দুর্য্যোধন-মৃত্যুকথা, সঞ্জয় কহিল তথা,
ধৃতরাষ্ট্র শুনিল প্রভাতে।
যেন হৈল বজ্রাঘাত, আকাশের চন্দ্রপাত,
কর্ণ যেন রুদ্ধ হৈল বাতে।।
সকল পৃথিবীপতি, দুর্য্যোধন মহামতি,
বলে ইন্দ্র না হয় সোসর।
হেন পুত্র যার মরে, সে কেমনে প্রাণ ধরে,
শোকেতে হইল জর জর।।
পুত্রশোকে নরপতি, বিহবল পড়িল ক্ষিতি,
নয়নে ঝরয়ে জলধার।
বায়ুভগ্ন যেন তরু, শোক হৈল অতি গুরু,
পড়িয়া করয়ে হাহাকার।।
একশত পুত্র আর, মরিলেক পরিবার,
সঞ্জয় কহিল নৃপবরে।
হা পুত্র হা পুত্র করি, পড়ে কুরু অধিকারী,
বজ্রাপাত পড়ে যেন শিরে।।
বিধি কৈল হেন দশা, মনে ছিল যত আশা,
দূর হৈল দৈবের ঘটন।
শতপুত্র বিনাশিল, একজন না রহিল,
শ্রাদ্ধ শান্তি করিতে তপূণ।।
হাহা পুত্র দুর্য্যোধন, কোথা গেল দুঃশাসন,
শোকে মম না রহে শরীর।
আমারে সঞ্জয় কহ, কোথা তার পিতামহ,
কোথা গেল দ্রোণ মহাবীর।।
কোথা কর্ণ মহীশুর, রিপু দপূ করি দূর,
কোথা গেল শকুনি দুম্মতি।
কুমন্ত্রণা দিল মোরে, সে কারণে পুত্র মরে,
না শুনিল সুহৃদ ভারতী।।
আর্ত্তনাদ করি বীর, ভুমেতে লোটায় শির,
হাহা পুত্র দুর্য্যোধন করি।
পড়ি আছে রাজ্যপাট, মানিক মন্দির খাট,
কি হইল কুরু অধিকারী।।
বৃদ্ধকালে পুত্রশোক, পড়িল অমাত্যলোক,
মরিল সুহৃদ বন্ধুজন।
করপুটে ভিক্ষা করি, হইল যে দেশান্তরী,
পৃথিবী করিব পর্য্যটন।।
আগার ললাট তটে, এ লিখন ছিল বটে,
কুরুকুল হইবে আঁধার।
সকল পৃথিবী শাসি, ভুঞ্জিয়া বিভবরাশি,
পরিচর্য্যা করিব কাহার।।
হইলাম অতি দীন, যেন পক্ষী পক্ষহীন,
জরাতে হারাই রাজ্যসুখ।
নয়নবিহীন তনু, যেন তেজোহীন ভানু,
কেমনে সহিব এত দুঃখ।।
আমারে সে হিত কাম, প্রবোধ দিলেন রাম,
তাহা আমি না ধরিনু মনে।
ভূপতি সভাতে আসি, কহিল নারদ ঋষি,
তাঁর বাক্য না শুনিনু কাণে।।
ভীষ্মদেব কুরুগুরু, মহামন্ত্রী কল্পতরু,
হিতকথা কহিল বিস্তর।
না শুনি তাহার বোল, বিপদেদিলাম কোল,
হাতে হাতে ফল পাই তার ।।
দুর্য্যোধন বধ ধ্বনি, দুঃশাসন মৃত্যুবাণী,
কর্ণ বধ কর্ণে নাহি সয়।
হৈল দ্রোণ বিনাশন, দগ্ধ হয় মম মন,
মোর বাক্য গুনহ সঞ্জয়।।
পূর্ব্বে করিয়াছি পাপ, সে কারণে পাইতাপ,
বিচারিয়া বল তুমি মোরে।
আপনার কর্ম্মভোগ, সুত বন্ধু এ বিয়োগ,
কর্ম্মবন্ধে ভোগ সবে করে।।
শুনহ সঞ্জয় তুমি, ইহা নাহি জানি আমি,
কখন ভীষ্মের পরাজয়।
সেজনে অর্জ্জুন মারে, একথা কহিব কারে,
মনে বড় জন্মিল বিস্ময়।।
যাঁর সঙ্গে ভৃগুরাম. করি রণ অবিশ্রাম,
