রিহার্সালের জন্য বড় বৈঠকখানা ঘরটিকে ঠিক করা হয়েছে। পুরনো আমলের ঢাউস ঢাউস সোফাগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দেওয়ালের পাশে। ওগুলো সবই এখন ছেঁড়াখোঁড়া। হাড়গোড় বার করা অবস্থা, ফেলে দিলেই ভাল হয়।
টাকিতে বেশ কয়েকটি দল যাত্রা করে, নাটক করে, তাদের ডাকা হয়নি। শুধু বেছে নেওয়া হয়েছে ইস্কুলের কিছু ছেলেকে।
কাকাবাবুর উৎসাহ দেখে সন্তুর খুব মজা লাগছে। আগে তিনি বলেছিলেন, সামনের মঙ্গল-বুধবার তাঁর জরুরি কাজ আছে কলকাতায়। এখন সেসব ভুলে গিয়ে মেতে উঠেছেন নাটক নিয়ে।
প্রথমে তিনি পুরো নাটকটি সবাইকে পড়ে শোনালেন। গানগুলোও গাইলেন একটু একটু। তারপর বললেন, এবারে ঠিক করতে হবে, কে কোন পার্ট করবে। শোনো, অভিনয়ের সময় নাটকের ছোট-বড় সব পার্টই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ একটা পার্টও খারাপ হলে নাটক ঝুলে যায়। আমি প্রত্যেককে দু-তিন লাইন করে বলতে বলে টেস্ট নেব। তারপর আমি যাকে যে পার্ট দেব, মেনে নিতে হবে। কোনও আপত্তি চলবে না।
তিনি ভূমিকা বাছাই শুরু করার আগেই ছোটমামা এসে বললেন, রাজাদা, এক মিনিট একটু বাইরে এসো, একটা কথা বলব।
কাকাবাবু উঠে গেলেন।
ছোটমামা বললেন, আমার একটা অনুরোধ আছে, এখানকার পুলিশসাহেবের ছেলে সুকোমলকে রামের পার্টটা দিতে হবে। ওর মায়ের খুব ইচ্ছে!
কাকাবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, এই রে, তুমি প্রথম থেকেই এসব শুরু করলে? আমার কাজে মাথা গলালে আমি এর মধ্যে থাকতে চাই না। এই করে নাটক নষ্ট হয়? সবাই যোগ্যতা অনুসারে পার্ট পাবে।
ছোটমামা মিনতি করে বললেন, আমি আর কিছুতে মাথা গলাব না। পুলিশসাহেব আমাদের অনেক উপকার করেন। উনি সাহায্য করলে আমাদের টিকিটও বেশি বিক্রি হবে।
কাকাবাবু বললেন, রামের পার্টে যাকে-তাকে মানায় নাকি? চেহারাটা সুন্দর হওয়া দরকার।
ছোটমামা বললেন, তুমি ছেলেটাকে আগে দেখো। আমার ধারণা, বেমানান হবে না। মফস্সলে এইসব অনুরোধ একটু রাখতেই হয়।
প্রথমেই ডাকা হল সেই ছেলেটিকে। তার চেহারা বেশ ভালই। বারো-তেরো বছর বয়েস, সেই তুলনায় বেশ লম্বা, ফরসা রং, টানা টানা চোখ। পুলিশসাহেবের ছেলে হলেও তার মুখে অন্ধকারের ভাব নেই। শান্ত, কোমল মুখোনি, তার নামের সঙ্গে মিল আছে।
কাকাবাবু তাকে কয়েকটা লাইন বলতে দিলেন :
পিঁপড়ের পাখা উঠে মরিবার তরে।
জোনাকি যেমতি হায়, অগ্নিপানে রুষি
সম্বরে খদ্যোত লীলা—
ছেলেটির গলার আওয়াজও ভাল। দোষের মধ্যে এই, সে একটু তোতলা।
কাকাবাবু মনে মনে একটু হাসলেন। সুকুমার রায়ের নাটকে সব কিছুই উলটোপালটা, তা হলে রাম একটু তোতলা হলেই বা ক্ষতি কী?
অন্য সবাই হেসে উঠেছে, কাকাবাবু তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন, চুপ! একেই রাম মানাবে।
তারপর একে একে অন্য পার্ট দেওয়া হতে লাগল। কাকাবাবু জোজোকে বললেন, তুমি হবে হনুমান!
