[লস এঞ্জেলেস্, ক্যালিফর্নিয়া, ৮ জানুআরী ১৯০০ খ্রীঃ]
সর্ব যুগে পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষ অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছে। অসাধারণ ঘটনার কথা আমরা সকলেই শুনিয়াছি, এ-বিষয়ে আমাদের অনেকের নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতাও আছে। বিষয়টির প্রস্তাবনারূপে আমি বরং তোমাদের নিকট প্রথমে আমার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি ঘটনারই উল্লেখ করিব। একবার এক ব্যক্তির কথা শুনিয়া-ছিলাম; মনে মনে কোন প্রশ্ন ভাবিয়া তাঁহার কাছে যাওয়া মাত্রই তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়া দিতেন; আরও শুনিয়াছিলাম, তিনি ভবিষ্যদ্বাণীও করেন। মনে কৌতূহল জাগিল; তাই কয়েকজন বন্ধুসঙ্গে তাঁহাকে দেখিতে গেলাম। প্রত্যেকেই মনে মনে কোন-না-কোন প্রশ্ন ঠিক করিয়া রাখিলাম এবং পাছে ভুল হয়, সেজন্য প্রশ্নগুলি এক এক খণ্ড কাগজে লিখিয়া নিজ নিজ জামার পকেটে রাখিয়া দিলাম। আমাদের এক একজনের সঙ্গে তাঁহার যেমনি দেখা হইতে লাগিল, অমনি তিনি তাঁহার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিয়া উত্তর বলিয়া দিতে লাগিলেন। পরে একখণ্ড কাগজে কি লিখিয়া কাগজটি ভাঁজ করিয়া আমার হাতে দিলেন, এবং তাহার অপর পিঠে আমাকে নাম স্বাক্ষর করিতে অনুরোধ করিয়া বলিলেন, ‘এটি দেখিবেন না, পকেটে রাখিয়া দিন; যখন বলিব, তখন বাহির করিবেন।’ আমাদের সকলের সঙ্গেই এই রকম করিলেন। তারপর আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে ঘটিবে, এমন কয়েকটি ঘটনার কথাও বলিলেন। অবশেষে বলিলেন, ‘আপনাদের যে ভাষায় খুশী, কোন শব্দ বা বাক্য চিন্তা করুন।’ আমি সংস্কৃত ভাষায় একটি প্রকাণ্ড বাক্য মনে মনে আওড়াইলাম; সংস্কৃতের বিন্দু-বিসর্গও তিনি জানিতেন না। তিনি বলিলেন, ‘পকেট হইতে কাগজটি বাহির করুন তো!’ দেখি, তাহাতে সেই সংস্কৃত বাক্যটিই লেখা রহিয়াছে! এক ঘণ্টা আগে তিনি এটি লিখিয়াছিলেন, আর নীচে মন্তব্য দিয়াছিলেন, ‘যাহা লিখিয়া রাখিলাম, ইনি পরে সেই বাক্যটিই ভাবিবেন’—ঠিক তাহাই হইল। আমাদের অন্য একজন বন্ধুকেও অনুরূপ একখানি কাগজ দিয়াছিলেন, এবং তিনিও তাহা স্বাক্ষর করিয়া পকেটে রাখিয়াছিলেন। এখন বন্ধুটিকেও একটি বাক্য চিন্তা করিতে বলিলে তিনি কোরানের একাংশ হইতে আরবী ভাষায় একটি বাক্য ভাবিলেন। ঐ ব্যক্তির সে ভাষা জানিবার সম্ভাবনা ছিল আরও কম। বন্ধুটি দেখিলেন, সেই বাক্যটিই কাগজে লেখা আছে।
সঙ্গীদের মধ্যে আর একজন ছিলেন ডাক্তার। তিনি জার্মান ভাষায় লিখিত কোন ডাক্তারি পুস্তক হইতে একটি বাক্য ভাবিলেন। তাঁহার কাগজে তাহাই পাওয়া গেল।
সেদিন হয়তো কোনরূপ প্রতারিত হইয়াছি ভাবিয়া কিছুদিন পরে আমি আবার সেই ব্যক্তির নিকট গেলাম। সেদিন আমার সঙ্গে নূতন আর একদল বন্ধু ছিলেন। সেদিনও তিনি অদ্ভুত সাফল্যের পরিচয় দিয়াছিলেন।
আর একবার—ভারতে হায়দ্রাবাদ শহরে থাকার সময় শুনিলাম যে, সেখানে একজন ব্রাহ্মণ আছেন; তিনি হরেক রকমের জিনিষ বাহির করিয়া দিতে পারেন। কোথা হইতে যে আসে সেগুলি, কেহই জানে না। তিনি একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক। আমি তাঁহার কৌশল দেখিতে চাহিলাম। ঘটনাচক্রে তখন তাঁহার জ্বর। ভারতে একটি সাধারণ বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, কোন সাধু ব্যক্তি অসুস্থ লোকের মাথায় হাত বুলাইয়া দিলে তাহার অসুখ সারিয়া যায়। ব্রাহ্মণটি সেজন্য আমার নিকট আসিয়া বলিলেন, ‘মহাশয়, মাথায় হাত বুলাইয়া আমার জ্বর সারাইয়া দিন।’ আমি বলিলাম, ‘ভাল কথা, তবে আমাকে আপনার কৌশল দেখাইতে হইবে।’ তিনি রাজী হইলেন। তাঁহার ইচ্ছামত আমি তাঁহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিলাম; তিনিও তাঁহার প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য বাহিরে আসিলেন। তাঁহার কটিদেশে জড়ানো একফালি কাপড় ছাড়া আমরা তাঁহার দেহ হইতে আর সব পোষাকই খুলিয়া লইলাম। বেশ শীত পড়িয়াছিল, সেজন্য আমার কম্বলখানি তাঁহার গায়ে জড়াইয়া দিলাম; ঘরের এক-কোণে তাঁহাকে বসাইয়া দেওয়া হইল, আর পঁচিশ জোড়া চোখ চাহিয়া রহিল তাঁহার দিকে। তিনি বলিলেন, ‘যিনি যাহা চান, কাগজে তাহা লিখিয়া ফেলুন।’ সে অঞ্চলে কখনও জন্মে না, এমন সব ফলের নাম আমরা লিখিলাম—আঙুর, কমলালেবু, এই-সব ফল। লেখার পর কাগজগুলি তাঁহাকে দিলাম। তারপর কম্বলের ভিতর হইতে আঙুরের থোলো, কমলালেবু ইত্যাদি সবই বাহির হইল। এত ফল জমিয়া গেল যে, ওজন করিলে সব মিলিয়া তাঁহার দেহের ওজনের দ্বিগুণ হইয়া যাইত। সে-সব ফল আমাদের খাইতে বলিলেন। আমাদের ভিতর কেহ কেহ আপত্তি জানাইলেন, ভাবিলেন ইহাতে সম্মোহনের ব্যাপার আছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ নিজেই খাইতে শুরু করিলেন দেখিয়া আমরাও সবাই উহা খাইলাম। সেগুলি আসল ফলই ছিল।
সব শেষে তিনি একরাশি গোলাপফুল বাহির করিলেন। প্রত্যেকটি ফুলই নিখুঁত—শিশিরবিন্দু পর্যন্ত রহিয়াছে পাপড়ির উপর; একটিও থেঁতলানো নয়, একটিও নষ্ট হয় নাই। আর একটি দুটি তো নয়, রাশি রাশি ফুল! কি করিয়া ইহা সম্ভব হইল—জানিতে চাহিলে তিনি বলিলেন, ‘সবই হাত-সাফাই এর ব্যাপার।’
তা যে-ভাবেই ঘটুক, এটি বেশ বোঝা গেল যে, শুধু হাত-সাফাই এর দ্বারা এরূপ ঘটানো অসম্ভব। এত বিপুল পরিমাণ জিনিষ তিনি আনিলেন কোথা হইতে?
