[১৯০০ খ্রীঃ ১ ফ্রেব্রুআরী ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত প্যাসাডেনা ‘সেক্সপীয়র ক্লাবে’ প্রদত্ত বক্তৃতা]
গতকাল আমি রামায়ণ মহাকাব্য সম্বন্ধে আপনাদিগকে কিছু শুনাইয়াছি। অদ্যকার সান্ধ্যসভায় অপর মহাকাব্য ‘মহাভারত’ সম্বন্ধে কিছু বলিব। রাজা দুষ্মন্তের ঔরসে শকুন্তলার গর্ভে রাজা ভরত জন্মগ্রহণ করেন। রাজা ভরত হইতে যে বংশ প্রবর্তিত হয়, মহাভারতে সেই বংশীয় রাজাদের উপাখ্যান আছে। উক্ত ভরত রাজা হইতেই ভারতবর্ষের নাম হইয়াছে, এবং তাঁহার নাম হইতেই এই মহাকাব্যের নাম ‘মহাভারত’ হইয়াছে। মহাভারত শব্দের অর্থ—মহান্ অর্থাৎ গৌরবসম্পন্ন, ভারত অর্থাৎ ভারতবর্ষ; অথবা মহান্ ভারতবংশীয়গণের উপাখ্যান। কুরুদিগের প্রাচীন রাজ্যই এই মহাকাব্যের রঙ্গক্ষেত্র, আর এই উপাখ্যানের ভিত্তি—কুরুপাঞ্চাল মহাসংগ্রাম। অতএব এই বিবাদের সীমাক্ষেত্র খুব বিস্তৃত নহে। এই মহাকাব্য ভারতে সর্বসাধারণের বড়ই আদরের সামগ্রী। হোমারের কাব্য গ্রীকদের উপর যেরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, মহাভারতও ভারতবাসীর উপর সেইরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। কালক্রমে মূল মহাভারতের সহিত অনেক অবান্তর বিষয় সংযোজিত হইতে লাগিল, শেষে উহা প্রায় লক্ষশ্লোকাত্মক এক বিরাট গ্রন্থে পরিণত হইল। কালে কালে মূল মহাভারতে নানাবিধ আখ্যায়িকা, উপাখ্যান, পুরাণ, দার্শনিক নিবন্ধ, ইতিহাস, নানাবিধ বিচার প্রভৃতি বিষয় সংযোজিত হইয়াছে, পরিশেষে উহা এক প্রকাণ্ড গ্রন্থ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কিন্তু এই সমুদয় অবান্তর প্রসঙ্গ থাকিলেও সমুদয় গ্রন্থের ভিতর মূল উপাখ্যানটি অনুস্যূত রহিয়াছে, দেখিতে পাওয়া যায়।
মহাভারতের মূল উপাখ্যানটি ভারত-সাম্রাজ্যের জন্য কৌরব ও পাণ্ডব নামক একবংশজাত জ্ঞাতিগণের মধ্যে যুদ্ধ।
আর্যগণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভারতে আসেন। ক্রমে আর্যগণের এই সকল বিভিন্ন শাখা ভারতের নানাস্থানে ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল। শেষে আর্যগণই ভারতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসনকর্তা হইয়া উঠিলেন। এই সময়ে একই বংশের দুই বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রভুত্বলাভের চেষ্টা হইতেই এই যুদ্ধের উৎপত্তি। আপনাদের মধ্যে যাঁহারা গীতা পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন, এই গ্রন্থের প্রারম্ভেই প্রতিদ্বন্দ্বী দুইটি সৈন্যদলের অধিকৃত যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনা রহিয়াছে। ইহাই মহাভারতের যুদ্ধ।
কুরুবংশীয় মহারাজ বিচিত্রবীর্যের দুই পুত্র ছিলেন—জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র, কনিষ্ঠ পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন। ভারতীয় স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান অনুসারে—অন্ধ, খঞ্জ, বিকলাঙ্গ এবং ক্ষয়রোগ এবং অন্য কোন প্রকার জন্মগত ব্যাধিযুক্ত ব্যক্তি পৈতৃক কোন ধরনের অধিকারী হইতে পারে না, সে কেবল নিজ ভরণপোষণের ব্যয় মাত্র পাইতে পারে। সুতরাং ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠ হইলেও সিংহাসনে আরোহণ করিতে পারিলেন না, পাণ্ডুই রাজা হইলেন।
ধৃতরাষ্ট্রের এক শত পুত্র ছিল এবং পাণ্ডুর মাত্র পাঁচটি। অল্প বয়সে পাণ্ডুর দেহত্যাগ হইলে ধৃতরাষ্ট্রের উপরই রাজ্যভার পড়িল, তিনি পাণ্ডুর পুত্রগণকে নিজের পুত্রগণের সহিত লালন-পালন করিতে লাগিলেন। পুত্রগণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে মহাধনুর্ধর বিপ্র দ্রোণাচার্যের উপর তাঁহাদের শিক্ষার ভার অর্পিত হইল; দ্রোণাচার্যের নিকট তাঁহারা ক্ষত্রিয়োচিত নানাবিধ অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত হইলেন। রাজপুত্রগণের শিক্ষা সমাপ্ত হইলে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। যুধিষ্ঠিরের ধর্মপরায়ণতা ও বহুবিধ গুণগ্রাম এবং তাঁহারা ভ্রাতৃচতুষ্টয়ের শৌর্যবীর্য ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি অপরিসীম ভক্তিদর্শনে অন্ধ রাজার পুত্রগণের হৃদয়ে বিষম ঈর্ষার উদয় হইল এবং তাঁহাদের জ্যেষ্ঠ দুর্যোধনের চাতুরীতে এক ধর্মমহোৎসব-দর্শনের ছলে পঞ্চপাণ্ডব বারণাবত নগরে প্রেরিত হইলেন। তথায় দুর্যোধনের উপদেশানুসারে তাঁহাদের জন্য শণ, জতু, লাক্ষা, ঘৃত, তৈল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ দ্বারা এক প্রাসাদ নির্মিত হইয়াছিল। সেই জতুগৃহে তাঁহাদের বাসস্থান নির্দিষ্ট হইল। সেখানে তাঁহারা কিছুকাল বাস করিলে পর সেই গৃহে এক রাত্রে গোপনে অগ্নি প্রদত্ত হইল। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা ধর্মাত্মা বিদুর—দুর্যোধন ও তাঁহার অনুচরবর্গের এই দুরভিসন্ধির বিষয় পূর্বেই অবগত হইয়া, পাণ্ডবগণকে এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন; সুতরাং তাঁহারা সকলের অজ্ঞাতসারে প্রজ্বলিত জতুগৃহ হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হইলেন। কৌরবগণ যখন সংবাদ পাইলেন যে, জতুগৃহ দগ্ধ হইয়া ভস্মে পরিণত হইয়াছে, তখন তাঁহারা পরম আনন্দিত হইলেন; ভাবিলেন, এত দিনে আমরা নিষ্কণ্টক হইলাম, এখন আমাদের সকল বাধাবিঘ্ন দূরীভূত হইল। তখন ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ রাজ্যভার গ্রহণ করিলেন।
জতুগৃহ হইতে বহির্গত হইয়া পঞ্চপাণ্ডব জননী কুন্তীর সহিত বনে বনে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে লাগিলেন। গভীর অরণ্যমধ্যে তাঁহাদিগকে অনেক দুঃখকষ্ট, দৈবদুর্বিপাক সহ্য করিতে হইল, কিন্তু তাঁহারা শৌর্যবীর্য ও সহিষ্ণুতাবলে সর্ববিধ বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইলেন। এইরূপে কিছুকাল অতিবাহিত হইলে শুনিতে পাইলেন, শীঘ্র নিকটবর্তী পাঞ্চাল দেশের রাজকন্যার স্বয়ম্বর হইবে।
আমি গত রাত্রে এই স্বয়ম্বরপ্রথার বিষয়ে একবার১ উল্লেখ করিয়াছি। কোন রাজকন্যার স্বয়ম্বরের সময় চতুর্দিক হইতে নানা দেশের রাজপুত্রগণ স্বয়ম্বর-সভায় আহূত হইতেন। এই সকল সমবেত রাজকুমারদের মধ্য হইতে রাজকুমারীকে ইচ্ছামত বর মনোনীত করিতে হইত। ভাট রাজপরিচারকগণ মাল্যহস্তে রাজকুমারীর অগ্রে অগ্রে যাইয়া প্রত্যেক রাজকুমারের সিংহাসনের নিকট গিয়া তাঁহার নাম ধাম বংশমর্যাদা শৌর্যবীর্যের বিষয় উল্লেখ করিত। রাজকন্যা এইসব রাজপুত্রদের মধ্যে যাঁহাকে পতিরূপে মনোনীত করিতেন, তাঁহারই গলদেশে ঐ বরমাল্য অর্পণ করিতেন। তখন মহাসমারোহে পরিণয়-ক্রিয়া সম্পন্ন হইত। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ একজন প্রবল-পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন। তাঁহার কন্যা দ্রৌপদীর রূপগুণের খ্যাতি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। পাণ্ডবেরা শুনিলেন, সেই দ্রৌপদীই স্বয়ম্বরা হইবেন।
স্বয়ম্বরে প্রায়ই রাজকুমারীর পাণিপ্রার্থীকে সাধারণতঃ কোন প্রকার শৌর্যবীর্যের পরিচয়, অস্ত্রশিক্ষার কৌশলাদি দেখাইতে হইত। দ্রুপদরাজ স্বয়ম্বর-সভায় তদীয় কন্যার পাণিগ্রহণার্থিগণের বলপরীক্ষার এইরূপ আয়োজন করিয়াছিলেনঃ অতি ঊর্ধ্বদেশে আকাশে এক কৃত্রিম মৎস লক্ষ্যরূপে স্থাপিত হইয়াছিল, তাহার নিম্নদেশে সতত ঘূর্ণমান মধ্যভাগে ছিদ্রযুক্ত একটি চক্র স্থাপিত ছিল, আর নিম্নে একটি জলপাত্র। জলপাত্রে মৎসের প্রতিবিম্ব দেখিয়া চক্রছিদ্রের মধ্য দিয়া বাণদ্বারা মৎস্যের চক্ষু যিনি বিঁধিতে পারিবেন, তিনিই রাজকুমারীকে লাভ করিবেন। এই স্বয়ম্বর-সভায় ভারতের বিভিন্ন স্থান হইতে রাজা ও রাজকুমারগণ সমবেত হইয়াছিলেন। সকলেই রাজকুমারীর পাণিগ্রহণের জন্য সমুৎসুক, সকলেই লক্ষ্য বিদ্ধ করিবার জন্য প্রাণপণে যত্ন করিলেন, কিন্তু কেহই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না।
আপনারা সকলেই ভারতের বর্ণচতুষ্টয়ের বিষয়ে অবগত আছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণ— ব্রাহ্মণ, পুত্রপৌত্রাদিক্রমে পৌরোহিত্য বা যাজনাদি তাঁহাদের কার্য; ব্রাহ্মণের নীচে ক্ষত্রিয়—রাজা ও যোদ্ধাগণ এই ক্ষত্রিয়বর্ণের অন্তর্ভুক্ত; তৃতীয়—বৈশ্য অর্থাৎ ব্যবসায়ী; চতুর্থ—শূদ্র বা সেবক। অবশ্য এই রাজকুমারী ক্ষত্রিয়বর্ণভুক্তা ছিলেন।
যখন রাজপুত্রগণ একের পর এক চেষ্টা করিয়া কেহ লক্ষ্য ভেদ করিতে পারিলেন না, তখন দ্রুপদ রাজপুত্র সভামধ্যে উঠিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘ক্ষত্রিয়েরা লক্ষ্য বিদ্ধ করিতে অকৃতকার্য হইয়াছেন, এক্ষণে অন্য ত্রিবর্ণের মধ্যে যে কেহ লক্ষ্য বিদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতে পারেন; ব্রাহ্মণই হউন, বৈশ্যই হউন, এমন কি শূদ্রই হউন, যিনি লক্ষ্য বিদ্ধ করিবেন, তিনিই দ্রৌপদীকে লাভ করিবেন।’
