মাহতাব উদ্দিন সাহেবের দুটা অফিস। একটা মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায়, অন্যটা বাদামতলীতে। তিনি সম্প্রতি ইটের ভাটা বসিয়েছেন। ইট বানানোর এই ব্যবসা খুবই লাভজনক বলে কাছাকাছি নতুন অফিস নিয়েছেন। অফিস বুড়িগঙ্গার পাশে। অফিস ঘরটা দোতলা। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। চারদিকে প্রচুর লোকজন, ভিড়, হৈচৈ এর মধ্যে মাহতাব উদ্দিনের অফিস ঘরটা নির্জন।
মাহতাব সাহেব সময় পেলেই এই অফিসে বিশ্রাম নিতে আসেন।
তিনি যে ঘরে বসেন সেখান থেকে বুড়িগঙ্গা দেখা যায়। পুরনো দিনের ভারি একটা ইজিচেয়ার জানালার কাছাকাছি রাখা আছে। তিনি ইজিচেয়ারে শুয়ে বুড়িগঙ্গায় নৌকা চলাচল দেখেন।
আজও তিনি ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টি অবশ্যি বুড়িগঙ্গার দিকে না। খলিলুল্লাহর দিকে। খলিলুল্লাহকে একটা কাজ দেয়া হয়েছে। নষ্ট টিভি ঠিক করেতে দেয়া হয়েছে। মাহতাব উদ্দিন তাকিয়ে আছেন। তীক্ষ্ণচোখে।
খলিলুল্লাহর হাতে যন্ত্রপাতি বলতে একটা বড় স্কু ড্রাইভার। টিভিটা রাখা হয়েছে টেবিলে। সে কাজ করছে দাঁড়িয়ে। অতি দ্রুত সে টিভির যন্ত্রপাতি খুলে ফেলছে। টেবিল ভর্তি হয়েছে নানান ধরনের স্কুতে। একেক ধরনের স্কু একেক জায়গায় রাখা উচিত। তা সে করছে না। সব এক জায়গায় রেখেছে। কোন স্কু কোথায় বসবে এটা সে মনে রাখবে কী করে কে জানে। এটা নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। এটা তার ব্যাপার।
মাহতাব সাহেব বললেন, খলিলুল্লাহ, টিভি কীভাবে কাজ করে তুমি জানো?
খলিলুল্লাহ বলল, জ্বে না।
একটা যন্ত্র সম্পর্কে তুমি কিছু জানোনা, যন্ত্রটা ঠিক করবে কীভাবে?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না।
টিভিটা ঠিক করতে কতক্ষণ লাগবে?
খলিলুল্লাহ বলল, ঠিক হয়ে গেছে।
মাহতাব সাহেব বললেন, ঠিক হয়ে গেছে।
খলিলুল্লাহ বলল, জ্বে হয়েছে।
এখন কানেকশান দিলে টিভি চলবে?
জ্বে চলবে।
মাহতাব সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, যদি না চলে আমি কানে ধরে তোমাকে একশ বার ওঠবস করা।
খলিলুল্লাহ অবাক হয়ে বলল, আমারে কানে ধইরা উঠবস কেন করাইবেন?
আমার সময় নষ্ট করেছ এই জন্যে। আমার সময়ের দাম আছে। যাই হোক টিভির স্কুগুলো লাগাও। এখানে ডিশের লাইন আছে কানেকশান দাও। তারপর কানে ধরে ওঠবস করার জন্যে তৈরি হয়ে যাও।
জ্বে আইচ্ছা।
আমি পুরস্কার যেমন দিতে পারি, শাস্তিও দিতে পারি। যদি দেখি সত্যি সত্যি টিভি ঠিক হয়েছে তাহলে তোমার জন্যে পুরস্কার আছে।
স্যার, আমার পুরস্কার লাগবে না।
না চাইলেও পুরস্কার দেয়া হবে। শাস্তির ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। শাস্তি না চাইলেও পাবে।
টিভির স্কু লাগানো হয়েছে। খলিলুল্লাহ বলল, কাউরে যন্ত্রটা চালু করতে বলেন।
মাহতাব উদ্দিন বললেন, কাউকে চালু করতে বলতে হবে কেন? তুমি চালু কর। It is your duty.
