গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

০২. রঙ্গনার জন্মকথা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – রঙ্গনার জন্মকথা

কুটির হইতে বাহির হইয়া রঙ্গনা মাঠের দিকে গেল না, যদিও মাঠের ভিতর দিয়াই নদীতে যাইবার সিধা পথ। সে কুটিরের পিছন দিক ঘুরিয়া নদীর পানে চলিল। মাঠের ভিতর দিয়া যাইলে সকলে তাহাকে দেখিতে পাইবে, হয়তো কেহ কিছু বলিবে। তাহাতে কাজ নাই।

চলিতে চলিতে রঙ্গনার কালো চোখ দুটি ছলছল করিতে লাগিল। আবার একটি নিশ্বাস পড়িল।

ক্রমে সে বেতসবনের কাছে আসিয়া পৌঁছিল। এই দিকটা বেতসবনের শেষ প্রান্ত, তেমন ঘন নয়। এখানে ওখানে দুই চারিটা ঝোপ, যত নদীর দিকে গিয়াছে তত ঘন হইয়াছে।

এইখানে ঝোপঝাড়ের অন্তরালে একটি নিভৃত বেতসকুঞ্জ ছিল; এটি রঙ্গনার নিজস্ব, আর কেহ ইহার সন্ধান জানিত না। পাখির খাঁচার মত চারিদিকে জীবন্ত শাখাপত্র দিয়া ঘেরা নিরালা একটি স্থান; এই স্থানটিকে সযত্নে পরিষ্কৃত করিয়া রঙ্গনা কুটির-কক্ষের মতই তক্‌তকে ঝক্‌ঝকে করিয়া রাখিয়াছিল। দ্বিপ্রহরে যখন ঘরে মন টিকিত না বা হাতে কাজ থাকিত না তখন সে চুপি চুপি এই কুঞ্জে আসিত। কয়েকটি খড়ের আঁটি আগে হইতে কুঞ্জে সঞ্চিত ছিল, তাহাই বিছাইয়া শয়ন করিত। নির্জন দ্বিপ্রহরে পত্রান্তরাল-নির্গলিত সবুজ আলো উপর হইতে ঝরিয়া পড়িত; রঙ্গনা সেইদিকে চাহিয়া চাহিয়া যৌবনের কল্পকুহকময় স্বপ্ন দেখিত। কখনও একজোড়া মৌটুসী পাখি আসিয়া শাখাপত্রের মধ্যে খেলা করিত; কখনও দূর আকাশে শঙ্খচিল ডাকিত। এইভাবে তাহার নিঃসঙ্গ তন্দ্রামন্থর মধ্যাহ্ন কাটিয়া যাইত।

আজ রঙ্গনা মাতার আদেশ অনুযায়ী নদীতে না গিয়া প্রথমে তাহার কুঞ্জে আসিয়া ক্লান্তভাবে কলস নামাইয়া বসিল। মনের মধ্যে যখন অভিমান ও অভীপ্সার মল্লযুদ্ধ চলিতে থাকে তখন শরীর অকারণেই ক্লান্ত হইয়া পড়ে। রঙ্গনা দুই হাঁটুর উপর মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। মাঠ এখান হইতে অনেকটা দূরে, তবু নৃত্যপরা যুবতীদের কণ্ঠোত্থিত ঝুমুর গান বংশীর সহযোগে তাহার কানে আসিতে লাগিল—

ও ভোমরা সুজন, তুমি কাছে এস না

আমার রসের কলস উছলে পড়ে

কাছে এস না।

রঙ্গনা চক্ষু মুদিয়া ভাবিতে লাগিল— কেন! কেন আমি ওদের একজন নই? কেন সবাই আমাকে দূরে ঠেলে রাখে? কেন আমার বিয়ে হয়নি? কেন আমার মা সকলের সঙ্গে ঝগড়া করে? কেন? কেন?