জোজো দাঁড়িয়ে উঠে বলল, হনুমান? না, না, আমি এ পার্ট চাই না!
কাকাবাবু বললেন, আগেই বলেছি না, আমার কথায় আপত্তি করা চলবে না? নাটক সাকসেসফুল হয় কীসে জানো? যদি হাসির কথায় দর্শক হেসে ওঠে আর ভাল ভাল জায়গায় হাততালি দেয়। থিয়েটারের ভাষায় হাততালিকে বলে ক্ল্যাপ। এই নাটকে হনুমানের পার্টেই সবচেয়ে বেশি হাসির কথা আছে, আর সবচেয়ে বেশিবার ক্ল্যাপ পেতে পার! রাম-লক্ষ্মণের চেয়েও হনুমানই এখানে আসল হিরো!
জোজো বলল, তা বলে আমাকে হনুমান সাজতে হবে? মুখে মুখোশ?
কাকাবাবু বললেন, না, না, সেরকম কিছুই না। শুধু একটা লম্বা ল্যাজ থাকবে আর মাঝে মাঝে তুমি হুপ হুপ শব্দ করে লাফাবে!
জাম্বুবানের পার্ট পেয়ে সন্তু কোনও আপত্তি করেনি।
সব পার্ট দেওয়া হয়ে গেল। নিচু ক্লাসের কয়েকটি বাচ্চা ছেলেকে সাজানো হবে বানর-সেনা, তাদের কোনও কথা নেই।
তারপর কাকাবাবু বললেন, শোনো সবাই, দুদিনের মধ্যে সবাইকে যার যার পার্ট মুখস্থ করে ফেলতে হবে। এখন কয়েকদিন ইস্কুল কলেজের পড়া না করলেও চলবে। শুধু পার্ট মুখস্থ। ইস্কুলের পড়া প্রতি বছর বদলে যায়, পরে অনেক কিছু মনেও থাকে না। কিন্তু দেখো, এই থিয়েটারের কথা তোমাদের সারাজীবন মনে থাকবে! আর একটা কথা, রিহার্সালের সময় এক মিনিটও দেরি করে হাজির হলে চলবে না। যার দেরি হবে, তাকে আমি কান ধরে ওঠ-বোস করাব, আর পর পর দুদিন যে দেরি করে আসবে, সে থিয়েটার থেকে বাদ!
পর পর দুদিন বেশ ভালই রিহার্সাল হল। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত। মাঝখানে দুপুরবেলা এ বাড়িতেই সবাই মিলে একসঙ্গে খিচুড়ি-মাংস খাওয়া।
তৃতীয় দিনে হঠাৎ দেখা দিল এক উপদ্রব।
বিকেলবেলা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হল দেবলীনা।
রিহার্সাল বেশ জমে উঠেছে, তার মধ্যেই সে ঢুকে পড়ে এগিয়ে গেল কাকাবাবুর দিকে। টকটকে লাল রঙের ফ্রক পরেছে, তাকে মনে হচ্ছে আগুনের হলকা।
কাকাবাবুকে সে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, তোমাদের সোমবারে ফেরার কথা ছিল না? আমি দুদিন ধরে টেলিফোন করে করে পাচ্ছি না।
কাকাবাবু বললেন, নাঃ, ফেরা হল না।
দেবলীনা সন্তুর দিকে ফিরে চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই সন্তু, খুব কলেজে ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে? লেখাপড়া গোল্লায় গেছে। বেশিদিন গ্রামে থাকলে পেঁয়ো ভূত হয়ে যায়, জানিস না?
জোজো বলল, এই রে, এসে গেছে মূর্তিমতী ঝঞ্ঝা!
দেবলীনা তার দিকে ফিরে বলল, কী বললি, কী বললি?
সন্তু জোজোকে বলল, এত শক্ত শক্ত বাংলা এ বোঝে না!
দেবলীনা বলল, আমি বাংলা বুঝি না? আমি ঝঞ্ঝা মানে জানি, কুজ্ঝটিকা মানেও জানি! তুই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানে বলতে পারবি?
সময় নষ্ট হচ্ছে বলে, কাকাবাবু অস্থির হয়ে বললেন, দেবলীনা, তুমি একটু পাশে বসে থাকে। আমরা একটা কাজ করছি।
এতক্ষণ ঘরের মধ্যে আর কে আছে, না আছে, তা লক্ষই করেনি দেবলীনা। এবার সে মুখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখল। তারপর বলল, এরা সবাই একটা করে বই হাতে নিয়ে বসে আছে কেন? ইস্কুল হচ্ছে বুঝি?
