেডরুম, বাথরুম ইত্যাদি। সব মিলিয়ে জলের উপর একটি বাংলো বাড়ি যাতে সব রকম ব্যবস্থা আছে। কিচেনও আছে, তবে সেটা পিছনদিকে একটা ছোট্ট আলাদা নোকোয়।

লালমোহনবাবুর মুখে হাসি লেগেই আছে, বললেন, ‘ভাগ্যিস ডিসিশনটা নিয়েছিলাম। এর ক্রেডিট কিন্তু সবটাই আমার পাওনা। তোমার দাদা ভূস্বর্গের কথা ভাবেননি।’

ফেলুদা বলল, ‘আমি তো আপনার মতো লেখক নই। আইডিয়া আসা উচিত আপনারই মাথা থেকে। যাকগে, এখন আগে একটু চা খেয়ে শিকারায় করে লেকটা একবার ঘুরে দেখা যাক।’

দুজন চাকর রয়েছে হাউসবোটের সঙ্গে, নাম মাহমুদিয়া আর আবদুল্লা।

চা খেয়ে বেরোতে বেরোতে সূর্য হেলে এল পশ্চিমে। মে মাস হলে কী হবে, বেশ ঠাণ্ডা; আমাদের কলকাতায় শীতের সময় যে পোশাক পরতে হয়, এখন এখানেও তাই পরতে হয়। ফেলুদা বলল, ‘আজ শুধু লেকটা ঘুরে দেখা যাবে, কাল থেকে সাইট সীইং আরম্ভ হবে। বুলেভার্ডের পিছনেই দেখতে পাচ্ছেন পাহাড় রয়েছে, এক হাজার ফুট উঁচু। ওর মাথায় রয়েছে শঙ্করাচার্যের মন্দির। সম্রাট অশোকের ছেলে জালুকের তৈরি। তাছাড়া লেকের পুবদিকে মোগল বাগান রয়েছে—নিশাদবাগ, শালিমার, চশমা শাহি—এগুলোও দেখা চাই। চশমা শাহির স্প্রিং-এর জল নাকি একেবারে অমৃত—যেমনি স্বাদ, তেমনি ক্ষুধাবর্ধক।’

‘লেকের মাঝখানে একটা ছোট্ট দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, ওটা কী?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি জানতাম ফেলুদা কাশ্মীর সম্বন্ধে সব পড়াশুনা করে এসেছে।

ফেলুদা বলল, ‘ওটাকে বলে চার চিনার। দ্বীপটার চার কোণে চারটে চিনার গাছ রয়েছে।’

মাহমুদিয়া আর আবদুল্লা শিকারা চালাতে আরম্ভ করল, আমরা বাঁয়ে গোটা দশেক হাউসবোট পেরিয়ে আসল লেকে গিয়ে পড়লাম। দুটো পাশাপাশি হাউসবোট নিয়ে রয়েছেন রিটায়ার্ড জজ সিদ্ধেশ্বর মল্লিক আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ। আমরা খোলা লেকে পড়বার আগে একটা বোট থেকে সুশান্ত সোম আমাদের দিকে হাত নেড়ে বললেন, ‘ফেরার পথে একবার ঢুঁ মেরে যাবেন। চায়ের নেমন্তন্ন রইল।’

ডাল লেকের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। স্বচ্ছ কাচের মতো জল, হাওয়া নেই বলে ঢেউ নেই, তাই আয়নার মতো চারিদিকের পাহাড়গুলো প্রতিফলিত হচ্ছে। এখানে ওখানে পদ্ম শালুক শাপলা ফুটে আছে, শিকারা সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলেছে। লালমোহনবাবুকে কবিতায় পেয়েছে, বললেন, ‘কাশ্মীর সম্পর্কে আমাদের এথিনিয়াম ইস্কুলের মাস্টার বৈকুণ্ঠ মল্লিকের একটা আট লাইনের কবিতা আছে। ভদ্রলোক বহু জায়গায় ঘুরেছিলেন, আর সেই সব জায়গা নিয়ে পদ্য লিখে গেছেন। কাশ্মীরেরটা শুনুন ফেলুবাবু, কিরকম ডিসেন্ট—

