লম্বা হলঘরটাতে আমরা সারি বেঁধে বসে আছি। আজকে এই শহরের কমিউনের সভা, তাই শহরের মানুষেরা এসেছে। শহরের সব মানুষকে নিয়ে একসাথে সভা করা যায় না। তাই একেক দিন একেক ধরনের মানুষকে নিয়ে সভা করা হয়। আজকের সভাটা আমাদের মতো কমবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সবাই এসেছে কিনা বুঝতে পারছি না–আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে পরিচিত সবাইকে পেয়ে গেছি। শুধু টিশাকে এখনো দেখছি না। আমি পাশের জায়গাটা খালি রেখেছি টিশার জন্যে–টিশা এতই খেয়ালি মেয়ে সে হয়তো আমার পাশে বসতেই চাইবে না।
একটু অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম সবাই এক ধরনের আনন্দের শব্দ করে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমিও তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। হলঘরের সামনে উঁচু স্টেজে আমাদের শহরের কমান্ড্যান্ট এসে হাজির হয়েছে, তার সাথে কুশ, মিকি আর ক্রিটন। আমরা আনন্দে হাততালি দিতে থাকি। কুশ, মিকি আর ক্রিটনের বয়স ষোলো হয়ে গেছে, তাই তাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন তাদের দেখিনি। আজকে কমান্ড্যান্ট তাদেরকে নিয়ে এসেছে। তাদের সাথে লুক আর হুনাও ছিল, এই দুজনকে দেখতে পাচ্ছি না, আমি তাদের দেখার জন্য মাথা উঁচু করে আশেপাশে তাকাতে লাগলাম কিন্তু খুঁজে পেলাম না।
“নেই। আর কেউ নেই।” কানের কাছে কেউ একজন ফিসফিস করে কথা বলছে, আমি মাথা ঘুরে তাকালাম, কখন টিশা এসে দাঁড়িয়েছে আমি লক্ষ করিনি।
আমি টিশার দিকে তাকালাম, টিশা নিচু গলায় বলল, “লুক আর হুনা নেই।”
“কোথায়? ওরা কোথায়?”
টিশা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “শ-স-স-স, প্রশ্ন করা নিষেধ।”
আমরা কমান্ড্যান্টের গমগমে গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, “আমার প্রিয় সন্তানেরা। কমিউনের সভায় তোমাদের আমন্ত্রণ!”
কমান্ড্যান্ট একটু থামল, আমরা জোরে জোরে হাততালি দিলাম। কমান্ড্যান্ট যখন কথা বলে তখন মাঝে মাঝে হাততালি দিতে হয়।
কমান্ড্যান্ট বলল, “আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন! আজ কুশ, মিকি আর ক্রিটন তোমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। অল্প কিছুদিন আগেও এই তিনজন ছিল অন্য দশজনের মতো কমবয়সী সাধারণ ছেলে আর মেয়ে। এখন তারা এই শহরের মূল্যবান নাগরিক। দায়িত্বশীল নাগরিক। তাদের মাথায় এখন ক্রেনিয়াল লাগানো হয়েছে, মানুষের সঞ্চিত জ্ঞান ভান্ডারের সাথে যোগাযোগ করে যখন খুশি তারা যে কোনো জ্ঞান জেনে নিতে পারবে।”
কমান্ড্যান্ট আবার থামল, যার অর্থ আবার আমাদের চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করতে হবে, হাততালি দিতে হবে। আমরা চিৎকার করলাম, হাততালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলাম। আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম টিশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গলা নামিয়ে তাকে বললাম, “টিশা! হাততালি না দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
টিশা কিছু না বলে একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে রইল। কমান্ড্যান্ট আবার কথা বলতে শুরু করল, “তোমরা সবাই জান আজ থেকে একশ বছর আগে পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এটি মনে হয়, সভ্যতার নিয়ম, একেবারে উঁচুতে উঠে সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাচীনকালে সভ্যতা ছিল বিচ্ছিন্ন, তাই তারা বিচ্ছিন্নভাবে ধ্বংস হতো। এক প্রান্তে সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার পর অন্য প্রান্তে সভ্যতা গড়ে উঠত। কিন্তু একশ বছর আগে যখন পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল সেটি ছিল একটি পরিপূর্ণ ধ্বংসলীলা। তোমরা কি কেউ বলতে পারবে, কেন এটি ছিল একটি পরিপূর্ণ ধ্বংস প্রক্রিয়া?”