প্রশংসা করিয়া গেল ঘরে।
তাঁহার হইল নাশ, শুনি মনে পাই ত্রাস,
সঞ্জয় কহিল আসি মোরে।।
দ্রোণ মহাবলবান, পৃথিবী না ধরে টান,
তাঁহারে মারিল ধনঞ্জয়।
এ বড় আশ্চর্য্য কথা, কাটিল কর্ণের মাথা,
অর্জ্জুন করিল কুরুক্ষয়।।
আমা হেন দুঃখী জন, নাহি দেখি ত্রিভুবন,
আমার মরণ সমুচিত।
শীঘ্র মোরে লহ রণে, দেখাও পান্ডবগণে,
আমি সবে মারিব নিশ্চিত।।
যুড়িয়া ধনুকে বাণ, ভীমের বধিব প্রাণ,
পুত্রশোক সহিতে না পারি।
অর্জ্জুনের কাটি মাথা, ঘুচাইব মনোব্যথা,
ধর্ম্মে দিব হস্তিনানগরী।।
রাজার বচন শুনি, সঞ্জয় মনেতে গণি,
যোড়হাতে করে নিবেদন।
শুন শুন মহারাজ, সকলি বিধির কাজ,
বুঝিয়া না বুঝ কি কারণ।।
তোমার সমান গুনী, পৃথিবীতে নাহি শুনি,
সংসারেতে তোমার আখ্যান।
বৃদ্ধ হৈতে বৃদ্ধোত্তম, নাহি কেহ তোমা সম,
শোকে কেন হও হতজ্ঞান।।
নরপতি পুন্যবান, সঞ্জয় তাহার নাম,
পুত্রশোকে ছিল সে পীড়িত।
নারদের উপদেশ, পাইলেন সবিশেষ,
তাহে তাঁর হৈল সুস্থ চিত।।
আপনি সে সব কথা, অবশ্য আছেন জ্ঞাতা,
তবে কেন শোকে দেহ মতি।
জীবন মরণ যোগ, সুখ দুঃখে ভোগাভোগ,
কর্ম্মফলে হয় সে সঙ্গতি।।
সহজে দুর্ম্মতি জন, রাজা হয়ে দুর্য্যোধন,
সাধুজন বচন না শুনে।
দুঃশাসন মহাবীর, শকুনি পাপেতে ধীর,
বুদ্ধি দিল কৌরব নন্দনে।।
কর্ণ বলিলেন যত, তাহে মাত্র অভিরত,
কার বোল না শুনিল কাণে।
ভীষ্মদেব বুঝাইল, কর্ণে তাহা না শুনিল,
গান্ধাবীর বাক্য নাহি শুনে।।
গুরুজন বলে যত. উপহাস করে তত,
এ জনের কেমনে কল্যাণ।
দ্রোণ কৃপ বিধিমতে, বুঝাইল বিদ্যুরেতে,
প্রবোধ দিলেন ভৃগুরাম।।
পান্ডবে মাগিল গ্রাম, আসিলেন ঘনশ্রাম,
নীতি বুঝাইল নারায়ণ।
অসম্মত দুর্য্যেধন, কেবল মাগেন রণ,
কেন নাহি ত্যজিবে জীবন।।
না শুনে ব্যাসের বাণী, অহঙ্কার মনে গণি,
ধর্ম্মপত্র পরিহরি দূরে।
আপনি মধ্যস্থ হৈলা, কত তারে বুঝাইলা,
দৈবে যাবে শমনের পুরে।।
পাশা খেলাইল যবে, শকুনি কহিল তবে,
সর্ব্ব ধন হারিল পান্ডব।
কিংজিতং কিজিতং বলি, হইলা যে কুতুহলী,
কেন তাহা না ভাব কৌরব।।
ক্ষিতির করিয়া ক্ষয়, শত্রুর বাড়ালে জয়,
পুত্রগণ মরিল অকালে।
তুমি কেন শোক কর, আমার বচন ধর,
কি কারণ লোটাও ভূতলে।
জানিয়া করিলা পাপ, শেষে পাও মনস্তাপ,
অনুশোচ না কর তাহাতে।
আপনার কর্ম্ম যত, ফল হয় অনুগত,
বিজ্ঞজন মুগ্ধ হন তাতে।।
জ্বলন্ত অনশ কেন, বসনে বাঁধিয়া আন,
সে অগ্নিতে দহিবে শরীর।
এ সব আপন দোষে, কহি রাজা তব পাশে,