খলিলুল্লাহ বলল, আমি যন্ত্র চালাইতে পারি না। ফইড় করতে পারি।
মাহতাব উদ্দিনকে কফির মগ এনে দেয়া হয়েছে। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে তিনি টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর বাড়ির কেয়ারটেকার বারেক কানেকশান দিচ্ছে। একটু দূরে মেঝেতে গম্ভীর মুখে বসে আছে খলিলুল্লাহ। তার দৃষ্টি টিভি স্ক্রিনের দিকে না। তার দৃষ্টি তার নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। সে এখনো তার দুআঙুল নাচাচ্ছে।
টিভি-পর্দায় সুন্দর ছবি আসছে। শব্দ আসছে। বারেক কৌতূহলী হয়ে টিভি পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। মাহতাব উদ্দিন তাকিয়ে আছেন খলিলুল্লাহর দিকে। যে নষ্ট টিভিটা ঠিক করেছে তার তো অন্তত একবারের জন্যে হলেও টিভি সেটের দিকে তাকানোর কথা। সে তাকাচ্ছে না। সে মুগ্ধ হয়ে নিজের বুড়ো আঙুলই দেখছে। মাহতাব উদ্দিন বারেকের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, বারেক, তুমি খলিলুল্লাহকে বাসায় নিয়ে যাও। দারোয়ানকে বলে দাও।
সে যেন বাসা থেকে বের হতে না পারে। তাকে ঘরে আটকে রাখো।
বারেক হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
মাহতাব সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, এই টিভি সেটটা কোনো মেকানিকের কাছে নিয়ে যাও। তাকে বলে এখান থেকে কোন আইসি খুলে রাখতে যেন টিভি সেটটা অচল হয়ে যায়। আইসি খুলে রাখার পর সেটটা বাসায় নিয়ে যাবে।
ঠিক আছে স্যার।
কী বলেছি বুঝতে পারছ?
পারছি।
কী বললাম, রিপিট করো।
বারেক বলল, খলিলুল্লাহকে বাসায় নিয়ে যাব। দারোয়ানকে বলব সে যেন বাসা থেকে বের না হতে পারে। টিভি সেটটা মেকানিকের কাছে নিয়ে যাব। মেকানিককে বলব একটা আইসি খুলে রাখতে। নষ্ট টিভিটাও বাসায় নিয়ে যাব।
ঠিক আছে। খলিলুল্লাহকে আমার কাছে পাঠাও।
খলিলুল্লাহ সামনে এসে দাঁড়াল। মাহতাব সাহেব বললেন, তোমাকে পুরস্কার দেব বলেছিলাম। পুরস্কার দিচ্ছি। বারেক তোমাকে দোকানে নিয়ে যাবে। সার্ট, প্যান্ট, স্যান্ডেল কিনে দেবে। নাপিতের দোকানে গিয়ে ভালোমতো চুলদাড়ি কাটবে। এই হলো পুরস্কার। বিড়ি সিগারেট খাও?
জ্বে না।
মাহতাব সাহেব মানিব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করতে করতে বললেন, টাকাটা রাখো। তোমার হাতখরচ। যে কদিন তুমি আমার এখানে থাকবে পাঁচশ টাকা করে প্রতিদিন পাবে। মাটি কেটে দিনে কত করে পেতে?
আশি টাকা রোজ।
আশি টাকা রোজের জায়গায় তুমি পাচ্ছ পাঁচশ টাকা রোজ। এটা ভালো না?
জ্বে।
সাভারে আমার একটা বাগানবাড়ি আছে। সেখানে বড় পুকুর আছে। তোমাকে পুকুরে নামাব। দেখতে চাই তুমি কতক্ষণ পুকুরে ডুবে থাকতে পারো।
জ্বে আইচ্ছা।
চা বিকিট কিছু খাবে?