আমরা কেউ কিছু জানি না, আমাদের জানার কোনো উপায় নেই। নিজেরা নিজেরা মাঝে মাঝে কথা বলি, তার মাঝে কোনো তথ্য থাকে না, নানারকম গুজব থাকে। তাই আমরা কমান্ড্যান্টের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। তারপরও দেখলাম সামনের দিকে বসে থাকা লাল চুলের একজন কমবয়সী মেয়ে উত্তর দেবার চেষ্টা করল, বলল, “কারণ শেষ যুদ্ধে এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করেছিল।”
কমান্ড্যান্টের মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে হাততালি দিয়ে বলল, “চমৎকার! তোমার উত্তরটি পুরোপুরি ঠিক নয়, কিন্তু তারপরও তোমাকে অভিনন্দন। তোমার মাথায় কোনো ক্রেনিয়াল নেই, তারপরও তুমি নিউক্লিয়ার বোমার কথা জান! তোমাকে অভিনন্দন।”
লাল চুলের মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কেন সারা পৃথিবীর সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল?”
কমান্ড্যান্ট গম্ভীর মুখে বলল, “কারণটি মানুষের নির্বুদ্ধিতা।” কথাটি শেষ করে কমান্ড্যান্ট থেমে গেল, কাজেই আমরা সবাই বিস্ময়ের মতো শব্দ করলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “নির্বুদ্ধিতা?”
কমান্ড্যান্ট মুখটি আরো গম্ভীর করে বলল, ”হ্যাঁ নির্বুদ্ধিতা। তোমরা কি সেই নির্বুদ্ধিতার ইতিহাস শুনতে চাও?”
আমরা চিৎকার করে বললাম, “শুনতে চাই, শুনতে চাই।” শুধু টিশা কোনো কথা না বলে সামনে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলল, “কিন্তু লুক আর হুনা কোথায় গেল?” তার কথাটা আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পেল না।
কমান্ড্যান্ট তখন এই পৃথিবীতে মানবসভ্যতা ধ্বংসের ইতিহাস বলতে শুরু করল। কমান্ড্যান্টের গলার স্বর গমগমে, কথা বলার ধরনটিও ভালো, আমরা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকি। তার কথার সারমর্মটি এরকম:
পৃথিবীতে সভ্যতার একটা বিস্ফোরণ শুরু হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে। মোটামুটিভাবে বলা যায় এই নতুন সভ্যতার পেছনে ছিল একটা যন্ত্র, ভুল করে তার নাম দেওয়া হয়েছিল কম্পিউটার–অর্থাৎ যেটা দিয়ে হিসাব করা হয়। দেখা গেল এই যন্ত্রটি আসলে অন্যরকম। এর আগে যতবার কোনো যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেটি সব সময়ে একটা নির্দিষ্ট কাজ করেছে-কিন্তু কম্পিউটার নামক যন্ত্রটা কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি হয়নি, এটা যে কোনো কাজে ব্যবহার করা যেত। যন্ত্রটার আকার ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করল এবং এক সময় সেটা সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব জায়গায় ব্যবহার হতে শুরু করল।
এর আগে তথ্য জমা করে রাখা কিংবা তথ্য ব্যবহার করার ব্যাপারটা ছিল কঠিন, তাই তথ্যটুকু নির্দিষ্ট ছিল অল্প কিছু ক্ষমতাশালী মানুষের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে নেটওয়ার্কিং এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেল যে, যে কোনো মানুষই তথ্য পেতে শুরু করল। তখন মানুষের মাঝে ধীরে ধীরে একটা খুব বড় পরিবর্তন ঘটে গেল। এর আগে মানুষ তথ্য জমা রাখত তার মস্তিষ্কে, সেটা প্রক্রিয়া করত তার মস্তিষ্কে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দেখা