ফগ জানতেন তার এই বাজি নিয়ে বিলেতে রীতিমত একটা হৈ-চৈ পড়ে যাবে। হলোও তাই। এই অদ্ভুত বাজির কথা যখন খবরের কাগজে বেরুলো, তখন সারা ইংল্যাণ্ড আর আয়ারল্যাণ্ডে একটা তুমুল শোরগোল পড়ে গেলো। যে শুনলো, সেই নানান রকম যুক্তি-তর্ক দিয়ে এই দুঃসাহসিক পর্যটনের পরিণাম আলোচনা করতে লাগলো। কেউকেউ বললে, ফগ নিশ্চয়ই সফল হবেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকেই বললে, এমন অসম্ভব ব্যাপার কখনো সম্ভব হবে না—ফগের পরাজয় সুনিশ্চিত। অনেকে আবার বললে, এ ফগের পাগলামি ছাড়া আর-কিছু না। টাইমস, স্ট্যাণ্ডার্ড, মনিংক্রনিকল ইত্যাদি খান-কুড়ি পত্র-পত্রিকা জানালে যে, এ-রকমটা ককখনো হবে না, ফিলিয়াস ফগের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। শুধু ডেইলি টেলিগ্রাফ ফিলিয়াস ফগের পক্ষ নিলে। অনেকে বললে; ফিলিয়াস ফগ একটা বদ্ধপাগল। আর রিফর্ম ক্লাবের সভ্যরাও ডাহাউন্মাদ। মাথাখারাপ না-হলে কি কেউ কখনও এমনতর অসম্ভব ব্যাপারে বাজি ধরে? কেউ-কেউ তো বললে, ফিলিয়াস ফগ বলেই কেউ নেই, ও-সব কাগজওলাদের কাটতি বাড়াবার চাল।
ইলাসট্রেটেড লণ্ডন নিউজে যখন ফিলিয়াস ফগের ছবি বেরুলো, তখন কেউকেউ এবং অনেক মহিলা ফগকে সমর্থন করলেন। কেউ-কেউ এ-কথাও বললেন, দুনিয়ায় কত আশ্চর্য ব্যাপারই তো ঘটছে, তাহলে আর এমনটা হতে বাধা কোথায়?
সাতুই অক্টোবর রয়্যাল জিয়োগ্রাফিক্যাল সোসাইটির পত্রিকায় একটা বিরাট প্রবন্ধ বেরুলো। প্রবন্ধলেখক বিরাট এক ফিরিস্তি দিয়ে উপসংহারে জানালেন যে, আশিদিনে পৃথিবী-পরিক্রমার ব্যাপারটা এক উম্মাদ ছাড়া আর-কারু পক্ষে ভাবাও সম্ভব নয়। প্রবন্ধটি বিলেতের সকল কাগজেই পুনর্মুদ্রিত হলো। আগে এই ব্যাপারে লোকে যে-সব বাজি ধরেছিলো, এই প্রবন্ধে ফিলিয়াসের নিশ্চিত পরাজয় জেনে প্রায় সকলেই সেই বাজি প্রত্যাহার করলো। সপ্তাহখানেক যেতে-না-যেতেই ফগের দল একান্ত দুর্বল হয়ে পড়লো।
এমন সময় স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের বোকর্তা নিচের টেলিগ্রামটা পেলেন :
ব্যাংকের নোট-চোর ফিলিয়াস ফগের খোঁজ পেয়েছি। ওকে বম্বাইয়ে গ্রেপ্তার করার জন্যে পরোয়ানা চাই।–ডিটেকটিভ ফিক্স।
এই টেলিগ্রামের খবরও ছড়িয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দেরি হলো না। মুহূর্তমধ্যে ফিলিয়াস ফগ ঘৃণ্য ব্যাংক-দস্যু বলে পরিচিত হয়ে পড়লেন। রিফর্ম ক্লাবের সভ্যদের ছবির মধ্যে ফিলিয়াস ফগের যে-ছবি ছিলো, লোকে উৎসুক হয়ে সেই ছবির সঙ্গে দস্যুর চেহারা মিলিয়ে সমস্বরে বলে উঠলো : এ-কী! ফিলিয়াস ফগ তবে দস্যু! সর্বনাশ! লোকটা কী চালাক! কেউ-কেউ বললে : ফিলিয়াস ফগ যে একটা দস্যু এতো আগেই জানতুম। দস্যু না-হলে কি কেউ এমন একলা থাকে—ত্রিসংসারে কারু সঙ্গে মেলামেশা করে না। অনেকে বললে : অবাক কাণ্ড! ফিলিয়াস ফগ যে এত ভয়ানক লোক তা তো জানতুম না! যেই ব্যাংকের টাকাটা হাতে পড়েছে, অমনি পৃথিবী পরিভ্রমণের একটা ছুতো করে সটকে পড়েছে, যাতে পুলিশ তার আর কোনো খোঁজ না-পায়! ওঃ! কী সাংঘাতিক!