এই সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হইলে রঙ্গনার জন্মকথা বলিতে হয়।

আঠারো বছর আগে গোপার স্বামী দারুক বেতসগ্রামের অধিবাসী ছিল। গোপার বয়স তখন একুশ-বাইশ; দারুকের বয়স ত্রিশ। কিন্তু তাঁহাদের সন্তান হয় নাই। এই লইয়া স্ত্রী-পুরুষে কলহ লাগিয়া থাকিত। দারুক রাগী মানুষ, গোপাও অতিশয় প্রখরা; উভয়ে উভয়কে দোষ দিত। গাঁয়ের লোক হাসিতে হাসিতে তামাসা দেখিত।

একদিন বসন্ত কালের প্রভাতে দাম্পত্য কলহ চরমে উঠিয়াছিল। প্রতিবেশীরা কুটির সম্মুখে সমবেত হইয়া বাগ্‌যুদ্ধ উপভোগ করিতেছিল এবং শব্দভেদী সমর কখন দার্দণ্ড রণে পরিণত হইবে উদ্‌গ্রীবভাবে তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছিল, এমন সময় তাহাদের দৃষ্টি অন্যদিকে আকৃষ্ট হইল। দেখা গেল, গো-রথে আরোহণ করিয়া একজন আগন্তুক গ্রামে প্রবেশ করিতেছে।

গ্রামে বহির্জগৎ হইতে বড় কেহ আসে না, উদ্দীপনা উত্তেজনার অবকাশ বড় অল্প। সুতরাং গ্রামের যে-যেখানে ছিল সকলে গিয়া গো-রথ ঘিরিয়া দাঁড়াইল; স্ত্রীপুরুষ, বালক-বালিকা, কুকুর-বিড়াল, কেহই বাদ গেল না। এমন কি দারুকও দাম্পত্য কলহ ধামাচাপা দিয়া মাঠে আসিয়া জুটিল।

মাঠের মাঝখানে গো-রথ থামাইয়া যিনি অবতরণ করিলেন তিনি একজন রাজপুরুষ, নাম কপিলদেব। অতি সুন্দর আকৃতি, বলদৃপ্ত তপ্তকাঞ্চনবর্ণ দেহ। পরিধানে যোদ্ধৃবেশ, মস্তকে উজ্জ্বল শিরস্ত্রাণ, কটিদেশে তরবারি। পরমদৈবত শ্রীমন্মহারাজ শশাঙ্কদেবের পক্ষ হইতে ইনি সৈন্য সংগ্রহে বাহির হইয়াছেন।

গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক তখন হর্ষবর্ধনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছেন। রাজ্যবর্ধনের অপমৃত্যুর ফলে উত্তর ভারতে যে আগুন জ্বলিয়াছিল তাহা উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে। হর্ষবর্ধন প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন পৃথিবী গৌড়শূন্য করিবেন, গৌড়-পিশুন শশাঙ্কের রাজ্য ছারখার না করিয়া তিনি নিরস্ত হইবেন না। বছরের পর বছর যুদ্ধ চলিয়াছে; শশাঙ্কের কান্যকুব্জ পর্যন্ত বিস্তৃত রাজ্যসীমা ক্রমশ পূর্বদিকে হটিয়া আসিতেছে। যুদ্ধে ক্রমাগত সৈন্যক্ষয় হইতেছে; তাই নিত্য নূতন সৈন্যের প্রয়োজন। গৌড় রাজ্যের প্রতি গ্রামে প্রতি জনপদে রাজপুরুষগণ পরিভ্রমণ করিয়া সৈন্য সংগ্রহ করিতেছে।

বেতসগ্রামে ইতিপূর্বে কেহ সৈন্য সংগ্রহে আসে নাই, কপিলদেবই প্রথম। কপিলদেবের আকৃতি যেমন নয়নাভিরাম, বচন-পটিমাও তেমনি মনোমুগ্ধকর। তিনি সমবেত গ্রামিকমণ্ডলিকে নিজ আগমনের উদ্দেশ্য সুললিত ভাষায় ব্যক্ত করিলেন। গৌড়-গৌরব শশাঙ্কদেব উত্তর ভারতে অগণিত শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতেছেন, রণদুর্মদ গৌড়সৈন্যের পরাক্রমে আর্যবর্ত থরথর কম্পমান। যে সকল বীর গৌড়বাসী যুদ্ধে যাইতেছে তাহারা বহু নগর লুণ্ঠন করিয়া স্বর্ণ রৌপ্য মণিমাণিক্য লইয়া ঘরে ফিরিতেছে। এস, কে যুদ্ধে যাইবে— কে অক্ষয়কীর্তি অর্জন করিবে? তে নির্যান্তু ময়া সহৈকমনসো যেষাং অভীষ্টং যশঃ।

প্রথমেই দারুক লাফাইয়া উঠিয়া বলিল— ‘আমি যুদ্ধে যাব।’

