ও ঘরে নয়। মামাকে দেখতে এসেছেন তো আপনি?
সমর কতকটা বোকার মতই যেন ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়, হ্যাঁ—
চলুন ঐ ঘরে।
কোন মানুষের কণ্ঠস্বর এতখানি কর্কশ, চাপা ও অস্বাভাবিক হতে পারে সমরের যেন ধারণারও। অতীত ছিল।
অবাক বিস্ময়ে তখনও সমর লোকটির দিকে তাকিয়ে ছিল।
লোকটার পরিধানে পায়জামা ও গায়ে একটা কালো রঙের ভারী গ্রেট কোট।
আশ্চর্য! অমন রোগা লোকটা অতবড় একটা ভারী গ্রেট কোট কেমন করে গায়ে দিয়ে আছে।
আপনি–কি যেন বলবার চেষ্টা করে সমর।
লোকটি পূর্ববৎ কর্কশ গলায় বলে, আমি রায়বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর ভাগ্নে। আমার নাম শকুনি ঘোষ।
শকুনি ঘোষ! বিস্মিত হতভম্ব সমর পাল্টা প্রশ্নটা যেন নিজের অজ্ঞাতেই উচ্চারণ করে ফেলে।
হা হা করে লোকটা বিশ্রী কুৎসিত ভাবে একটা চাপা হাসি হেসে ওঠে। মনে হয় যেন করাত দিয়ে কেউ কাঠ চিরছে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দে।
আজ্ঞে, মাতুল দুর্যোধনের ভাগিনেয় শকুনি। কেন, মহাভারত পড়েননি? নামটা আবার আমার ঐ মামারই দেওয়া। চলুন–
আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে এবারে সমর অগ্রসর হয় শকুনিকে অনুসরণ করে, একেবারে বারান্দার শেষ প্রান্তের বদ্ধ দরজাটা ঠেলে খুলতে কতকটা জড়িত চাপা কণ্ঠের একটা চিৎকার সমরের কানে এসে প্রবেশ করল, সম্পত্তি ভোগ করবে! আমার এত কষ্টের সম্পত্তি শালারা বারো ভূতে লুটে খাবে! একটি আধলা পয়সাও নয়। কোন শালাকে একটা কানাকড়িও দেব না।
সমর তখন শকুনির নীরব চোখের ইঙ্গিতে কক্ষের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
বড় আকারের হলঘরের মত বেশ প্রশস্ত একখানা ঘর।
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি কালো রঙের একটা ভারী পর্দা ঝুলছিল অনেকটা পার্টিশনের মত।
পর্দার ওপাশ থেকে নীলাভ আলোর একটা দ্যুতির চাপা ইশারা পাওয়া যায়। পর্দার ওপাশ থেকেই কণ্ঠস্বরটা শোনা যায় বেশ স্পষ্ট এতক্ষণে। আর একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডাঃ সেন ঘরের চারদিকে তাকায়। পর্দার এপাশে একটি বেশ বড় সাইজের গোলাকার টেবিলের চারপাশে খানপাঁচেক চেয়ার ও গোটা দুই সোফা, একটা সেলফ-সেলফের তিনটি তাকে নানাবিধ ওষুধপত্রের ছোট-বড় নানা আকারের শিশি, রোগীর খাবার ও ফিডিং কাপ, স্প্রে, ড়ুস-কেনিউলা প্রভৃতি সাজানো রয়েছে।
এবং ডাঃ সেনের নজরে পড়ে ঘরের দুটি সোফা অধিকার করে পাশাপাশি দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন নিঃশব্দে। আর তাঁদের সামনে একজন দাঁড়িয়ে।
তাঁদের মধ্যে একজন মনে হয় মধ্যবয়সীই হবেন, প্যান্ট ও সাট পরিধানে, গলায় স্টেথোটি জড়ানো, উনি যে একজন চিকিৎসক বোঝা গেল। দ্বিতীয় ব্যক্তি অল্পবয়সী, তেইশ-চব্বিশের মধ্যে, পরিধানে তার ধুতি ও গায়ে একটি শাল জড়ানো।
তৃতীয় যে দাঁড়িয়ে, তার বয়স চৌত্রিশ-পয়ত্রিশের মধ্যে হবে। মাথার চুল ব্যাক-ব্রাস করা, সযত্নে।
বেশ উঁচু লম্বা চেহারা এবং অতি সুশ্রী। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। ভদ্রলোকের পরিধানে ধুতি ও শেরওয়ানী।
শেরওয়ানীর বোতামগুলি খোলা। দণ্ডায়মান ব্যক্তির নজরই ঘরে প্রবেশ করবার পর সর্বপ্রথম সমর ও শকুনির উপরে পড়ল। এবং কেউ কিছু বলবার আগে শকুনিই বলে তার সেই বিশ্রী গলায়, ডক্টর সেন। উপবিষ্ট দুজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ান বোধ হয় ডাক্তারকে অভ্যর্থনা জানাতেই। আর ঠিক ঐ সময়ে পর্দার ওপাশ থেকে আবার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