ব্রাহ্মণগণমধ্যে পঞ্চপাণ্ডব সমাসীন ছিলেন, তন্মধ্যে অর্জুনই পরম ধনুর্ধর। দ্রুপদপুত্রের পূর্বোক্ত আহ্বান-শ্রবণে তিনি উঠিয়া লক্ষ্য বিঁধিবার জন্য অগ্রসর হইলেন। ব্রাহ্মণজাতি সাধারণতঃ অতি শান্তপ্রকৃতি ও কিঞ্চিৎ নম্রস্বভাব। শাস্ত্রবিধানানুসারে তাঁহাদের কোন অস্ত্রশস্ত্র স্পর্শ করা বা সাহসের কর্ম করা নিষিদ্ধ। ধ্যান, ধারণা, স্বাধ্যায় ও আত্মসংযমে সতত নিযুক্ত থাকাই তাঁহাদের শাস্ত্রসঙ্গত ধর্ম। অতএব তাঁহারা কিরূপ শান্তপ্রকৃতি ও শান্তিপ্রিয়, ভাবিয়া দেখুন। ব্রাহ্মণেরা যখন দেখিলেন, তাঁহাদের মধ্যে একজন উঠিয়া লক্ষ্য বিদ্ধ করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছেন, তখন তাঁহারা ভাবিলেন, এই ব্যক্তির আচরণে ক্ষত্রিয়গণ ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাদের সকলকে সমূলে ধ্বংস করিয়া ফেলিবেন। এই ভাবিয়া তাঁহারা ছদ্মবেশী অর্জুনকে তাঁহার চেষ্টা হইতে নিবৃত্ত করিতে প্রয়াস পাইলেন, কিন্তু তিনি ক্ষত্রিয়, অতএব তাঁহাদের কথায় নিবৃত্ত হইলেন না। তিনি অবলীলাক্রমে ধনু তুলিয়া উহাতে জ্যা রোপণ করিলেন। পরে ধনু আকর্ষণ করিয়া অনায়াসে চক্রছিদ্রের মধ্য দিয়া বাণ ক্ষেপণ করিয়া লক্ষ্যবস্তু—মৎসটির চক্ষু বিদ্ধ করিলেন।
তখন সভাস্থলে তুমুল আনন্দধ্বনি হইতে লাগিল। রাজকুমারী দ্রৌপদী অর্জুনের নিকট অগ্রসর হইয়া তদীয় গলদেশে মনোহর বরমাল্য অর্পণ করিলেন। কিন্তু এদিকে রাজগণের মধ্যে তুমুল কোলাহল হইতে লাগিল। এই মহতী সভায় সমবেত রাজা ও রাজকুমারগণকে অতিক্রম করিয়া একজন ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কুলসম্ভূতা পরমাসুন্দরী রাজকুমারীকে লইয়া যাইবে, এ চিন্তাও তাঁহাদের অসহ্য হইয়া উঠিল। তাঁহারা অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিয়া বলপূর্বক তাঁহার নিকট হইতে দ্রৌপদীকে কাড়িয়া লইবেন, স্থির করিলেন। পাণ্ডবগণের সহিত রাজাদের তুমুল যুদ্ধ হইল, কিন্তু পাণ্ডবরা কোনমতেই পরাভূত হইলেন না, অবশেষে জয়লাভ করিয়া দ্রৌপদীকে নিজের গৃহে লইয়া গেলেন।
পঞ্চভ্রাতা এক্ষণে রাজকুমারীকে সঙ্গে লইয়া তাঁহাদের বাসস্থানে জননী কুন্তী সমীপে ফিরিয়া আসিলেন। ভিক্ষাই ব্রাহ্মণের উপজীবিকা, সুতরাং ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করাতে তাঁহাদিগকেও বাহিরে গিয়া ভিক্ষাদ্বারা খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করিয়া আনিতে হইত। ভিক্ষালব্ধ বস্তু গৃহে আসিলে কুন্তী উহা তাঁহাদিগকে ভাগ করিয়া দিতেন। পঞ্চভ্রাতা যখন দ্রৌপদীকে লইয়া মাতৃসন্নিধানে উপস্থিত হইলেন, তখন তাঁহারা কৌতুকবশে জননীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘দেখ মা, আজ কেমন মনোহর ভিক্ষা আনিয়াছি।’ কুন্তী না দেখিয়াই বলিলেন, ‘যাহা আনিয়াছ, পাঁচজনে মিলিয়া ভোগ কর।’ এই কথা বলিবার পর যখন রাজকুমারীর দিকে তাঁহার দৃষ্টি নিপতিত হইল, তখন তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘একি! এ আমি কি কথা বলিলাম, এ যে এক কন্যা!’ কিন্তু এখন আর কি হইবে? মাতৃবাক্য লঙ্ঘন করা তো যায় না, মাতৃ-আজ্ঞা অবশ্যই পালন করিতে হইবে। তাঁহাদের জননী জীবনে কখনও মিথ্যা কথা উচ্চারণ করেন নাই, সুতরাং তাঁহার বাক্য কখনই ব্যর্থ হইতে পারে না। এইরূপে দ্রৌপদী পঞ্চভ্রাতার সাধারণ সহধর্মিণী হইলেন।
আপনারা জানেন, সমাজের সামাজিক রীতিনীতির ক্রমবিকাশের বিভিন্ন সোপান আছে। এই মহাকাব্যের ভিতর প্রাচীন ইতিহাসের কিছু কিছু আশ্চর্য আভাস পাওয়া যায়। পঞ্চভ্রাতা মিলিয়া যে এক নারীকে বিবাহ করিয়াছিলেন, মহাভারত-প্রণেতা এই ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু উহাকে কোনরূপ সামাজিক প্রথা বলিয়া নির্দেশ না করিয়া উহার বিশেষ কারণ দেখাইবার চেষ্টা পাইয়াছেন। মাতৃ-আজ্ঞা—তাঁহাদের জননী এই অদ্ভুত পরিণয়ে সম্মতিদান করিয়াছেন—ইত্যাদি নানা যুক্তি দিয়া মহাভারতকার এই ঘটনাটির উপর টীকা করিয়াছেন। কিন্তু আপনাদের জানা আছে, সকল সমাজেই এমন এক অবস্থা ছিল, যখন বহুপতিত্ব অনুমোদিত ছিল—এক পরিবারের সকল ভ্রাতা মিলিয়া এক নারীকে বিবাহ করিত। ইহা সেই অতীত বহুপতিক যুগের একটা পরবর্তী আভাসমাত্র।
যাহা হউক, এদিকে পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে লইয়া প্রস্থান করিলে তাঁহার ভ্রাতার মনে নানাবিধ আন্দোলন হইতে লাগিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন—‘যে পঞ্চ ব্যক্তি আমার ভগিনীকে লইয়া গেল, ইহারা কাহারা! আমার ভগিনী যাহার গলে বরমাল্য অর্পণ করিল, যাহার সহিত তাহার বিবাহ হইবে, সে-ই বা কে! ইহাদের তো অশ্বরথ বা অন্য কোনরূপ ঐশ্বর্যের চিহ্ন দেখিতেছি না। ইহারা তো পদব্রজেই চলিয়া গেল দেখিলাম’’ মনে মনে এই সকল বিতর্ক করিতে করিতে তিনি তাঁহাদের যথার্থ পরিচয় জানিবার জন্য দূরে দূরে থাকিয়া তাঁহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। অবশেষে গোপনে রাত্রে তাঁহাদের কথোপকথন শুনিয়া তাঁহারা যে যথার্থ ক্ষত্রিয়, এ বিষয়ে তাঁহার কোন সংশয় রহিল না। তখন দ্রুপদরাজ তাঁহাদের যথার্থ পরিচয় পাইয়া পরম আনন্দিত হইলেন।
অনেকে প্রথমে এইরূপ বিবাহে ঘোরতর আপত্তি করিলেন বটে, কিন্তু ব্যাসের উপদেশে সকলে বুঝিলেন যে, এক্ষেত্রে এইরূপ বিবাহ দোষাবহ হইতে পারে না। সুতরাং দ্রুপদরাজকেও এইরূপ বিবাহে সম্মত হইতে হইল; রাজকুমারী পঞ্চপাণ্ডবদের সহিত পরিণয়পাশে বদ্ধ হইল।
পরিণয়ের পর পাণ্ডবগণ দ্রুপদগৃহে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করিতে লাগিলেন। দিন দিন তাঁহাদের বলবীর্য বর্ধিত হইতে লাগিল। তাঁহারা জীবিত আছেন, দগ্ধ হন নাই—ক্রমে এই সংবাদ কৌরবগণের নিকট পৌঁছিল। দুর্যোধন ও তাঁহার অনুচরবর্গ পাণ্ডবগণের বিনাশের জন্য নূতন নূতন ষড়যন্ত্র করিতে লাগিলেন, কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরাদি বর্ষীয়ান্ মন্ত্রী ও অমাত্যবর্গের পরামর্শে রাজা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি করিতে সম্মত হইলেন। নিমন্ত্রণ করিয়া তিনি তাঁহাদিগকে হস্তিনাপুরে লইয়া আসিলেন। বহুদিনের পর প্রজাবর্গ পাণ্ডবগণকে দর্শন করিয়া পরমানন্দে মহোৎসব করিতে লাগিল। ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাদিগকে অর্ধরাজ্য প্রদান করিলেন। তখন পঞ্চভ্রাতায় মিলিয়া ইন্দ্রপ্রস্থ নামক মনোহর নগর নির্মাণ করিয়া তথায় রাজধানী স্থাপন করিলেন। তাঁহারা আপনাদের রাজ্য ক্রমে বাড়াইতে লাগিলেন, চতুষ্পার্শস্থ বিভিন্ন প্রদেশের রাজগণকে বশীভূত করিয়া কর প্রদান করিতে বাধ্য করিলেন। অতঃপর সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির নিজেকে ভারতের তদানীন্তন সমস্ত রাজগণের সম্রাটরূপে ঘোষণা করিবার জন্য রাজ্যসূয় যজ্ঞ করিবার সঙ্কল্প করিলেন। এই যজ্ঞে পরাজিত রাজগণকে কর সহ আসিয়া সম্রাটের অধীনতা স্বীকার করিতে হয় ও প্রত্যেককে যজ্ঞোৎসবের এক একটি কার্যভার নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া যজ্ঞকার্যে সাহায্য করিতে হয়। শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবগণের আত্মীয় এবং বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তিনি পাণ্ডবগণের নিকট আসিয়া রাজসূয় যজ্ঞ সম্পাদনে নিজ সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানে একটি বিষম বিঘ্ন ছিল। জরাসন্ধ নামক জনৈক রাজা একশত রাজাকে বলি দিয়া নরমেধ যজ্ঞ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন এবং তদুদ্দেশ্যে ছিয়াশি জন রাজাকে কারাগারে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধকে আক্রমণ করিবার পরামর্শ দিলেন। এই পরামর্শ অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন জরাসন্ধের নিকট যাইয়া তাঁহাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করিলেন। জরাসন্ধও সম্মত হইলেন। চতুর্দশ দিবস ক্রমাগত দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর ভীম জরাসন্ধকে পরাভূত করিলেন। তখন বন্দী রাজগণকে মুক্ত করিয়া দেওয়া হইল।
ইহার পর যুধিষ্ঠিরের কনিষ্ঠ চারি ভ্রাতা সৈন্যসামন্ত লইয়া প্রত্যেকে এক এক দিকে দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইলেন ও সমস্ত রাজন্যবর্গকে যুধিষ্ঠিরের বশে আনয়ন করিলেন। তাঁহারা রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করিয়া জয়লব্ধ অগাধ ধনসম্পত্তি ঐ বিরাট যজ্ঞের ব্যয় নির্বাহের জন্য যুধিষ্ঠিরের নিকট অর্পণ করিলেন।