যাহাই হউক, এরূপ বহু ঘটনা আমি দেখিয়াছি। ভারতে ঘুরিলে বিভিন্ন স্থানে এরূপ শত শত ঘটনা দেখিতে পাওয়া যায়। প্রত্যেক দেশেই এ-সব আছে। এমন কি এদেশেও এ ধরনের অদ্ভুত ঘটনা কিছু কিছু চোখে পড়ে। অবশ্য ভণ্ডামিও বেশ কিছু আছে, সন্দেহ নাই; কিন্তু দেখ—ভণ্ডামি দেখিলেই এ-কথাও তো বলিতে হইবে যে, উহা কোন কিছু সত্য ঘটনার অনুকরণ। কোথাও না কোথাও সত্য নিশ্চয়ই আছে, যাহার অনুকরণ করা হইতেছে। শূন্য- পদার্থের তো আর অনুকরণ হয় না। অনুকরণ করিতে হইলে অনুকরণ করিবার মত যথার্থ সত্য বস্তু একটি থাকা চাই-ই।
অতি প্রাচীন কালে, হাজার হাজার বছর আগে, ভারতে আজকালকার চেয়ে অনেক বেশী করিয়াই এই-সব ঘটনা ঘটিত। আমার মনে হয়, যখন কোন দেশে লোকবসতি খুব বেশী ঘন হয়, তখন যেন মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তি হ্রাস পায়। আবার কোন বিস্তৃত দেশে যদি লোকবসতি খুব পাতলা হয়, তাহা হইলে সেখানে বোধ হয় আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকতর বিকাশ ঘটে।
হিন্দুদের ধাত খুব বিচারপ্রবণ বলিয়া এই-সব ঘটনার প্রতি তাঁহাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছিল; ইহা লইয়া তাঁহারা গবেষণা করিয়াছিলেন এবং কতকগুলি বিশেষ সিদ্ধান্তেও পৌঁছিয়াছিলেন, অর্থাৎ ইহা লইয়া তাঁহারা একটি বিজ্ঞানই গড়িয়া তুলিয়াছেন। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন, এ-সব ঘটনা অসাধারণ হইলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই সংঘটিত হয়; অতি-প্রাকৃতিক বলিয়া কিছুই নাই। জড়জগতের অন্য যে-কোন ঘটনার মতই এগুলিও নিয়মাধীন। কেহ এইরূপ শক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিলে উহাকে প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলার কোন কারণ নাই; কেন-না এই সিদ্ধান্তগুলি লইয়া যথারীতি গবেষণা ও সাধন করা যায়, এবং এগুলি অর্জন করা যায়। তাঁহারা এই বিদ্যার নাম দিয়াছিলেন ‘রাজযোগ’। ভারতে হাজার হাজার লোক এই বিদ্যার চর্চা করে; ইহা সে-জাতির নিত্য-উপাসনার একটি অঙ্গ হইয়া গিয়াছে।
হিন্দুরা এই সিদ্ধান্তে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন যে, মানুষের মনের মধ্যেই এই-সব অসাধারণ শক্তি নিহিত আছে। আমাদের মন বিশ্বব্যাপী বিরাট মনেরই অংশমাত্র। প্রত্যেক মনের সঙ্গেই অপরাপর সব মনের সংযোগ রহিয়াছে। একটি মন যেখানেই থাকুক না কেন, গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাহার সত্যিকারের যোগাযোগ রহিয়াছে।
দূরদেশে চিন্তা প্রেরণ করা-রূপ যে একজাতীয় ঘটনা আছে, তাহা কখনও লক্ষ্য করিয়াছ কি? এখানে কেহ কিছু চিন্তা করিল; হয়তো ঐ চিন্তাটি অন্য কোথাও অন্য কাহারও মনে স্পষ্ট ভাসিয়া উঠিল। হঠাৎ যে এমন হয়, তাহা নয়। উপযুক্ত প্রস্তুতির পরে—কেহ হয়তো দূরবর্তী কাহারও মনে কোন চিন্তা পাঠাইবার ইচ্ছা করে; আর যাহার কাছে পাঠানো হয়, সেও টের পায় যে, চিন্তাটি আসিতেছে; এবং যেভাবে পাঠানো হইয়াছে ঠিক সেইভাবেই উহা গ্রহণ করে—দূরত্বে কিছু যায় আসে না। চিন্তাটি লোকটির কাছে ঠিক পৌঁছায়, এবং সে সেটি বুঝিতে পারে। তোমার মন যদি একটি স্বতন্ত্র পদার্থরূপে এখানে থাকে, আর আমার মন অন্য একটি স্বতন্ত্র পদার্থ হিসাবে ওখানে থাকে এবং এ দুই-এর মধ্যে কোন যোগাযোগ না থাকে, তাহা হইলে আমার মনের চিন্তা তোমার কাছে পৌঁছায় কিরূপে? সাধারণ ক্ষেত্রে আমার চিন্তাগুলি যে তোমার কাছে সোজাসুজি পৌঁছায়, তা নয়; আমার চিন্তাগুলিকে ‘ইথার’-এর তরঙ্গে পরিণত করিতে হয়, সেই ইথার-তরঙ্গগুলি তোমার মস্তিষ্কে পৌঁছিলে সেগুলিকে আবার তোমার নিজের মনের চিন্তায় রূপায়িত করিতে হয়। চিন্তাকে এখন রূপান্তরিত করা হইতেছে, আর সেখানে আবার উহাকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হইতেছে। প্রক্রিয়াটি এক পরোক্ষ জটিল পথে চলে। কিন্তু টেলিপ্যাথিতে (ইচ্ছাসহায়ে দূরদেশে চিন্তা প্রেরণের ব্যাপারে) তাহা করিতে হয় না; এটি প্রত্যক্ষ সোজাসুজি ব্যাপার।
ইহা হইতেই বোঝা যায়, যোগীরা যেরূপ বলিয়া থাকেন মনটি সেরূপ নিরবচ্ছিন্নই বটে। মন বিশ্বব্যাপী। তোমার মন, আমার মন, ছোট ছোট এই-সব মনই সেই এক বিরাট মনের ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, একই মানস-সমুদ্রের কয়েকটি ছোট ছোট তরঙ্গ; আর মনের এই নিরবচ্ছিন্নতার জন্যই আমরা একজন আর একজনের কাছে প্রত্যক্ষভাবে চিন্তা পাঠাইতে পারি।