অত্যন্ত বিরক্তিপূর্ণ চাপা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর : শালারা ভাবছে আমি কিছু বুঝি না! আমায় slow poison করছে, টের পাচ্ছি না, না? সব—সব জানি। সব বুঝতে পারছি, পুলিশ সাহেব মিঃ দালালকে চিঠি দিয়েছি। Conspiracy—বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছে—সব জানিয়েছি তাকে।
কতকটা স্তম্ভিত হয়েই যেন ডাঃ সেন সেই কথাগুলো শুনছিল, হঠাৎ অন্য একটি কণ্ঠস্বরে ডাঃ সেন সামনের দিকে তাকায়। প্যান্ট-কোট পরিহিত ভদ্রলোকটি এগিয়ে এলেন এবং মৃদু মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, আসুন ডাঃ সেন। এবং পরক্ষণেই ঘরের মধ্যে উপস্থিত প্রথম ভদ্রলোকটির দিকে নির্দেশ করে বললেন, ইনি ডাঃ সানিয়াল, দাদার attending physician.
উভয়ে উভয়কে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার জানায়।
ওপাশে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তখন আবার নীরব হয়ে গিয়েছে।
আপনি attending physician, অন্য কোন বড় ডাক্তার রায়বাহাদুরকে দেখেছেন কি?
সমরের কথায় মৃদু হাসির ক্ষীণ একটা আভাস ডাঃ সানিয়ালের ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দিয়েই আবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
তারপর বলেন, বলুন বরং কে রায়বাহাদুরকে আজ পর্যন্ত দেখেননি! কলকাতার হেন বড় ডাক্তার নেই ওঁকে একাধিকবার এসে দেখে যাননি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। রায়বাহাদুরের একটা ডাক্তার ফোবিয়া আছে বলতে পারেন; এক বছর ধরে এক প্রকার শয্যাগত হয়ে আছেন। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত অ্যানজাইনার সাতটা অ্যাটাক হয়েছে–
বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষে তাকাল সমর ডাঃ সানিয়ালের মুখের দিকে এবং বলে, বলেন কি?
হ্যাঁ, ডাঃ সানিয়াল বলেন, রায়বাহাদুরের একটা নয়, দশটা নাকি হার্ট আছে। শুধু কি তাই ডাঃ সেন, ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কোঠায়। আটবার ডবল নিউমোনিয়ার অ্যাটাক, সাতবার অ্যাকিউট ব্যাসিলারী ডিসেন্ট্রি, তিনবার পারনিসা ম্যালেরিয়া ও দুবার টাইফয়েডে ভুগেছেন। এবারের অ্যাটাকটা হার্ট অ্যাটাক থেকে শুরু হয়, বর্তমানে এক বৎসর শয্যাশায়ী। এখন জেনারেল অ্যানাসারকা উইথ কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর।
হুঁ। তা আমি ওঁকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি—
বেডসোর থেকে গ্যাংগ্রিন হতে চলেছে তাই আপনাকে ডাকা হয়েছে—
ও–কথাটা উচ্চারণ করে সমর চুপ করে যায়।
বুঝতে পারে না ঐজন্য এত রাত্রে এই ভাবে তাকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনবার এমন কি জরুরী প্রয়োজন ছিল।
সমর ভাবছিল, শুধু এই বাড়িটা, তার আবহাওয়া ও এখানকার বাসিন্দারাই বিচিত্র নয়, এ-বাড়ির সব কিছুই যেন কেমন বিচিত্র। কোথাও স্বাভাবিকতার যেন লেশমাত্র নেই। শুধু বিচিত্র হলেও বুঝি কথা ছিল, সেই বৈচিত্রের মধ্যে যেন একটা রহস্যের ইঙ্গিত।
ঢং করে রাত্রি আড়াইটে ঘোষণা করে ঘরের দেওয়ালে বসানো একটি ওয়াল-ক্লক ঐ সময়।
এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার পর্দার ওপাশ থেকে শোনা গেল সেই পূর্ব কণ্ঠস্বরডাক এল, ডাক্তার!