এইরূপে পাণ্ডবগণ কর্তৃক পরাজিত এবং জরাসন্ধের কারাগার হইতে মুক্ত রাজগণ রাজসূয় যজ্ঞে আসিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্রাট্ বলিয়া স্বীকার করিয়া তাঁহার যথোচিত সম্মান করিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র এবং তৎপুত্রগণও এই যজ্ঞে যোগদান করিবার জন্য নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। যজ্ঞাবসানে যুধিষ্ঠির সম্রাটের মুকুট পরিধান করিলেন এবং ‘রাজচক্রবর্তী’ বলিয়া ঘোষিত হইলেন। এই সময় হইতেই কৌরব ও পাণ্ডবগণের মধ্য নূতন বিরোধের বীজ উপ্ত হইল। পাণ্ডবগণের রাজ্য ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি দুর্যোধনের অসহ্য মনে হইল, সুতরাং তিনি যুধিষ্ঠিরের প্রতি প্রবল ঈর্ষার ভাব লইয়া রাজসূয় যজ্ঞ হইতে ফিরিলেন। এইরূপে ঈর্ষাপরবশ হইয়া তিনি মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন কিরূপে ছলে ও কৌশলে পাণ্ডবগণের সর্বনাশ সাধন করিতে পারেন। কারণ, তিনি জানিতেন বলপূর্বক পাণ্ডবগণকে পরাভূত করা তাঁহার সাধ্যাতীত। রাজা যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত ছিলেন। অতি অশুভ ক্ষণে তিনি চতুর অক্ষবিদ্ ও দুর্যোধনের কুমন্ত্রণাদাতা শকুনির সহিত দ্যূতক্রীড়া করিতে আহূত হইলেন।
প্রাচীন ভারতে এইরূপ নিয়ম ছিল যে, কোন ক্ষত্রিয় যুদ্ধের জন্য আহূত হইলে সর্ববিধ ক্ষতি স্বীকার করিয়াও নিজ মানরক্ষার জন্য তাঁহাকে যুদ্ধ করিতে হইত; এইরূপে দ্যূতক্রীড়ার জন্য আহূত হইয়া ক্রীড়া করিলেই মানরক্ষা হইত; আর ক্রীড়ায় অসম্মত হইলে তাহা অতি অযশস্কর বলিয়া পরিগণিত হইত। মহাভারত বলেন, রাজা যুধিষ্ঠির সর্ববিধ ধর্মের মূর্তিমান্ বিগ্রহ ছিলেন, কিন্তু পূর্বোক্ত কারণে সেই রাজর্ষিকেও দ্যূতক্রীড়ায় সম্মত হইতে হইয়াছিল। শকুনি ও তাহার অনুচরবর্গ কপট পাশা প্রস্তুত করিয়াছিল। তাহাতেই যুধিষ্ঠির যতবার পণ রাখিতে লাগিলেন ততবারই হারিতে লাগিলেন। বার বার এইরূপ পরাজিত হওয়াতে তিনি অন্তরে অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া জয়লাভের আশায় একে একে তাঁহার যাহা কিছু ছিল সমুদয় পণ রাখিতে লাগিলেন এবং একে একে সকলই হারাইলেন। তাঁহার রাজ্য, ঐশ্বর্য সর্বস্ব এইরূপে নষ্ট হইল। অবশেষে যখন তাঁহার রাজ্য ঐশ্বর্য কৌরবগণ কর্তৃক বিজিত হইল, অথচ তিনি বার বার দ্যূতক্রীড়ার জন্য আহূত হইতে লাগিলেন, তখন দেখিলেন নিজ ভাতৃগণ, নিজে স্বয়ং এবং সুন্দরী দ্রৌপদী ব্যতীত পণ রাখিবার তাঁহার আর কিছুই নাই। এইগুলিও তিনি একে একে পণ রাখিলেন এবং একে একে সমস্তই হারাইলেন। এইরূপে পাণ্ডবগণ সম্পূর্ণরূপে কৌরবগণের বশীভূত হইলেন। কৌরবগণ তাঁহাদিগকে অবমাননা করিতে আর কিছুই বাকী রাখিলেন না; বিশেষতঃ তাহারা দ্রৌপদীকে যেরূপ অবমানিতা করিল, মানুষের প্রতি মানুষ কখনও সেইরূপ ব্যবহার করিতে পারে না। অবশেষে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কৃপায় পাণ্ডবগণ কৌরবদের দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীনতা লাভ করিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাদিগকে নিজ রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিয়া রাজ্যশাসনের অনুমতি দিলেন। দুর্যোধন দেখিল বড় বিপদ, তাহার সব কৌশল বুঝি ব্যর্থ হয়; সুতরাং সে পিতাকে আর একবার মাত্র অক্ষক্রীড়ার অনুমতি দিবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতে লাগিল। অবশেষে ধৃতরাষ্ট্র সম্মত হইলেন। এবার পণ রহিল—যে-পক্ষ হারিবে, সে পক্ষকে দ্বাদশ বর্ষ বনবাস ও এক বর্ষ অজ্ঞাতবাস করিতে হইবে। কিন্তু যদি এই অজ্ঞাতবাসের সময় জয়ী পক্ষ অজ্ঞাতবাসকারীদের কোন সন্ধান পায়, তবে পুনরায় ঐরূপ দ্বাদশ বর্ষ বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিতে হইবে। কিন্তু বিজিত পক্ষ যদি অজ্ঞাতবাসের সম্পূর্ণ কাল অজ্ঞাতভাবে যাপন করিতে পারে, তবে তারা আবার রাজ্য পাইবে।
এই শেষ খেলাতেও যুধিষ্ঠিরের হার হইল; তখন পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীর সহিত নির্বাসিত গৃহহীনদের বনে গমন করিলেন। তাঁহারা অরণ্যে কোনরূপে দ্বাদশ বর্ষ যাপন করিলেন। এই সময় তাঁহারা ধার্মিক ও বীরপুরুষোচিত অনেক কঠিন কঠিন কার্য অনুষ্ঠিত করেন, মধ্যে মধ্যে দীর্ঘকাল তীর্থভ্রমণ করিয়া বহু প্রাচীন ও পবিত্র স্মৃতি-উদ্দীপক স্থানসমূহ দর্শন করেন। মহাভারতের এই বনপর্বটি বড়ই মনোহর ও শিক্ষাপ্রদ, ইহা নানাবিধ উপাখ্যান ও আখ্যায়িকায় পূর্ণ। ইহাতে প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও দর্শন সম্বন্ধে অনেক মনোহর অপূর্ব উপাখ্যান আছে। এই নির্বাসনের সময় মহর্ষিগণ পাণ্ডবগণকে দর্শন করিতে আসিতেন এবং তাঁহারা যাহাতে নির্বাসন-দুঃখ অক্লেশে সহিতে পারেন, সেজন্য তাঁহাদিগকে প্রাচীন ভারতের অনেক মনোহর উপাখ্যান শুনাইতেন। তন্মধ্যে একটি উপাখ্যান আমি আপনাদিগকে বলিব।
অশ্বপতি নামে এক রাজা ছিলেন, সাবিত্রী নামে তাঁহার এক পরমাসুন্দরী গুণবতী কন্যা ছিল। হিন্দুদের এক অতি পবিত্র মন্ত্রের নাম ‘সাবিত্রী’। এই কন্যার এত গুণ ও রূপ ছিল যে, তাঁহারও সাবিত্রী নাম রাখা হইয়াছিল। সাবিত্রী বয়ঃপ্রাপ্তা হইলে পিতা তাঁহাকে স্বামী মনোনীত করিতে বলিলেন। আপনারা দেখিতেছেন, ভারতে প্রাচীন রাজকন্যাগণের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। অনেক সময়েই তাঁহারা পাণিগ্রহণার্থী রাজকুমারগণের মধ্য হইতে নিজেরাই পতি নির্বাচন করিতেন।
সাবিত্রী পিতৃবাক্যে সম্মতা হইয়া সুবর্ণ-রথে আরোহণ করিয়া পিতৃরাজ্য হইতে অতি দূরবর্তী স্থানসমূহে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। পিতা কয়েকজন রক্ষী ও বৃদ্ধসভাসদকে তাঁহার সঙ্গে দিয়াছিলেন। তিনি তাহাদের সঙ্গে অনেক রাজসভায় যাইয়া রাজকুমারগণকে দেখিলেন, কিন্তু কেহই তাঁহার চিত্ত জয় করিতে পারিল না। অবশেষে তিনি বনের মধ্যে এক পবিত্র তপোবনে উপনীত হইলেন। প্রাচীনকালে এইসকল অরণ্যে পশুগণ নির্ভয়ে বিচরণ করিত। সেখানে কোন জীবকে হত্যা করিতে দেখা যাইত না; এইজন্য সেখানে পশুগণ মানুষকে ভয় করিত না। এমন কি—সরোবরের মৎসকুল পর্যন্ত মানুষের হাত হইতে নির্ভয়ে খাদ্য লইয়া যাইত। সহস্র সহস্র বর্ষ ধরিয়া এই সকল অরণ্যে কেহ কোন জীবহত্যা করে নাই। মুনি ও বৃদ্ধগণ সেখানে মৃগ ও পক্ষীদের মধ্যে আনন্দে বাস করিতেন। এমন কি—এই নির্বাসনের সময় কোন গুরুতর অপরাধীও এই সকল স্থানে যাইলে তাহার উপর কোন অত্যাচার করিবার সাধ্য কাহারও ছিল না। গার্হস্থ্যজীবনে যখন আর সুখ পাইত না, তখন লোক এই সকল অরণ্যে গিয়া বাস করিত; সেখানে মুনিগণের সঙ্গে ধর্মপ্রসঙ্গ ও তত্ত্বচিন্তায় জীবনের অবশিষ্ট কাল অতিবাহিত করিত।
দ্যুমৎসেন নামক জনৈক রাজা পূর্বোক্ত তপোবনে বাস করিতেন। তিনি জরাগ্রস্থ ও দৃষ্টিশক্তিহীন হইলে শত্রুগণ তাঁহার রাজ্য আক্রমণপূর্বক তাঁহাকে পরাভূত করিয়া তাঁহার রাজ্য অধিকার করিল। এই বৃদ্ধ অসহায় অন্ধ রাজা তাঁহার মহিষী ও পুত্রদের সহিত এই তপোবনে আশ্রয় লইয়াছিলেন। সেখানে অতি কঠোর তপস্যায় তিনি জীবন অতিবাহিত করিতেন। তাঁহার পুত্রের নাম সত্যবান।
সাবিত্রী অনেক রাজসভা দর্শন করিয়া অবশেষে এই পবিত্র আশ্রমে উপনীত হইলেন। প্রাচীনকালে এই তপোবনবাসী ঋষি-তপস্বিগণের উপর সকলেই এত শ্রদ্ধাভক্তির ভাব পোষণ করিতেন যে, সম্রাটও এই সমস্ত তপোবন বা আশ্রমের নিকট দিয়া যাইবার সময় ঋষি-মুনিগণকে পূজা করিবার জন্য আশ্রমে প্রবেশ না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। এখনও ভারতে এই ঋষি-মুনিগণের প্রতি লোকের এতদূর শ্রদ্ধার ভাব আছে যে, ভারতের একজন শ্রেষ্ঠ সম্রাটও অরণ্যবাসী ফলমূলভোজী চীরপরিহিত কোন ঋষির বংশধর বলিয়া আপনার পরিচয় দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করিয়া বরং পরম গৌরব ও আনন্দ অনুভব করিবেন। আমরা সকলেই সেই ঋষির বংশধর। এইরূপেই ভারতে ধর্মের প্রতি অতিশয় সম্মান ও শ্রদ্ধাভক্তি প্রদর্শিত হইয়া থাকে; অতএব রাজগণ যে তপোবনের নিকট দিয়া যাইবার সময় উহার ভিতর প্রবেশ করিয়া সেই তপোবনবাসী ঋষিগণকে পূজা করিয়া আপনাদিগকে গৌরবান্বিত বোধ করিবেন, ইহা আর বিচিত্র কি! যদি তাঁহারা অশ্বারোহণে আসিয়া থাকেন, তবে আশ্রমের বাহিরে অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজে আশ্রমে প্রবেশ করিবেন। আর যদি তাঁহারা রথারোহণে আসিয়া থাকেন, তবে রথ ও বর্মাদি বাহিরে রাখিয়া আশ্রমে প্রবেশ করিতে হইবে। বিনীত শমগুণসম্পন্ন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির ন্যায় না যাইলে কোন যোদ্ধারই আশ্রমে প্রবেশাধিকার ছিল না।
এইরূপে সাবিত্রী রাজকন্যা হইয়াও এই আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং সেখানে রাজতপস্বী দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবানকে দর্শন করিলেন। সত্যবানকে দর্শন করিয়াই সাবিত্রী মনে মনে তাঁহাকে হৃদয় সমর্পণ করিলেন। সাবিত্রী কত রাজপ্রাসাদে, কত রাজসভায় গিয়াছিলেন, কিন্তু কোন স্থানেই কোন রাজকুমার তাঁহার চিত্ত হরণ করিতে পারেন নাই। এখানে অরণ্যাবাসে রাজা দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবান তাঁহার হৃদয় হরণ করিলেন।