আরও দুই চারিজন নবীন যুবক তাহার সহিত যোগ দিল। কপিলদেব তাহাদের বলিয়া দিলেন— কোথায় গিয়া রাজসৈন্যদের সহিত মিলিত হইতে হইবে। কপিলদেব নিজে তাহাদের সহিত যাইবেন না, আজ রাত্রে গ্রামে বিশ্রাম করিয়া কল্য প্রাতে কর্ণসুবর্ণে ফিরিয়া যাইবেন।

দারুক লাফাইতে লাফাইতে নিজ কুটিরে ফিরিয়া গিয়া সদর্পে পিঠে ঢাল বাঁধিল, হাতে সুদীর্ঘ বংশদণ্ড লইয়া বাহির হইয়া পড়িল। যাত্রাকালে গোপাকে শাসাইয়া গেল— ‘যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আর একটা বিয়ে করব। দেখিস্‌ তখন ছেলে হয় কিনা—’

গোপা খরশান চক্ষে চাহিল। তাহার জিহ্বায় যে কথাটা উদ্‌গত হইয়াছিল তাহা সে অধর দংশন করিয়া রোধ করিল। দারুক বীর্যপদক্ষেপে চলিয়া গেল।

কপিলদেব গ্রামে রহিলেন। গ্রামের মহত্তর সসম্মানে রাজপুরুষকে স্বতন্ত্র স্থান নির্দেশ করিলেন। দধি দুগ্ধ ছাগবৎস প্রভৃতি চর্ব্যচুষ্যেরও প্রচুর আয়োজন হইল। রাজপুরুষ মহাশয় কিছুই অবহেলা করিলেন না।

অন্যান্য গুণাবলির সঙ্গে রাজপুরুষ মহাশয়ের আর একটি সদগুণ ছিল, সুন্দরী রমণীর প্রতি তাঁহার দৃষ্টি স্বভাবতই আকৃষ্ট হইত। গোপাকে তিনি দেখিয়াছিলেন; তাঁহার অভিজ্ঞ চক্ষের মানদণ্ডে গোপার রূপ-যৌবন তুলিত হইয়াছিল। অবশ্য সামান্যা পল্লীবধূ নগরকামিনীর বিলাস-বিভ্রম কোথায় পাইবে? কিন্তু মধু’র অভাব গুড়ের দ্বারা পূরণ করিতে হয়, এরূপ প্রবাদবাক্য আছে। সুতরাং চেষ্টা করিয়া দেখিতে দোষ কি? রাজকার্যে ভ্রাম্যমাণ সৈন্য-সংগ্রাহকের মাঝে মাঝে চিত্তবিনোদনেরও তো প্রয়োজন আছে।

সেদিন অপরাহ্ণে গোপা নিজের দ্বার-পিপণ্ডিকায় বসিয়া তূলার পাঁজ কাটিতেছিল। তাহার অন্তরের ক্রোধ এখনও শান্ত হয় নাই। দারুক তাহাকে মিথ্যা দোষ দিয়া চলিয়া গিয়াছে— ইহার প্রতিশোধ যদি সে লইতে পারিত! কিন্তু সে কী করিবে? নারী তো আর যুদ্ধে যাইতে পারে না—

একটি মধুর কণ্ঠস্বর তাহার উত্তপ্ত চিন্তার উপর যেন কোমল করাঙ্গুলি বুলাইয়া দিল— ‘সুচরিতে, তোমার কাছে আমি বড়ই অপরাধী—’

গোপা চমকিয়া মুখ তুলিল। দেখিল, কান্তিমান রাজপুরুষ স্মিতমুখে কুটির সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন। গোপা জড়সড় হইয়া চক্ষু নত করিল।

অনাহূত কপিলদেব দেহলীর এক প্রান্তে বসিলেন। দক্ষিণ হইতে ঝিরি ঝিরি বাতাস দিতে আরম্ভ করিয়াছে, গোপার কর্ণে তালপত্রের লঘু অবতংস দুলিতেছে। কপিলদেব স্নিগ্ধকণ্ঠে কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। কর্তব্যের অনুরোধে মানুষকে কত অপ্রীতিকর কাজ করিতে হয়, কত সুখের সংসারে বিচ্ছেদ ঘটাইতে হয়। গ্রামবধূরা স্বভাবতই পতিপ্রাণা হইয়া থাকে—

এই কথা শুনিয়া গোপা অধরের ঈষৎ ভঙ্গি করিয়া ভ্রূকুটি করিল, কপিলদেব তাহা লক্ষ্য করিলেন। তিনি তৃপ্ত মনে অন্য কথা পাড়িলেন। নগরের নানা কথা; গ্রাম সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন। গোপা প্রথমে নীরব রহিল, তারপর একাক্ষর উত্তর দিল; শেষে দুই একটি কথা বলিল।