আমাদের চারিদিকে কি ঘটিতেছে—দেখ না। জগৎ জুড়িয়া যেন একটা প্রভাব-প্রসারের ব্যাপার চলিতেছে। নিজ শরীর-রক্ষার কাজে আমাদের শক্তির একটা অংশ ব্যয়িত হয়, বাকী শক্তির প্রতিটি বিন্দুই দিনরাত ব্যয়িত হইতেছে অপরকে প্রভাবান্বিত করার কাজে। আমাদের শরীর, আমাদের গুণ, আমাদের বুদ্ধি এবং আমাদের আধ্যাত্মিকতা—এ-সবই সর্বক্ষণ অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। অপর দিকে আবার ঠিক এইভাবেই আমরাও অপরের দ্বারা প্রভাবিত হইতেছি। আমাদের চারিদিকেই এই কাণ্ড ঘটিতেছে। একটি স্থূল উদাহরণ দিতেছি। কেহ হয়তো আসিলেন, যাঁহাকে তুমি সুপণ্ডিত বলিয়া জান এবং যাঁহার ভাষা মনোরম; ঘণ্টাখানেক ধরিয়া তিনি তোমার সঙ্গে কথা বলিলেন। কিন্তু তিনি তোমার মনে কোন রেখাপাত করিতে পারিলেন না। আর একজন আসিয়া কয়েকটি মাত্র কথা বলিলেন, তাও সুসংবদ্ধ ভাষায় নয়, হয়তো বা ব্যাকরণের ভুলও রহিয়াছে; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি তোমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিলেন। তোমরা অনেকেই ইহা লক্ষ্য করিয়াছ। কাজেই বেশ বোঝা যাইতেছে যে, শুধু কথা সব সময় মনে দাগ কাটিতে পারে না; লোকের মনে ছাপ দিবার কাজে ভাষা—এমন কি চিন্তা পর্যন্ত কাজ করে তিনভাগের একভাগ মাত্র, বাকী দুইভাগ কাজ করে ব্যক্তিটি। ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ বলিতে যাহা বুঝায়, তাহাই বাহিরে গিয়া তোমাকে প্রভাবিত করে।
আমাদের সব পরিবারেই একজন কর্তা আছেন; দেখা যায়—তাঁহাদের ভিতর কয়েকজন এ-কাজে সফলকাম হন, কয়েকজন হন না। কেন? আমাদের সফলতার জন্য আমরা দোষ চাপাই পরিবারের অন্য লোকদের উপর। অকৃতকার্য হইলেই বলি, এই অমুকের দোষে এইরূপ হইল। বিফলতার সময় নিজের দোষ বা দুর্বলতা কেহ স্বীকার করিতে চায় না। নিজেকে নির্দোষ দেখাইতে চায় সকলেই, আর দোষ চাপায় অপর কাহারও বা অপর কিছুর ঘাড়ে, না হয়তো দুর্ভাগ্যের ঘাড়ে। গৃহকর্তারা যখন অকৃতকার্য হন, তখন তাঁহাদের নিজেদের মনেই প্রশ্ন তোলা উচিত যে, কেহ কেহ তো বেশ ভালভাবেই সংসার চালায়, আবার কেহ কেহ তাহা পারে না কেন? দেখা যাইবে যে, সব নির্ভর করিতেছে ব্যক্তিটির উপর; পার্থক্য সৃষ্টির কারণ হয় লোকটি নিজে, তাহার উপস্থিতি বা তাহার ব্যক্তিত্ব।
মানবজাতির বড় বড় নেতাদের কথা ভাবিতে গেলে আমরা সর্বদা দেখিব, নিজ নিজ ব্যক্তিত্বের জন্যই তাঁহারা নেতা হইতে পারিয়াছিলেন। অতীতের বড় বড় সব গ্রন্থকারদের, বড় বড় সব চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কথা ধর। খাঁটি কথা বলিতে গেলে কয়টি চিন্তাই বা তাঁহারা করিয়াছেন? মানবজাতির পুরাতন নেতারা যাহা কিছু লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার সবটার কথাই ভাব; তাঁহাদের প্রত্যেকখানি পুস্তক লইয়া উহার মূল্য নির্ধারণ কর। জগতে আজ পর্যন্ত যে-সব যথার্থ চিন্তার, নূতন ও খাঁটি চিন্তার উদ্ভব হইয়াছে, সেগুলির পরিমাণ মুষ্টিমেয়। আমাদের জন্য যে-সব চিন্তা তাঁহারা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, সেগুলি পড়িয়া দেখ। গ্রন্থকারেরা যে মহামানব ছিলেন, তাহা তো মনে হয় না, অথচ জীবৎকালে তাঁহারা যে মহামানবই ছিলেন, তাহা সুবিদিত। তাঁহারা এত বড় হইয়াছিলেন কিভাবে? শুধু তাঁহাদের চিন্তা, তাঁহাদের লেখা গ্রন্থ বা তাঁহাদের বক্তৃতার জন্য তাঁহারা বড় হন নাই; এ-সব ছাড়া আরও কিছু ছিল, যাহা এখন আর নাই; সেটি তাঁহাদের ব্যক্তিত্ব। আগেই বলিয়াছি, এ ব্যাপারে মানুষটির ব্যক্তিত্বের প্রভাব তিনভাগের দুইভাগ, আর তাঁহার বুদ্ধির, তাঁহার ভাষার প্রভাব তিনভাগের একভাগ। প্রত্যেকের ভিতরই আমাদের আসল মানুষটি, আসল ব্যক্তিত্বটি প্রকৃত কাজ করে; আমাদের ক্রিয়াগুলি তো শুধু উহার বহিঃপ্রকাশ। মানুষটি থাকিলে কাজ হইবেই; কার্য কারণকে অনুসরণ করিতে বাধ্য।
সর্ববিধ জ্ঞানদানের, সর্ববিধ শিক্ষার আদর্শ হওয়া উচিত ভিতরের মানুষটিকে গড়িয়া তোলা। কিন্তু তাহার বদলে আমরা সব সময় বাহিরটি মাজিয়া ঘষিয়া চাকচিক্যময় করিতেই ব্যস্ত। ভিতর বলিয়া যদি কিছু নাই রহিল, তবে শুধু বাহিরের চাকচিক্য বাড়াইয়া লাভ কি? মানুষকে উন্নত করাই সর্ববিধ শিক্ষণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। যে-ব্যক্তি অপরের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন, তিনি সমজাতীয় ব্যক্তিদের উপর যেন যাদুমন্ত্র ছড়াইতে পারেন, তিনি যেন শক্তির একটা আধার-বিশেষ। ঐরূপ মানুষ তৈরী হইয়া গেলে তিনি যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে সমর্থ হন; এরূপ ব্যক্তিত্ব যে-বিষয়ে নিয়োজিত হইবে, তাহাই সফল করিয়া তুলিবে।