জ্বে না।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।
খলিলুল্লাহ চলে গিয়েছে। মাহতাব সাহেব একা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। অফিসের প্রচুর কাজ জমে আছে। কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। মাথার ভেতর। খলিলুল্লাহর ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছে। ইলেকট্রনিক্সের কিছুই জানে না একটা লোক ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি ঠিক করে ফেলবে এটা হতে পারে না। অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া একটা মানুষ পানির নিচে শুয়ে থাকবে এটা হতে পারে না। প্রকৃতি মানুষকে সেভাবে বানায় নি। খলিলুল্লাহ মানুষ না, অন্যকিছু। সেই অন্যকিছুটা কী? মানুষ তার সমাজে মানুষের রূপে অন্যকিছু পছন্দ করে না। | এমনকি পাগলদেরকেও তারা চিকিৎসার নাম করে আলাদা সরিয়ে রাখে। খলিলুল্লাহ যদি সেরকম অন্যকিছু হয় তাকেও আলাদা সরিয়ে রাখতে হবে। মানুষের সমাজে তাকে থাকতে দেয়াটা বিরাট বোকামি হবে। এত বড় বোকামি আর যেই করুক তিনি করতে পারেন না। খলিলুল্লাহর ব্যাপারটা কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে ভালো হতো। এমন কেউ যে সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারবে। বেশিরভাগ মানুষ শুরুতেই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে তখন আর সমস্যা হাতের মুঠোয় থাকে না। হাতের মুঠো থেকে বের হয়ে যায়।
মাহতাব সাহেব মোবাইল টেলিফোন হাতে নিলেন। জালালের সঙ্গে কথা বলবেন। তার টেলিফোন নাম্বার মনে নেই, তবে জোগাড় করা সমস্যা হবে না। জালাল খাঁ তার কলেজ-জীবনের বন্ধু। বই পড়া তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তার সকাল শুরু হয় হাতে একটা বই নিয়ে। রাতে যখন ঘুমুতে যায় তখনো হাতে বই থাকে। চাকরি বাকরি নিলে পড়াশোনার সময় কমে যাবে এই যুক্তিতে সে চাকরিই নিল না। অবশ্যি যে পরিমাণ টাকাপয়সা তার বাবা মা তার জন্যে রেখে গেছে তাতে জালাল খাঁর পরের তিন পুরুষেরও কিছু করতে হবে না। এখানেও শুভংকরের ফাঁকি, জালাল বিয়েই করে নি।
তার টেলিফোন নাম্বার পাওয়া গেল। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর তাকে ধরা গেল। মাহতাব বললেন, জালাল, কেমন আছিস?
জালাল শুকনো গলায় বললেন, ভাল।
মাহতাব সাহেব বললেন, কী করছিস?
পড়ছি। আপনাকে চিনতে পারছি না। আপনি কে?
আগে বল কী পড়ছিল, তারপর বলব আমি কে?
ফাইবার অপটিক্সের উপর একটা পপুলার বই।
বইটা কেমন লিখেছে?
মোটামুটি। তথ্য কম, বর্ণনা বেশি। লেখক খুব সহজ ভাষায় জটিল জিনিস বলতে গিয়ে লেজে-গোবরে করে ফেলেছেন। বেশি সহজ হয়ে গেছে। নিউজ পেপারের সায়েন্স আর্টিকেল হয়ে গেছে।
খটমট কিছু না হলে তোর ভালো লাগে না?
তা-না। আমি আপনাকে এখনো চিনতে পারছি না। দয়া করে নামটা বলুন।
মাহতাব।
জালাল খাঁ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ও আচ্ছা, তুই? টুনটুনি কেমন আছে? ও আমাকে একটা জটিল প্ৰশ্ন করেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম বই দেখে প্রশ্নের উত্তর দেব। বাসায় এসে প্রশ্নটা ভুলে গেছি। টুনটুনিকে একটু জিজ্ঞেস করতো প্রশ্নটা কী?