বরাত বলে যে একটা-কিছু রহস্যময় ব্যাপার আছে তা লোকের সঙ্গে-সঙ্গেই থাকে। ফিলিয়াস ফগের অদৃষ্টও নিশ্চয়ই তার সঙ্গে-সঙ্গেই ছিলো, মিস্টার ফি ডিটেকটিভের বরাতও তাঁর কাছ-ছাড়া হয়নি। তবু দুজনের বরাত যে এমনিভাবে জড়িয়েমড়িয়ে জট পাকিয়ে পড়বে, তা আগে কে জানতো?
পি. অ্যাণ্ড ও. কম্পানির যতগুলো জাহাজ ছিলো, তার মধ্যে মংগোলিয়াই সবচেয়ে দ্রুত চলতে পারতো! নয়ই অক্টোবর বুধবার সুয়েজ-বন্দরে মংগোলিয়া জাহাজের পৌঁছুবার কথা বলে জাহাজের প্রতীক্ষ্ণয় জাহাজ-ঘাট লোকে লোকারণ্য হয়েছে। সকলের মুখেই এককথা : ঐ এলো। ঐ এলো!
জাহাজের জন্যে অপেক্ষা করতে-করতে শ্রান্ত হয়ে দুই ভদ্রলোক সেই ভিড় ঠেলে জেটির ধারে পায়চারি করছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন সুয়েজের ইংরেজ কন্সাল। অন্যজন একটু বেঁটেখাটো ও শীর্ণ দেখতে—তবে মুখে-চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। কীসের যেন একটা চিন্তা ভদ্রলোককে এতই অধীর করেছিলো যে কিছুতেই একটুও সুস্থির হতে পারছিলেন না। এঁরই নাম মিস্টার ফিক্স, ডিটেকটিভ, ব্যাংক-দস্যুকে ধরবার জন্যে পোর্টসুয়েজে এঁকেই প্যঠানো হয়েছিলো।
ব্যাকুল আগ্রহে মংগোলিয়া জাহাজের জন্যে অপেক্ষা করতে-করতে ফিক্স কন্সালকে বললেন : আপনি তাহলে বলতে চান, মংগোলিয়ার কখনও দেরি হয় না?
না, কখনও দেরি হয় না। মংগোলিয়া কাল পোর্ট-সয়ীদ ছেড়েছে। অত-বড়ো একটা জাহাজের কাছে সুয়েজ ক্যানাল আর কতটুকু পথ? ঠিক সময়ের আগে পৌঁছুলে গবর্মেন্ট প্রত্যেকবার চারশো টাকা পুরস্কার দিয়ে থাকেন। আমি তো জানি মংগোলিয়াই বরাবর সে-টাকা পেয়ে এসেছে।
মংগোলিয়া কি বরাবর ব্রিন্দিসি থেকে আসে?
