যোগ-সর্পের হাঁড়ি
একে তো ক্যাবলার মেসোমশাইয়ের ওই উকট অট্টহাসি—তারপর আবার পাশের বাড়ির ছাতে দুটো আগুন-মাখা চোখ! জয় মা কালী বলে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাব ভাবছি, এমন সময় মিয়াঁও-মিয়াঁও—মিয়াঁও
সেই জ্বলন্ত চোখের মালিক এক লাফে ছাতের পাঁচিলে উঠে পড়ল, তারপর আর-এক লাফে আর-এক বাড়ির কার্নিশে।
পৈশাচিক অট্টহাসিটা থামিয়ে মেসোমশাই বললেন, একটা হুলো-বেড়াল দেখেই চোখ কপালে উঠল, তোমরা যাবে সেই ডাক বাংলোয়!—ভেংচি কাটার মতো করে আবার খানিকটা খ্যাঁকঘেঁকে হাসি হাসলেন ভদ্রলোক :বীর কী আর গাছে ফলে!
আমাদের ভেতর ক্যাবলাটা বোধহয় ভয়-টয় বিশেষ পায়নি—এক নম্বরের বিচ্ছু ছেলে। তাই সঙ্গে সঙ্গেই বললে, না—পটোলের মতো পটলডাঙায় ফলে।
টেনিদার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাবুল হাঁসফাঁস করে বললে, কিংবা ঢ্যাঁড়সের মতন গাছের ওপর ফলে।
এবার আমাকেও কিছু বলতে হল : কিংবা চালের ওপর চালকুমড়োর মতো ফলে।
টেনিদা দম নিচ্ছিল এতক্ষণ, এবার দাঁত খিঁচিয়ে উঠল,—থাম থাম সব বাজে বকিসনি! সত্যি বলছি মেসোমশাই ইয়ে—আমরা একদম ভয় পাইনি। এই প্যালাটা বেজায় ভিতু কিনা, তাই ওকে একটু ঠাট্টা করছিলাম।
বা রে, মজা মন্দ নয় তো! শেষকালে আমার ঘাড়েই চালাবার চেষ্টা। আমার ভীষণ রাগ হল। আমি ছাগলের মতো মুখ করে বললাম, না মেসোমশাই, আমি মোটে ভয় পাইনি। টেনিদার দাঁতকপাটি লেগে যাচ্ছিল কিনা, তাই চেঁচিয়ে ওকে সাহস দিচ্ছিলাম।
—ইঃ, সাহস দিচ্ছিল। ওরে আমার পাকা পালোয়ান রে!—টেনিদা নাক-টাক কুঁচকে মুখটাকে আমের মোরব্বার মতো করে বললে, দ্যাখ প্যালা, বেশি জ্যাঠামি করবি তো এক। চড়ে তোর কান দুটোকে কানপুরে পাঠিয়ে দেব!
মেসোমশাই বললেন, আচ্ছা থাক, থাক। তোমরা যে বীরপুরুষ এখন তা বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আসল কথা হোক। তোমরা কি সত্যিই ঝন্টিপাহাড়ে যেতে চাও?
ঝন্টিপাহাড়! সে আবার কোথায়? যা-বাব্বা, সেখানে মরতে যাব কেন?—টেনিদা চটাং করে বলে ফেলল।
মেসোমশাই বললেন, কী আশ্চর্য—এক্ষুনি তো সেখানে যাওয়ার কথা হচ্ছিল।
-তাই নাকি?—টেনিদা মাথা চুলকে বললে, বুঝতে পারিনি। তবে কিনাঝন্টিপাহাড় নামটা, কী বলে ইয়ে—তেমন ভালো নয়।
হাবুল বললে, হ, বড়ই বদখত।
আমি বললাম, শুনলেই মনে হয় ব্রহ্মদৈত্য আছে।
মেসোমশাই আবার খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে বললেন, তার মানে তোমরা যাবে না? ভয় ধরছে বুঝি?