তারপর তাহাদের চক্ষু এক সময় পরস্পর আবদ্ধ হইয়া গেল। চোখে চোখে যে কথার বিনিময় হইল তাহা জীবনের আদিমতম কথা, তাহা বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হয় না।

কপিলদেব গ্রামে রাত্রি কাটাইয়া পরদিন প্রত্যূষেই গো-রথে আরোহণপূর্বক প্রস্থান করিলেন। কিন্তু গ্রামের সতর্ক চক্ষুকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় নাই। কপিলদেব যে গভীর রাত্রে গোপার কুটিরে প্রবেশ করিয়াছিলেন তাহা একজন বিনিদ্র প্রতিবেশীর চক্ষু এড়ায় নাই। কথাটা কিন্তু কানাঘুষার মধ্যেই আবদ্ধ হইয়া রহিল, প্রকাশ্যে কেহ গোপার নামে কোনও রটনা করিতে সাহস করিল না। প্রমাণ তেমন বলবান নয়; গোপা বড় মুখরা; তাহার নামে এরূপ অপবাদ দিলে সেও ছাড়িয়া কথা কহিবে না।

ইহার পর তিন মাস কাটিয়া গেল। গোপার গর্ভ লক্ষণ প্রকাশ পাইলে সে নিজেই তাহা সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করিল। কাহারও দোষ ধরিবার উপায় ছিল না, তবু গ্রামের কৌতুক-কৌতূহলী রসনা আর একবার চঞ্চল হইয়া উঠিল। রসিক ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করিতে লাগিল— ভাগ্যে রাজপুরুষ আসিয়া দারুককে যুদ্ধে পাঠাইয়াছিল তাই তো দারুকের বংশরক্ষা হইল।

দারুক আর যুদ্ধ হইতে ফিরিল না। তাহার সঙ্গীদের মধ্যে একজন ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল, মুদ্‌গগিরির যুদ্ধে দারুক মরিয়াছে। গোপা হাতের শঙ্খ ভাঙ্গিয়া কপালের সিন্দূর মুছিল।

তারপর যথাসময়ে, দারুক যুদ্ধে যাইবার নয় মাস পরে, গোপা এক কন্যা প্রসব করিল। এই ঘটনার জন্য গ্রামবাসীরা প্রস্তুত ছিল, সুতরাং ইহা লইয়া অধিক চাঞ্চল্য সৃষ্টির কথা নয়। কিন্তু জানা গেল, সদ্যপ্রসূত কন্যাটির গাত্রবর্ণ দুগ্ধফেনের ন্যায় শুভ্র! ইহা কি করিয়া সম্ভব হয়? দারুকের বর্ণ ছিল ধান-সিদ্ধ-করা হাঁড়ির তলদেশের ন্যায়, গোপাকেও বড় জোর উজ্জ্বল শ্যাম বলা চলে। তবে কন্যা এমন গৌরাঙ্গী হইল কেন? গোপার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ বড়ই গুরুতর হইয়া উঠিল। এত বড় প্রমাণ হাতে পাইয়া কেহই চুপ করিয়া রহিল না।

কন্যা জন্মিবার একুশ দিন পরে গ্রামের মহত্তর মহাশয় গোপার কুটির সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। গোপা কুটিরের মধ্যে কন্যা কোলে লইয়া বসিয়া ছিল, তাহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন— ‘সকলে জানতে চাইছে তোমার মেয়ে এমন ফরসা হল কি করে?’

গোপা মুখ কঠিন করিয়া বলিল— ‘আমি দেবস্থানে রাঙা ডাব মানত করেছিলাম, তা রাঙা মেয়ে হয়েছে।’

মহত্তর মহাশয় বয়সে প্রবীণ, তিনি একটু হাসিলেন। বলিলেন— ‘গোপা-বৌ, আমরা তোমাকে বেশি শাস্তি দিতে চাই না। যা হবার হয়েছে। তুমি পাঁচ কাহন দণ্ড দিলে আর কেউ কিছু বলবে না।’

কিন্তু দণ্ড দিলেই প্রকারান্তরে অপরাধ স্বীকার করা হয়। গোপা শক্ত হইয়া বলিল— ‘আমি এক কানাকড়ি দণ্ড দেব না।’