কাকাবাবু বললেন, না, আমরা নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছি।
দেবলীনা বলল, নাটকের রিহার্সাল মানে?
জোজো বলল, কাকাবাবু, ও রিহার্সাল মানেও জানে না। কা
কাবাবু বললেন, এখানে থিয়েটার হবে।
দেবলীনা ভুরু কুঁচকে, জোর দিয়ে বলল, থিয়েটার? থিয়েটার? আমাকে বাদ দিয়ে? ও সেইজন্য তোমরা গ্রামে লুকিয়ে বসে আছ? ঠিক সময়ে এসে পড়েছি।
আমাকেও পার্ট দিতে হবে।
জোজো বুড়োআঙুলে কলা দেখিয়ে বলল, উপায় নেই! উপায় নেই, সব পার্ট দেওয়া হয়ে গেছে!
দেবলীনা সে-কথা গ্রাহ্য না করে কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, ওসব আমি জানি না। আমাকে পার্ট দিতেই হবে। ওই সন্তুটা তো কিছু পারে না, ওর পার্টটা আমাকে দাও!
সন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি আমার পার্ট ছেড়ে দিতে রাজি আছি। তোকে কিন্তু পুরুষ সাজতে হবে!
দেবলীনা বলল, পুরুষ সাজতে হবে কেন? তোর ইচ্ছে হয়, তুই মেয়ে সাজ গিয়ে। আমি মেয়ের পার্টই চাই!
সন্তু বলল, এ নাটকে তো একটাও মেয়ের পার্ট নেই!
দেবলীনা বলল, কেন, মেয়ের পার্ট নেই কেন?
সন্তু বলল, তা আমি কী জানি! নাট্যকারকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, নাট্যকারকে জিজ্ঞেস করার একটু অসুবিধে আছে। সুকুমার রায় আমারও জন্মের আগে স্বর্গে চলে গেছেন?
দেবলীনা সন্তুর হাত থেকে বইটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, মেয়েদের পার্ট নেই, তার মানে এটা বিচ্ছিরি নাটক! অন্য বই করো।
কাকাবাবু বললেন, অনেকদূর এগিয়ে গেছে, এখন তো আর বদলানো যায় না। আমরা বরং কলকাতায় গিয়ে আবার থিয়েটার করব। তখন তোমাকে
দেবলীনা বলল, ওসব শুনতে চাই না। আমাকে এই থিয়েটারেই পার্ট দিতে হবে!
জোজো বলল, কাকাবাবু, ওকে কাটা সৈনিকের পার্ট দেওয়া যেতে পারে। স্টেজে মরে পড়ে থাকবে!
দেবলীনা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই জোজোটা কীসের পার্ট করছে?
কাকাবাবু বললেন, হনুমান!
দেবলীনা ভেংচি কেটে বলল, হনুমান? ঠিক মানিয়েছে। নিশ্চয়ই মস্ত বড় ল্যাজ থাকবে? থিয়েটারের দিনে আমি ওর ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দেব!
জোজো বলল, বোকা মেয়ে, হনুমান বুঝি আগুনকে ভয় পায়? রামায়ণ পড়িসনি?
গ্রামের অন্য ছেলেরা দেবলীনার কাণ্ডকারখানা দেখে হা হয়ে আছে। অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে বলে কাকাবাবু একরকম জোর করেই দেবলীনাকে টেনে এনে নিজের পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।
দেবলীনার মুখোনা থমথমে হয়ে আছে। মনে হয় যেন রাগে আর দুঃখে সে কেঁদেই ফেলবে।
তারপর রিহার্সালে মজার মজার কথাগুলো শুনে একটু একটু বদলাতে লাগল তার মুখের রং।
একসময় বিভীষণ হনুমানের উদ্দেশে গান ধরল :
শোন রে ওরে হনুমান
হও রে ব্যাটা সাবধান
আগে হতে স্পষ্ট বলে রাখি।
তুই ব্যাটা জানোয়ার
নিষ্কর্মার অবতার
কাজেকন্মে দিস বড় ফাঁকি!
তা শুনতে শুনতে হি হি করে হেসে ফেলল দেবলীনা। এবার সেও দুই আঙুলে কলা দেখাল জোজোর দিকে।