কণ্ঠস্বরে পূর্বের মতই বিরক্তি।
ডাঃ সানিয়াল হন্তদন্ত হয়ে যেন পর্দার ওপাশে চলে গেলেন।
ওপাশের কথাবাতা স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল। ডাঃ সেন কান পেতে থাকে।
আমাকে ডাকছিলেন রায়বাহাদুর?
কি কর? তুমি-তুমিও ঐ ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছ নাকি?
আজ্ঞে–
সব টের পাই। শকুনিও আছে, সে বেটাও ষড়যন্ত্র করছে। তাড়াও। তাড়াও দুঃশাসনকে তাড়াও। জান না he is dangerous
ডাক্তার সানিয়াল বোধ হয় রায়বাহাদুরের কথার কোন জবাব দিলেন না, পার্শ্ববতী নার্সকে সম্বোধন করে বললেন, নার্স, ঘুমের ওষুধটা দিয়েছিলেন?
সঙ্গে সঙ্গে রোগীর তীব্র-তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ শোনা গেল, না না—ঘুম পাড়িয়ে তোমরা সকলে মিলে আমাকে খুন করতে চাও। আমি কিছু বুঝি না বটে, না!! Get out বের হয়ে যাও সব এখান থেকে, দূর হও। খাব না, ঘুমের ওষুধ খাব না।
ডাঃ সানিয়ালের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, ডাঃ বর্ধন আজ ফোনে বলেছেন ঐ ওষুধটা দিতে
একটা আর্ত যন্ত্রণাকাতর শব্দ শোনা গেল।
পরক্ষণেই আবার শোনা গেল রায়বাহাদুরের কণ্ঠস্বর : বলুক, আমি খাব না—কিন্তু যা বলেছিলাম তা করা হয়েছে? ডাঃ সেনকে কল দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, তিনি এসেছেন—
কোথায়? ডাক-ডাক তাকে—
ডাঃ সেন এবারে নিজেই পর্দার দিকে এগিয়ে যায়।
প্রকাণ্ড একটা পালঙ্কের উপরে রবারের গদি ও ব্যারেস্টের সাহায্যে রোগীকে উঁচু করে শয্যার উপরে শোয়ানো আছে।
এক কোণে ত্রিপয়ের ওপর নীল কাঁচের ডোমে ঢাকা স্বল্পশক্তির একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে, বাতির নীলাভ আলোয় শয্যার উপরে শায়িত রোগী রায়বাহাদুর দুর্যোধন চৌধুরীর দিকে তাকাল সমর। প্রকাণ্ড উপাধানের উপরে সবঙ্গ সাদা চাদরে আচ্ছাদিত রায়বাহাদুর শুয়ে আছেন। কেবলমাত্র রোগীর মুখখানা দেখা যায় আর সব ঢাকা।
নিরাশা, ক্রোধ, বিরক্তি, বেদনা ও বিতৃষ্ণা সব কিছু যেন একসঙ্গে ফুটে উঠেছে বলিরেখাঙ্কিত রোগীর সেই মুখের ওপরে। হাড় ও চর্মসার মুখখানা, মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা।
সমস্ত হাড়সর্বস্ব মুখখানির মধ্যে দীর্ঘ উন্নত নাসিকা যেন উদ্ধত একটা প্রশ্নের মত জেগে আছে।
চক্ষুর পাতা দুটি মুদ্রিত। পাশে দাঁড়িয়ে ডাঃ সানিয়াল ও মাথার সামনে ওষুধের গ্লাস হাতে স্থিরনির্বাক দাঁড়িয়ে তখনও একটি অল্পবয়সী অত্যন্ত সুশ্রী ক্রিশ্চান বাঙালী নার্স।
ডাঃ সেন এসেছেন—
কথাটা ডাঃ সানিয়াল রায়বাহাদুরকে জানালেন।
চক্ষু মুদ্রিত অবস্থাতেই রায়বাহাদুর প্রশ্ন করেন, কোথায়?
