০২. মনসুর সাহেব

মনসুর সাহেব থাকেন আজিজ খাঁ বেপারির গুদামঘরের উপরে। কেরোগেটেড টিনের দেয়ালে ঘেরা গুদামঘর। তার উপরে দুটা ঘর। একটায় থাকেন মনসুর সাহেব। অন্য ঘরটা খালি। আজিজ খাঁ বলেছেন—স্যার, ইচ্ছা করলে এই ঘরটাও আপনি ব্যবহার করতে পারেন। একটায় ঘুমাবেন, অন্যটায় লেখাপড়ার কাজ করবেন।

মনসুর সাহেব রাজি হননি। তাঁর জন্যে একটা কামরাই যথেষ্ট। দুটা কামরা মানেই বাহুল্য। তিনি সারাজীবন বাহুল্য বর্জন করতে চেয়েছেন।

নিজের ঘরটা তিনি তার প্রয়োজনমতো সাজিয়ে নিয়েছেন। বড় একটা খাট আছে। ছোট খাটে তিনি শুতে পারেন না। ঘুমুবার সময় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে ভালো লাগে। খাটের সঙ্গেই টেবিল। টেবিলটাও বড়। ঘরে কোনো চেয়ার নেই। খাটে বসেই যেহেতু টেবিলে লেখালেখি করা যায় কাজেই চেয়ার তাঁর কাছে বাহুল্য বলে মনে হয়েছে। একটা আলনা আছে। আলনা তাঁর কাছে প্রয়োজনীয়। কাপড়-চোপড় সামনে থাকে। যখন যেটা দরকার হাত বাড়িয়ে নিতে পারেন।।

তাঁর ঘরে শৌখিন জিনিসের মধ্যে একটা সিলিং ফ্যান আছে। নতুন সিলিং ফ্যান। এর পাখা খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া। আজিজ খা বেপারি সিলিং ফ্যান। লাগিয়ে দিয়েছেন। ইলেকট্রিসিটি নেই বলে সিলিং ফ্যান কখনো চলে না।

নেত্রকোনা শহরে ইলেকট্রিসিটি আছে। আজিজ বেপারির গুদাম শহরের বাইরে বলে ইলেকট্রিসিটির লাইন এখনো দেয়নি। তবে পোল বসাচ্ছে। খুব শিগগিরই ইলেকট্রিসিটি চলে আসার কথা।

মনসুর সাহেবের জায়গাটা খুব পছন্দ। নিরিবিলির কারণেই পছন্দ। গুদামে যখন মাল তোলা হয় কিংবা মাল খালাস করা হয় তখন কিছু চৈ-চৈ থাকে। বাকি সময়টা সুনসান নীরবতা। গুদামের দুজন দারোয়ান। এর একজন কোনো কথাই বলে না। অন্যজনের কথা বলার প্রচণ্ড নেশা। কথা বলার লোক পায় না। বলে সেও কথা বলতে পারে না। এই দারোয়ানের নাম হরমুজ মিয়া। সে মনসুর সাহেবের খাওয়া-দাওয়া দেখে। এই কাজের জন্যে মাসে তাকে পঞ্চাশ টাকা করে দেয়া হয়। মনসুর সাহেবের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা অত্যন্ত সরল। তিনি বলে দিয়েছেন, এক পদের বেশি দ্বিতীয়পদ যেন কখনো রান্না করা না হয়। দ্বিতীয়পদ মানেই বাহুল্য।