মহত্তর বিরক্ত হইলেন। ‘না দাও সমাজে পতিত হবে। তোমার জারজ সন্তানের বিয়ে হবে না।’ বলিয়া চলিয়া আসিলেন।

ইহার পর সমস্ত গ্রাম গোপার বিরুদ্ধে দাঁড়াইল। গোপা যদি গ্রামের শাসন মানিয়া লইত তাহা হইলে তাহার অপরাধ কেহ মনে রাখিত না, দু’দিন পরে ভুলিয়া যাইত। এমন তো কতই হয়। কিন্তু গোপা দণ্ড দিল না; সে ভাঙ্গিবে তবু মচ্‌কাইবে না। গ্রামের লোক তাহার স্পর্ধায় ক্রুদ্ধ হইয়া তাহার সহিত সম্পর্ক ত্যাগ করিল। নষ্ট স্ত্রীলোকের এত তেজ কিসের!

এরূপ অবস্থায় এক নিঃসহায় রমণীর গ্রামে বাস করা কঠিন হইত। কিন্তু দেবস্থানের পূজারী চাতক ঠাকুর দয়ালু লোক ছিলেন; অনাথা স্ত্রীলোক যাহাতে অনাহারে না মরে তিনি সেদিকে দৃষ্টি রাখিলেন। তাঁহার প্রভাবে গাঁয়ের লোকের রাগও কিছু পড়িল। কিন্তু গোপার সহিত গায়ে পড়িয়া কেহ সদ্ভাব স্থাপন করিতে আসিল না। গোপাও শক্ত হইয়া রহিল।

গোপার মেয়ে বড় হইয়া উঠিতে লাগিল। ফুলের মত সুন্দর টুকটুকে মেয়েটির চাতক ঠাকুরই নাম রাখিলেন— রঙ্গনা। কিন্তু রঙ্গনার সহিত গ্রামের ছেলেমেয়েরা খেলা করে না; তাহারা খেলা করিতে চাহিলে তাহাদের বাপ-মা তাড়না করে। রঙ্গনা কাঁদে, মায়ের কোলে আছড়াইয়া পড়ে। গোপা মেয়েকে বুকে চাপিয়া গলদশ্রুনেত্রে তিরস্কার করে— ‘ওরা তোর সমান নয়। তুই ওদের সঙ্গে খেলবি না।’

রঙ্গনা যখন কিশোরী হইল তখন সে নিজেই সমবয়স্কাদের নিকট হইতে দূরে দূরে থাকিতে শিখিল। গ্রামে তাহার সমবয়স্ক যত মেয়ে আছে সকলকে সে চেনে, সকলের নাম জানে; কিন্তু কাহারও সহিত মেশে না। কদাচিৎ নদীর ঘাটে কোনও মেয়ের সঙ্গে দু’একটা কথা হয়, তাহার বেশি নয়। অন্য মেয়েরাও রঙ্গনার সহিত মিলিতে উৎসুক; তাহার রূপের জন্য অনেকেই তাহার প্রতি ঈর্ষান্বিতা, তবু রঙ্গনা তাহাদের আকর্ষণ করে। সে কেন তাহাদের একজন নয়, কিশোরীরা তাহা ভাল করিয়া জানে না। রঙ্গনাকে লইয়া নিত্য তাহাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা হয়, কিন্তু নিষেধ লঙ্ঘন করিয়া কেহই তাহার সহিত সখিত্ব স্থাপন করিতে সাহস করে না।

রঙ্গনার সমবয়স্কাদের একে একে বিবাহ হয়। বিবাহে নৃত্যগীত উৎসব হয়। কিন্তু রঙ্গনা তাহাতে যোগ দিতে পারে না। রঙ্গনার বিবাহের কথাও কেহ তোলে না। গ্রামের দুই চারিজন অবিবাহিত যুবক দূর হইতে তাহার পানে সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বটে, কিন্তু বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিবার সাহস কাহারও নাই। আর, রঙ্গনার সহিত গুপ্ত প্রণয়ের কথা কেহ ভাবিতেই পারে না; গোপার তীক্ষ্ণ চক্ষু ও শাণিত রসনাকে সকলেই ভয় করে।

এইভাবে শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করিয়া রঙ্গনা যৌবনে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। শৈশবে নিঃসঙ্গতার বেদনা শিশুই জানে। কৈশোরে সঙ্গিসাথীর অভাব মর্মপীড়াদায়ক। কিন্তু নিঃসঙ্গ যৌবনের অন্তর্দাহ বড় গভীর যন্ত্রণাময়।