গেল মানুষ তথ্য রাখা কিংবা প্রক্রিয়া করার জন্য মস্তিষ্ক ব্যবহার করে না। সবকিছুই মানুষ করে যন্ত্র দিয়ে, কম্পিউটার নামের সেই যন্ত্রটি তখন আর যন্ত্র নেই, তার বুদ্ধিমত্তা আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা তখন মানুষ নিজেরা করে না, বুদ্ধিমান কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে করে। একজন মানুষ কতটুকু ক্ষমতাশালী সেটা নির্ভর করে তার কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কতটুকু অধিকার তার উপর। আগে সোনা রুপা হীরা ছিল মূল্যবান সম্পদ, তখন সম্পদ হয়ে গেল কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষমতা।
মানুষে মানুষে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। ইতিহাসে সব সময়েই দেখা গেছে একদল মানুষ চেষ্টা করেছে অন্য দলের মানুষকে দমন করে রাখতে–এখানেও সেটা শুরু হয়ে গেল। প্রথমে যুদ্ধ শুরু হলো এক দেশের কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে অন্য দেশের কোয়ান্টাম কম্পিউটার দখল করে নেওয়ার জন্য। সেটা করার জন্য কাউকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আক্রমণ করতে হয় না–নেটওয়ার্কের ভেতর দিয়ে এক দেশের কোয়ান্টাম কম্পিউটার অন্য দেশে আক্রমণ করতে শুরু করে।
তথ্যের জন্য মানুষ নিজের মস্তিষ্কের উপর নির্ভর না করে তখন নেটওয়ার্ক আর কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপর নির্ভর করতে শুরু করে। সেটি ছিল মানুষের প্রথম নির্বুদ্ধিতা। এক দেশের পক্ষ থেকে
অন্য দেশের উপর আক্রমণ করার জন্য মানুষ যখন নিজেদের পরিকল্পনার উপর নির্ভর না করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপর নির্ভর করতে শুরু করে সেটি ছিল দ্বিতীয় নির্বুদ্ধিতা।
মানুষকে এই নির্বুদ্ধিতার জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রথমে একে অন্যকে ধ্বংস করেছে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজ, শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, খাবার, আশ্রয় সবকিছুর জন্য এই কম্পিউটার আর নেটওয়ার্কের উপর নির্ভর করত। হঠাৎ করে তাদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষ রোগে শোকে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে লাগল। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কমতে কমতে অর্ধেক থেকেও নিচে নেমে এল, তখন সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটি ঘটতে শুরু করে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিজে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একে অন্যের উপর নিউক্লিয়ার বোমা ছুঁড়তে শুরু করে। দেখতে দেখতে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে সেখানে কিছু মানুষ বেঁচে থাকে–সারা পৃথিবীতে এখন কতজন মানুষ আছে সেটিও কেউ জানে না। কয়েক হাজার নাকি কয়েক লক্ষ, নাকি কয়েক কোটি সে কথা কেউ বলতে পারে না।
কমান্ড্যান্ট যখন তার কথা শেষ করল তখন আমরা সবাই নিঃশব্দে বসে রইলাম। ঠিক কী কারণ জানা নেই আমাদের কেমন যেন এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। সামনের দিকে বসে থাকা কমবয়সী একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী হবে?”
