খুব সম্ভবত আমি স্টাইলসে পৌঁছেছিলাম ৫ই জুলাই। ১৫ই আর ১৬ই জুলাই-এর কথা আমার খুব মনে পড়ছে। ঐ দুটো দিনের ঘটনা মনকে ভয়ানক নাড়া দিয়েছে।
মিস হাওয়ার্ড যাওয়ার দিন কয়েক পরে ওঁর কাছ থেকে একটা চিঠি এল। তাতে উনি লিখেছেন মিডলিংহ্যামের একটা বড় হাসপাতালে তিনি নার্সের চাকরী পেয়েছেন।
আমার সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। শুধু একটা ব্যাপারে আমার বেশ অদ্ভুত লাগত। মেরী ক্যাভেণ্ডিস কেন যে সবসময় ডাঃ বরস্টিনের সঙ্গে সময় কাটান তা কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। লোকটার মধ্যে যে উনি কি দেখেছেন কে জানে। সময়ে অসময়ে তিনি লোকটাকে বাড়িতে আসতে বলতেন, না হয় তার সঙ্গে কোথাও বেরিয়ে যেতেন।
১৬ই জুলাই ছিল সোমবার। এর আগের শনিবার এক মেলার ব্যবস্থা করেছিলেন মিসেস ইঙ্গলথর্প। সোমবার রাত্রে ছিল ঐ মেলা সংক্রান্তই এক আসর।
সকালবেলা থেকেই তাই খুব ব্যস্ত ছিলাম। গ্রামের একটা বড় হলঘরকে আসরের জন্য সাজান হচ্ছিল। খাওয়া-দাওয়া সারতে আমাদের অনেক দেরি হল।
চা পানের পর মিসেস ইঙ্গলথর্প একটু বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন। আমার কোনো কাজ ছিল না বলে মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে এক হাত টেনিস খেলতে আমন্ত্রণ জানালাম।
কিছুক্ষণ পরে মিসেস ইঙ্গলথর্প আসরের জন্য সকলকে খুব তাড়া দিলেন। আসরটা বেশ জমজমাট হয়েছিল। মিসেস ইঙ্গলথর্প খুব হাততালি পেলেন যুদ্ধ বিষয়ক একটি কবিতা আবৃত্তি করে। সিনথিয়াও বেশ সুন্দর অভিনয় করে সকলকে আনন্দ দিল।
পরদিন সকালে অনেকবেলায় মিসেস ইঙ্গলথর্প বিছানা ছেড়ে উঠলেন। অনেক পরিশ্রম করেছেন। অবশ্য দুপুরে খাওয়ার টেবিলে তিনি যথারীতি হাজির ছিলেন। বিকালে উনি লরেন্স দিল।
আর আমাকে নিয়ে একটি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বেরোলেন। গাড়িতে যেতে যেতে অনেক কথা বললেন।
ওখানে বেশ ভালোই কাটল। ফিরে আসার সময় লরেন্স ট্যাডমিনস্টার ঘুরে যাওয়ার কথা বলল। মিসেস ইঙ্গলথর্প আপত্তি করলেন না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। লরেন্সের ইচ্ছা সিনথিয়াকে অবাক করে দেবে। হাসপাতালে পৌঁছতে দারোয়ান আমাদের ঢুকতে দিল না, কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখতে লাগল, শেষ পর্যন্ত সিনথিয়াই আমাদের উদ্ধার করল।
সাদা পোশাকে সিনথিয়াকে চমৎকার লাগছিল। সিনথিয়া আমাদের তার ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে ওর সহকারিণী নিবসের সঙ্গে পরিচয় হল।
ঘোট ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলে ফেললাম কত বোতল এখানে। জানতে চাইলাম সব বোতলে যা আছে সেগুলোর নাম সে জানে কিনা। সিনথিয়া আক্ষেপের সুরে বলল সকলের মত আমিও তাকে শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন করলাম। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিলাম।
সিনথিয়া আমাদের চা খাওয়াল, আমরা তাকে কাপ ডিসগুলো ধুয়ে রাখতে সাহায্য করলাম। সিনথিয়া সেগুলো গুছিয়ে রাখল। এমন সময় কেউ দরজায় টোকা মারল। সিনথিয়া আর তার বান্ধবীর মুখের ভাব পাল্টে গেল।
অতি সাধারণ দেখতে একজন নার্স ঘরে ঢুকলো। নার্সটির হাতে একটি বোতল ছিল, সে বোতলটা নিবসের দিকে এগিয়ে দিতেই নিবস সিনথিয়াকে দেখিয়ে দিল। সিনথিয়া দেখলাম বেশ রেগে গেছে। নার্সকে এক ধমক দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল জিনিষটা আনতে এত দেরি হল কেন। এটা তো সকালে আসার কথা ছিল। নার্সটি বলল তার ভুল হয়ে গেছে। জিনিষটা রাত্রেই লাগবে বলে জানাল। সিনথিয়া বলল পরের দিন সকালবেলার আগে হবে না। নার্সটি এবার চলে গেল।
সিনথিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাক থেকে একটা বড় বোতল নিয়ে ঐ বোতলে কিছু ঢাললো, তারপর দরজার বাইরে রেখে দিল।
সিনথিয়ার কাজ দেখে হেসে বললাম তাহলে সে খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণা।
এরপর সিনথিয়ার সঙ্গে বারান্দায় গেলাম, অন্য ঘরগুলোেও সে আমাকে দেখাল। লরেন্স তখন ঘরেই বসেছিল। পরে সিনথিয়ার ডাকে বাইরে এল। সিনথিয়া এবার ঘড়ি দেখে নিবসকে ঘরগুলো বন্ধ করে চলে যেতে বলল।
এবার আমাদেরও ফেরার পালা। গাড়ি করে গ্রামের দিকে রওনা হতেই হঠাৎ আমার কিছু ডাক টিকিট কেনার কথা মনে হওয়ায় ডাকঘরের সামনে গাড়ি থামানো হল।
টিকিট কিনে ফিরে আসার সময় খুব মজার একটা ব্যাপার ঘটল। একজনের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগল, অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি ক্ষমা চাইলাম। আর তখনই চিৎকার করে লোকটা আমাকে জড়িয়ে ধরল। পোয়ারোকে এখানে এভাবে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ঘোড়ার গাড়ির কাছে পোয়ারোকে সিনথিয়ার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গেলাম।
সিনথিয়া জানাল পোয়ারো তার অতি পরিচিত। তবে একথা সে জানত না যে পোয়ারো আমার বন্ধু।
পোয়ারোও বলল সে সিনথিয়াকে চেনে। এরপর আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে জানাল মিসেস ইঙ্গলথর্পের দয়াতেই সে এখানে রয়েছে।
পোয়ারো এক আশ্চর্য মানুষ। ওর উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। মানুষটি ছোটখাটো হলেও ওকে ঘিরে রয়েছে এক আশ্চর্য সম্ভ্রমবোধ। পোয়ারোর মাথাটি একেবারে ডিম্বাকৃতি, তাও আবার একপাশে একটু হেলে থাকে। সৈনিকদের মত গোঁফ জোড়াটি সর্বদাই খাড়া থাকে। সে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকত।
এতদিন পরে পোয়ারোকে দেখে আমার খুবই কষ্ট হল। আগে কী ছিল আর এখন কি হয়ে গেছে। দেখলাম ও বেশ খুঁড়িয়ে চলছে। একসময় বেলজিয়ান পুলিশের এক নামজাদা লোক ছিল সে আর গোয়েন্দা হিসাবে তুখোড়–কত যে রহস্যের কিনারা রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
যেতে যেতে পোয়ারো একটা ছোট্ট বাড়ি দেখিয়ে বলল সেখানেই অন্য বেলজিয়ানদের সঙ্গে এখন পোয়ারো বাস করছে।
পোয়ারোকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম। যেতে যেতে পোয়ারোর বিভিন্ন কীর্তির গল্প শোনালাম ওদের।
খুশি মনেই আমরা বাড়ি ফিরলাম। বড় হলঘরটাতে ঢুকতেই দেখলাম মিসেস ইঙ্গলথর্প তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন–তাঁকে বেশ অস্থির মনে হল। সিনথিয়া জানতে চাইল কিছু হয়েছে কিনা। মিসেস ইঙ্গলথর্প রাগত স্বরেই বললেন কিছু হয়নি।
মিসেস ইঙ্গলথর্প নিজের ঘরে চলে খেলেন। আমারও মনে একটু খটকা লাগল। লরেন্স, বাড়ির বাইরে চলে গেল।
খাওয়া দাওয়ার আগে সিনথিয়াকে এক হাত টেনিস খেলতে ডাকলাম। সে রাজী হলে আমি র্যাকেট আনার জন্য ওপরে ছুটলাম।
সিঁড়িতে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার মনে হল যেন উনি খুব চিন্তিত। তবু বেশ হাল্কাভাবেই জিজ্ঞাসা করলাম তিনি ডঃ বরস্টিনের সঙ্গে কেমন বেড়ালেন? মেরী জানালেন তিনি যাননি। মিসেস ইঙ্গলথর্প কোথায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম তিনি তাঁর ঘরেই আছেন।