এখন কথা হইতেছে, ইহা সত্য হইলেও আমাদের পরিচিত কোন প্রাকৃতিক নিয়ম সহায়ে ইহার ব্যাখ্যা করা যায় না। রসায়নের বা পদার্থবিদ্যার জ্ঞানসহায়ে ইহা বুঝানো যাইবে কিরূপে? কতখানি ‘অক্সিজেন,’ কতখানি ‘হাইড্রোজেন,’ কতখানি ‘কার্বন’ ইহাতে আছে, কতগুলি অণু কিভাবে সাজানো আছে, কতগুলি কোষ লইয়াই বা ইহা গঠিত হইয়াছে—ইত্যাদির খোঁজ করিয়া এই রহস্যময় ব্যক্তিত্বের কি বুঝিব আমরা? তবু দেখা যাইতেছে, ইহা বাস্তব সত্য; শুধু তাহাই নয়, এই ব্যক্তিত্বটিই আসল মানুষ; এই মানুষটিই বাঁচিয়া থাকে, চলাফেরা করে, কাজ করে; এই মানুষটিই সঙ্গীদের উপর প্রভাব বিস্তার করে, তাহাদের পরিচালিত করে, আর শেষে চলিয়া যায়; তাহার বুদ্ধি, তাহার গ্রন্থ, তাহার কাজ—এগুলি তাহার পশ্চাতে রাখিয়া যাওয়া নিদর্শন মাত্র। বিষয়টি ভাবিয়া দেখ। বড় বড় ধর্মাচার্যদের সঙ্গে বড় বড় দার্শনিকদের তুলনা করিয়া দেখ। দার্শনিকেরা ক্বচিৎ কখনও কাহারও ভিতরের মানুষটিকে প্রভাবিত করিতে পারিয়াছেন, অথচ লিখিয়া গিয়াছেন অতি অপূর্ব সব গ্রন্থ। অপরদিকে ধর্মাচার্যেরা জীবৎকালেই বহুদেশের লোকের মনে সাড়া জাগাইয়া গিয়াছেন। ব্যক্তিত্বই এই পার্থক্য সৃষ্টি করিয়াছে। দার্শনিকদের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করিবার মত ব্যক্তিত্ব অতি ক্ষীণ। বড় বড় ঈশ্বরপ্রেরিত ব্যক্তিদের বেলা উহা অতি প্রবল। দার্শনিকদের ব্যক্তিত্ব বুদ্ধিবৃত্তিকে স্পর্শ করে, আর ধর্মাচার্যদের ব্যক্তিত্ব স্পর্শ করে জীবনকে। একটি হইতেছে যেন শুধু রাসায়নিক পদ্ধতি—কতকগুলি রাসায়নিক উপাদান একত্র করিয়া রাখা হইয়াছে, উপযুক্ত পরিবেশে সেগুলি ধীরে ধীরে মিশ্রিত হইয়া একটি আলোর ঝলক সৃষ্টি করিতে পারে, নাও করিতে পারে। অপরটি যেন একটি আলোকবর্তিকা—ক্ষিপ্রবেগে চারিদিকে ঘুরিয়া অপর জীবন-দীপগুলি অচিরে প্রজ্বলিত করে।
যোগ-বিজ্ঞান দাবী করে যে, এই ব্যক্তিত্বকে ক্রমবর্ধিত করিবার প্রক্রিয়া সে আবিষ্কার করিয়াছে; সে-সব রীতি ও প্রক্রিয়া যথাযথভাবে মানিয়া চলিলে প্রত্যেকেই নিজ ব্যক্তিত্বকে বাড়াইয়া অধিকতর শক্তিশালী করিতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবহারিক বিষয়গুলির মধ্যে ইহা অন্যতম, এবং সর্ববিধ শিক্ষার রহস্যও ইহাই। সকলেরই পক্ষে ইহা প্রযোজ্য। গৃহস্থের জীবনে, ধনী দরিদ্র ব্যবসায়ীর জীবনে, আধ্যাত্মিক জীবনে, সকলেরই জীবনে এই ব্যক্তিত্বকে বাড়াইয়া তোলার মূল্য অনেক। প্রাকৃতিক যে-সব নিয়ম আমাদের জানা আছে, সেগুলিরও পিছনে অতি সূক্ষ্ম সব নিয়ম রহিয়াছে। অর্থাৎ স্থূলজগতের সত্তা, মনোজগতের সত্তা, অধ্যাত্মজগতের সত্তা প্রভৃতি বলিয়া আলাদা আলাদা কোন সত্তা নাই। সত্তা বলিতে যাহা আছে, তাহা একটি-ই। বলা যায়, ইহা যেন একটি ক্রমঃসূক্ষ্ম অস্তিত্ব; ইহার স্থূলতম অংশটি এখানে রহিয়াছে; (একবিন্দু অভিমুখে) এটি যতই সঙ্কীর্ণ হইয়া গিয়াছে, ততই সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর হইয়া চলিয়াছে; আমরা যাহাকে ‘আত্মা’ বলি, তাহাই সূক্ষ্মতম, আমাদের দেহ স্থূলতম। আর মনুষ্যরূপ এই ক্ষুদ্র জগতেও যাহা আছে, ব্রহ্মাণ্ডেও ঠিক তাহাই আছে। আমাদের এই বিশ্বটিও ঠিক এইরূপই, জগৎ তাহার স্থূলতম বাহ্যপ্রকাশ, আর ক্রমশঃ একবিন্দু-অভিমুখী হইয়া চলিয়া তাহা সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর হইতে হইতে শেষে ঈশ্বরে পর্যবসিত হইয়াছে।
তাহা ছাড়া আমরা জানি যে, সূক্ষ্মের মধ্যেই প্রচণ্ডতম শক্তি নিহিত থাকে; স্থূলের মধ্যে নয়। কোন লোককে হয়তো বিপুল ভার উত্তোলন করিতে দেখা যায়; তখন তাহার মাংসপেশীগুলি ফুলিয়া উঠে, তাহার সারা অঙ্গে শ্রমের চিহ্ন পরিস্ফুট হয়। এ-সব দেখিয়া আমরা ভাবি, মাংসপেশীর কি শক্তি! কিন্তু মাংসপেশীতে শক্তি যোগায় সুতার মত সরু স্নায়ুগুলিই; মাংসপেশীর সঙ্গে একটিমাত্রও স্নায়ুর সংযোগ ছিন্ন হইবামাত্র মাংসপেশী কোন কাজই আর করিতে পারে না। এই ক্ষুদ্র স্নায়ুগুলি আবার শক্তি আহরণ করে আরও সূক্ষ্ম বস্তু হইতে, সেই সূক্ষ্ম বস্তুটি আবার শক্তি পায় চিন্তা নামক সূক্ষ্মতর বস্তুর নিকট হইতে; ক্রমে আরও সূক্ষ্ম, আরও সূক্ষ্ম আসিয়া পড়ে। কাজেই সূক্ষ্মই শক্তির যথার্থ আধার। অবশ্য স্থূল স্তরের গতিগুলিই আমরা দেখিতে পাই, কিন্তু সূক্ষ্ম স্তরে যে গতি হয়, তাহা দেখিতে পাই না। যখন কোন স্থূল বস্তু নড়ে, আমরা তাহা বুঝিতে পারি, সেজন্য স্বভাবতই গতির সঙ্গে স্থূলের সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য মনে করি। কিন্তু সব শক্তিরই যথার্থ আধার সূক্ষ্ম। সূক্ষ্মে কোন গতি আমরা দেখি না, সে গতি অতি তীব্র বলিয়াই বোধ হয়, তাহা আমরা অনুভব করিতে পারি না। কিন্তু কোন বিজ্ঞানের সহায়তায়, কোন গবেষণার সহায়তায় যদি বাহ্যপ্রকাশের কারণ-রূপ শক্তিগুলি ধরিতে পারি, তাহা হইলে