করি নত শির

তোমারে প্রণমি কাশ্মীর

কুমারীকার অপর প্রান্তে

অবস্থান তব ভারতের উত্তর সীমান্তে

রাজধানী শ্রীনগর

ঝিলামের জলে ধোয়া অপূর্ব শহর

কত হ্রদ, কত বাগ, কত বাগিচা

অন্য নগরের সাথে তুলনা করিতে যাওয়া মিছা।… ’

‘বাঃ, দিব্যি’, বলল ফেলুদা—যদিও বুঝলাম সেটা জটায়ুর মনে কষ্ট না দেবার জন্য। কবিতায় লালমোহনবাবুর রুচিটা যে একটু গোলমেলে তার পরিচয় এর আগেও অনেকবার পেয়েছি।

শুধু কবিতা নয়, ডাল লেকের দৃশ্যে ভদ্রলোককে গানেও পেয়েছে। গুন গুন করে কী গাইছেন জিজ্ঞেস করাতে বললেন উর্দু গজল।

এদিকে সন্ধ্যার আলো অনেক বেশিক্ষণ থাকে—অন্তত বছরের এই সময়টায়। আমরা সাড়ে সাতটায় যখন ফিরছি তখনও পুরো অন্ধকার হয়নি।

সুশান্ত সোম তাঁদের হাউসবোটের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের দেখে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

‘আসুন, একটু আড্ডা মারা যাক।’

আমরা এঁদের বোটের সামনে শিকারা দাঁড় করিয়ে ওপরে উঠলাম। এঁদের বোটের নাম ‘রোজমেরি’। এঁদের পাশেই রয়েছে এঁদের অন্য বোট, সেটার নাম ‘মিরাণ্ডা’। ‘রোজমেরি’-তে থাকেন সুশান্ত সোম আর জজ সাহেবের ছেলে, নাম বিজয় মল্লিক। ‘মিরাণ্ডা’-তে আছেন মিঃ মল্লিক, তাঁর ডাক্তার হরিনাথ মজুমদার আর বেয়ারা প্রয়াগ।

চায়ের অর্ডার দিয়ে উপরের ডেকে উঠে সুশান্তবাবু ফেলুদাকে বললেন, ‘আপনার তাস চলে? তিন-তাস?’

‘অভ্যেস নেই’, বলল ফেলুদা, ‘তবে তাসের প্রায় সব খেলাই মোটামুটি জানা আছে। কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’

‘নিচের বৈঠকখানায় তাসের আড্ডা জমেছে।’

‘এত লোক পেলেন কোথায়?’

‘প্লেনে দুই ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বিজয়ের। একজন বাঙালী, নাম সরকার: আরেকজন পাঞ্জাবী। তিনজনেই জুয়াড়ি।’

আমরা চারজনে বসলাম। সত্যি, কলকাতা যে কোন সুদূরে চলে গেছে তার কোনো হিসাবই নেই! হাউসবোটের টপ ডেকে বসে চা খাওয়ার আয়োজন—এ এক অভাবনীয় ব্যাপার। আমাদের ডানদিকের হাউসবোটে সাহেবরা এসে উঠেছে—সেখান থেকে বিলিতি বাজনার শব্দ আসছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সাহেব মেম সেই বাজনার সঙ্গে নাচছে সামনের বৈঠকখানায়।

ফেলুদা সুশান্তবাবুকে উদ্দেশ করে প্রশ্ন করল, ‘সিদ্ধেশ্বরবাবু কদিন হল রিটায়ার করেছেন?’