সাবিত্রী পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিলে পিতা তাঁহাকে জিজ্ঞাস করিলেন, ‘বৎসে সাবিত্রী, তুমি তো নানা স্থান ভ্রমণ করিয়া আসিলে; বল দেখি, তুমি কোথাও এমন কাহাকেও দেখিয়াছ কি, যাহার সহিত তুমি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হইতে ইচ্ছা কর? বল মা, কিছুমাত্র গোপন না করিয়া হৃদয়ের কথা খুলিয়া বল।’ তখন সাবিত্রী লজ্জানম্রবদনে মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ, পিতা, দেখিয়াছি।’ পিতা কহিলেন, ‘বৎসে, যে রাজকুমার তোমার চিত্ত হরণ করিয়াছে, তাহার নাম কি?’ তখন সাবিত্রী বলিলেন, ‘তাঁহাকে ঠিক রাজকুমার বলিতে পারা যায় না, কারণ তাঁর পিতা দ্যুমৎসেন রাজা ছিলেন বটে, কিন্তু এক্ষণে শত্রুগণ তাঁহার রাজ্য অপহরণ করিয়াছে। অতএব তিনি রাজকুমার হইলেও রাজ্যের অধিকারী নহেন, তিনি তপস্বিভাবে জীবনযাপন করিতেছেন, বনজাত ফলমূল সংগ্রহ করিয়া কুটীরবাসী বৃদ্ধ জনক-জননীর সেবায় নিরত রহিয়াছেন।’
সেই সময় দেবর্ষি নারদ সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। রাজা অশ্বপতি তাঁহাকে সাবিত্রীর পতি-নির্বাচন-বৃত্তান্ত বলিয়া তৎসম্বন্ধে তাঁহার মতামত জিজ্ঞাসা করিলেন। নারদ বলিলেন, ‘এই নির্বাচন বড়ই অশুভ হইয়াছে।’ কথাগুলি শুনিয়া রাজা তাঁহাকে এইরূপ বলিবার কারণ স্পষ্টরূপে নির্দেশ করিবার জন্য অনুরোধ করিলে তিনি বলিলেন, ‘অদ্য হইতে দ্বাদশ মাস পরে সত্যবান নিজ কর্মানুসারে দেহত্যাগ করিবে।’ নারদের এই কথা শুনিয়া ভয়বিহ্বল চিত্তে রাজা কন্যাকে বলিলেন, ‘সাবিত্রী, শুনিলে তো, অদ্য হইতে দ্বাদশ মাস পরে সত্যবান দেহত্যাগ করিবে; অতএব তুমি তাহাকে বিবাহ করিলে অল্প বয়সেই বিধবা হইবে, একবার এই কথা বেশ ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখ। বৎসে, তুমি সত্যবানের বিষয় আর হৃদয়ে স্থান দিও না, এরূপ অল্পায়ু আসন্নমৃত্যু বরের সহিত তোমার কোনমতে বিবাহ হইতে পারে না।’ সাবিত্রী কহিলেন, ‘পিতঃ, সত্যবান অল্পায়ুই হউক বা আসন্নমৃত্যুই হউক, তাহাতে আমার কোন ক্ষতি নাই। আমার হৃদয় সত্যবানের প্রতি অনুরাগী, আমি মনে মনে সেই সাধুচরিত্র বীর সত্যবানকেই পতিত্বে বরণ করিয়াছি। অতএব আপনি অন্য ব্যক্তিকে পতিরূপে বরণ করিতে আমাকে বলিবেন না, তাহা হইলে আমি দ্বিচারিণী হইব। কুমারীর পতিনির্বাচনে একবার মাত্র অধিকার আছে। একবারে সে যাহাকে মনে মনে পতিরূপে বরণ করিয়াছে, তাহাকে ছাড়া আর কাহাকেও তাহার মনে কখনও স্থান দেওয়া উচিত নহে।’ রাজা যখন দেখিলেন, সাবিত্রী সত্যবানকে পতিত্বে বরণ করিতে দৃঢ়নিশ্চয়, তখন তিনি এই বিবাহ অনুমোদন করিলেন। সাবিত্রী সত্যবানের সহিত যথাবিধানে বিবাহিতা হইয়া তাঁহার মনোনীত পতির সহিত বাস করিবার জন্য ও শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবার জন্য পিতার রাজপ্রাসাদ হইতে অরণ্যমধ্যে তাঁহাদের আশ্রমে গমন করিলেন।
নারদের মুখ হইতে শুনিয়া সাবিত্রী সত্যবানের ঠিক কোন্ দিন দেহত্যাগ হইবে তাহা অবগত হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি উহা সত্যবানের নিকট গোপন রাখিয়াছিলেন। সত্যবান প্রতিদিন গভীর অরণ্যে গিয়া কাষ্ঠ এবং ফলমূল সংগ্রহ করিয়া পুনরায় কুটীরে ফিরিয়া আসিতেন। সাবিত্রী রন্ধনাদি গৃহকার্য করিয়া বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা করিতেন। এইরূপে তাঁহাদের জীবন সুখে দুঃখে অতিবাহিত হইতে লাগিল, অবশেষে সত্যবানের দেহত্যাগের দিন নিকটবর্তী হইল। তিন দিন মাত্র অবশিষ্ট থাকিতে সাবিত্রী এক কঠোর ব্রত গ্রহণ করিলেন। উপবাসে থাকিয়া রাত্রিজাগরণ করিয়া তিনি ব্যাকুল ভাবে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। এই তিন রাত্রি তিনি পতির আসন্ন মৃত্যুচিন্তা করিয়া কত গভীর দুঃখে কাটাইয়াছিলেন, অপরের অজ্ঞাতসারে কত অশ্রু মোচন করিয়াছিলেন, দেবতার নিকট পতির শুভকামনায় কাতরভাবে কত প্রার্থনা করিয়াছেন, কে তাহার ইয়ত্তা করিবে?
অবশেষে সেই কালদিবসের প্রভাত উপস্থিত হইল। সেদিন আর সাবিত্রীর—পতিকে এক মুহূর্তের জন্যও নয়নের অন্তরাল করিতে সাহস হইল না। অতএব সত্যবানের অরণ্যে কাষ্ঠ ও ফলমূল সংগ্রহ করিতে যাইবার সময় সাবিত্রী সেদিন পতির সঙ্গে যাইতে শ্বশুর-শাশুড়ীর অনুমতি প্রার্থনা করিলেন এবং অনুমতি লাভ করিয়া সত্যবানের সঙ্গে অরণ্যে গেলেন। হঠাৎ সত্যবান বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে পত্নীকে বলিলেন, ‘প্রিয়া সাবিত্রী, আমার মাথা ঘুরিতেছে, আমার ইন্দ্রিয়সকল অবসন্নবোধ হইতেছে, আমার সর্বশরীর যেন নিদ্রাভারাক্রান্ত হইতেছে, আমি কিছুকাল তোমার পার্শ্বে বিশ্রাম করিব।’ সাবিত্রী ভয়বিজড়িত ও কম্পিত স্বরে উত্তর দিলেন, ‘প্রভো, আপনি আমার অঙ্কদেশে মস্তক স্থাপন করিয়া বিশ্রাম করুন।’ তখন সত্যবান নিজ উত্তপ্ত মস্তক সাবিত্রীর অঙ্কদেশে স্থাপন করিলেন। কিছুক্ষণ পরেই তাঁহার শ্বাস উপস্থিত হইল, তিনি দেহত্যাগ করিলেন। সাবিত্রী গলদশ্রুলোচনে পতিকে আলিঙ্গন করিয়া সেই জনশূন্য অরণ্যে বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে যমদূতগণ সত্যবানের সূক্ষ্ম দেহ গ্রহণ করিবার জন্য তথায় উপস্থিত হইল। কিন্তু সাবিত্রী যেখানে পতির মস্তক ক্রোড়ে লইয়া উপবিষ্ট ছিলেন, তাহারা তাঁহার নিকটে আসিতে পারিল না। তাহারা দেখিল সাবিত্রীর চতুষ্পার্শ্বে অগ্নির গণ্ডী রহিয়াছে, যমদূতগণের মধ্যে কেহই তাহা অতিক্রম করিতে পারিল না, সাবিত্রীর সান্নিধ্য হইতে পলাইয়া গিয়া তাহারা যমরাজের নিকট উপস্থিত হইল এবং সত্যবানের আত্মাকে আনিতে না পারার কারণ নিবেদন করিল।
তখন মৃত ব্যক্তিগণের বিচারক মৃত্যুদেবতা যমরাজ স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন। লোকের বিশ্বাস—পৃথিবীতে প্রথম মানুষ যিনি মরেন, তিনিই মৃত্যুদেবতা অর্থাৎ তৎপরবর্তী মৃত ব্যক্তিগণের অধিপতি হইয়াছেন। মৃত্যুর পর কাহাকে পুরস্কার অথবা কাহাকে শাস্তি দিতে হইবে, তিনি তাহা বিচার করেন। সেই যমরাজ এখন স্বয়ং আসিলেন। অবশ্য যমরাজ দেবতা, অতএব সাবিত্রীর চতুষ্পার্শ্বস্থ সেই অগ্নির ভিতরে অনায়াসে প্রবেশ করিবার অধিকার তাঁহার ছিল। তিনি সাবিত্রীর নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘মা, তুমি এই শব দেহ পরিত্যাগ কর। কারণ, জানিও মর্ত্যমাত্রকেই দেহত্যাগ করিতে হয়, ইহাই বিধির বিধান। মর্ত্যগণের মধ্যে আমিই প্রথম মরিয়াছি, তারপর হইতে সকলকেই মরিতে হয়। মৃত্যুই মানবের নিয়তি।’ যমরাজ এই কথা বলিলে সাবিত্রী সত্যবানের শবদেহ ত্যাগ করিয়া কিছু দূরে সরিয়া গেলেন, তখন যম সত্যবানের দেহ হইতে তাঁহার জীবাত্মাকে বাহির করিয়া লইলেন। যম এইরূপে সেই যুবকের জীবাত্মাকে লইয়া স্বীয় পুরী অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। কিন্তু কিয়দ্দূর যাইতে না যাইতে তিনি শুনিলেন তাঁহার পশ্চাতে শুষ্ক পত্রের উপর কাহার পদশব্দ হইতেছে। শুনিয়া তিনি ফিরিয়া দেখেন—সাবিত্রী। তখন তিনি সাবিত্রীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মা সাবিত্রী, বৃথা কেন আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছ? সকল মর্ত্যজনেরই অদৃষ্টে মৃত্যু ঘটিয়া থাকে।’ সাবিত্রী বলিলেন, ‘পিতঃ, আমি আপনাকে অনুসরণ করিতেছি না। কিন্তু আপনি যেমন বলিলেন, মর্ত্যগণের পক্ষে মৃত্যুই বিধির বিধান, সেইরূপ বিধির বিধানেই নারীও তাহার প্রিয় পতির অনুসরণ করিয়া থাকে, আর বিধির সনাতন বিধানেই পতিব্রতা ভার্যাকে কখনও তাহার পতি হইতে বিচ্ছিন্ন করা যাইতে পারে না।’ তখন যমরাজ বলিলেন, ‘বৎসে, তোমার বাক্য-শ্রবণে পরম প্রীত হইয়াছি, অতএব তুমি তোমার পতির পুনর্জীবন ব্যতীত আমার নিকট হইতে যাহা ইচ্ছা বর প্রার্থনা কর।’ তখন সাবিত্রী বলিলেন, ‘হে প্রভু যমরাজ, যদি আপনি আমার উপর প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আমায় এই বর দিন যে, আমার শ্বশুর যেন পুনরায় তাঁহার চক্ষু লাভ করেন ও সুখী হইতে পারেন।’ যম বলিলেন, ‘প্রিয় বৎসে, আমি ধর্মজ্ঞ, তোমার এই ধর্মসঙ্গত বাসনা পূর্ণ হউক।’ এই বলিয়া যমরাজ সত্যবানের জীবাত্মাকে লইয়া আবার নিজ গন্তব্য পথে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। কিছুদূর যাইতে না যাইতে তিনি পূর্ববৎ আবার পশ্চাতে পদশব্দ শুনিতে পাইয়া ফিরিয়া আবার সাবিত্রীকে দেখিলেন। তখন তিনি তাঁহাকে বলিলেন, ‘বৎসে সাবিত্রী, তুমি এখনও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অসিতেছ?’ সাবিত্রী উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, পিতা, আমি আপনার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অসিতেছি বটে। আমি যে না আসিয়া থাকিতে পারিতেছি না, কে যেন আমায় টানিয়া লইয়া যাইতেছে। আমি ফিরিবার জন্য বার বার চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু আমার মনপ্রাণ যে আমার স্বামীর নিকট পড়িয়া আছে, সুতরাং যেখানে আমার স্বামীকে লইয়া যাইতেছেন, সেখানে আমার দেহও যাইতেছে। আমার আত্মা তো পূর্বেই গিয়াছে—কারণ, আমার আত্মা আমার স্বামীর আত্মাতেই অবস্থিত। সুতরাং আপনি যখন আমার আত্মাকে লইয়া যাইতেছেন, তখন আমার দেহ যাইবেই। উহা না গিয়া কি করিয়া থাকিবে?’ যম কহিলেন, ‘সাবিত্রী, আমি তোমার বাক্যশ্রবণে পরম প্রীত হইলাম। আমার নিকট হইতে তোমার স্বামীর জীবন ব্যতীত আর একটি বর প্রার্থনা কর।’ সাবিত্রী কহিলেন, ‘দেব, আপনি যদি আমার উপর প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আপনার নিকট একটি বর প্রার্থনা করি যে, আমার শ্বশুর যেন তাঁহার নষ্ট রাজ্য ও ঐশ্বর্য ফিরিয়া পান।’ যম কহিলেন, ‘প্রিয় বৎসে, তোমায় এই বরও দান করিলাম। কিন্তু এখন তুমি গৃহে ফিরিয়া যাও, কারণ জীবিত মানুষ কখন যমরাজের সহিত যাইতে পারে না।’ এই বলিয়া যম আবার চলিতে লাগিলেন। যম যদিও বারংবার সাবিত্রীকে ফিরিতে বলিলেন, তথাপি সেই নম্রস্বভাবা পতিপরায়ণা সাবিত্রী তাঁহার মৃত স্বামীর অনুসরণ করিতে লাগিলেন। যম আবার ফিরিয়া সাবিত্রীকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, ‘হে সাবিত্রী, হে মহানুভবে, তুমি এরূপ তীব্র শোক বিহ্বল হইয়া পাগলের মত স্বামীর অনুসরণ করিও না।’ সাবিত্রী কহিলেন, ‘আমার মনের উপর আমার কোন কর্তৃত্ব নাই, আপনি আমার প্রিয়তম স্বামীকে যেখানে লইয়া যাইবেন, আমি সেখানেই তাঁহার অনুসরণ করিব।’ যম বলিলেন, ‘আচ্ছা সাবিত্রী, মনে কর তোমার স্বামী ইহলোকে অনেক পাপ করিয়াছে, তাহার ফলে তাহাকে নরকে যাইতে হইবে; তাহা হইলেও কি তুমি তোমার পতির সহিত যাইতে প্রস্তুত?’ পতির প্রতি পরম অনুরাগিণী সাবিত্রী কহিলেন, ‘আমার পতি যেখানে যাইবেন—জীবন হউক, মৃত্যু হউক, স্বর্গ হউক, নরকই হউক—আমি পরমানন্দে সেখানে যাইব।’ যম কহিলেন, ‘বৎসে তোমার কথাগুলি অতি মনোহর ও ধর্মসঙ্গত, আমি তোমার উপর পরম প্রীত হইয়াছি; তুমি আর একটি বর প্রার্থণা কর, কিন্তু জানিও মৃত ব্যক্তি কখনও আবার জীবিত হয় না।’ সাবিত্রী কহিলেন, ‘যদি আমার উপর আপনি এতদূর প্রসন্ন হইয়া থাকেন তবে আমায় এই বর দান করুন, যেন আমার শ্বশুরের রাজবংশের লোপ না হয়, যেন সত্যবানের পুত্রগণ তাঁহার রাজ্য লাভ করে।’ তখন যমরাজ ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, ‘বৎসে, তোমার মনস্কামনা সফল হউক, এই তোমার পতির জীবাত্মাকে পরিত্যাগ করিলাম। তোমার পতি আবার জীবিত হইবে। সত্যবানের ঔরসে তোমার অনেক পুত্র জন্মিবে, কালে তাহারা রাজপদ লাভ করিবে। এক্ষণে গৃহে ফিরিয়া যাও। প্রেম মৃত্যুকেও জয় করিল। পূর্বে কোন নারী পতিকে এমন ভালবাসে নাই, আর আমি সাক্ষাৎ মৃত্যুদেবতাও অকপট অব্যভিচারী প্রেমের শক্তির নিকট পরাজিত হইলাম।’
সাবিত্রী-উপাখ্যান সংক্ষেপে কথিত হইল। ভারতে প্রত্যেক বালিকাকে সাবিত্রীর ন্যায় সতী হইতে শিক্ষা দেওয়া হয়—মৃত্যুও যে সাবিত্রীর প্রেমের নিকট পরাভূত হইয়াছিল, যে সাবিত্রী ঐকান্তিক প্রেমবলে যমরাজের নিকট হইতেও স্বীয় স্বামীর আত্মাকে ফিরাইয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।
মহাভারত এই সাবিত্রীর উপাখ্যানের মত শত শত মনোহর উপাখ্যানে পূর্ণ। আমি আপনাদিগকে প্রথমেই বলিয়াছি, জগতের মধ্যে মহাভারত একখানি বিরাট গ্রন্থ। ইহা অষ্টাদশ পর্বে বিভক্ত এবং প্রায় লক্ষশ্লোকে পূর্ণ।
যাহা হউক, এক্ষণে মূল আখ্যানের সূত্র আবার ধরা যাউক। পাণ্ডবগণ রাজ্য হইতে নির্বাসিত হইয়া বনে বাস করিতেছেন, এই অবস্থায় আমরা পাণ্ডবদিগকে ফেলিয়া আসিয়াছি। সেখানেও তাঁহারা দুর্যোধনের কুমন্ত্রণাপ্রসূত নানাবিধ অত্যাচার হইতে একেবারে মুক্ত হন নাই, কিন্তু অনেক চেষ্টা করিয়াও দুর্যোধন কখনই তাঁহাদের বিশেষ অনিষ্টসাধনে কৃতকার্য হয় নাই।
অরণ্যে বাসকালে পাণ্ডবগণের একদিনের ঘটনা আমি আপনাদের নিকট বলিব। একদিন তাঁহারা বড়ই তৃষ্ণার্ত হইলেন। যুধিষ্ঠির কনিষ্ঠ ভ্রাতা সহদেবকে জল অন্বেষণ করিয়া আনিতে আদেশ করিলেন। তিনি দ্রুতপদে যাইয়া অনেক অন্বেষণের পর একস্থানে একটি অতি নির্মলসলিল সরোবর দেখিতে পাইলেন। তিনি যেমন জলপানের জন্য সরোবরে অবতরণ করিবেন, শুনিলেন—কে যেন তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছে, ‘বৎস, জল পান করিও না। অগ্রে আমার প্রশ্নগুলির উত্তর দাও, পরে যত ইচ্ছা জল পান করিও।’ কিন্তু সহদেব অতিশয় তৃষ্ণার্ত থাকাতে এই বাক্য গ্রহণ না করিয়া ইচ্ছামত জলপান করিলেন, জলপান করিবামাত্র তিনি দেহত্যাগ করিলেন। সহদেবকে অনেকক্ষণ ফিরিতে না দেখিয়া রাজা যুধিষ্ঠির নকুলকে তাহার সন্ধানে ও জল আনয়নের জন্য পাঠাইলেন।
নকুল ইতস্থতঃ অন্বেষণ করিতে করিতে উক্ত সরোবরের সমীপে যাইয়া ভ্রাতা সহদেবকে মৃত অবস্থায় নিশ্চেষ্টভাবে পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন। নকুল তৃষ্ণার্ত থাকায় জলের দিকে অগ্রসর হইলেন, অমনি তিনিও সহদেবের মত শুনিলেন, ‘বৎস, অগ্রে আমার প্রশ্নগুলির উত্তর দাও, পশ্চাতে জল পান করিও।’ তিনিও ঐ বাক্য অমান্য করিয়া জল পান করিলেন ও জল পান করিয়াই সহদেবের মত মানবলীলা সংবরণ করিলেন। পরে অর্জুন ও ভীম ঐরূপে ভাতৃগণের অন্বেষণে ও জল আনিবার জন্য প্রেরিত হইলেন, কিন্তু তাঁহারাও কেহ ফিরিলেন না। তাঁহাদেরও নকুল সহদেবের মত অবস্থা হইল। তাঁহারাও জল পান করিয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। অবশেষে যুধিষ্ঠির স্বয়ং উঠিয়া ভাতৃচতুষ্টয়ের অন্বেষণে গমন করিলেন। অনেকক্ষণ ইতস্ততঃ ভ্রমণের পর পরিশেষে সেই মনোহর সরোবরের সমীপে উপস্থিত হইয়া তিনি ভাতৃচতুষ্টয়কে মৃত অবস্থায় ভূতলে শয়ান দেখিলেন। এই দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার অন্তঃকরণ শোকভারাক্রান্ত হইল, তিনি ভাতৃগণের জন্য বিলাপ করিতে লাগিলেন; সেই সময় হঠাৎ শুনিলেন, কে যেন তাঁহাকে বলিতেছে, ‘বৎস, দুঃসাহস করিও না। আমি একজন যক্ষ—বকরূপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৎস খাইয়া জীবনধারণ করি এবং এই সরোবরে বাস করি; এই সরোবর আমার অধিকৃত। আমার দ্বারাই তোমার ভ্রাতারা প্রেতলোকে নীত হইয়াছে। হে রাজন্, যদি তুমিও তোমার ভ্রাতাদের মত আমার প্রশ্নগুলির উত্তর না দিয়া জল পান কর, তবে ভাতৃচতুষ্টয়ের পার্শ্বে পঞ্চম শবরূপে তোমাকেও শয়ন করিতে হইবে। হে কুরুনন্দন, প্রথমে আমার প্রশ্নগুলির উত্তর দিয়া স্বয়ং যথেচ্ছা জল পান কর ও অন্যত্র লইয়া যাও।’ যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘আমি আপনার প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর দিতে চেষ্টা করিব। আপনি আমাকে যথাভিরুচি প্রশ্ন করুন।’ তখন যক্ষ তাহাকে একে একে অনেকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, যুধিষ্ঠিরও প্রশ্নের সদুত্তর প্রদান করিলেন। তন্মধ্যে দুইটি প্রশ্ন ও যুধিষ্ঠিরপ্রদত্ত উত্তর আপনাদের নিকট বলিতেছি। যক্ষ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কিমাশ্চর্যম্?’—জগতে সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ব্যাপার কি? যুধিষ্ঠির তদুত্তরে বলিলেনঃ
প্রতিমুহূর্তে আমরা দেখিতেছি, আমাদের চারিদিকে প্রাণিগণ মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছে, কিন্তু যাহারা এখনও মরে নাই, তাহারা ভাবিতেছে যে, তাহারা কখনও মরিবে না। জগতের মধ্যে ইহাই সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য ব্যাপার—মৃত্যু অহরহঃ সম্মুখে থাকিলেও কেহ বিশ্বাস করে না যে, সে মরিবে।২
যক্ষের আর এক প্রশ্ন ছিল, ‘কঃ পন্থাঃ?’—কোন্ পথ অনুসরণ করিলে মানবের যথার্থ শ্রেয়োলাভ হয়? যুধিষ্ঠির ঐ প্রশ্নের এই উত্তর প্রদান করিলেনঃ
তর্কের দ্বারা কিছুই নিশ্চয় হইতে পারে না। কারণ, জগতে নানা মত-মতান্তর রহিয়াছে। বেদও নানাবিধ—উহার এক ভাগ যাহা বলিতেছে, অপর ভাগ তাহারই প্রতিবাদ করিতেছে। এমন দুই জন মুনি বাহির করিতে পারা যায় না, যাঁহাদের পরস্পরের মতভেদ নাই। ধর্মের রহস্য যেন গুহায় নিহিত রহিয়াছে। অতএব মহাপুরুষগণ যে পথে চলিয়াছেন, সেই পথই অনুসরণীয়।৩
যক্ষ যুধিষ্ঠিরের সমুদয় উত্তর শ্রবণ করিয়া অবশেষে বলিলেন, ‘হে রাজন্, আমি তোমার উপর বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি। আমি বকরূপী ধর্ম। আমি তোমায় পরীক্ষা করিবার জন্যই এইরূপ করিয়াছি। তোমার ভ্রাতৃগণের মধ্যে কেহই মরে নাই। আমার মায়াবলেই তাহারা মৃত প্রতীয়মান হইতেছে। হে ভরতর্ষভ, তুমি যখন ধনলাভ ও সম্ভোগ অপেক্ষা অনৃশংসতাকে মহত্তর বিবেচনা করিয়াছ, তখন তোমার ভ্রাতৃবর্গ জীবিত হউক।’ এই কথা বলিবামাত্র ভীমাদি পাণ্ডবচতুষ্টয় জীবিত হইয়া উঠিলেন।