শক্তির প্রকাশগুলিও আমাদের আয়ত্তে আসিবে। কোন হ্রদের তলদেশ হইতে একটি বুদ্বুদ উঠিতেছে; যখন হ্রদের উপরে উঠিয়া উহা ফাটিয়া যায়, তখনই মাত্র উহা আমাদের নজরে পড়ে, তলদেশ হইতে উপরে উঠিয়া আসিবার মধ্যে কোন সময়ই সেটিকে দেখিতে পাই না। চিন্তার বেলাও চিন্তাটি অনেকখানি পরিণতি লাভ করিবার পর বা কর্মে পরিণত হইবার পর উহা আমাদের অনুভবে আসে। আমরা ক্রমাগত অভিযোগ করি যে, আমাদের চিন্তা—আমাদের কর্ম আমাদের বশে থাকে না। কিন্তু থাকিবে কি করিয়া? যদি সূক্ষ্মগতিগুলি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারি, চিন্তারূপে কর্মরূপে পরিণত হইবার পূর্বেই যদি চিন্তাকে আরও সূক্ষ্মাবস্থায় তাহার মূলাবস্থায় ধরিতে পারি, তাহা হইলেই আমাদের পক্ষে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এখন এমন কোন প্রক্রিয়া যদি থাকে, যাহা অবলম্বনে এই-সব সূক্ষ্মশক্তি ও সূক্ষ্ম কারণগুলিকে বিশ্লেষণ করা, অনুসন্ধান করা, ধারণা করা এবং পরিশেষে এগুলিকে আয়ত্ত করা সম্ভব হয়, শুধু তাহা হইলেই আমরা নিজেকে নিজের বশে আনিতে পারিব। আর নিজের মনকে যে বশে আনিতে পারে, অপরাপর ব্যক্তির মনও তাহার বশে আসিবে নিশ্চিত। এইজন্যই সর্বকালে পবিত্রতা ও নীতিপরায়ণতা ধর্মের অঙ্গরূপে গৃহীত হইয়াছে। পবিত্র ও নীতিপরায়ণ ব্যক্তি নিজেকে নিজের বশে রাখিতে পারে। সব মন একই মনের বিভিন্ন অংশ মাত্র। একটি মৃৎখণ্ডের জ্ঞান যাহার হইয়াছে, তাহার নিকট বিশ্বের সমুদয় মৃত্তিকাই জানা হইয়া গিয়াছে। নিজের মন সম্বন্ধে জ্ঞান যাহার হইয়াছে, নিজের মনকে যে আয়ত্তে আনিয়াছে, সব মনের রহস্যই সে জানে, সব মনের উপরই তাহার প্রভাব আছে।
এখন সূক্ষ্মাংশগুলি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিলে আমরা বহু শারীরিক দুর্ভোগের হাত হইতে রক্ষা পাইতে পারি; সেইরূপ সূক্ষ্মগতিগুলি আয়ত্তে আনিতে পারিলে আমরা বহু দুর্ভাবনার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইতে পারি; এ-সব সূক্ষ্মশক্তি নিয়ন্ত্রণ করিবার ক্ষমতালাভ করিলে বহু বিফলতা এড়াইয়া চলা যায়। এ-পর্যন্ত যাহা বলা হইল, তাহা ইহার উপযোগিতার কথা। তারপর আরও উঁচু কথা আছে।
এখন এমন একটি মতের কথা তুলিতেছি, যাহা লইয়া সম্প্রতি কোন বিচার করিব না, শুধু সিদ্ধান্তটি বলিয়া যাইব। কোন জাতি যে-সব অবস্থার ভিতর দিয়া বর্তমান অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে, সেই জাতির প্রত্যেক মানুষকেই শৈশবে দ্রুতগতিতে ঐ-সব অবস্থা অতিক্রম করিয়া আসিতে হয়; যে-সব অবস্থা পার হইয়া আসিতে একটা জাতির হাজার হাজার বছরের প্রয়োজন হইয়াছে, সে-সব পার হইতে শিশুটির প্রয়োজন হয় মাত্র কয়েক বছরের—এইটুকু যা প্রভেদ। শিশুটি প্রথমে আদিম অসভ্য মানুষেরই মত থাকে—সে পায়ের তলায় প্রজাপতি দলিয়া চলে। প্রথমাবস্থায় শিশুটি স্বজাতির পূর্বপুরুষেরই মত। যত বড় হইতে থাকে, বিভিন্ন অবস্থার ভিতর দিয়া চলিতে চলিতে শেষে জাতির পরিণত অবস্থায় আসিয়া পৌঁছায়। তবে সে ইহা খুব ক্ষিপ্র বেগে ও অল্প সময়ে করিয়া ফেলে। এখন সব মানুষকে একটি জাতি বলিয়া ধর, অথবা সমগ্র প্রাণিজগৎকে—মানুষ ও নিম্নতর প্রাণিগণ—একটি সমগ্র সত্তা বলিয়া ভাব। এমন একটি লক্ষ্য আছে, যাহার দিকে এই জীব-সমষ্টি অগ্রসর হইতেছে। এই লক্ষ্যকে ‘পূর্ণতা’ বলা যাক। এমন অনেক নর-নারী জন্মগ্রহণ করেন, যাঁহাদের জীবনে মানবজাতির সম্পূর্ণ উন্নতির পূর্বাভাস সূচিত হয়। সমগ্র মানবজাতি যতদিন না পূর্ণতা লাভ করে, ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করিয়া, যুগ যুগ ধরিয়া বারে বারে জন্ম এবং পুনর্জন্ম বরণ না করিয়া তাঁহারা তাঁহাদের জীবনের স্বল্প কয়েক বছরের মধ্যেই যেন ক্ষীপ্রগতিতে সেই যুগ যুগান্তর পার হইয়া যান। আর ইহাও আমাদের জানা আছে যে, আন্তরিকতা থাকিলে প্রগতির এই প্রণালীগুলিকে খুবই ত্বরান্বিত করা সম্ভব। শুধু জীবনধারণের উপযুক্ত খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় দিয়া কয়েকটি সংস্কৃতিহীন লোককে যদি কোন দ্বীপে বাস করিবার জন্য ছাড়িয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলেও তাহারা ধীরে ধীরে উচ্চ, উচ্চতর সভ্যতা উদ্ভাবন করিতে থাকিবে। ইহাও আমাদের অজানা নয় যে, কিছু অতিরিক্ত সাহায্য পাইলে এই উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হয়। আমরা গাছপালার বৃদ্ধির সহায়তা করি; করি না কি? প্রকৃতির হাতে ছাড়িয়া দিলেও গাছগুলি বাড়িয়া উঠিত, তবে দেরী হইত; বিনা সাহায্যে যতদিনে বাড়িত, তদপেক্ষা অল্প সময়ে বাড়িবার জন্য আমরা তাহাদিগকে সাহায্য করি। এ-কাজ আমরা