টেনিদা এবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর সাঁ করে একটা বুকডন দিয়ে বললে, ভয়? দুনিয়ায় আছে বলে আমি জানিনে! নিজের বুকে একটা থাপ্পড় মেরে বললে, কেউ না যায় হাম জায়েঙ্গা! একাই জায়েঙ্গা!
ক্যাবলা বললে, আর যখন ভূতে ধরেঙ্গা?
—তখন ভূতকে চাটনি বানিয়ে খায়েঙ্গা!—টেনিদা বীররসে চাগিয়ে উঠল :সত্যি, কেউ যায় আমি একাই যাব! হঠাৎ আমার ভারি উৎসাহ হল।
—আমিও যাব।
ক্যাবলা বললে, আমিও!
হাবুল, সেন ঢাকাই ভাষায় বললে, হ, আমিও জামু!
মেসোমশাই বললেন, তোমরা ভয় পাবে না?
টেনিদা বুক চিতিয়ে বললেন, একদম না!
আমিও ওই কথাটা বলতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ হতভাগা ক্যাবলা একটা ফোড়ন কেটে দিলে তবে, রাত্তিরবেলা হুলোবেড়াল দেখলে কী হবে কিছুই বলা যায় না।
মেসোমশাই আবার ছাত-ফাটানো অট্টহাসি হেসে উঠলেন। টেনিদা গর্জন করে বললে, দ্যাখ ক্যাবলা, বেশি বকবক করবি তো এক ঘুষিতে তোর নাক—
আমি জুড়ে দিলাম : নাসিকে পাঠিয়ে দেব।
—যা বলেছিস! একখানা কথার মতো কথা।—এই বলে টেনিদা এমনভাবে আমার পিঠ চাপড়ে দিলে যে, আমি উহু-উহু শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম।
তার পরের খানিকটা ঘটনা সংক্ষেপে বলে যাব। কেমন করে আমরা চার মূর্তি বাড়ি থেকে পারমিশন আদায় করলাম সে-সব কথা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। সেসব এলাহি কাণ্ড এখন থাক। মোট কথা, এর তিনদিন পরে, কাঁধে চারটে সুটকেশ আর বগলে চারটে সতরঞ্চি জড়ানো বিছানা নিয়ে আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছুলাম।
ট্রেন প্রায় ফাঁকাই ছিল। এই গরমে নেহাত মাথা খারাপ না হলে আর কে রাঁচি যায়? ফাঁকা একটা ইন্টার ক্লাস দেখে আমরা উঠে পড়লাম, তারপর চারটে বিছানা পেতে নিলাম।
ভাবলাম, বেশ আরামে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি, হঠাৎ টেনিদা ডাকল—এই প্যালা!
—আবার কী হল!
–ভারি খিদে পেয়েছে মাইরি! পেটের ভেতর যেন একপাল ছুঁচো বক্সিং করছে।
বললাম, সে কী এই তো বাড়ি থেকে বেরুবার মুখে প্রায় তিরিশখানা লুচি আর সের-টাক মাংস সাবাড় করে এলে! গেল কোথায় সেগুলো?
হাবুল বললে, তোমার প্যাটে ভস্মকীট ঢুইক্যা বসছে!
টেনিদা বললে, যা বলেছিস! ভস্মকীটই বটে! যা ঢোকে সঙ্গে সঙ্গে স্রেফ ভস্ম হয়ে যায়! বলেই দরাজভাবে হাসল : বামুনের ছেলে, বুঝলিসাক্ষাৎ অগস্ত্য মুনির বংশধর! বাতাপি ও ইল-ফিশ্বল যা ঢুকবে দেন-অ্যাঁন্ড-দেয়ার হজম হয়ে যাবে! হুঁ হুঁ!—এরই নাম ব্ৰহ্মতেজ।
ক্যাবলা বলে বসল : ঘোড়ার ডিমের বামুন তুমি! পৈতে আছে তোমার?
—পৈতে? টেনিদা একটা ঢোক গিলল : ইয়ে, ব্যাপারটা কী জানিস? গরমের সময় পিঠ চুলকোতে গিয়ে কেমন পটাং করে ছিড়ে যায়। তা আদত বামুনের আর পৈতের দরকার কী, ব্ৰহ্মতেজ থাকলেই হল। কিন্তু সত্যি, কী করা যায় বল তো? পেটের ভেতর ছুঁচোগুলো যে রেগুলার হাড়ু-ড়ু খেলছে!