হরমুজ মিয়ার উপর কঠিন নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সে প্রায়ই এটা-ওটা বেঁধে ফেলে। সিমের ভর্তা, পাকা টমেটোর ভর্তা, কুমড়ো ফুলের বড়া। মনসুর সাহেব বিরক্ত হন, কিন্তু হরমুজকে কিছু বলতে পারেন না। কারণ তিনি জানেন মানুষ মাত্ৰই বাহুল্যপ্রিয়। একটা বাড়িই মানুষের জন্যে যথেষ্ট, তারপরেও টাকা থাকলেই সে দুটা-তিনটি বাড়ি বানাবে। আজিজ বেপারির নেত্রকোনা শহরেই তিনটা বাড়ি। এখন আবার ঢাকার সোবাহানবাগ এলাকায় বাড়ি বানাচ্ছে। বাড়ি বানানোর খবর দেয়ার জন্যে কে মনসুর সাহেবের কাছে এসেছিল। মনসুর সাহেব বলেছেন—এতগুলি বাড়ির তোমার দরকার কি? একটা মাকড়সাকে দেখ। সে একটাই বাড়ি বানায়। সুতার তৈরি একটাই ঘর। কোনো মাকড়সা দেখবে না যে চার-পাঁচটা ঘর বানিয়ে রেখেছে।

আজিজ খ বিনয়ের সঙ্গে বলেছে, যথার্থ বলেছেন স্যার। যথার্থ কথা। তবে ব্যাপার হল কিবাড়িগুলি ভাড়া দিলে আয় হয়। ফিক্সড ইনকাম। মাসের শেষে হাতে চলে আসে। চিন্তা-ভাবনা করা লাগে না।

এত ইনকাম দিয়ে-ই বা তোমার প্রয়োজন কি?

খরচ-বরচ আছে। টাকার দরকার কখনো শেষ হয় না। তারপর ধরেন, টাকার কারণে দান-খয়রাত করতে পারি। এতে সোয়াব হয়। স্যার শুনলে সুখী হবেন—নিজের খরচে আমি একটা হাফেজিয়া মাদ্রাসা করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে

একটা মসজিদ বানানোর ইচ্ছা আছে। মাকড়সার তো আর মাদ্রাসা দিতে হয় না, মসজিদও বানাতে হয় না।

আজিজ বেপারির হাস্যকর যুক্তিতে রাগে গা জ্বলে যাবার কথা। মনসুর সাহেবের তেমন রাগ হয় না। নির্বোধ মানুষের সকল কথা ধরতে নেই। নির্বোধ মানুষের যুক্তিও শুনতে নেই। আজিজকে তিনি নির্বোধ শ্রেণীর একজন হিসেবেই জানেন। নির্বোধদের প্রতি এক ধরনের মমতা মানুষের থাকে। তারও আছে। আজিজ খাঁ ঘোর বৈষয়িক মানুষ। বৈষয়িক মানুষ বিষয় ছাড়া অন্য কিছু ভালবাসতে পারে না। তাদের সেই ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু আজিজ খাঁ সত্যিকার অর্থেই মনসুর সাহেবকে ভালবাসেন। নতুন ফ্যান কিনে এনে লাগিয়ে দেয়ার পেছনে তাঁর ভালোবাসাই কাজ করেছে। অন্য কিছু না। তাঁর গুদামঘর পর্যন্ত ইলেকট্রিসিটির লাইন আনার জন্যে তিনি সাবডিভিশনাল ইনজিনিয়ারকে এক হাজার টাকা ঘুস দিয়েছেন।

মনসুর সাহেবকে যেন পোলাওয়ের চালের ভাত রান্না করে দেয়া হয় সে জন্যে মাসের শুরুতেই তিনি আধমণ চিনিগুড়া চাল হরমুজের কাছে পাঠিয়ে দেন। হরমুজকে বলা হয়েছে এই ব্যাপারটা সে যেন গোপন রাখে। হরমুজ সেই পোলাওয়ের চাল বাজারে বিক্রি করে দেয়। কারণ সে লক্ষ করেছে মনসুর সাহেব পোলাওয়ের চাল এবং সাধারণ চালের পার্থক্য ধরতে পারেন না। কয়েকবার সে পোলাওয়ের চালের ভাত বেঁধে দিয়েছে। মনসুর সাহেব একটা শব্দও করেননি।