।কমান্ড্যান্টের মুখটা এতক্ষণ কেমন জানি থমথমে হয়ে ছিল। এই প্রথমবার সেখানে আমরা একটু হাসির চিহ্ন দেখতে পেলাম। কমান্ড্যান্ট হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি খুব আনন্দের সাথে তোমাদেরকে বলতে চাই, প্রায় কয়েক বৎসরের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পর আমরা প্রথমবার আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছি।”
কমবয়সী ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”
কমান্ড্যান্ট বলল, “মানুষ যে নির্বুদ্ধিতা করেছিল আমরা সেই নির্বুদ্ধিতা থেকে সরে এসেছি। মানুষ তার মস্তিষ্ক ব্যবহার না করে সকল সিদ্ধান্ত নিত কম্পিউটার নামক যন্ত্র দিয়ে, নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। আমরা মানুষের মস্তিষ্ক আবার ব্যবহার করতে শুরু করেছি, তোমরা নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছ তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে
তুলে ভাবে ছিল আমরা করে কুশ, মিকি আর ক্রিটন। তাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানো হয়েছে, সেই ক্রেনিয়াল ব্যবহার করে আমরা সেখানে বিশাল তথ্যের সম্ভার ঢুকিয়ে দিয়েছি। তারা ইচ্ছে করলে সেই তথ্য ব্যবহার করে যে কোনো কাজ করতে পারবে।”
কমান্ড্যান্ট চোখ নাচিয়ে বলল, “আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা নিজেরা প্রশ্ন করে যাচাই করে নিতে পার।”
কেউ প্রশ্ন করল না। কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে হলে সেটা সম্পর্কে কিছু জানতে হয়। আমরা কিছুই জানি না, কী নিয়ে প্রশ্ন করব?
কমান্ড্যান্ট আবার বলল, “করো। প্রশ্ন করো।”
খুব ইতস্তত করে মাঝামাঝি জায়গা থেকে একজন প্রশ্ন করল, “চিমটি দিলে ব্যথা লাগে কেন?”
প্রশ্নটি শুনে অনেকেই হেসে উঠল, কুশ, মিকি আর ক্রিটন হাসল। মিকি গম্ভীর হয়ে বলল, “আমাদের সারা শরীরে স্নায়ুর একটা বিশাল নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে। এই পুরো নেটওয়ার্ক কেন্দ্রীভূত হয়েছে আমাদের মস্তিষ্কে। আমাদের মস্তিষ্কে দশ হাজার কোটি নিউরন। এক নিউরন অন্য নিউরনের সাথে…”
মিকি যন্ত্রের মতো কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক কথা বলতে থাকল। নানারকম সংখ্যা, নানারকম জটিল জটিল নাম, নানারকম সূত্র, নানারকম গবেষণার ইতিহাস–যার বেশির ভাগ আমরা বুঝতেই পারলাম না। অল্প কিছুদিন আগেই মিকি ছিল আমাদের মতো খুবই সাধারণ একটা ছেলে, এখন সে রীতিমতো একজন জ্ঞানী মানুষ। কী আশ্চর্য!
মিকি শেষ পর্যন্ত যখন কথা শেষ করল তখন আমরা সবাই প্রথমে চুপচাপ বসে রইলাম। আমাদের বেশির ভাগ মানুষ ততক্ষণে ঠিক কোন প্রশ্নের উত্তরে মিকি এত বড় একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটাই ভুলে গেছি। কমান্ড্যান্ট তখন হাসি হাসি মুখে সবার দিকে তাকাল এবং তখন আমরা বুঝতে পারলাম আবার আমাদের হাততালি দিতে হবে। আমরা তখন আবার জোরে জোরে হাততালি দিলাম।
হাততালি শেষ হবার পর কমান্ড্যান্ট আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর কোনো প্রশ্ন?” তার কথার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারলাম কমান্ড্যান্ট চাইছে আরো কেউ একটা প্রশ্ন করুক। কিন্তু প্রশ্ন করার কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত পেছন থেকে একজন ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “একটা ঘরে গেলে ঘরের আলো কেমন করে জ্বলে ওঠে?”