ক্যাবলা বললে, তা আর কী করবে! তুমি রেফারিগিরি করো।
কী বললি ক্যাবলা?
কী আর বলব—কিছুই বলিনি বলেই ক্যাবলা বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ল।
হাবুল সেন এর মধ্যে বলে বসল, প্যাটে কিল মাইরা বইস্যা থাকো।
কার পেটে কিল মারব? তোর?বলে ঘুষি বাগিয়ে টেনিদা উঠে পড়ে আর কি!
হাবুল চটপট বলে বসল, আমার না—আমার না—প্যালার।
বা-রে, এ তো বেশ মজা দেখছি! মিছিমিছি আমি কেন পেটে কিল খেতে যাই? তোক করে একটা বাঙ্কের ওপর উঠে বসে আমি বললাম, আমি কেন কিল খাব? কী দরকার আমার?
টেনিদা বললে, খেতেই হবে তোকে! হয় আমায় যা-হোক কিছু খাওয়া, নইলে শুধু কিল কেন—রাম-কিল আছে তোর বরাতে। ওই তো কত ফিরিওলা যাচ্ছে—ডাক না একটাকে। পুরি কচৌরি, কমলালেবু চকোলেট-ডালমুট
আমি তো দেখছি একটা জুতো-ব্রাশ যাচ্ছে। ওকেই ডাকব?—আমি নিরীহ গলায় জানতে চাইলাম।
—তবে রেবলে টেনিদা প্রায় তেড়ে আসছিল আর আমি জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ব কি না ভাবছিলুম, এমন সময় ঢনাটন করে ঘণ্টা বাজল। ইঞ্জিনে ভোঁ করে আওয়াজ হল–আর গাড়ি নড়ে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে আর-একজন ঢুকে পড়ল কামরায়, তার হাতে এক প্রকাণ্ড সন্দেহজনক চেহারার হাঁড়ি। আর তক্ষুনি পেছন থেকে কে যেন কী-একটা ছুঁড়ে দিলে –গাড়ির ভেতর। সেটা পড়বি তো পড়, একেবারে টেনিদার ঘাড়ের ওপর। টেনিদা হাঁই-মাই। করে উঠল।
তারপরে চোখ পাকিয়ে এটা কী হল মশাই বলতে গিয়েই স্পিটি নট! সঙ্গে সঙ্গে আমরাও!
গাড়িতে যিনি ঢুকেছেন তাঁর চেহারাখানা দেখবার মতো। একটি দশাসই চেহারার সাধু। মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, দাড়িগোঁফে মুখ একেবারে ছয়লাপ। গলায় অ্যাঁই মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে লাল টকটকে সিঁদুরের তিলক আঁকা, পায়ে শুড়-তোলা নাগরা।
হাতের সন্দেহজনক হাঁড়িটা নামিয়ে রেখে সাধুবাবা বললেন, ঘাবড়ে যেও না বৎস—ওটা আমার বিছানা। তাড়াহুড়োতে আমার শিষ্য জানালা গলিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছে। তোমার বিশেষ লাগেনি তো?
—না, তেমন আর কী লেগেছে বাবা! তবে সাতদিনে ঘাড়ের ব্যথা ছাড়লে হয়!—টেনিদা ঘাড় ডলতে লাগল। আমি কিন্তু ভারি খুশি হয়ে গেলাম সাধুবাবার ওপরে। যেমন আমার পেটে কিল মারতে এসেছিল—ববাঝে এবার!
সাধুবাবা হেসে বললেন, একটা বিছানার ঘায়েই কাবু হয়ে পড়লে বৎস, আর আমার কাঁধে একবার একটা আস্ত কাবুলিওয়ালা এক মন হিংয়ের বস্তা নিয়ে বাঙ্ক থেকে পড়ে গিয়েছিল। তবু আমি অক্কা পাইনি—সাতদিন হাসপাতালে থেকেই সামলে নিয়েছিলুম। বুঝেছ বৎস—এরই নাম যোগবল!