সর্বদাই করিতেছি, আমরা কৃত্রিম উপায়ে বস্তুর বৃদ্ধির গতি দ্রুততর করিয়া তুলিতেছি। মানুষের উন্নতিই বা দ্রুততর করিতে পারিব না কেন? জাতি হিসাবে আমরা তাহা করিতে পারি। অপর দেশে প্রচারক পাঠানো হয় কেন? কারণ এই উপায়ে অপর জাতিগুলিকে তাড়াতাড়ি উন্নত করিতে পারা যায়। তাহা হইলে ব্যক্তির উন্নতিও কি আমরা দ্রুততর করিতে পারি না? পারি বইকি। এই উন্নতির দ্রুততর কোন সীমা কি নির্দেশ করা যায়? এক জীবনে মানুষ কতদূর উন্নত হইবে, কেহ তাহা বলিতে পারে না। কোন মানুষ এইটুকুমাত্র উন্নত হইতে পারে, তাহার বেশী নয়, এ-কথা বলার পিছনে কোনই যুক্তি নাই। পরিবেশ অদ্ভুতভাবে তাহার গতিবেগ বাড়াইয়া দিতে পারে। কাজেই পূর্ণতালাভের পূর্ব পর্যন্ত কোন সীমা টানা যায় কি? ইহাতে কি বোঝা যায়? বোঝা যায় যে, আজ হইতে হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর পরে গোটা জাতিটিই যে ধরনের মানুষে ভরিয়া যাইবে, সেইরূপ পূর্ণতাপ্রাপ্ত একজন মানুষ আজই অবতীর্ণ হইতে পারেন। যোগীরা এই কথাই বলেন। তাঁহারা বলেন যে, বড় বড় অবতারপুরুষ ও আচার্যেরা এই ধরনেরই মানুষ; তাঁহারা এই এক-জীবনেই পূর্ণতা-লাভ করিয়াছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বযুগে, সর্বকালেই আমরা এরূপ মানবের দর্শন পাইয়াছি। সম্প্রতি—এই সেদিনকার কথা—এরূপ একজন মানব আসিয়াছিলেন, যিনি এই জন্মেই সমগ্র মানবজাতির জীবনের সবটুকু পথ অতিক্রম করিয়া চরম সীমায় পৌঁছিয়াছিলেন। উন্নতির গতি ত্বরান্বিত করার এই কার্যটিকে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অবলম্বনে পরিচালিত করিতে হইবে। এই নিয়মগুলি আমরা খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি, এগুলির রহস্য উদ্ঘাটন করিতে পারি এবং নিজ প্রয়োজনে এগুলিকে লাগাইতে পারি। এরূপ করিতে পারা মানেই উন্নত হওয়া। এই উন্নতির বেগ দ্রুততর করিয়া, ক্ষিপ্রগতিতে নিজেকে বিকশিত করিয়া এই জীবনেই আমরা পূর্ণতা লাভ করিতে পারি। ইহাই আমাদের জীবনের উচ্চতর দিক্; এবং যে বিজ্ঞানসহায়ে মন ও তাহার শক্তির অনুশীলন করা হয়, তাহার যথার্থ লক্ষ্য এই পূর্ণতালাভ। অর্থ ও অন্যান্য জাগতিক বস্তু দান করিয়া অপরকে সাহায্য করা বা দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে চলা যায়, তাহা শিক্ষা দেওয়া—এ-সব নিতান্তই তুচ্ছ আনুষঙ্গিক কার্য মাত্র।
তরঙ্গের পর তরঙ্গের আঘাতে সমুদ্রবক্ষে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত ভাসমান কাষ্ঠখণ্ডের ন্যায় বাহ্যপ্রকৃতির ক্রীড়াপুত্তলিকারূপে যুগ যুগ ধরিয়া মানুষকে অপেক্ষা করিতে না দিয়া তাহার পূর্ণত্বকে প্রকট করিয়া দেওয়াই এই বিজ্ঞানের উপযোগিতা। এই বিজ্ঞান চায় তুমি সবল হও, প্রকৃতির হাতে ছাড়িয়া না দিয়া কাজটি তুমি নিজের হাতে তুলিয়া লও এবং এই ক্ষুদ্র জীবনের ঊর্ধ্বে চলিয়া যাও। ইহাই তাহার মহান্ উদ্দেশ্য।
জ্ঞানে, শক্তিতে, সুখ-সমৃদ্ধিতে মানুষ বাড়িয়াই চলিয়াছে। জাতি হিসাবে আমরা ক্রমাগত উন্নত হইয়া চলিয়াছি। ইহা যে সত্য—ধ্রুব সত্য, তাহা আমরা প্রত্যক্ষ দেখিতেছি। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও কি তাহা সত্য? হাঁ, কিছুটা তো বটেই। কিন্তু তবু এ প্রশ্ন জাগেঃ ইহার সীমা-নির্ধারণ হইবে কোথায়? আমার দৃষ্টিশক্তি কয়েক ফুট দূরে মাত্র প্রসারিত হয়। কিন্তু এমন লোক আমি দেখিয়াছি—যে পাশের ঘরে কি ঘটিতেছে, চোখ বন্ধ করিয়াও তাহা দেখিতে পায়। তোমার যদি ইহা বিশ্বাস না হয়, সে-লোকটি হয়তো তিন সপ্তাহের মধ্যে তোমাকেই শিখাইয়া দিবে কি করিয়া এভাবে দেখিতে হয়। যে-কোন লোককে ইহা শেখানো যায়। কেহ কেহ পাঁচ মিনিটের শিক্ষায় অপরের মনে কি ঘটিতেছে, তাহা জানিবার ক্ষমতা অর্জন করিতে পারে। এই-সব হাতে হাতে দেখাইয়া দেওয়া যায়।
ইহা যদি সত্য হয়, তবে আমরা সীমারেখা টানিব কোথায়? এই ঘরের এককোণে বসিয়া অপরে কি চিন্তা করিতেছে, তাহা যদি কেহ জানিতে পারে, পাশের ঘরের লোকটির মনের খবরই বা সে পাইবে না কেন? যে-কোন জায়গায় লোকের চিন্তাই বা টের পাইবে না কেন? না পাইবার কোন কারণ আমরা দেখাইতে পারিব না। সাহস করিয়া বলিতে পারি না, ইহা অসম্ভব। আমরা শুধু বলিতে পারি, কিভাবে ইহা সম্ভব হয়—তাহা জানি না। এরূপ ঘটা অসম্ভব—এ-কথা বলিবার কোন অধিকার জড়বিজ্ঞানীদের নাই; তাঁহারা শুধু এইটুকু বলিতে পারেন, ‘আমরা জানি না।’ বিজ্ঞানের কর্তব্য হইল তথ্য সংগ্রহ করা, সামান্যীকরণ করা, কতকগুলি মূলতত্ত্বে উপনীত হওয়া এবং সত্য প্রকাশ করা—এই পর্যন্ত। কিন্তু তথ্যকে অস্বীকার করিয়া চলিতে শুরু করিলে বিজ্ঞান গড়িয়া উঠিবে কিরূপে?