তাকে জিজ্ঞেস করতে পারব না, সে আশেপাশে নেই। আমি অফিস থেকে টেলিফোন করছি। তুই কি আজ সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসতে পারবি?
কেন?
অদ্ভুত এক হিউম্যান স্পেসিমেন দেখবি।
সব হিউম্যান স্পেসিমেনই তো অদ্ভুত।
এ একটু বেশি অদ্ভুত। সে নষ্ট কলকবজা ফইড় করতে পারে।
মানে কী?
যে-কোনো ইলেকট্রনিক্সের জিনিস ঠিক করতে পারে।
সে তাহলে ভালো একজন ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ার। এতে অদ্ভুতের কী আছে!
তার কোনো ডিগ্রি নেই।
এটাও কোনো ব্যাপার না। নিজে নিজে পড়াশোনা করে মানুষ অনেকদূর উঠতে পারে।
সে পড়াশোনাও জানে না।
অনেক ভালো মিস্ত্ৰি আছে পড়াশোনা জানে না।
জালাল শোন, আমি যার কথা বলছি সে মাটিকাটা শ্ৰমিক। তার হাতে যেকোনো জটিল যন্ত্র দিলে সে কীভাবে কীভাবে সেটা ঠিক করে ফেলে। শোনা কথা না। আমার নিজের দেখা। তার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। সে কোনোর ওস্তাদের সঙ্গে কখনো এ্যাসিসটেন্ট হিসেবে কাজ করে নি। তার সঙ্গে কোনো এমিটার, ভোল্টামিটার নেই। সে কাজ করে তার দুটা হাত দিয়ে।
তা কী করে হবে?
আমিও বলছি—তা কী করে হবে। কিন্তু হচ্ছে। সমস্যাটা এইখানেই। তোর সামনে আমি পরীক্ষাটা করতে চাই। তোর সামনে আমি একটা নষ্ট টিভি সারাতে দেব।
নষ্ট টিভি সারানোর দরকার কী? আমি এক কাজ করি, বেশকিছু আইসি নিয়ে আসি, তার মধ্যে একটা আইসির লজিক গেট থাকবে নষ্ট। সে আইসিগুলি হাতে নিয়ে বলুক কোনটা নষ্ট।
তুই যেটা ভালো বুঝিস। আমি ঠিক সন্ধাবেলা ততকে নিয়ে যেতে গাড়ি পাঠাব।
গাড়ি পাঠাতে হবে না।
অবশ্যই পাঠাতে হবে। গাড়ি না পাঠালে তুই ভুলে যাবি।
মাহতাব সাহেব ইজিচেয়ার ছেড়ে টেবিলের কাছে চলে এলেন। হাবীবুর রহমানকে আরেকটা চিঠি পাঠাতে হবে। আজ দিনে দিনে লোক মারফত চিঠি পাঠিয়ে দিতে হবে। যে চিঠি নিয়ে যাবে সে-ই উত্তর নিয়ে আসবে। দেরি করা যাবে না। মাহতাব সাহেব নিজের ভেতর চাপা অস্থিরতা অনুভব করছেন। মনে হচ্ছে প্রেসার বেড়েছে। ডাক্তার ডেকে প্রেসার ছাপানো দরকার। তিনি বেল টিপে ডাক্তারকে খবর দিতে বললেন। ডাক্তার আসতে আসতে দ্রুত চিঠি লিখে ফেললেন।
জনাব হাবীবুর রহমান সাহেব,
আপনি লিখেছেন আপনার বড় বৌমা খলিলুল্লাহ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানে। আমি নিজে আপনার বড় বৌমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।
আপনি চিকিৎসার জন্যে যে-কোনো সময় ঢাকা আসতে পারেন। বাকি ব্যবস্থা আমি করে দেব।
বিনীত
মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী
যা ভেবেছিলেন তাই। প্রেসার বেড়েছে ১৩০/১০০। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন।
মাহতাব সাহেব বললেন, না।
বিলাক্সেন ট্যাবলেট খেয়ে রেস্ট নিন।
মাহতাব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আমি রেস্টেই আছি।