এই উপাখ্যান হইতে রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রকৃতির অনেকটা আভাস পাওয়া যায়। যক্ষের প্রশ্নগুলির উত্তর হইতে আমরা দেখিতে পাই, রাজার ভাব অপেক্ষা তত্ত্বজ্ঞ ও যোগীর ভাবই তাঁহার মধ্যে অধিক ছিল।
এদিকে পাণ্ডবদিগের দ্বাদশ বর্ষ বনবাসের কাল শেষ হইয়া অজ্ঞাতবাস করিবার ত্রয়োদশ বর্ষ নিকটবর্তী হইতেছিল। এই কারণে যক্ষ তাঁহাদিগকে বিরাটের রাজ্যে গমন করিয়া তথায় যাহার যেরূপ অভিরুচি, সেই রূপ ছদ্মবেশে থাকিবার উপদেশ দিলেন।
এইরূপে দ্বাদশ বর্ষ বনবাসের পর তাঁহারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে অজ্ঞাতবাসের এক বৎসর কাটাইলেন এবং বিরাটরাজ্যে গমন করিয়া সেখানে রাজার অধীনে সামান্য সামান্য কার্যে নিযুক্ত হইলেন। যুধিষ্ঠির বিরাট রাজার দ্যুতজ্ঞ সভাসদ্ হইলেন। ভীম পাচকের কাজে নিযুক্ত হইলেন। অর্জুন নপুংসকবেশে রাজকন্যা উত্তরার নৃত্য ও সঙ্গীতশিক্ষার শিক্ষক হইয়া রাজার অন্তঃপুরে বাস করিতে লাগিলেন। নকুল রাজার অশ্বশালার অধ্যক্ষ হইলেন এবং সহদেব গোশালার তত্ত্বাবধানকার্যে নিযুক্ত হইলেন। দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রীবেশে রাজ্ঞীর অন্তঃপুরে পরিচারিকারূপে গৃহীতা হইলেন। এইরূপ ছদ্মবেশে পাণ্ডবভাতৃগণ এক বৎসর নিরাপদে অজ্ঞাতবাসের কাল অতিবাহিত করিলেন। দুর্যোধন তাঁহাদের অনেক অনুসন্ধান করিল, কিন্তু কোনমতে কৃতকার্য হইতে পারিল না। বর্ষ পূর্ণ হইবার ঠিক পরেই কৌরবগণ তাঁহাদের সন্ধান পাইল।
এইবার যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের নিকট এক দূত পাঠাইলেন। দূত ধৃতরাষ্ট্রসমীপে যাইয়া যুধিষ্ঠিরের এই বাক্য তাঁহার নিকট নিবেদন করিলেন যে, তাঁহারা ধর্মতঃ ও ন্যায়তঃ অর্ধরাজ্যের অধিকারী; অতএব তাঁহাদিগকে যেন এক্ষণে অর্ধরাজ্য প্রদান করা হয়। কিন্তু দুর্যোধন পাণ্ডবগণের প্রতি অতিশয় দ্বেষ পোষণ করিত, সুতরাং সে কিছুতেই পাণ্ডবগণের এই ন্যায়সঙ্গত প্রার্থনায় সম্মত হইল না। পাণ্ডবেরা রাজ্যের অতি অল্পাংশ একটি প্রদেশ, এমন কি পাঁচখানি গ্রাম পাইলেই সন্তুষ্ট হইবেন, বলিলেন। কিন্তু উদ্ধতস্বভাব দুর্যোধন বলিল যে, বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্রপরিমিত ভূমিও পাণ্ডবগণকে দেওয়া হইবে না। ধৃতরাষ্ট্র সন্ধি করিবার জন্য দুর্যোধনকে অনেক বুঝাইলেন। কৃষ্ণও কৌরবসভায় গিয়া এই আসন্ন যুদ্ধ ও জ্ঞাতিক্ষয় যাহাতে না হয়, তাহার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুরাদি কৌরবরাজসভার বৃদ্ধগণ দুর্যোধনকে অনেক বুঝাইলেন। কিন্তু সন্ধির চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইল। সুতরাং উভয় পক্ষেই যুদ্ধের উদ্যোগ চলিতে লাগিল এবং ভারতের সকল ক্ষত্রিয়ই এই যুদ্ধে যোগদান করিলেন।
এই যুদ্ধ ক্ষত্রিয়গণের প্রাচীন প্রথা ও নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হইয়াছিল। এক দিকে যুধিষ্ঠির, অপর দিকে দুর্যোধন—উভয়ই নিজ নিজ পক্ষে যোগ দিবার জন্য অনুরোধ করিয়া ভারতের সকল রাজগণের নিকট দূত পাঠাইতে লাগিলেন। ক্ষত্রিয়গণের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত ছিল যে, যাঁহার অনুরোধ প্রথম পৌঁছিবে, ধার্মিক ক্ষত্রিয়কে তাঁহারই পক্ষ অবলম্বন করিয়া যুদ্ধ করিতে হইবে। এইরূপে বিভিন্ন রাজা ও যোদ্ধৃবর্গ অনুরোধের পৌর্বাপর্য অনুসারে পাণ্ডব ও কৌরবগণের পক্ষ অবলম্বন করিবার জন্য সমবেত হইতে লাগিলেন। পিতা এক পক্ষে, পুত্র হয়তো অপর পক্ষে যোগ দিলেন। এক ভ্রাতা এক পক্ষে, অপর ভ্রাতা হয়তো অপর পক্ষে যোগ দিলেন। তখনকার সমরনীতি বড়ই অদ্ভুত ছিল। সারাদিনের যুদ্ধের পর সন্ধ্যা হইলে যখন যুদ্ধ শেষ হইত, তখন উভয় পক্ষের মধ্যে আর শত্রুভাব থাকিত না, এমন কি এক পক্ষ অপর পক্ষের শিবিরে পর্যন্ত যাতায়াত করিত। প্রাতঃকাল হইলেই কিন্তু তাহারা আবার পরস্পর যুদ্ধ করিত। মুসলমানগণের ভারত-আক্রমণের সময় পর্যন্ত হিন্দুগণ নিজেদের এই চরিত্রগত বিশেষত্ব রক্ষা করিয়া আসিয়াছিলেন। আবার প্রাচীনকালে এইরূপ নিয়ম ছিল যে, অশ্বারোহী পদাতিককে আঘাত করিতে পারিবে না, বিষাক্ত অস্ত্রের দ্বারা কেহ কখনও যুদ্ধ করিতে পারিবে না, নিজের যে সুবিধাগুলি আছে, শত্রুরও ঠিক সেইগুলি না থাকিলে তাহাকে কখনও পরাজিত করিতে পারিবে না, কোন প্রকার ছল প্রয়োগ করিতে পারিবে না। মোট কথা কোন প্রকারে শত্রুর কোন ছিদ্র থাকিলে তাহার অবৈধ সুযোগ লইয়া তাহাকে বশীভূত করিতে পারিবে না, ইত্যাদি। যদি কেহ এই সকল যুদ্ধনীতি লঙ্ঘন করিতেন, তবে তিনি ঘোর অপযশের ভাগী হইতেন, তাঁহার সজ্জন-সমাজে মুখ দেখাইবার যো থাকিত না। তখনকার ক্ষত্রিয়গণ এইরূপ শিক্ষা পাইতেন। যখন মধ্য-এশিয়া হইতে ভারতের উপর বহিরাক্রমণের তরঙ্গ আসিল, তখনও হিন্দুরা তাঁহাদের আক্রমণকারীদের প্রতি সেই শিক্ষানুযায়ী ব্যবহার করিয়াছিলেন। হিন্দুরা তাঁহাদিগকে বারবার পরাজিত করিয়াছিলেন এবং প্রতিবারই পরাজয়ের পর উপহারাদি দিয়া তাঁহাদিগকে সম্মানের সহিত গৃহে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাদের শাস্ত্রের বিধিই ছিল যে, অপরের দেশে কখনও বলপূর্বক অধিকার করিবে না, আর কেহ পরাস্ত হইলে তাঁহার পদমর্যাদা অনুযায়ী সম্মান প্রদর্শন করিয়া তাঁহাকে দেশে পাঠাইয়া দিতে হইবে। মুসলমানবিজেতৃগণ কিন্তু হিন্দুরাজগণের উপর অন্য প্রকার ব্যবহার করিয়াছিলেন। তাঁহারা একবার তাঁহাদিগকে হাতে পাইলে বিনা বিচারে তাঁহাদের প্রাণনাশ করিতেন।
এই যুদ্ধপ্রসঙ্গে আর একটি বিষয় আপনাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে। মহাভারত বলিতেছেন, যে সময়ে এই যুদ্ধব্যাপার সংঘটিত হয়, তখন সে কেবল সাধারণ ধনুর্বাণ লইয়া যুদ্ধ হইত, তাহা নহে; তখন দৈবাস্ত্রের ব্যবহারও ছিল। এই দৈবাস্ত্র প্রয়োগ করিতে হইলে মন্ত্রশক্তি, চিত্তের একাগ্রতা প্রভৃতির বিশেষ প্রয়োজন হইত। এইরূপ দৈবাস্ত্র প্রয়োগ করিয়া এক ব্যক্তি দশলক্ষ ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করিতে ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে দগ্ধ করিতে পারিতেন। এই মন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করিয়া এক বাণ নিক্ষেপ করিলে তাহা হইতে সহস্র সহস্র বাণবৃষ্টি হইবে—এই মন্ত্রশক্তিবলে, দৈবশক্তিবলে চারিদিকে বজ্রপাত হইবে, যে কোন জিনিষ দগ্ধ করিতে পারা যাইবে, নানা অদ্ভুত ইন্দ্রজালের সৃষ্টি হইবে। রামায়ণ ও মহাভারত—উভয় মহাকাব্যের মধ্যে একটি বিশেষ বিষয় দেখিয়া আশ্চর্য হইতে হয়, এইসব অস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কামানের ব্যবহারও দেখিতে পাই। কামান খুব প্রাচীন জিনিষ। চীনা ও হিন্দুরা উভয়েই উহার ব্যবহার করিতেন। তাঁহাদের নগরসমূহের প্রাচীরে লৌহনির্মিত শূন্যগর্ভ নলনির্মিত শত শত অদ্ভুত অস্ত্র থাকিত। লোকে বিশ্বাস করিত, চীনারা ইন্দ্রজালবিদ্যা দ্বারা শয়তানকে এক শূন্যগর্ভ লৌহনালীর ভিতর প্রবেশ করাইত, আর একটি গর্তে একটু অগ্নি সংযোগ করিলেই শয়তান ভয়ঙ্কর শব্দে উহা হইতে বাহির হইয়া অসংখ্য লোকের বিনাশ সাধন করিত।
যাহা হউক, পূর্বোক্ত প্রকারে দৈবাস্ত্র প্রয়োগ করিয়া একজনের যেমন লক্ষ লক্ষ ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করিবার কথা পাঠ করা যায়, সেইরূপ তাঁহাদের যুদ্ধের জন্য নানাবিধ কৌশল-অবলম্বন, ব্যূহ-রচনা, বিভিন্ন প্রকার সৈন্যবিভাগ প্রভৃতির বিষয়ও পাঠ করা যায়। চারিপ্রকার যোদ্ধার কথা মহাভারতাদিতে বর্ণিত আছে—পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্থী ও রথ। ইহার মধ্যে আধুনিক যুদ্ধে শেষ দুইটির ব্যবহার নাই। কিন্তু সে সময় উহাদের বিশেষ প্রচলন ছিল। শত সহস্র হস্তী, তাহাদের আরোহীর সহিত লৌহবর্মাদিতে বিশেষভাবে রক্ষিত হইয়া সৈন্যশ্রেণীরূপে গঠিত হইত—এই হস্তীসৈন্যকে শত্রুসৈন্যের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হইত। তারপর অবশ্য রথের খুব প্রচলন ছিল। আপনারা সকলেই প্রাচীন রথের ছবি দেখিয়াছেন। সকল দেশেই প্রাচীনকালে এই রথের ব্যবহার ছিল।
কৌরব পাণ্ডব উভয় পক্ষই, কৃষ্ণ যাহাতে তাঁহাদের পক্ষে আসিয়া যোগ দেন, তাঁহারা চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিন্ত কৃষ্ণ স্বয়ং এই যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিতে সম্মত হইলেন না। তবে তিনি অর্জুনের সারথ্য স্বীকার করিলেন এবং যুদ্ধকালে পাণ্ডবগণকে পরামর্শ দিতে রাজী হইলেন, আর দুর্যোধনকে নিজ অজেয় নারায়ণী সেনা প্রদান করিলেন।