একজন মানুষ কতখানি শক্তি অর্জন করিতে পারে, তাহার কোন সীমা নাই। ভারতীয় মনের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কোন কিছুতে সে অনুরক্ত হইলে আর সব-কিছু ভুলিয়া তাহাতে একেবারে তন্ময় হইয়া যায়। ভারত যে বহু বিজ্ঞানের জন্মভূমি, তাহা তোমরা জান। গণিতের আরম্ভ সেখানে। আজ পর্যন্ত তোমরা সংস্কৃত গণনানুযায়ী ১, ২, ৩ হইতে ০ পর্যন্ত সংখ্যা গণনা করিতেছ। সকলেই জানে বীজগণিতের উৎপত্তিও ভারতে। আর নিউটনের জন্মের হাজার বছর আগে ভারতবাসীরা মাধ্যাকর্ষণের কথা জানিত।
এই বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। ভারতের ইতিহাসে এমন একটি যুগ ছিল, যখন শুধু মানুষ ও মানুষের মন—এই একটি বিষয়ে ভারতের সমগ্র মনোযোগ আকৃষ্ট হইয়াছিল, তাহাতেই সে তন্ময় হইয়া গিয়াছিল। লক্ষ্য-লাভের সহজতম উপায় মনে হওয়ায় এ-বিষয়টি তাঁহাদের নিকট এত আকর্ষণীয় হইয়াছিল। যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করিলে মনের অসাধ্য কিছুই নাই—এই বিষয়ে ভারতীয় মনে এতখানি দৃঢ়বিশ্বাস আসিয়াছিল যে, মনঃশক্তির গবেষণাই তাহার মহান্ লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাঁহাদের নিকট সম্মোহন, যাদু ও এই জাতীয় অন্যান্য শক্তিগুলির কোনটিই অলৌকিক মনে হয় নাই। ইতঃপূর্বে ভারতীয়েরা যেভাবে যথানিয়মে জড়বিজ্ঞানের শিক্ষা দিতেন, তখন তেমনি যথা নিয়মে এই বিজ্ঞানটিও শিখাইতে লাগিলেন। এ বিষয়ে জাতির এত বেশী দৃঢ়-প্রত্যয় আসিয়াছিল যে, তাহার ফলে জড়বিজ্ঞান প্রায় লুপ্ত হইয়া গেল। তাহাদের দৃষ্টি নিবন্ধ রহিল শুধু এই একটি লক্ষ্যে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের যোগীরা বিবিধ পরীক্ষার কাজে লাগিয়া গেলেন। কেহ পরীক্ষা করিতে লাগিলেন আলো লইয়া; বিভিন্ন বর্ণের আলোক কিভাবে শরীরে পরিবর্তন আনে, তাহা আবিষ্কার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহারা একটি বিশেষ বর্ণের বস্ত্র পরিধান করিতেন, একটি বিশেষ বর্ণের ভিতর বাস করিতেন, এবং বিশেষ বর্ণের খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করিতেন। এইরূপে কত রকমের পরীক্ষাই না চলিতে লাগিল। অপরে কান খুলিয়া রাখিয়া ও বন্ধ করিয়া, শব্দ লইয়া পরীক্ষা চালাইতে লাগিলেন। তাছাড়া আরও অনেকে গন্ধ এবং অন্যান্য বিষয় লইয়াও পরীক্ষা চালাইতে লাগিলেন।
সব-কিছুরই লক্ষ্য ছিল মূলে উপস্থিত হওয়া, বিষয়ের সূক্ষ্মভাগগুলিতে গিয়া পৌঁছানো। তাঁহাদের মধ্যে অনেকে সত্যই অতি অদ্ভুত শক্তির পরিচয়ও দিয়াছেন। বাতাসের ভিতর ভাসিয়া থাকিবার জন্য, বাতাসের মধ্য দিয়া চলিয়া যাইবার জন্য অনেকেই চেষ্টা করিতেছিলেন। পাশ্চাত্যের একজন বড় পণ্ডিতের মুখে একটি গল্প শুনিয়াছিলাম, সেটি বলিতেছি। সিংহলের গভর্নর স্বচক্ষে ঘটনাটি দেখিয়া উহা তাঁহাকে বলিয়াছিলেন। কতকগুলি কাঠি আড়াআড়িভাবে একটি টুলের মত সাজাইয়া ঐ টুলের উপর একটি বালিকাকে আসন করাইয়া বসানো হইল। বালিকাটি কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিবার পর, যে-লোকটি খেলা দেখাইতেছিল সে একটি একটি করিয়া এই কাঠিগুলি সরাইয়া লইতে লাগিল; সব কাঠিগুলি সরাইয়া লইবার পর বালিকাটি শূন্যে ভাসিতে লাগিল। কিছু একটা গোপন কৌশল আছে ভাবিয়া গভর্নর তাঁহার তরবারি বাহির করিয়া বালিকাটির নীচের শূন্য স্থানে সজোরে চালাইয়া দিলেন। দেখিলেন, কিছুই নাই সেখানে। এখন ইহাকে কি বলিবে? কোনরূপ যাদু বা অলৌকিকত্ব ইহাতে ছিল না। এইটিই আশ্চর্য ব্যাপার। এ-জাতীয় ঘটনা অলীক, এমন কথা ভারতে কেহই বলিবে না। হিন্দুদের কাছে ইহা স্বাভাবিক ঘটনা। শত্রুর সঙ্গে লড়াই করিবার পূর্বে হিন্দুদের প্রায়ই বলিতে শোনা যায়, ‘আরে, আমাদের কোন যোগী আসিয়া সকলকে হটাইয়া দিবে।’ এটি জাতির এক চরম বিশ্বাস। বাহুবল বা তরবারির বল আর কতটুকু? শক্তি তো সবই আত্মার। ইহা সত্য হইলে ইহাতে মনের সব শক্তি নিয়োগ করিবার প্রলোভন খুবই বেশী হইবে। তবে অপরাপর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের সাফল্য অর্জন করা যেমন খুব কঠিন, এই ক্ষেত্রেও তাহাই; তাহাই বা বলি কেন, ইহা তাহার চেয়ে আরও বেশী কঠিন। তবু বেশীরভাগ লোকেরই ধারণা যে, এই-সব শক্তি অতি সহজেই অর্জন করা যায়। বিপুল সম্পদ্ গড়িয়া তুলিতে তোমার কত বছর লাগিয়াছে বল দেখি। সে-কথা ভাবিয়া দেখ একবার। প্রথমে বৈদ্যুতিক বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনীয়ারিং বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করিতেই তো বহু বছর গিয়াছে। তারপর তোমাকে বাকী জীবনটাই তো পরিশ্রম করিতে হইয়াছে।