হ্যাঁ। ভারতবর্ষের ডাক ব্রিলিসিতেই জাহাজে ওঠে। শনিবার বিকেল পাঁচটায় জাহাজ ছেড়েছে-এই এলো বলে। অত ব্যাকুল হবার কী আছে? আপনি অত ব্যস্ত হবেন না। আচ্ছা, ব্যাংক-দস্যু যদি সত্যি-সত্যিই জাহাজে থাকে, আপনি দস্যুর চেহারার যেবর্ণনা পেয়েছেন, তা থেকেই তাকে চিনে নিতে পারবেন? ও-রকম কোনো ধূর্ত দস্যুকে কি অত সহজে শনাক্ত করা যাবে? আমার তো তা মনে হয় না
চেহারা কি আমার মনই তাকে চিনিয়ে দেবে। চোখে না-দেখেও যেমন কখনোকখনো গায়ের গন্ধে মানুষ চেনা যায়, এ-ও ঠিক তেমনি। হাজার-হাজার চোর দেখেছি আমি। যদি এই জাহাজে সে এসে থাকে তবে আমায় সে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারবে না।
উঃ! কী সাংঘাতিক চুরি! ঈশ্বর করুন, আপনি যেন চোরকে ধরতে পারেন।
সাংঘাতিক বলে সাংঘাতিক! এমন চুরি ক-টা হয়? ভাবুন দেখি, নগদ সাড়েআট লাখ টাকা! এ কি যেমন-তেমন কথা! যদি ধরতে পারি, পুরস্কারও পাবো অঢেল। এমন সুযোগ জীবনে আসে ক-বার? আজকাল যে কেমন হয়েছে, এমন জাহাবাজ চোর বড়ো-একটা দেখতে পাওয়া যায় না। আজকাল শুধু গোটাকতক ছিচকে চোর আর পুঁচকে চুরিই জ্বালিয়ে খাচ্ছে আমাদের।
বড় উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন আপনি। আপনি যদি ধরতে পারেন, তবে তো ভালোই হয়। কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে কাজটা অত সহজ হবে না। আপনি যার চেহারার বর্ণনা পেয়েছেন তিনি হয়তো নেহাৎই নিরীহ একজন নির্বিরোধী নির্দোষ ভদ্রলোক।
বড়ো-বড়ো চোরদের বাইরে থেকে দেখতে নিরীহ ভদ্রলোকই লাগে। ডাকাতের মতো চেহারা যার, সে কি আর সাহস করে চুরি করতে পারে? চেহারা দেখেই যে লোকে আগেভাগেই তাকে সন্দেহ করবে। ভণ্ড সাধুতার মুখোশ খুলে ফেলাই আমাদের কাজ-আর গোয়েন্দার কাজের সত্যিকার বাহাদুরি তো তাতেই!
জেটির উপর ভিড় তখন বেড়েই চলছিলো।
দিনটাও ছিলো সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন। পূবদিক থেকে সমুদ্রের সোঁদা-গন্ধ-মাখা হাওয়া বইছিলো ধীরে-ধীরে।
জেটির ঘড়িতে সাড়ে-দশটা বেজে গেলো।
ব্যগ্র হয়ে উঠলেন ফিক্স। না, এ-জাহাজ আজ আর আসবে না দেখছি!
কন্সাল বললেন : উঁহু, ভাববেন না। আর বেশি দেরি নেই।
সুয়েজে কতক্ষণের জন্য নোঙর করবে?
ঘণ্টা-চারেকের জন্যে। এখানেই কয়লা তোলে জাহাজে। সুয়েজ থেকে এডেন তেরোশো দশ মাইল দূরে। বুঝতেই তো পারছেন, কত কয়লা লাগে।
সুয়েজ থেকেই বুঝি সরাসরি বম্বাই যায়?
