যুধিষ্ঠিরাদির সেবায় ধৃতরাষ্ট্রের তুষ্টিসাধন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডব ও ঋষিগণকর্ত্তৃক এইরূপে সম্মানিত হইয়া পূৰ্ব্বের ন্যায় সুখস্বচ্ছন্দে কালহরণপূৰ্ব্বক বন্ধুবান্ধবগণের শ্রাদ্ধোপলক্ষে ব্রাহ্মণদিগকে বিবিধ উৎকৃষ্ট বস্তুসমুদয় প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সরলস্বভাব মহাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সেই সমুদয় বস্তু প্রদানপূর্ব্বক প্রীতমনে অমাত্য ও ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, “অন্ধরাজ আমার ও তোমাদিগের পরমপূজনীয়। অতএব যিনি উঁহার আজ্ঞানুবর্ত্তী থাকিবেন, তিনি আমার সুহৃদ, আর যিনি উহার আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করিবেন, তিনি আমার শত্রুস্বরূপ হইবেন, সন্দেহ নাই। এক্ষণে উনি স্বীয় পুত্র ও বন্ধুবান্ধবগণের শ্রাদ্ধোপলক্ষে ইচ্ছানুসারে ধনদান করুন।”
যুধিষ্ঠির এইরূপ কহিলে, অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র উপযুক্ত ব্রাহ্মণগণকে প্রভূত ধনদান করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব ইঁহারা সকলেই তাঁহার প্রীতির নিমিত্ত তাঁহাকে বিবিধ ধনদান করিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, এই বৃদ্ধ অন্ধরাজকে আমাদিগের নিমিত্তই পুত্রপৌত্রশোকে নিতান্ত অভিভূত হইতে হইয়াছে; অতএব যাহাতে ইনি সেই শোকনিবন্ধন কালকবলে নিপতিত না হয়েন, তদ্বিষয়ে যত্নবান হওয়া আমাদের সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। ইঁহার পুত্রগণ জীবিত থাকিতে ইনি যেরূপ সুখস্বচ্ছন্দে কালহরণ করিয়াছেন, এক্ষণেও সেইরূপ সুখভোগে কালহরণ করুন।
পাণ্ডবগণ এইরূপ চিন্তা করিয়া তাঁহার আজ্ঞানুসারে সমুদয় কাৰ্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাদিগকে নিতান্ত বিনীত, আজ্ঞানুবর্ত্তী ও ভক্তিমান দেখিয়া তাঁহাদিগের প্রতি অতিশয় প্রীত হইলেন। ঐ সময় মহানুভবা গান্ধারীও পিতৃলোকপ্রাপ্ত পুত্রগণের শ্রাদ্ধোপলক্ষে ব্রাহ্মণদিগকে বিবিধ ধনদান করিয়া পিতৃঋণ হইতে মুক্ত হইলেন।
এইরূপে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সহিত প্রতিনিয়ত অন্ধরাজের যথাযোগ্য সৎকার করিতে আরম্ভ করিলে, তিনি কোন বিষয়ে পাণ্ডবগণের দোষ দেখিতে না পাইয়া, তাঁহাদের প্রতি পরম পরিতুষ্ট হইলেন। পতিপরায়ণা গান্ধারীও পুত্রশোক পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাদিগকে স্বীয় পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কোনরূপ অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলেন না। অন্ধরাজ ও গান্ধারী তাঁহাকে যে কাৰ্য্যে নিয়োগ করিতে লাগিলেন, তৎসমুদয় কঠিন হউক বা সহজ হউক, তিনি প্রীতমনে সম্পাদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন অন্ধরাজ ধৰ্ম্মরাজের এইরূপ সদাচারদ্বারা পরম প্রীত হইয়া মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধনকে স্মরণপূৰ্ব্বক যারপরনাই অনুতাপযুক্ত হইলেন এবং প্রতিদিন প্রাতঃকালে গাত্রোত্থানপূৰ্ব্বক জপাদিক্রিয়া সমাপন করিয়া পাণ্ডবগণের সংগ্রামে অপরাজয় ও ব্রাহ্মণদ্বারা স্বস্তিবাচন ও অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিয়া তাঁহাদের আয়ুবৃদ্ধি প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। ফলতঃ তৎকালে পাণ্ডবগণ হইতে তাঁহার যেরূপ প্রীতিলাভ হইল, পূৰ্ব্বে তিনি স্বীয় পুত্রগণ হইতেও সেরূপ প্রীতিলাভে সমর্থ হয়েন নাই।
ঐ সময় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র চারি বর্ণই ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি প্রীত হইলেন। ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির দুৰ্য্যোধনাদির অত্যাচারের বিষয় একবার স্মরণও না করিয়া অন্ধরাজের আজ্ঞানুসারে সমুদয় কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। ঐ সময় যে ব্যক্তি ধৃতরাষ্ট্রের কোনরূপ অপ্রিয়কার্য্যের অনুষ্ঠান করিত, যুধিষ্ঠির তাঁহার সহিত শত্ৰুবৎ ব্যবহার করিতেন। সুতরাং ধর্ম্মরাজের ভয়ে কেহই তৎকালে ধৃতরাষ্ট্রের বা দুর্য্যোধনের দোষকীৰ্ত্তনে সমর্থ হইত না। মহাত্মা বিদুর ও গান্ধারী ধৰ্ম্মরাজের সৌজন্যদর্শনে তাঁহার প্রতি নিতান্ত প্রীত হইলেন, কিন্তু ভীমসেনের প্রতি তাঁহাদিগের তাদৃশ প্রীতিসঞ্চার হইল না। ভীমসেন অন্ধরাজকে দর্শন করিবামাত্র মনে মনে নিতান্ত বিরক্ত হইতেন; কেবল যুধিষ্ঠির উঁহার পরিচর্য্যা করিতেন বলিয়াই নিতান্ত অপ্রীতচিত্তে তাঁহার শুশ্রূষা করিতেন।