—তবে তো আপনি মহাপুরুষ স্যার—দিন দিন পায়ের ধুলো দিন। বলেই টেনিদা ঝাঁ করে সাধুবাবাকে একটা প্রণাম ঠুকে বসল।
সাধু বললেন, ভারি খুশি হলুম—তোমার সুমতি হোক। তা তোমরা কারা? এমন দল বেঁধে চলেছই বা কোথায়?
—প্রভু, আমরা রামগড়ে যাচ্ছি। বেড়াতে। আমার নাম টেনিথুড়ি, ভজহরি মুখুজ্যে। এ হচ্ছে প্যালারাম বাঁড়ুজ্যে—খালি জ্বরে ভোগে আর পেটে মস্ত একটা পিলে আছে। এ হল হাবুল সেন—যদিও ঢাকাই বাঙাল, কিন্তু আমাদের পটলডাঙা থান্ডার ক্লাবে অনেক টাকা চাঁদা দেয়। আর ও হল ক্যাবলা মিত্তির, ক্লাসে টকাটক ফার্স্ট হয় আর ওদের বাড়িতে আমাদের বিস্তর পোলাও-মাংস খাওয়ায়।
-পোলাও-মাংস! আহা—তা বেশ-দাড়ির ভেতরে সাধুবাবা যেন নোলার জল সামলালেন মনে হল : তা বেশ—তা বেশ!
-বাবা, আপনি কোন্ মহাপুরুষ হাবুল, সেন হাত জোড় করে জানতে চাইল।
–আমার নাম? স্বামী ঘুটঘুটানন্দ।
—ঘুটঘুটানন্দ! ওরে বাবা!-ক্যাবলার স্বগতোক্তি শোনা গেল।
–এতেই ঘাবড়ালে বস ক্যাবল? আমার গুরুর নাম কী ছিল জানো? ডমরু-ঢক্কা-পট্টনানন্দ; তাঁর গুরুর নাম ছিল উচ্চ-মার্তণ্ড কুকুটডিম্বভর্জন; তাঁর গুরুর নাম ছিল—
—আর বলবেন না প্রভু ঘুটঘুটান—এতেই দম আটকে আসছে। এরপর হার্টফেল করব!বাঙ্কের ওপর থেকে এবার কথাটা বলতেই হল আমাকে।
শুনে ঘুটঘুটানন্দ করুণার হাসি হাসলেন : আহানাবালক! তা, তোমাদের আর দোষ কী—আমার গুরুদেবের ঊর্ধ্বতন চতুর্থ গুরুর নাম শুনে আমারই দু-দিন ধরে সমানে হিক্কা উঠেছিল। সে যাক—তোমরা চারজন আছ দেখছি, যাবেও রামগড়ে। আমি নামব। মুরিতে—সেখান থেকে রাঁচি। তা বৎসগণ, আমার যোগনিদ্রা একটু প্রবলচট করে ভাঙতে চায় না। মুরিতে গাড়ি ভোরবেলায় পৌঁছয়যদি উঠিয়ে দাও বড় ভাল হয়।
—সেজন্যে ভাববেন না প্রভু, ঘাটশিলাতেই উঠিয়ে দেব আপনাকে।-ক্যাবলা আশ্বাস দিলে।
–না–না বৎস, অত তাড়াতাড়ি জাগাবার দরকার নেই। ঘাটশিলায় মাঝরাত।
—তাহলে টাটানগরে?