মিকি বলল, “আমার মস্তিষ্কের তথ্য শুধু জীববিজ্ঞানের তথ্য। অন্য কাউকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।” উত্তরের জন্যে মিকি কুশ আর ক্রিটনের দিকে তাকাল।
ক্রিটন মাথা নেড়ে বলল, “আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু তৈরি হয়েছে কিছু মৌলিক কণা দিয়ে। এই মৌলিক কণাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগের নাম লেপটন, আমাদের সবচেয়ে পরিচিত লেপটন হচ্ছে ইলেকট্রন…”
ক্রিটন ঠিক মিকির কথামতোই কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক শব্দ ব্যবহার করে খুব জটিল কথা বলতে শুরু করল। মিকির কথা তবু আমরা একটু বুঝেছিলাম, ক্রিটনের কথা আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমরা সবাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকলাম, যখন ক্রিটন শেষ পর্যন্ত থামল আমরা নিজেরাই জোরে জোরে হাততালি দিতে শুরু করলাম।
আমরা ভেবেছিলাম কমান্ড্যান্ট আবার আমাদেরকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে বলবে কিন্তু মনে হয় সে টের পেয়েছে আমরা মিকি আর ক্রিটনের কোনো কথাই বুঝতে পারিনি, তাই সে আর চেষ্টা করল না। খানিকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “এখন তোমরা বুঝতে পেরেছ কীভাবে আমরা আবার একেবারে শূন্য থেকে একটা সভ্যতা তৈরি করতে শুরু করেছি?”
সত্যি কথা বলতে কি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কীভাবে কয়েকজন ছেলেমেয়ের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে তাদেরকে কঠিন কঠিন জ্ঞানের বিষয় শিখিয়ে দিলেই একটা সভ্যতা তৈরি হয়ে যায়। সভ্যতা জিনিসটা কী আমি সেটাও জানি না!
আমার মতো আরো অনেকেরই মনে হয় এরকম প্রশ্ন ছিল, একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেলল, “সভ্যতা তৈরি করতে কী কী লাগে?”
কমান্ড্যান্ট হাল ছেড়ে দেবার মতো করে মাথা নাড়ল, বলল, “তোমাকে এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আগের সভ্যতার মূল উপাদানটি ছিল কম্পিউটার নামের একটি যন্ত্র –”
“আমাদের কি কম্পিউটার আছে?”
কমান্ড্যান্ট কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা শুনে খুব খুশি হবে পৃথিবীর মানুষ আবার নতুন করে কম্পিউটার তৈরি করতে শুরু করেছে। তবে এখন এটাকে কম্পিউটার বলে না। এখন এটার নাম ক্রেনিপিউটার।”
এই প্রথমবার আমরা সবাই সত্যিকারভাবে চমকে উঠে কমান্ড্যান্টের কথা শুনতে আগ্রহী হলাম। প্রায় সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, “কোথায়? দেখতে কেমন? কত বড়? কী করতে পারে?”
কমান্ড্যান্ট হাত নেড়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অনেকদিন থেকে ক্রেনিপিউটার তৈরি করার জন্য কাজ চলছিল। পৃথিবীর সব ফ্যাক্টরি ধ্বংস হয়ে গেছে বলে কাজটি খুব কঠিন। নানা জায়গা থেকে টুকরো টুকরো যন্ত্রপাতি জোগাড় করে তৈরি করতে হচ্ছে। এখান থেকে প্রায় দুশ কিলোমিটার দূরে মানুষের আরেকটা আস্তানা আছে–জ্ঞানবিজ্ঞানে তারা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। সেখানে একজন বিজ্ঞানী আছে তার নাম হচ্ছে লিংলি। বিজ্ঞানী লিংলি। আসলে বলা উচিত মহাবিজ্ঞানী লিংলি। সেই মহাবিজ্ঞানী লিংলি ক্রেনিপিউটার তৈরি করছে।”
কমান্ড্যান্ট একটু থামল, আমরা ঠিক বুঝতে পারলাম না, এখন মহাবিজ্ঞানী লিংলির জন্য আমাদের চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করার দরকার আছে কি না। কয়েকজন অবশ্যি আনন্দধ্বনি করেও ফেলল।
কমান্ড্যান্ট মনে হলো এবারে আনন্দধ্বনির জন্য অপেক্ষা করছে না, সে আবার কথা বলতে শুরু করল, বলল, “তোমরা শুনে খুব খুশি হবে। আমাদের এই শহর থেকে আমরা বিজ্ঞানী লিংলির সাথে যোগাযোগ করেছি এবং বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
এবারে আমরা হাততালি দিয়ে আনন্দের শব্দ করলাম। কমান্ড্যান্ট বলতে থাকল, “বিজ্ঞানী লিংলি বলেছে এই দুই শহরের
মাঝে একশ বছর আগের যে নেটওয়ার্কের যোগাযোগ আছে সেটাকে আবার কার্যকর করে নতুন সভ্যতার নতুন ক্রেনিপিউটারের সাথে যোগাযযাগ করে দেবে।”
আমরা আবার আনন্দের শব্দ করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই হঠাৎ টিশা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “তার জন্য আমাদের বিজ্ঞানী লিংলিকে কী দিতে হবে?”