সমর আরও একটু এগিয়ে গিয়ে একেবারে রোগীর শয্যার সামনে দাঁড়াল।
রায়বাহাদুর চোখ খুললেন এবং পূর্ণ দৃষ্টিতে সমরের দিকে তাকালেন।
ডাক্তার সেন? You are Dr. Sen
হ্যাঁ।
কিন্তু you are too late! আর মাত্র দেড় ঘণ্টা সময় আছে।
সমর রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে কেমন যেন বোকার মত। রায়বাহাদুরের চোখ ততক্ষণে আবার মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে।
তোমরা! You? All of youসাক্ষী থাকবে, ওরা আমায় রাত ঢারটের সময় হত্যা করেছে। কিরীটী—কিরীটীবাবু কই? তাঁকে যে এত করে আমি ডেকে নিয়ে এলাম, তিনি যদি কাছাকাছি না থাকেন তো বুঝবেন কি করে—আমার হত্যারহস্য মীমাংসা করবেন কি করে! ডাক-নার্স—মিঃ রায়কে ডাক–
নার্স বোধ হয় রায়বাহাদুরের আদেশ পালনের জন্যই পর্দার ওপাশে চলে গেল।
আপনার হাতটা একটিবার দেখতে পারি কি?
ডাঃ সমর সেন সামনের দিকে একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করে।
পালস দেখবেন? কিন্তু কি হবে দেখে? পালস্ ঠিকই আছে—তাছাড়া যাকে আর দেড় ঘণ্টা বাদে হত্যা করা হবে তার পালস্ দেখে কি বুঝবেন? Not a natural death. Not a case of heart failure.পালস্ দেখে কি সে-মৃত্যুকে আপনি ঠেকাতে পারবেন?
কি করে জানলেন যে আর দেড় ঘণ্টার মধ্যে কেউ আপনাকে হত্যা করবে?
ভাবছেন প্রলাপ বকছি, না হয় পাগল হয়ে গেছি, না ডাঃ সেন? শুধু আপনি কেন, সকলেই তাই ভাবছেন, কিন্তু দেখবেন, এখুনি দেখবেন। দেখতে পাবেন আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয় কিনা। দেড় ঘণ্টা আর কতটুকু সময়–
সমর ওষুধের গ্লাসটা, একটু আগে যেটি নার্স কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার সময় সামনের টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিল সেটা তুলে নিয়ে বলে, এই ঘুমের ওষুধটা খান তো। আপনার একান্তভাবে এখন ঘুমনো দরকার—একটু ঘুমতো পারলে নিশ্চয়ই সুস্থ বোধ করবেন। জেগে জেগে আপনি যত দুঃস্বপ্ন দেখছেন।
কি বললেন, দুঃস্বপ্ন-আমি জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখছি? হুঁ, দুঃস্বপ্নই বটে। দেখছি গত এক বৎসর ধরে। But it is as true as anything, একটু পরেই আপনারা জানতে পারবেন গত এক বৎসর ধরে যে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর কথাটা আমার কাছে প্রকট হয়ে উঠছে সেটা সত্য—it is coming,—আসছে মৃত্যু, আসছে, ঘুম হবে না জানি আমি কোন ওষুধেই আর ঘুম হবে না, তবু যখন বলছেন দিন কি ওষুধ খেতে হবে। সত্যিই আমি ঘুমোত চাই। Deep, sound sleep
সমর রায়বাহাদুরকে ওষুধটা খাইয়ে দিল।
নার্সের সঙ্গে সঙ্গে এমন সময় কিরীটী রায় এসে পর্দার পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল।
কে?