‘পাঁচ বছর’, বললেন সুশান্তবাবু। ‘ওঁর তখন ষাট বছর বয়স।’

‘কিন্তু জজের ত রিটায়ার করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’

‘ওঁর শরীরটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অ্যানজাইনা। ভদ্রলোকের রিটায়ার করার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু ডাক্তারের কথায় বাধ্য হয়ে করতে হয়। উনি বহু অপরাধীর প্রাণদণ্ড দিয়েছেন। একেক সময় বলেন, ‘আমার শেষ জীবনে দুঃখ আছে। এত লোককে ফাঁসিতে পাঠালে তার একটা প্রতিক্রিয়া হবেই। উনি ডায়েরি লিখতেন; সে ডায়েরি সব এখন আমার হাতে কারণ আমি ওঁর একটা জীবনী লিখছি—যদিও সেটা আত্মজীবনী হিসেবেই বেরোবে। সেই ডায়েরিতে উনি যেদিনই কারুর প্রাণদণ্ড দিয়েছেন সেদিনই লাল কালিতে একটা ক্রস দিয়ে রেখেছেন। মাঝে মাঝে ক্রসের সঙ্গে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। সেটাতে বুঝতে হবে প্রাণদণ্ড দিয়ে নিজেরই মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে এটা ঠিক হল কি না। এখন কী করছেন জানেন? ওঁর যে ডাক্তার—মজুমদার—তিনি ভালো মিডিয়ম—তাঁর সাহায্যে প্ল্যানচেট করছেন, আর ফাঁসির আসামীর আত্মাদের ডেকে এনে তাদের জিজ্ঞেস করছেন তারা সত্যি খুন করেছিল কিনা। আত্মা যদি বলে যে হ্যাঁ, সে সত্যিই খুন করেছিল, তাহলে উনি খানিকটা নিশ্চিন্তবোধ করেন। এখন পর্যন্ত ওর জাজমেন্টে কোনো ভুল বেরোয়নি।’

‘আপনারা কি এখানে এসেও প্ল্যানচেট করবেন নাকি?’

‘সেই জন্যেই ত ডাক্তারকে একই হাউসবোটে রেখেছেন। ওর অ্যানজাইনাটা এখন অনেকটা কন্ট্রোলে এসেছে। আসলে ডাক্তার সঙ্গে এসেছেন প্ল্যানচেটের জন্য।’

‘আজ রাত্রেও কি আপনাদের প্ল্যানচেট হবে?’

‘আজ হয়ত হবে না, কিন্তু দু একদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।…কেন বলুন ত?’

‘আমি ইণ্টারেস্টেড’, বলল ফেলুদা। ‘অবশ্যি উনি আমার উপস্থিতি বরদাস্ত করবেন কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।’

‘সেটা আমি বলে দেখতে পারি। উনি আপনার প্রতি বেশ প্রসন্ন সেটা আমি এর মধ্যেই বুঝেছি। আর এমনিতে প্ল্যানচেটের ব্যাপারে উনি কোনো গোপনতা অবলম্বন করেন না। যা ফলাফল হয়, সবই ত ওঁর আত্মজীবনীতে যাবে। আমি ত সম্পূর্ণ রেকর্ড রাখছি।’

‘তাহলে আপনি একটু জিজ্ঞেস করে জানাবেন।’

‘নিশ্চয়ই।’

আমরা চা খাওয়া শেষ করে আরো কিছুক্ষণ গল্প করে নিজেদের বোটে চলে এলাম। বৈঠকখানায় ঢুকে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে লালমোহনবাবু বললেন, ‘হাইলি ইণ্টারেস্টিং ম্যান—দিস্‌ জজ সাহেব।’

‘ইণ্টারেস্টিং ত বটেই’, বলল ফেলুদা, ‘তবে উনিই একমাত্র জজ নন যাঁর এইরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এরকম ঘটনা দেশেবিদেশে আগেও শোনা গেছে।’

‘ভালো কথা—আপনার সঙ্গে আমার পারমিশনটাও চেয়ে রাখবেন। প্ল্যানচেট দেখার সুযোগ ছাড়া যায় না।’