এইবার কুরুক্ষেত্রের সুবৃহৎ ভূভাগে অষ্টাদশ-দিবসব্যাপী মহাযুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধনের ভাতৃগণ, উভয় পক্ষেরই আত্মীয়স্বজনগণ এবং অন্যান্য সহস্র সহস্র বীর নিহত হইলেন। এমন কি উভয় পক্ষের মিলিত যে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্য ছিল, যুদ্ধাবসানে তাহার অতি অল্পই অবশিষ্ট রহিল। দুর্যোধনের মৃত্যুর পর যুদ্ধের অবসান হইল; পাণ্ডবরা জয়লাভ করিলেন। ধৃতরাষ্ট্র-মহিষী গান্ধারী এবং অন্যান্য নারীগণ পতিপুত্রাদির শোকে অতিশয় বিলাপ করিতে লাগিলেন। যাহা হউক, অবশেষে সকলে কিছু পরিমাণে শান্ত হইলে মৃত বীরগণের যথোচিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল।
এই যুদ্ধের প্রধানতম ঘটনা অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের উপদেশ, যাহা ‘ভগবদ্গীতা’ অপূর্ব ও অমর কাব্যরূপে জগতে পরিচিত। ভারতে ইহাই সর্বজনপরিচিত ও সর্বজনপ্রিয় শাস্ত্র, আর ইহাতে যা উপদেশ আছে, তাহা শ্রেষ্ঠ উপদেশ। কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে কৃষ্ণার্জুনের যে কথোপকথন হয়, তাহাই ‘ভগবদ্গীতা’ নামে পরিচিত। আপনাদের মধ্যে যাঁহারা ঐ গ্রন্থ পড়েন নাই, তাঁহাদিগকে আমি উহা পড়িতে পরামর্শ দিই। ঐ গ্রন্থ আপনাদের দেশের উপরও কি প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, তাহা যদি আপনারা জানিতেন, তবে এতদিন উহা না পড়িয়া থাকিতে পারিতেন না। এমার্সন যে উচ্চ তত্ত্বের প্রচার করিয়া গিয়াছেন, তাহার মূল যদি জানিতে চান, তবে শুনুন—তাহা এই গীতা। তিনি একবার ইংলণ্ডে কার্লাইলের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান, কার্লাইল তাঁহাকে একখানি গীতা উপহার দেন—কংকর্ডে৪ যে উদার দার্শনিক তত্ত্বের আন্দোলন আরম্ভ হয়, এই ক্ষুদ্র গ্রন্থখানি তাহার মূল। আমেরিকায় উদার ভাবের যত প্রকার আন্দোলন দেখিতে পাওয়া যায়, কোন না কোনরূপে সেগুলি ঐ কংকর্ড-আন্দোলনের নিকট ঋণী।
গীতার মূল বক্তা কৃষ্ণ। আপনারা যেমন ন্যাজারেথবাসী যীশুকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া উপাসনা করেন, হিন্দুরা তেমনি ঈশ্বরের অনেক অবতারের পূজা করিয়া থাকেন। জগতের প্রয়োজন অনুসারে ধর্মের রক্ষা ও অধর্মের বিনাশের জন্য বিভিন্ন সময়ে অবতীর্ণ বহু অবতারে তাঁহারা বিশ্বাস করিয়া থাকেন। ভারতের প্রত্যেক ধর্ম-সম্প্রদায় এক এক অবতারের উপাসক। কৃষ্ণের উপাসক একটি সম্প্রদায়ও আছে। অন্যান্য অবতারের উপাসক অপাক্ষা বোধ হয় ভারতে কৃষ্ণোপাসকের সংখ্যাই সর্বাপেক্ষা অধিক। কৃষ্ণভক্তগণ বলেন, কৃষ্ণই অবতারগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা বলেন, বুদ্ধ ও অন্যান্য অবতারের কথা ভাবিয়া দেখঃ তাঁহারা সন্ন্যাসী ছিলেন, সুতরাং গৃহীদের সুখে দুঃখে তাঁহাদের সহানুভূতি ছিল না; কি করিয়াই বা থাকিবে? কিন্তু কৃষ্ণের বিষয় আলোচনা করিয়া দেখঃ তিনি কি পুত্ররূপে, কি পিতারূপে, কি রাজারূপে সর্ব অবস্থাতেই আদর্শ চরিত্র দেখাইয়াছেন, আর তিনি যে অপূর্ব উপদেশ প্রচার করিয়া গিয়াছেন, সমগ্র জীবনে নিজে তাহা আচরণ করিয়া জীবকে শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
যিনি প্রবল কর্মশীলতার মধ্যে থাকিয়াও মধুর শান্তি লাভ করেন, আবার গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যেও মহাকর্মশীল, তিনিই জীবনের যথার্থ রহস্য বুঝিয়াছেন।৫
ইহা কিরূপে কার্যে পরিণত হইতে পারে, কৃষ্ণ তাহা দেখাইয়া গিয়াছেন—ইহার উপায় অনাসক্তি। সব কাজ কর, কিন্তু কোন কিছুর সহিত নিজেকে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত করিও না। তুমি সর্বদাই শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত সাক্ষিস্বরূপ আত্মা। কর্ম আমাদের দুঃখের কারণ নহে, আসক্তিই দুঃখের কারণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ অর্থের কথা ধরুন, ধনবান্ হওয়া খুব ভাল কথা। কৃষ্ণের উপদেশ এই—অর্থ উপার্জন কর, টাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা কর, কিন্তু উহার প্রতি আসক্ত হইও না। পতিপত্নী, পুত্রকন্যা, আত্মীয়স্বজন, মানযশ সকল সম্বন্ধেই এই কথা। ইহাদিগকে ত্যাগ করিবার প্রয়োজন নাই, কেবল এইটুকু লক্ষ্য রাখিবেন যে, ইহাদের প্রতি যেন আসক্ত হইয়া না পড়েন। আসক্তি বা অনুরাগের পাত্র কেবল একজন—স্বয়ং প্রভু ভগবান্, আর কেহ নহে। আত্মীয়স্বজনের জন্য কার্য করুন, তাহাদিগকে ভালবাসুন, তাহাদের ভাল করুন, যদি প্রয়োজন হয় তাহাদের জন্য শত শত জীবন উৎসর্গ করুন, কিন্তু কখনও তাহাদের প্রতি আসক্ত হইবেন না। শ্রীকৃষ্ণের নিজের জীবন উক্ত উপদেশের যথার্থ উদাহরণস্বরূপ ছিল।
স্মরণ রাখিবেন—যে গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত বর্ণিত আছে, তাহা বহু সহস্র বৎসরের প্রাচীন, আর তাঁহার জীবনের কতক অংশ প্রায় ন্যাজারেথবাসী যীশুর মত। কৃষ্ণ রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। কংস নামক এক অত্যাচারী রাজা ছিল। আর কংস দৈববাণী-শ্রবণে অবগত হইয়াছিল যে, শীঘ্রই তাহার নিধনকর্তা জন্মগ্রহণ করিবেন। উহা শুনিয়া সে নিজ অনুচরবর্গকে সকল পুরুষ-শিশু হত্যা করিবার আদেশ দিল। কৃষ্ণের পিতামাতাও কংসকর্তৃক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন—সেই কারাগারেই কৃষ্ণের জন্ম হয়। কৃষ্ণের জন্মগ্রহণমাত্র সমুদয় কারাগার জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। নবজাত শিশু বলিয়া উঠিল, ‘আমিই সমস্ত জীব-জগতের জ্যোতিঃস্বরূপ, জগতের কল্যাণের জন্য জন্মগ্রহণ করিয়াছি।’ আবার কৃষ্ণকে রূপকচ্ছলে ব্রজগোপাল বলা হইয়াছে, তাঁহার একটি নাম ‘রাখালরাজ’। সাক্ষাৎ ভগবান্ নরকলেবর পরিগ্রহ করিয়াছে জানিতে পারিয়া ঋষিরা তাঁহার পূজার জন্য উপস্থিত হইলেন। উভয়ের জীবনলীলার অন্যান্য অংশে আর কোন সাদৃশ্য নাই।
যাহা হউক, শ্রীকৃষ্ণই এই অত্যাচারী কংসকে পরাভূত করিলেন বটে, কিন্তু তিনি কখনও স্বয়ং সিংহাসন আরোহণ করিবার কল্পনাও করেন নাই। তিনি কর্তব্য বলিয়াই ঐ কার্য সম্পদান করিয়াছিলেন; উহার ফলাফল লইয়া বা উহাতে নিজের কি স্বার্থসিদ্ধি হইতে পারে—এই বিষয়ে তাঁহার কোন চিন্তা উঠে নাই।
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের অবসানে মহারথী বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম—যিনি আঠার দিনের মধ্যে দু-দশ দিন যুদ্ধ করিয়া মৃত্যুর অপেক্ষায় শরশয্যায় শয়ান ছিলেন—যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্ম, বর্ণাশ্রমধর্ম, দানধর্ম, বিবাহবিধি প্রভৃতি বিষয়গুলি প্রাচীন ঋষিগণের উপদেশ অবলম্বন করিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের নিকট সাংখ্য ও যোগতত্ত্ব এবং ঋষি দেবতা ও প্রাচীন রাজগণ সম্বন্ধে অনেক আখ্যায়িকা ও কিংবদন্তী বিবৃত করিলেন। মহাভারতের প্রায় এক চতুর্থাংশ ভীষ্মের এই উপদেশে পূর্ণ; ইহা হিন্দুগণের ধর্মসম্বন্ধীয় বিবিধ বিধান, নীতিতত্ত্ব প্রভৃতির অক্ষয় ভাণ্ডারস্বরূপ। ইতোমধ্যে যুধিষ্ঠিরের রাজপদে অভিষেক-ক্রিয়া সমাপ্ত হইল। কিন্তু কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের ভয়ঙ্কর রক্তপাতে এবং আত্মীয়স্বজন ও কুলবৃদ্ধগণের নিধনে তাঁহার হৃদয় গভীর শোকে আচ্ছন্ন হইল। এক্ষণে ব্যাসের উপদেশানুসারে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করিলেন।
যুদ্ধাবসানে পঞ্চদশ বর্ষ যাবৎ যুধিষ্ঠির ও তদীয় ভ্রাতৃগণ কর্তৃক পূজিত হইয়া ধৃতরাষ্ট্র সসম্মানে নিরুদ্বেগে অতিবাহিত করিলেন। পরে সেই বৃদ্ধ ভূপতি যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যের সমুদয় ভার অর্পণ করিয়া নিজ পতিব্রতা মহিষী ও পাণ্ডবগণের মাতা কুন্তীর সহিত শেষ জীবনে তপস্যার জন্য অরণ্যে প্রস্থান করিলেন।
সিংহাসনে আরোহণের পর ছত্রিশ বৎসর অতিবাহিত হইলে একদিন সংবাদ আসিল—পাণ্ডবদের পরম সুহৃৎ, পরম আত্মীয়, আচার্য, পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টা শ্রীকৃষ্ণ এই মর্ত্যধাম পরিত্যাগ করিয়াছেন। অর্জুন অনতিবিলম্বে দ্বারকায় গমন ও তথা হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া পূর্বশ্রুত শোকসংবাদই সমর্থন করিলেন। শুধু কৃষ্ণ কেন, যাদবগণের প্রায় কেহই জীবিত ছিলেন না। তখন রাজা যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য ভ্রাতৃগণ শোকে মুহ্যমান হইয়া ভাবিলেন, আর কেন—আমাদেরও যাইবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। এই ভাবিয়া তাঁহারা রাজকার্য পরিত্যাগ করিয়া অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসাইয়া মহাপ্রস্থানের জন্য হিমালয়ে গমন করিলেন। মহাপ্রস্থান এক প্রকার সন্ন্যাসবিশেষ। প্রাচীনকালে ভারতে রাজগণও অন্যান্য সকলের ন্যায় বৃদ্ধ বয়সে সন্ন্যাসী হইতেন। জীবনের সকল মায়া কাটাইয়া পানাহারবর্জিত অবস্থায় যে পর্যন্ত না দেহপাত হয়, সে পর্যন্ত কেবল ঈশ্বরচিন্তা করিতে করিতে হিমালয়ের দিকে চলিতে হয়; এইরূপে চলিতে চলিতে দেহত্যাগ হইয়া থাকে।