আমি কিরীটী, রায়বাহাদুর।
সমর চোখ তুলে আগন্তুকের দিকে তাকায়। কিরীটীর পরিধানে শ্লিপিং পায়জামা ও কিমোনো। দেখলেই বোঝা যায় সদ্য সে শয্যা থেকে বোধ করি উঠে এসেছে।
কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?
এই ঘরেই তো ছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলেন, না? এমনি করে ঘুমোলেই আপনি আমার হত্যা-রহস্যের কিনারা করেছেন আর কি! সময় যে ঘনিয়ে এল সেদিকে খেয়াল আছে?
কিরীটী মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয়, সে তো আপনার হিসেবমত রাত চারটেয়। এখনও এক ঘণ্টার ওপরে সময় আছে।
আর সময় আছে!
তাছাড়া আপনাকে তো বলেছি, আমি একবার এসে যখন উপস্থিত হয়েছি, প্রাণ থাকতে আপনার আর কোন বিপদ যাতে না ঘটে সেই চেষ্টাই করব।
করুন। যত পারেন চেষ্টা করুন কিন্তু বাধা দিতে পারবেন না এও আমি জানি।
ঢং ঢং ঢং!…
রাত্রি তিনটে ঘোষিত হয় ওয়াল-ক্লকে।
রায়বাহাদুর আবার বলেন, আর এক ঘণ্টা–
আপনি এবারে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন দেখি রায়বাহাদুর!
কথাটা বলে কিরীটী।
রায়বাহাদুর চোখ বুজে ছিলেন, কিরীটীর কথার কোন জবাব দিলেন না।
ঘুমোবেন না বললে কি হবে—দু-চার মিনিটের মধ্যেই রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছেন ওষুধের প্রভাবে, বোঝা গেল তাঁর মৃদু নাসিকাধ্বনিতে।
রায়বাহাদুর ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝতে পেরে কিরীটী সকলকে চোখের ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলে।
একমাত্র নার্স বাদে বাকি তিনজনে বাইরে চলে আসে।
পদার এদিকে এসে ওরা দেখে একমাত্র দুঃশাসন চৌধুরী ভিন্ন বাকি দুজন—শকুনি ঘোষ ও অন্য ভদ্রলোকটি ঐ সময় সেখানে উপস্থিত নেই।
ডাঃ সানিয়াল কিরীটী ও ডাঃ সমর সেনকে লক্ষ্য করে বলেন, চলুন আমার ঘরে, আপনাদের সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
সকলে রোগীর ঘর থেকে বের হয়ে একেবারে লাগোয়া পাশ্ববতী কক্ষের দ্বার ঠেলে ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করে।
ছোট্ট একখানি ঘর, রোগীর ঘরের সঙ্গে মধ্যবর্তী একটি দ্বারপথে যোগাযোগ আছে।
একটি লোহার খাটে সাধারণ একটি শয্যা বিস্তৃত। ঘরের কোণে একটি আলনায় কয়েকটি জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে ঝুলনো। একটি ছোট্ট টেবিল। একধারে ছোট একটি নেয়ারের খাটে শয্যা বিছানো। খানকতক বই ও খাতাপত্র টেবিলের উপরে বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো। খাটের নীচে একটি চামড়ার সুটকেস্।
ইলেকট্রিক স্টোভে একটা অ্যালুমিনিয়ামের কেলীতে জল ফুটছিল। খানতিনেক চেয়ারও ঘরে ছিল। বসুন। কফি তৈরি করি একটু, কারও আপত্তি নেই তো-সানিয়াল বলেন। ডাক্তার সেন বা কিরীটী কারোরই আপত্তি ছিল না। দুজনেই তাই জবাব দেয়, বেশ তো! কেলীর জল ফুটে গিয়েছিল।
ডাঃ সমর সেন কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, আপনার সঙ্গে পরিচয় নেই আমার কিরীটীবাবু।
কেটলী থেকে গরম জল একটা কাঁচের টি-পটে ঢেলে কফির গুঁড়া মেশালেন ডাঃ সানিয়াল। সমর সেনের প্রশ্নে তার দিকে চেয়ে বললেন, বলেন কি মশাই, অমন একটা লোকের সঙ্গে আজও পরিচয় হয়নি আপনার?