—সেটা শেষরাত, বৎস—অজ ব্যস্ত হয়ো না। মুরিতে উঠিয়ে দিলেই চলবে। টেনিদা বললে, আচ্ছা তাই দেব। এবার আপনি যোগনিদ্রায় শুয়ে পড়তে পারেন।
—তা পারি। ঘুটঘুটানন্দ এবার চারিদিকে তাকালেন : কিন্তু শোব কোথায়? চারজনে। তো চারটে নীচের বেঞ্চি দখল করে বসেছ। আমি সন্ন্যাসী মানুষবাঙ্কে উঠলে যোগনিদ্রার ব্যাঘাত হবে।
টেনিদা বললে, আপনি উঠবেন কেন প্রভু—প্যালা বাঙ্কে শোবে। ও ব্যাঙ্কে শুতে ভীষণ ভালবাসে।
দ্যাখো তো কী অন্যায়! বাঙ্কে ওঠা আমি একদম পছন্দ করি না, খালি মনে হয় কখন ছিটকে পড়ে যাব—আর টেনিদা কিনা আমাকেই
আমি বললাম, কক্ষনো নাবাঙ্কে শুতে আমি মোটেই ভালোবাসি না! টেনিদা চোখ পাকাল।
—দ্যাখ প্যালা—সাধু-সন্নিসি নিয়ে ফাজলামো করিসনি–নরকে যাবি! প্রভু, আপনি প্যালার বিছানা ফেলে দিয়ে ওইখানেই লম্বা হোন—প্যালা যেখানে তোক শশাবে।
—আহা, বেঁচে থাকো বৎস বলে ঘুটঘুটানন্দ আমার বিছানা ওপরে তুলে দিয়ে নিজের বিছানাটা পাতলেন। আমি জুলজুল করে চেয়ে রইলাম।
তারপর শোয়ার আগে সেই সন্দেহজনক হাঁড়িটি নিজের বেঞ্চির তলায় টেনে নিলেন। টেনিদা অনেকক্ষণ লক্ষ করছিল, জিজ্ঞেস করল, হাঁড়িতে কী আছে প্রভু?
শুনেই ঘুটঘুটানন্দ চমকে উঠলেন; হাঁড়িতে? হাঁড়িতে বড় ভয়ঙ্কর জিনিস আছে বৎস! যোগসৰ্প!
—যোগসৰ্প?—হাবুল বললে, সেইটা আবার কী প্রভু?
ঘুটঘুটানন্দ চোখ কপালে তুলে বললেন, সে বড় সাংঘাতিক ব্যাপার! ভীষণ সমস্ত বিষধর সাপ-তপস্যাবলে আমি তাদের বন্দি করে রেখেছি। তারা দুধকলা খায় আর হরিনাম করে।
–সাপে হরিনাম করে!—আমি জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলুম না।
-তপস্যায় সব হয় বৎস! ঘুটঘটানন্দ হাসলেন : তা বলে তোমরা ওর ধারেকাছে যেও! যোগবল না থাকলে বোঁ করে ছোবল মেরে দেবে। সাবধান!
–আজ্ঞে আমরা খুব সাবধানে থাকব-টেনিদা গোবেচারির মতো বললে।
ঘুটাঘুটানন্দ আর-একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। বললেন, হ্যাঁ, খুব সাবধান! ওই হাঁড়ির দিকে ভুলেও তাকিও না। তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ি?
–পড়ুন।
তারপর পাঁচ মিনিট কাটল না। ঘর-ঘ-ঘরাৎ করে ঘুটঘুটানন্দের নাক ডাকতে লাগল।
বাঙ্কের উপরে দুলুনি খেতে খেতে আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। হঠাৎ কার যেন খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি, টেনিদা, আমার পাঁজরায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
—নেমে আয় না গাধাটা। সাধুবাবা জেগে উঠলে তখন লবডঙ্কা পাবি।
চেয়ে দেখি, টেনিদার বিছানার ওপর যোগসর্পের হাঁড়ি। আর তার ঢাকনা খুলে ক্যাবলা আর হাবুল সেন পটাপট রসগোল্লা আর লেডিকেনি সাবড়ে দিচ্ছে।
টেনিদা আবার ফিসফিসিয়ে বললে, হাঁ করে দেখছিস কী? নেমে আয় শিগগির। যোগসপের হাঁড়ি শেষ করে আবার তো মুখ বেঁধে রাখতে হবে।