হ্যাঁ, একদম বম্বাই। পথে আর-কোথাও দাঁড়ায় না।
তা-ই তো! ডাকাতটা যদি এই পথেই মংগোলিয়া জাহাজে এসে থাকে, তবে ইংরেজ-পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার মৎলবে সুয়েজেই নামবে। তারপর এখান থেকে দিনেমার কি ফরাশিদের কোনো-একটা কাছাকাছি উপনিবেশে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ভারতবর্ষ তো ইংরেজের অধীন-সেখানে গেলে যে তার কোনো সুবিধে হবে না, তা সে বেশ ভালো করেই জানে।
লোকটা যে অত চালাক, আমার তা মনে হয় না। চালাক হলে আসবে কেন অ্যান্দুর? লণ্ডনেই তো লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে সহজ। অত বিরাট শহরে কে তাকে খুঁজে বার করবে? খড়ের গাদায় কি আর ছুঁচ খুঁজে পাওয়া যায়? এই কথা বলে কন্সাল গোয়েন্দাবাহাদুর ফিক্সের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন। তার কথায় ফিক্সের চিন্তা আরো বেড়ে উঠলো।
একটু বাদেই ঘন-ঘন সিটি শোনা গেলো। যে যেখানে ছিলো সবাই দ্রুতপায়ে ছুটলো জেটির দিকে। তীরের নৌকাগুলো সঙ্গে-সঙ্গে নোঙর তুলে বাঁধন খুলে মংগোলিয়ার দিকে এগুলো। ঠিক এগারোটার সময় মংগোলিয়া নির্দিষ্ট জায়গায় নোঙর ফেলে চোঙ দিয়ে হুঁশ-হুঁশ করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো।
অনেক যাত্রী ছিলো জাহাজে। কেউ-কেউ জাহাজের ডেক থেকেই চারদিকের দৃশ্য দেখতে লাগলো, কেউ-বা নৌকোয় চড়ে এলো তীরে। ফিক্স খুব সাবধানে প্রত্যেক আরোহীকে দেখতে লাগলেন। ব্যাংকদস্যুর সন্ধানে তিনি যখন খুবই শশব্যস্ত, তখন একজন যাত্রী ভিড় ঠেলে তার কাছে এসে তাকেই শুধোলেন, মশায়, বলতে পারেন ইংরেজ সরকারের কন্সাল আপিশটা কোথায়? কথা বলতে-বলতে আগন্তুক একটা পাসপোর্ট বার করে বললেন, আমি এই পাসপোর্টে কন্সলের সই নিতে চাই।
ফিক্স পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পড়লেন। অমনি কেঁপে উঠলো তার হাত। কী তাজ্জব ব্যাপার! এ-যে সেই দস্যুরই পাসপোর্ট! এতে যার ছবি রয়েছে, দস্যুরও ছবি যে ঠিক তেমনি। ফিক্স আগন্তুকের দিকে তাকালেন। বললেন : এ তো তোমার পাসপোর্টে নয়!
না, এটা আমার মনিবের।
তিনি কোথায়?
জাহাজে আছেন।
তাকেই কাল আপিশে যেতে হবে, তুমি গেলে চলবে না।
আপিশটা কোথায়?
সামনের একটা বাড়ি দেখিয়ে ফিক্স বললেন : ঐ সামনের মোড়টায়-ঐ-যে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছো, ঐটেই।
তাহলে আমি যাই, তাকেই আনি-গে। এই বলে আগন্তুক ফের জাহাজে প্রত্যাবর্তন করলো।
ফিল্ম আর বিন্দুমাত্র দেরি না-করে কন্সলের কাছে গিয়ে বললেন, আপনাকে বিরক্ত করতে হলো বলে মাপ করবেন। নোট-চোর যে মংগোলিয়াতেই আছে, আমি তার বিশেষ প্রমাণ পেয়েছি। এই বলে যা-যা ঘটেছে, সব বিস্তারিতভাবে খুলে বললেন।
সব শুনে কন্সাল বললেন : তাহলে সে এখানেই আসছে? কিন্তু সত্যিই যদি সে চোর হয় তাহলে সে কখনও এখানে আসবে না।
যদি তার ঘটে একটুও বুদ্ধি থাকে, তাহলে সে নিশ্চয়ই আসবে এখানে। তার ঐ পাসপোের্টটা পাঁচজনকে দেখাতে নাকি?
হ্যাঁ। চোর-ডাকাতের পালানোর পথ নিষ্কণ্টক করা, আর ভালো মানুষকে খামকা ঝাটে ফেলা—এ ছাড়া পাসপোর্টের আর-কোনো দরকার আছে নাকি? এর পাসপোর্টটা যে ঠিকই আছে, কোনো জাল পাসপোর্ট নয় তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তবু আশা করি, আপনি ওতে সই করবেন না।
কেন? পাসপোর্টে গোলমাল না-থাকলে তো আমাকে সই করতেই হবে।
তা হোক, কিন্তু যতক্ষণ না লগুন থেকে ওয়ারেন্ট পাচ্ছি ততক্ষণ তো দস্যুকে এখানে আটকে রাখতে হবে।
সে হলো আপনার কাজ, আপনি তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আমার—কন্সলের কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় করাঘাত হলো। ভৃত্য এসে দুজন অপরিচিত লোককে সেখানে পৌঁছে দিয়ে প্রস্থান করলে। এঁদের একজন একটা পাসপোর্ট নিয়ে সই করাবার জন্যে কালের হাতে তুলে দিলেন। কন্সল পাসপোর্টটা ভালো করে পরীক্ষা করতে লাগলেন আর ফিক্স নারবে বসে আগন্তুকের আপাদ-মস্তক খুব ভালো করে দেখতে লাগলেন। পাসপোর্ট দেখে কন্সাল শুধোলেন : আপনার নামই ফিলিয়াস ফগ?