না। মৃদু হেসে সেন বলেন।
রহস্যভেদী কিরীটী রায়। ডাঃ সানিয়াল জবাব দিলেন।
আপনাকেও উনি বুঝি ডেকে এনেছেন? সমর প্রশ্ন করেন।
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, হ্যাঁ। শুনলেন না, রায়বাহাদুরের বদ্ধ ধারণা হয়ে গেছে যে তাঁকে হত্যা করবার জন্য তাঁর চারপাশে একটা প্রকাণ্ড ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে এবং আজ রাত্রেই তাঁর মৃত্যু অবধারিত!
হঠাৎ এমন ধারণা হল কেন তাঁর?
ঠিক যে হঠাৎ হয়েছে বললে ভুলই বলা হবে ডাঃ সেন, কিরীটী বলে, তবে–
ইতিমধ্যে ডাক্তার সানিয়াল কফি তৈরী করে কিরীটী ও ডাঃ সেনকে দুকাপ দিয়ে, নিজেও এক কাপ কফি নিয়ে বসলেন।
ডাঃ সানিয়াল কফিতে এক চুমুক দিয়ে ডাঃ সেনের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, রায়বাহাদুরকে দেখে আপনার কি মনে হল ডাঃ সেন?
মনে হল যেন একটা illusion-এ ভুগছেন, কিন্তু কতদিন থেকে এরকম হয়েছে? ডাঃ সেন বললেন।
দিন সাতেক হবে। দিন সাতেক আগে থেকেই ঐ কথাটা প্রায় বলছেন, আজকের তারিখে রাত চারটের সময় নাকি উনি নিহত হবেন।
এর আগে কখনও এ ধরণের কথা বলেননি?
না। আমি তো প্রায় মাস আষ্টেক হল এখানে আছি attending physician হয়ে—
I see—তা, আর ঐ যে সব ষড়যন্ত্রের কথা কি বলছিলেন? এবারে প্রশ্নটা করে সমর সেনই।
আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন, হঠাৎ এরকম ধারণা ওঁর হল কেন কিছু বলতে পারেন ডাঃ সানিয়াল?
কিরীটী এবার প্রশ্ন করল।
না। বরং আমি তো দেখতে পাচ্ছি রায়বাহাদুরের আত্মীয়স্বজনেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সর্বদা কি ভাবে ওঁকে একটু সুস্থ ও নিশ্চিন্ত রাখতে পারবেন। এ ধরণের সন্দেহ যে কি করে আসে–
ডাঃ সেন এবারে বলে, আমার কি মনে হচ্ছে জানেন, অভিশাপ—এটা একটা অর্থের, অভিশাপ ডাঃ সানিয়াল। অর্থ জিনিসটাই এমন যে না থাকলেও শান্তি নেই, আবার থাকলেও শান্তি নেই। শাঁখের করাত, এগুতেও কাটে পিছুতেও কাটে।
কিরীটী কথাটা শুনে মৃদু হাসে।
নিঃশেষিত কফির পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে কিমোনোর পকেট থেকে একটা সিগার বের করে দেশলাই সহযোগে অগ্নিসংযোগ করল কিরীটী।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধূমপান করবার পর কিরীটী বলে, গত দশ বৎসর থেকে রায়বাহাদুরকে চিনি। A self-made man. প্রথম জীবনে কুলি রিক্রুটিং থেকে শুরু করে ক্রমে নিজের অসাধারণ চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন। সাত-সাতটা কোল মাইনসূয়ের প্রোপাইটর হয়েছেন।
বলেন কি! ডাঃ সেন বলেন।
হ্যাঁ সত্যিই বিচিত্র মানুষটা, শুধু যে উপায়ই করেছেন তা নয়—রায়বাহাদুর শুনেছি জীবনে দানধ্যানও করেছেন প্রচুর। কথাটা বললেন ডাঃ সানিয়াল।