তারপর দেবগণ ও ঋষিগণ আসিয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন যে, তাঁহাকে সশরীরে স্বর্গে যাইতে হইবে। স্বর্গে যাইতে হইলে হিমালয়ের উচ্চতম চূড়াসমূহ পার হইয়া যাইতে হয়। হিমালয়ের পরপারে সুমেরু পর্বত। সুমেরু পর্বতের চূড়ায় স্বর্গলোক। সেখানে দেবগণ বাস করেন। কেহ কখনও সশরীরে স্বর্গে যাইতে পারেন নাই। দেবগণ যুধিষ্ঠিরকে এই স্বর্গে যাইবার জন্য আমন্ত্রণ করিলেন।
সুতরাং পঞ্চপাণ্ডব ও তাঁহাদের সহধর্মিণী দ্রৌপদী স্বর্গগমনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া বল্কল পরিধান করিয়া যাত্রা করিলেন। পথে একটি কুকুর তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিল। ক্রমে উত্তরাভিমুখে চলিতে চলিতে তাঁহারা হিমালয়ে উপনীত হইলেন ও ক্লান্তপদে হিমালয়ের চূড়ার পর চূড়া লঙ্ঘন করিতে করিতে অবশেষে সম্মুখে সুবিশাল সুমেরু গিরি দেখিতে পাইলেন। তাঁহারা নিস্তব্ধভাবে বরফের উপর দিয়া চলিতেছেন, এমন সময়ে দ্রৌপদী হঠাৎ অবসন্নদেহে পড়িয়া গেলেন, আর উঠিলেন না। সকলের অগ্রগামী যুধিষ্ঠিরকে ভীম বলিলেন, ‘রাজন্, দেখুন, রাজ্ঞী দ্রৌপদী ভূমিতলে পতিত হইয়াছেন।’ যুধিষ্ঠিরের চোখ দিয়া শোকাশ্রু ঝরিল, কিন্তু তিনি ফিরিয়া দেখিলেন না, কেবল বলিলেন, ‘আমরা কৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেছি, এখন আর পশ্চাতে ফিরিয়া দেখিবার সময় নাই। চল, অগ্রসর হও।’ কিয়ৎক্ষণ পরে আবার ভীম আবার বলিয়া উঠিলেন, ‘দেখুন, দেখুন আমাদের ভ্রাতা সহদেব পড়িল।’ রাজার শোকাশ্রু ঝরিল, কিন্তু তিনি থামিলেন না। কেবল বলিলেন, ‘চল, চল, অগ্রসর হও।’
সহদেবের পতনের পর এই অতিরিক্ত শীত ও হিমানীতে নকুল, অর্জুন ও ভীম একে একে পড়িলেন, কিন্তু রাজা যুধিষ্ঠির তখন একাকী হইলেও অবিচলিতভাবে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। পশ্চাতে একবার ফিরিয়া দেখিলেন, যে কুকুরটি তাঁহাদের সঙ্গ লইয়াছিল, সে তখনও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছে। তখন রাজা যুধিষ্ঠির ঐ কুকুরের সহিত হিমানীস্তূপের মধ্য দিয়া অনেক পর্বত উপত্যকা অতিক্রম করিয়া ক্রমশঃ উচ্চে আরোহণ করিতে লাগিলেন এবং এইরূপে অবশেষে সুমেরু পর্বতে উপনীত হইলেন। তখন স্বর্গের দুন্দুভিধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল, দেবগণ এই ধার্মিক রাজার উপর পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। এইবার ইন্দ্র দেবরথে আরোহণ করিয়া সেখানে অবতীর্ণ হইলেন এবং রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে রাজন্, তুমি মর্ত্যগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কারণ একমাত্র তোমাকেই সশরীরে স্বর্গারোহণের অধিকার দেওয়া হইয়াছে।’ কিন্তু যুধিষ্ঠির ইন্দ্রকে বলিলেন, ‘আমি আমার একান্ত অনুগত ভ্রাতৃচতুষ্টয় ও দ্রৌপদীকে না লইয়া স্বর্গে গমন করিতে প্রস্তুত নহি।’ তখন ইন্দ্র তাঁহাকে বলিলেন, ‘তাঁহারা পূর্বেই স্বর্গে গিয়াছেন।’
এখন যুধিষ্ঠির তাঁহার পশ্চাতে ফিরিয়া তাঁহার অনুসরণকারী সেই কুকুরটিকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘বৎস, এস, রথে আরোহণ কর।’ ইন্দ্র এই কথা শুনিয়া চমকিত হইয়া কহিলেন, ‘রাজন্, আপনি এ কি বলিতেছেন! কুকুর রথে আরোহণ করিবে! এই অশুচি কুকুরটাকে আপনি ত্যাগ করুন। কুকুর কখনও স্বর্গে যায় না। আপনার মনের ভাব কি? আপনি কি পাগল হইয়াছেন? মনুষ্যগণের মধ্যে আপনি ধার্মিকশ্রেষ্ঠ, আপনিই কেবল সশরীরে স্বর্গগমনের অধিকারী।’ তখন রাজা যুধিষ্ঠির কহিলেন, ‘হে ইন্দ্র, হে দেবরাজ, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা সকলই সত্য; কিন্তু এই কুকুরটি হিমানীস্তূপ-লঙ্ঘনের সময় প্রভুভক্ত ভৃত্যের মত বারবার আমার সঙ্গে আসিয়াছে, একবারও আমার সঙ্গ ত্যাগ করে নাই। আমার ভাতৃগণ একে একে দেহত্যাগ করিল, মহিষীরও প্রাণ গেল—সকলেই একে একে আমায় ত্যাগ করিল, কেবল এই কুকুরটিই আমায় ত্যাগ করে নাই। আমি এখন উহাকে কিরূপে ত্যাগ করিতে পারি?’ ইন্দ্র বলিলেন, ‘কুকুর-সঙ্গী মানুষের স্বর্গলোকে স্থান নাই। অতএব কুকুরটি পরিত্যাগ করিতে হইবে, ইহাতে আপনার কোন অধর্ম হইবে না।’ যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘কুকুরটি আমার সঙ্গে যাইতে না পাইলে আমি স্বর্গে যাইতে চাহি না। যতক্ষণ দেহে জীবন থাকিবে, ততক্ষণ আমি শরণাগতকে কখনও পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আমি জীবন থাকিতে স্বর্গসুখ-সম্ভোগের জন্য অথবা দেবতার অনুরোধেও ধর্মপথ কখনও পরিত্যাগ করিব না।’ তখন ইন্দ্র বলিলেন, ‘রাজন্, আপনার শরণাগত কুকুরটি স্বর্গে গমন করে, ইহাই যদি আপনার একান্ত অভিপ্রেত হয়, তবে আপনি এক কাজ করুন। আপনি মর্ত্যগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধার্মিক, আর ওই কুকুর অশুচি—প্রাণিহত্যাকারী, জীবমাংসভোজী, হিংসাবৃত্তিপরায়ণ; কুকুরটা পাপী, আপনি পুণ্যাত্মা। আপনি পুণ্যবলে যে স্বর্গলোক অর্জন করিয়াছেন, তাহা এই কুকুরের সহিত বিনিময় করিতে পারেন।’ রাজা যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘আমি ইহাতে সম্মত আছি। কুকুর আমার সমুদয় পুণ্য লইয়া স্বর্গে গমন করুক।’
যুধিষ্ঠির এই বাক্য বলিবামাত্র পট-পরিবর্তন হইল। যুধিষ্ঠির দেখিলেন, সেখানে কুকুর নাই, তাহার স্থানে সাক্ষাৎ ধর্মরাজ যম বর্তমান। তিনি রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘রাজন্, আমি সাক্ষাৎ ধর্মরাজ, আপনার ধর্ম পরীক্ষার জন্য কুকুররূপ পরিগ্রহ করিয়াছিলাম। আপনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন। একটা সামান্য কুকুরকে নিজের পুণ্যার্জিত স্বর্গ প্রদান করিয়া স্বয়ং তাহার জন্য নরকে গমন করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন, আপনার মত নিঃস্বার্থ ব্যক্তি এ পর্যন্ত ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করে নাই। হে মহারাজ, আপনার জন্ম দ্বারা পৃথিবী ধন্য হইয়াছে। সর্বপ্রাণীর প্রতি আপনার গভীর অনুকম্পা—এইমাত্র তাহার প্রকৃষ্ট পরিচয় পাইলাম। অতএব আপনি অক্ষয় সুখকর লোকসমূহ লাভ করুন। হে রাজন্, আপনি নিজধর্মবলে ঐ সকল লোক অর্জন করিয়াছেন, আপনার দিব্য পরমপদ লাভ হইবে।’
তখন যুধিষ্ঠির স্বর্গীয় বিমানে আরোহণ করিয়া ইন্দ্র ধর্ম ও অন্যান্য দেবগণের সঙ্গে স্বর্গে গমন করিলেন। সেখানে আবার প্রথমে তাঁহার আরও কিছু পরীক্ষা হইল, পরে স্বর্গস্থ মন্দাকিনীতে অবগাহন করিয়া তিনি দিব্যদেহ লাভ করিলেন। অবশেষে অমর দেবদেহপ্রাপ্ত ভাতৃগণের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। তখন সকল দুঃখের অবসান হইল, তাঁহারা সকলে আনন্দের পরাকাষ্ঠা লাভ করিলেন।
এইরূপে মহাভারত উচ্চভাবদ্যোতক কবিতায় ‘ধর্মের জয় ও অধর্মের পরাজয়’ বর্ণনা করিয়া এইখানেই পরিসমাপ্ত হইয়াছে।
উপসংহারে বলি, আপনাদের নিকট মহাভারতের মোটামুটি সংক্ষিপ্ত বিবরণমাত্র দিলাম। কিন্তু মহাপ্রতিভাবান্ ও মনীষাসম্পন্ন মহর্ষি বেদব্যাস ইহাতে যে অসংখ্য মহাপুরুষের উন্নত ও মহিমময় চরিত্রের সমাবেশ করিয়াছেন, তাহার সামান্য পরিচয়ও দিতে পারিলাম না। ধর্মভীরু অথচ দুর্বলচিত্ত বৃদ্ধ অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মনে একদিকে ধর্ম ও ন্যায়, অপরদিকে পুত্রবাৎসল্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব, পিতামহ ভীষ্মের মহৎ চরিত্র, রাজা যুধিষ্ঠিরের মহান্ ধর্মভাব, অপর চারি পাণ্ডবের উন্নত চরিত্র, যাহাতে একদিকে মহাশৌর্যবীর্য—অপর দিকে সর্বাবস্থায় জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজা যুধিষ্ঠিরের প্রতি অগাধ ভক্তি ও অপূর্ব আজ্ঞাবহতার সমাবেশ; মানবীয় অনুভূতির পরাকাষ্ঠা শ্রীকৃষ্ণের অতুলনীয় চরিত্র, এবং তপস্বিনী রাজ্ঞী গান্ধারী, পাণ্ডবগণের স্নেহময়ী জননী কুন্তী, সদা ভক্তিপরায়ণা ও সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি দ্রৌপদী প্রভৃতি নারীদের চরিত্র—যাহা পুরুষগণের চরিত্রের তুলনায় কোন অংশে কম উজ্জ্বল নহে—এই কাব্যের এই সকল এবং অন্যান্য শত শত চরিত্র এবং রামায়ণের চরিত্রসমূহ বিগত সহস্র বর্ষ ধরিয়া সমগ্র হিন্দুজগতের সযত্নে রক্ষিত জাতীয় সম্পত্তি, এবং তাঁহাদের ভাবধারা ও চরিত্রনীতির ভিত্তিরূপে বর্তমান রহিয়াছে। বাস্তবিক এই রামায়ণ ও মহাভারত প্রাচীন আর্যগণের জীবনচরিত ও জ্ঞানরাশির সুবৃহৎ বিশ্বকোষ। ইহাতে সভ্যতার যে আদর্শ চিত্রিত হইয়াছে, তাহা লাভ করিবার জন্য সমগ্র মানবজাতিকে এখনও বহুকাল ধরিয়া চেষ্টা করিতে হইবে।