আর বলবার দরকার ছিল না। একলাফে নেমে পড়লুম এবং এক থাবায় দুটো লেডিকেনি তুলে ফেললুম।
টেনিদা এগিয়ে এসে বললে, দাঁড়া দাঁড়া—সবগুলো মেরে দিসনি! দুটো-একটা আমার জন্যেও রাখিস।
ট্রেন টাটানগর ছেড়ে আবার অন্ধকারে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। স্বামী ঘুটঘুটানন্দের নাক সমানে ডেকে চলল : ঘরাৎ-ফোঁ—ফর্র্ ফোঁ-ফুরুৎ–ফুর্র্–
চারজনে মিলে যেভাবে আমরা স্বামী ঘুটঘুটানন্দের হাঁড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলুম, তাতে সেটা চিচিং ফাঁক হতে পাঁচ মিনিট সময় লাগল না। অর্ধেকের ওপর টেনিদা সাবড়ে দিলে বাকিটা আমি আর হাবুল সেন ম্যানেজ করে নিলুম। বয়েসে ছোট ক্যাবলাই বিশেষ জুত করতে পারল না। গোটা-দুই লেডিকেনি খেয়ে শেষে হাত চাটতে লাগল।
টেনিদা তবু হাঁড়িটাকে ছাড়ে না। শেষকালে মুখের ওপর তুলে চোঁ করে রসটা পর্যন্ত নিকেশ করে দিলে। তারপর নাক-টাক কুঁচকে বললে, দুত্তোর, গোটাকয়েক ডেয়ো পিঁপড়েও খেয়ে ফেললুম রে! জ্যান্তও ছিল দু-তিনটে! পেটের ভেতরে গিয়ে কামড়াবে না তো?
হাবুল বললে, কামড়াইতেও পারে।
কামড়াক গে, বয়ে গেল! একবার ভীমরুল-সুদ্ধ একটা জামরুল খেয়ে ফেলেছিলুম, তা সে-ই যখন কিছু করতে পারলে না, তখন কটা পিঁপড়েতে আর কী করবে!
—ইচ্ছে করলে গোটাকয়েক বাঘ-সুদ্ধ সুন্দরবন পর্যন্ত তুমি খেয়ে ফেলতে পারো—তোমাকে ঠেকাচ্ছে কে!—হাত চাটা শেষ করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল ক্যাবলা।
এর মধ্যে স্বামী ঘুটঘটানন্দের নাক সমানেই ডেকে চলছিল। যোগসিদ্ধ নাক কিনা—সেনাকের ডাকবার কায়দাই আলাদা। ঘ-ঘোঁ-ঘুরৎ!
টেনিদা বললে, যতই ঘুরুৎ-ঘুরুৎ করো না কেন—তোমার হাঁড়ি ফুড়ৎ! চালাকি পেয়েছে। কাঁধের ওপর দেড়মনি বিছানা ফেলে দেওয়া। ঘাড়টা টনটন করছে এখনও। প্রতিশোধ ভালোই নেওয়া হয়েছে কী বলিস প্যালা?
আমি বললুম, প্রতিশোধ বলে প্রতিশোধ! একেবারে নির্মম প্রতিশোধ!
যোগসর্পের শূন্য হাঁড়িটার মুখ টেনিদা বেশ করে বাঁধল। তারপর বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে বললে, এবার একটু ঘুমোনো যাক। পেটের জ্বলুনিটা এতক্ষণে একটু কমেছে।
আমার আর হাবুলেরও তাতে সন্দেহ ছিল না। কেবল ক্যাবলাই গজগজ করতে লাগল : তোমরাই সব খেয়ে নিলে, আমি কিছু পেলুম না!
টেনিদা বললে, যা যা, মেলা বকিসনি। ছেলেমানুষ, বেশি খেয়ে শেষে কি অসুখে পড়বি? নে, চুপচাপ ঘুমো–
ক্যাবলা ঘুমোলো কি না কে জানে, কিন্তু টেনিদার ঘুমোতে দু-মিনিটও লাগল না। স্বামীজীর, নাক বললে, ঘুরুৎ—টেনিদার নাক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলে, ফুড়ৎ। এই উত্তর-প্রত্যুত্তর কতক্ষণ চলল জানি না—মুখের ওপর থেকে দেওয়ালি পোকা তাড়াতে আমিও ঘুমিয়ে পড়লুম।