তাহা ছাড়া অন্যান্য বিজ্ঞানগুলির অধিকাংশেরই বিষয়বস্তু গতিহীন, স্থির। চেয়ারটিকে আমরা বিশ্লেষণ করিতে পারি, চেয়ারটি আমাদের সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবে না। কিন্তু এই বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু মন, যাহা সদা চঞ্চল। যখনই পর্যবেক্ষণ করিতে যাও দেখিবে উহা হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে। মন এখন একটি ভাবে রহিয়াছে, পরমুহূর্তে হয়তো সেই ভাব পালটাইয়া গেল; একটার পর একটা ভাবের এই পরিবর্তন সব সময় লাগিয়াই আছে। এই-সব পরিবর্তনের মধ্যেই উহার অনুশীলন চালাইতে হইবে, উহাকে বুঝিতে হইবে, ধরিতে হইবে এবং আয়ত্তে আনিতে হইবে। কাজেই কত বেশী কঠিন এই মনোবিজ্ঞান! এই বিষয়ে কঠোর শিক্ষার প্রয়োজন হয়। লোকে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কোন কার্যকরী প্রক্রিয়া তাহাদিগকে শিখাই না কেন? ইহা তো আর তামাশা নয়! এই মঞ্চের উপর দাঁড়াইয়া আমি তোমাদের বক্তৃতা শুনাইতেছি; বাড়ি ফিরিয়া দেখিলে—ইহাতে ফল কিছু হয় নাই; আমিও কোন ফল দেখিতে পাইলাম না! তারপর তুমি বলিলে, ‘যত সব বাজে কথা!’ এই রকম যে হয়, তাহার কারণ—তুমি এইটিকে বাজে জিনিষরূপেই চাহিয়াছিলে। এই বিজ্ঞানের অতি অল্পই আমি জানি; কিন্তু যেটুকু জানি, সেটুকু শিখিতেই আমাকে জীবনের ত্রিশ বছর ধরিয়া খাটিতে হইয়াছে, আর তারপর যেটুকু শিখিয়াছি, ছয় বছর ধরিয়া লোকের কাছে তাহা বলিয়া বেড়াইতেছি। ইহা শিখিতেই আমার ত্রিশ বছর লাগিয়াছে—কঠোর পরিশ্রম সহকারে ত্রিশ বছর খাটিতে হইয়াছে। কখনও কখনও চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কুড়িঘণ্টা খাটিয়াছি, কখনও রাত্রে মাত্র একঘণ্টা ঘুমাইয়াছি, কখনও-বা সারারাত্রই পরিশ্রম করিয়াছি; কখনও কখনও এমন সব জায়গায় গিয়া বাস করিয়াছি, যাহাকে প্রায় শব্দহীন, বায়ুহীন বলা চলে; কখনও-বা গুহায় বাস করিতে হইয়াছে। কথাগুলি ভাবিয়া দেখ। আর এই-সব সত্ত্বেও আমি অতি অল্পই জানি বা কিছুই জানি না; আমি যেন এই বিজ্ঞানের বহির্বাসের প্রান্তটুকু মাত্র স্পর্শ করিয়াছি। কিন্তু আমি ধারণা করিতে পারি যে, এই বিজ্ঞানটি সত্য, সুবিশাল ও অত্যাশ্চর্য।
এখন তোমাদের ভিতর কেহ যদি সত্য সত্যই এই বিজ্ঞানের অনুশীলন করিতে চাও, তাহা হইলে জীবনের যে-কোন বিষয়কার্যের জন্য যতখানি দৃঢ়সঙ্কল্প লইয়া উহাতে লাগিয়া পড়া প্রয়োজন হয়, ঠিক ততখানি বা তদপেক্ষা অধিক দৃঢ়সঙ্কল্প লইয়া এ বিষয়েও অগ্রসর হইতে হইবে।
বিষয়কর্মের জন্য কত মনোযোগই না দিতে হয়, আর কি কঠোর ভাবেই না উহা আমাদিগকে পরিচালিত করে! মাতা, পিতা, স্ত্রী বা সন্তান মরিয়া গেলেও বিষয়কর্ম বন্ধ থাকিতে পারে না! বুক যদি ফাটিয়াও যায়, তথাপি কর্মক্ষেত্রে আমাদের যাইতেই হইবে, প্রতিটি ঘণ্টা দারুণ যন্ত্রণাময় বলিয়া বোধ হইলেও কাজ করিতে হইবে। ইহারই নাম বিষয়কর্ম; আর আমরা ভাবি ইহা যুক্তিসঙ্গত, ইহা ন্যায়সঙ্গত।
যে-কোন বিষয়কর্মের চেয়ে অনেক বেশী পরিশ্রম করা প্রয়োজন হয় এই বিজ্ঞানের জন্য। বিষয়কর্মে অনেকেই সফলতা লাভ করিতে পারেন, কিন্তু ইহাতে সফল হন খুব কম লোক। কারণ—যিনি ইহার অনুশীলন করেন, তাঁহার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিষয়কর্মের বেলা যেমন সকলেই প্রচুর সমৃদ্ধিলাভ করিতে না পারিলেও প্রত্যেকেই কিছু না কিছু লাভ করেই, এই বিজ্ঞানের বেলাও ঠিক তাই; প্রত্যেকেই কিছু না কিছু আভাস পায়-ই, যাহার ফলে ইহার সত্যতায় আস্থা আসে, এবং বিশ্বাস আসে যে, বহু লোক সত্য সত্যই এই বিজ্ঞানের অন্তর্গত সব-কিছুই প্রত্যক্ষ করিয়াছেন।
ইহাই হইল বিজ্ঞানটির মোটামুটি কথা। নিজের শক্তিতে এবং নিজের আলোকের উপর নির্ভর করিয়া এই বিজ্ঞান অন্য যে-কোন বিজ্ঞানের সঙ্গে তাহাকে তুলনা করিয়া দেখিবার জন্য সগর্বে আমাদিগকে আহ্বান করে। প্রবঞ্চক, যাদুকর, শঠ—এই-সবও এক্ষেত্রে আছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে যাহা থাকে, তাহা অপেক্ষা বরং বেশীই আছে। কি কারণে? কারণ তো একই—যে কাজে যত বেশী লাভ, ঠক-প্রবঞ্চকের সংখ্যাও তাহাতে তত বেশী। কিন্তু তাহা বলিয়া কাজটি যে ভাল হইবে না, ইহা তো আর কোন যুক্তি নয়। আর একটি কথা আছে; সমস্ত যুক্তি-বিচার মন দিয়া শোনা বুদ্ধিবৃত্তির একটি ভাল ব্যায়াম হইতে পারে, মনোযোগ সহকারে অদ্ভুত বিষয়ের কথা শুনিলে বুদ্ধির পরিতৃপ্তিও ঘটিতে পারে। কিন্তু কেহ যদি তাহারও পরের কথা জানিতে চাও, তবে শুধু বক্তৃতা শুনিলে হইবে না। বক্তৃতায় ইহা শেখানো যায় না, কারণ ইহা জীবন-গঠনের কথা। আর জীবনই অপরের ভিতর জীবন সঞ্চার করিতে পারে। তোমাদের ভিতর যদি কেহ ইহা শিখিতে সত্যই কৃতনিশ্চয় হইয়া থাক, তাহা হইলে পরম আনন্দের সহিত আমি তাহাকে সাহায্য করিব।