সিঁড়ির রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরলেন মেরী–তারপর কোনো কথা না বলে হলঘর পার হয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
টেনিস র্যাকেটটা নিয়ে আসার সময় হলঘর পেরিয়ে ওই ঘরের পাশে দাঁড়াতেই শুনতে পেলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিসের গলা, তিনি শ্বাশুড়ীকে বলছেন সেই জিনিষটা কি তিনি তাকে দেখাবেন না। মিসেস ইঙ্গলথর্পের উত্তরও শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন মেরী যা ভাবছেন তার সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই।
মেরী এবার তিক্ত কণ্ঠে বললেন তিনি জানতেন যে তার শ্বাশুড়ী তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।
সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে এলাম। সিনথিয়ার সঙ্গে দেখা হতে সে জানাল বাড়িতে দারুণ ঝগড়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কার সাথে কার ঝগড়া হয়েছে।
সিনথিয়া বলল পরিচারিকা ডরকাসের কাছে সে শুনেছে মিসেস ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে তার স্বামীর ঝগড়া হয়েছে।
আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল রেইকসের জিপসী চেহারা আর ইভি হাওয়ার্ডের সাবধান বাণী।
রাত্রে খেতে আসার সময় মিঃ ইঙ্গলথর্পকে বসার ঘরে দেখলাম চুপচাপ বসে আছেন। সকলের শেষে মিসেস ইঙ্গলথর্প খেতে এলেন। তাকে খুবই উত্তেজিত মনে হল। সবাই নিঃশব্দে খেতে লাগল।
খাওয়া শেষ হতেই মিসেস ইঙ্গলথর্প তার নিজের ঘরে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় মেরীকে ওঁর ঘরে কফি পাঠিয়ে দিতে বললেন।
সিনথিয়ার সঙ্গে বসবার ঘরে গিয়ে জানলার পাশে বসলাম। মেরী ক্যাভেণ্ডিস সকলের জন্য কফি নিয়ে এলেন, তিনি সিনথিয়াকে মিসেস ইঙ্গলথর্পের কফিটা দিয়ে আসতে বললেন।
মিঃ ইঙ্গলথর্প বলে উঠলেন তিনিই তার স্ত্রীর জন্য কফি নিয়ে যাবেন, একথা বলে কফি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সময়টা বেশ কাটছিল।
কিন্তু একটা পরিচিত অথচ বিরক্তিকর কণ্ঠস্বর শুনে ভীষণ রাগ হল। ডাঃ বরস্টিন এসে উপস্থিত হয়েছেন। ডাক্তারের আগমনে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের কোনো ভাবান্তর না দেখে অবাক হলাম।
মিঃ ইঙ্গলথর্প ডাক্তারকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এলেন। ডাক্তার লাজুক হাসি হেসে বললেন তার পোশাকটি ঘরে ঢোকার জন্য একেবারে উপযুক্ত নয়। সত্যি তাকিয়ে দেখলাম সারা পোশাকে শুধু কাদা মাখানো।
মেরী ডাক্তারকে প্রশ্ন করল তিনি কি করছিলেন। এরকম অবস্থা হল কিভাবে। ডাক্তার মৃদু হেসে লজ্জিত স্বরে বললেন কিভাবে তিনি একটা দুষ্প্রাপ্য ফার্ণ গাছ খুঁজতে গিয়ে অসাবধানবশত একটা পুকুরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন।
সেই সময় হঠাৎ মিসেস ইঙ্গলথর্প সিনথিয়াকে ডাকলেন। সিনথিয়া ডাক শুনে উঠে গেল। আমিও উঠে পড়লাম।
সন্ধ্যাবেলাটা ভালোভাবে কাটাব ভেবেছিলাম। ডাঃ বরস্টিন এসে পড়ায় সব মাটি হয়ে গেল। ভদ্রলোক অবশ্য খুব বেশিক্ষণ থাকলেন না।
মিঃ ইঙ্গলথর্পপও ডাক্তারের সঙ্গে গেলেন, জমিদারীর একটা হিসাবের ব্যাপারে কোনো এক দালালের সঙ্গে তাকে দেখা করতে হবে বলে জানালেন। তিনি এও বললেন ল্যাচকিটা তিনি নিয়ে যাচ্ছেন, সুতরাং আর কাউকে তার জন্য জেগে অপেক্ষা করতে হবে না।