হ্যাঁ।
এই লোকটা কি আপনারই সঙ্গে চলেছে? আপনার ভৃত্য?
হ্যাঁ। ওর বাড়ি ফ্রানসে। নাম জাঁ পাসপার্তু।
আপনি লন্ডন থেকে আসছেন? যাবেন কোথায়?
হ্যাঁ, লণ্ডন থেকেই আসছি। যাবো বম্বাই। আমি যে এখানে এসেছি, আপনার সই নিয়ে তার প্রমাণ রাখতে চাই।
এরপর কল আর-কোনো দ্বিরুক্তি না-করে পাসপোর্টে স্বাক্ষর করলেন। ফগ তার ফি চুকিয়ে দিয়ে অভিবাদন করে পাসপার্তুকে নিয়ে প্রস্থান করলেন।
ব্যগ্রকণ্ঠে ফিক্স শুধোলেন : এখন আপনার কী মনে হয়?
চেহারাছিরি দেখে ভদ্রলোককে তো নেহাৎ ভালোমানুষ বলেই মনে হলো।
হতে পারে। কিন্তু সে-কথা হচ্ছে না। ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে দর চেহারা কি হুবহু মিলে যাচ্ছে না?
তা অবশ্য মিলছে, তবে সবসময় চেহারার বর্ণনা
বাধা দিয়ে ফিক্স বললেন : সে আমি দেখে নিচ্ছি। ভৃত্যের কাছে ঘেঁসতে অসুবিধে বিশেষ হবে না। লোকটা যখন ফরাশি, তখন কিছুতেই নিশ্চয়ই মুখ বুজে থাকতে পারবে না। আচ্ছা, চলি তবে। এক্ষুনি অবশ্য আবার ফিরে আসবো। ফিল্ম তক্ষুনি পাসপার্তুর খোজে বেরুলেন।
কন্সালের আপিশ থেকে বেরিয়ে ফগ সরাসরি জেটিতেই ফিরলেন। পাসপার্তুকে কতগুলো কাজের ভার দিয়ে সোজা ফিরে গেলেন জাহাজে।
ফিলিয়াস ফগের ডায়রিতে দোসরা অক্টোবর থেকে একুশে ডিসেম্বর অব্দি প্রত্যেক দিনের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছিলো। কোন মাসে, কোন তারিখে, কোন বারে, ক-টার সময় তাঁকে পারী, ব্রিন্দিসি, সুয়েজ, বম্বাই প্রভৃতি বড়ো-বড়ো জায়গাগুলোয় পৌঁছুতে হবে, তা লেখা ছিলো। কোনো জায়গায় পৌঁছুতে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কত বেশি বা কত কম সময় লাগলো, তাও তিনি লিখছিলেন। জাহাজে এসে ডায়রি বার করলেন তিনি তাতে লেখা ছিলো : দোসরা অক্টোবর বুধবার রাত্রি পৌনে ন-টার সময় লণ্ডন ত্যাগ, বৃহস্পতিবার ভোর আটটা চল্লিশ মিনিটের সময় পারী। শুক্রবার চৌঠা অক্টোবর ভোর ছ-টা পয়ত্রিশে মার্সে-এর পথে তুরীন শহরে আগমন—এবং সাতটা কুড়িতে তুরীন পবিত্যাগ। শনিবার পাঁচুই অক্টোবর বিকেল চারটেয় ব্রিন্দিসি, বিকেল পাঁচটায় মংগোলিয়া জাহাজে যাত্রা। এবার ফগ লিখলেন : বুধবার নয়ই অক্টোবর বেলা এগারোটায় পোর্ট সুয়েজে আগমন। এ পর্যন্ত আসতে লেগেছে সবমিলিয়ে সাড়ে ছ-দিন।