তাহে দোষ নাহিক বিধির।।
পুত্র তব মহাবলী, সুহৃদ বচন ঠেলি,
রাজ্যলোভ করিল দুর্জ্জয়।।
পূর্ব্বাপর না ভাবিল, অগ্নিতে পতঙ্গ হৈল,
তাহাতে হইল বংশক্ষয়।।
সঞ্জয়ের বাক্য শুনি, স্তব্ধ হৈয়া নৃপমনি,
অতি দীর্ঘ ছাড়িল নিশ্বাস।
বিদুর পন্ডিত গুরু, উপদেশে কল্পতরু,
নৃপতিরে করিল আশ্বাস।।
উঠ উঠ মহারাজ, সকলি বিধির কাজ,
সবার মরণ মাত্র গতি।
যত দিন নিয়ত যার, সেই দিন মৃত্যু তার,
তাহা নাহি ঘুচে মহামতি।।
মহা মহা বীর মরে, নিত্য যায় যমঘরে,
মৃত্যু বশ সব চরাচর।
সকল সংহারে কাল, নাহি তার কালাকাল,
অনুশোচ করহ অন্তর।।
পূর্ব্ব কথা মনে কর, শুন ওহে নৃপবর,
শকুনি খেলিল যবে পাশা।
সেই অনর্থের মূল, বিনাশিল কুরুকুল,
হাসি তুমি করিলা জিজ্ঞাসা।।
পাসরিলা সেই বানী, শুন অন্ধ নৃপমনি,
সে কথা নাহিক তব মনে।
এখনি ভাবহ শোক, নিন্দিবেক সর্ব্বলোক,
এই দশা হইল এক্ষণে।।
ক্ষত্রিয় নিধর করি, সম্মূখ সমরে মরি,
সবে গেল বৈকুন্ঠ ভবনে।
এখন ত্যজহ শোক, আমার বচন রাখ,
দুঃখ ভাব কিসের কারণে।।
জীর্ণ বস্ত্র পরিহরি, যেন নব বস্ত্র পরি,
তেমতি শরীর পরিবর্ত্ত।
কেহ মরে গর্ভবাসে, কেহ মরে দশমাসে,
ক্ষিতিস্পর্শে হইয়া নিবর্ত্ত ।।
কেহ মরে বাল্যকালে, সকলি কর্ম্মের ফলে,
কেহ কারে মারিতে না পারে।
আমার বচন শুনি, শান্ত হও নৃপমণি,
শোক আর না কর অন্তরে।।
বিদুরের বাক্য শুনি, স্তব্ধ হইল নৃপমনি,
কিন্তু শোকে দহয়ে শরীর।
না শুনে বচন হিত, ধরিতে না পারে চিত,
ধৈর্য্যাকে ধরিতে নারে বীর।।
তবে আসি ব্যাস মুনি, বিদুর সঞ্জয় গুনী,
আর যত সুহৃদ সকলে।
শীতল সলিল সেচি, তালের বিউনী বিচি,
চেতন করান মহীপালে।।
সন্বিত পাইয়া পুনঃ শোক করি চতুগুণ,
কহে ধিক্ মনুষ্য জনমে।
পাই এত দুঃখ সব, পুত্রশোকে পরাভব,
ছার তনু নাহি যার কেনে।।
শত পুত্র বিনাশিল, একজন না রহিল,
শ্রাদ্ধ শান্তি করিতে তপূণ।
অনিত্য এ সব দেহ, চিরজীবী নহে কেহ,
প্রাণ রাখি কিসের কারণ।।
ধৃতরাষ্ট্র নরপতি, বিলাপ করয়ে অতি,
পুত্রশোক সহিতে না পারে।
ভাবয়ে বান্ধব শোক, ক্ষণে ভাবে পরলোক,
নির্ণয় করিতে কিছু নারে।।
হাহাপুত্র দুর্য্যোধন, কোথা গেল দুঃশাসন,
দুর্ম্মূখ প্রভৃতি শত পুত্র।
ধরিতে না পারি হিয়া, লহ মোরে উদ্ধারিয়া,
শোকেতে দহিছে মোর গাত্র।।
ভারতের পুন্যকথা, শুনিলে ঘুচয়ে ব্যথা,
কলির কলুষ হয় নাশ।
গোবিন্দ চরণে মন, সমর্পিয়া অনুক্ষণ,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।