ঠিক কী কারণ জানা নেই হঠাৎ করে পুরো হলঘরটি একেবারে কবরের মতো নীরব হয়ে গেল, মুহূর্তে পুরো পরিবেশটাও কেমন জানি থমথমে হয়ে গেল। কমান্ড্যান্ট কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে থেকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে, মেয়ে?”
টিশা কাঁপা গলায় বলল, “আমার নাম টিশা। আমার আইডি সাত সাত দুই নয়…”
টিশাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কমান্ড্যান্ট জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এই প্রশ্নটি করেছ? তোমার উদ্দেশ্য কী?”
টিশা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “আমার কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম”
“তুমি কেন এমন একটা বিষয় জানতে চাইবে?”
টিশা তার গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু স্বাভাবিক রাখতে পারল না, প্রায় ভাঙা গলায় বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম যে আমাদের কিছু দিতে হবে কি না। সব সময় দেখে এসেছি কিছু একটা পেতে হলে কিছু একটা দিতে হয়।”
কমান্ড্যান্টের মুখটা দেখতে দেখতে হঠাৎ করে কেমন জানি কঠিন হয়ে ওঠে। তাকে দেখতে একটা নিষ্ঠুর মানুষের মতো মনে হতে থাকে। কমান্ড্যান্ট প্রায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “কিছু একটা পেতে হলে কিছু একটা দিতে হয়-কী আশ্চর্য!”
কমান্ড্যান্ট আরো কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ঠিক তখন দরজায় দাঁড়ানো গার্ডদের ধাক্কা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো দেখতে একজন মহিলা হলঘরে ঢুকে গেল, প্রায় ছুটে কমান্ড্যান্টের কাছে যেতে যেতে চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমার হুনা কই? হুনা! আমার হুনা।”
আমরা সবাই হুনার মাকে চিনতে পারলাম, খুব হাসিখুশি একজন মহিলা কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে দেখাচ্ছে প্রায় উন্মাদিনীর মতো। হুনার মা বেশি দূর যেতে পারল না তার আগেই পাহাড়ের মতো বড় দুজন গার্ড এসে দুই পাশ থেকে তাকে ধরে প্রায় টেনে হলঘরের বাইরে নিতে থাকে।
কমান্ড্যান্ট সেদিকে তাকাল না, তাকে দেখে মনে হলো সে পুরো ব্যাপারটি একটুও দেখেনি।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের সভা আজকের মতো এখানেই শেষ।”
টিশা ফিসফিস করে বলল, “বুঝেছ রিহি?”
আমি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝব?”
“হুনা আর লুক কোথায়?”
“কোথায়?”
“বিজ্ঞানী লিংলিকে দিয়েছে। আরো দেবে। তোমাকে আমাকেও দেবে। যারা একটু বেশি বোঝে সবাইকে দেবে।”
“কেন?”
“কিছু একটা পেতে হলে কিছু একটা দিতে হয়!” বলে টিশা আবার হাসির ভঙ্গি করল, আনন্দহীন এক ধরনের হাসি।