উঁ আমিও শুনেছি, বহু প্রতিষ্ঠানে ওঁর বহু দান আছে। জবাব দিল কিরীটী।
ডাঃ সমর সেন ও আসরে যেন নির্বাক শ্রোতা। অবাক বিস্ময়ে বিচিত্র অদ্ভুত রায়বাহাদুরের কাহিনী শুনছিল।
দরজার গায়ে এমন সময় সহসা মৃদু করাঘাত শুনতে পাওয়া গেল।
কে? ডাঃ সানিয়ালই প্রশ্ন করলেন এবং এগিয়ে গিয়ে দ্বার খুলে দিলেন।
ঘরে প্রবেশ করলেন রায়বাহাদুরের ভাই দুঃশাসন চৌধুরী।
এবং কক্ষের মধ্যে উপবিষ্ট কিরীটী ও ডাঃ সমর সেনকে লক্ষ্য না করেই ডাঃ সানিয়ালকে বলেন, ডাক্তার, আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিতে পার? কিছুতেই ঘুমোতে পারছি না। ঘুম আসছে না। এ আর তো পারি না—এক মাস হল, আর কত না ঘুমিয়ে কাটাব–
এখানে তো আমি কোন ওষুধ রাখি না মিঃ চৌধুরী। ও-ঘরে অনেক রকমের ঘুমের ওষুধ আছে। আমার নাম করে নার্সের কাছে চান গিয়ে, সে দেবেখন।
ওসব সাধারণ বারবিউটন গ্রুপ অফ ড্রাগসূয়ে আমার কিছু হবে না। সব খেয়ে দেখেছি। বরং যদি আমাকে একটু মরফিয়া injection করে দাও হাফ গ্রেন
মরফিয়া! বিস্মিত ডাঃ সানিয়াল যেন কতকটা আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করেন।
হ্যাঁ, মরফিয়া। আচ্ছা থাক, আজও যা হোক একটা কিছু খেয়েই দেখিবলতে বলতে দুঃশাসন চৌধুরী প্রস্থান করলেন।
ওঁরা আবার গল্প শুরু করলেন।
.
আরও আধ ঘণ্টাটাক পরে।
সহসা কতকটা যেন ঝড়ের বেগেই বৃদ্ধগোছের একটি ভৃত্য ঘরের দরজার সামনে এসে উদ্বেগাকুল কণ্ঠে বলে ওঠে, ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু! শীগগিরি আসুন! কর্তাবাবুকর্তাবাবু
কিরীটী ততক্ষণে চেয়ার থেকে কতকটা যেন লাফিয়েই উঠে ছুটে দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
কি — হয়েছে কতবাবুর?
খুন–খুন হয়েছেন কাবাবু!
সে কি! বিস্মিত একটা চিৎকারের মতই যেন কথাটা ডাঃ সানিয়ালের কণ্ঠ হতে নির্গত হয়।
হ্যাঁ, শীগগিরি আসুন।
সকলের আগে কিরীটী যেন ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল এবং তার পশ্চাতে ডাঃ সেন, ডাঃ সানিয়ালও বের হয়ে গেলেন।
রায়বাহাদুরের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। কিরীটী সর্বপ্রথম ঘরের মধ্যে গিয়ে পা দিল এবং ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ওয়াল-ক্লকটা রাত্রি চারটে ঘোষণা করল।
ঢং ঢং ঢং ঢং…
রাত চারটে।
কিরীটীর বুকের ভেতরটা যেন ধক করে ওঠে। তাহলে সত্যিসত্যিই রায়বাহাদুরের নিজের মৃত্যুর ব্যাপারে নিজের ভবিষ্যৎবাণীটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল!
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর কিরীটী কেমন যেন বিহ্বল বিভ্রান্ত ভাবে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন কথাই তার মুখ দিয়ে বের হয় না।