আজিজ বেপারির এই বাড়িতে মনসুর সাহেব আছেন গত এগারো বছর ধরে। প্রতি মাসে ঘরে থাকার ভাড়া বাবত ত্ৰিশটা টাকা নিজে আজিজ বেপারিকে দিয়ে তার কাছ থেকে রসিদ নিয়ে আসেন। তিনি জানেন না এগারো বছর আগে ত্রিশ টাকার যে মূল্য ছিল আজ সে মূল্য নেই। এক কেজি চিনির দামই ত্ৰিশ টাকা। জগৎ-সংসার থেমে নেই—শুধু মনসুর সাহেব থেমে আছেন। তিনি তা জানেন না।

চোখের সমস্যা নিয়ে মনসুর সাহেব অসময়ে তাঁর ঘরে ফিরে এলেন। তালা খুলে বিছানায় শুয়ে রইলেন। দুপুরে তাঁর ঘুমানোর অভ্যাস নেই। আজ বিকেল। পর্যন্ত ঘুমুলেন। ঘুম ভেঙে মুখ ধুতে গিয়ে লক্ষ করলেন—চোখ জ্বালা করছে। তার ভুরু কুঞ্চিত হল। চোখ জ্বালা করলে তো সমস্যা। রাত জেগে কাজ করতে হবে। চোখ জ্বালা করলে কাজ করবেন কীভাবে? ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসাই ভালো। তা ছাড়া ঘরে কাগজ নেই। কাগজ কিনতে হবে। কলমের কালি কিনতে হবে। বল পয়েন্টে তিনি লিখতে পারেন না। আরো কিছু টুকটাক জিনিস বোধহয় লাগবে। চিনি নেই। লেবু নেই। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে এক গ্লাস লেবুর সরবত খান। এটাও এক অর্থে বাহুল্য। তবে অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাস খুব খারাপ জিনিস। অভ্যাস মানুষকে বিলাসী করে।

স্যার কি ন্দ্রিা করতেছেন?

হরমুজ মিয়া দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। কঠিন কঠিন বাক্য ব্যবহার করে সে আনন্দ পায়।

কি ব্যাপার হরমুজ?

আপনের কাছে একটা আবেদন ছিল। বল।

হরমুজ ঘরে ঢুকল। দীর্ঘ কোনো গল্পের প্রস্তুতি সে নিচ্ছে। এক দুই কথায় সে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না।

স্যার, আমার মধ্যম কন্যার শাদি হয়েছে—সান্দিকোনায়। জামাই ঘরামির কাজ করে। চৈত্র মাসে এরার কোনো কাজকাম থাকে না…

মনসুর সাহেব হরমুজের গল্প সংক্ষেপ করার জন্যে বললেন সাহায্য চাও?

জ্বি না। সাহায্য না।

তাহলে কি?

মেয়েটার সন্তান হবে। এর আগে একবার গর্ভ নষ্ট হয়েছে। আমাকে বলেছে মদনপুরের পীর সাহেবের ফুল গাছ থেকে একটা পুষ্প তার জন্যে নিয়ে যেতে…

ছুটি চাও?

জ্বি। দুই দিনের ছুটি।

যাও।

আপনার খাওয়া-দাওয়া?

আমার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। একজন তো আছেই–। বসির আছে না?

জ্বি না। বসির ছুটি নিয়ে চলে গেছে।

অসুবিধে কিছু নেই।

বাইরে-টাইরে ভ্রমণের জন্যে গেলে গেইটে তালা দিয়ে যাবেন। এই যে স্যার তালাচাবি।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

ভয় পাবেন না তো স্যার?

না, ভয় পাব কেন? ভয় পাবার কিছু আছে?

জ্বি না। ভয়ের কিছু নাই। তবে স্যার সত্য কথা বলতে কি জিনের সামান্য উদ্রব আছে। একটা দুষ্ট জিন আছে—গ্রামেই থাকে। মাঝে মধ্যে ফাইলামি করে। একবার কি হয়েছে স্যার শুনুন-শ্ৰবণ মাস—বুম বৃষ্টি…

তুমি এখন যাও হরমুজ। আমার শরীরটা ভালো না। আমি একটু বিশ্রাম করব।

জ্বি আচ্ছা। আরেকটা ছোট্ট আবেদন ছিল স্যার। অপরাধ না নিলে নিবেদন করি–আমি স্যার এই যে ছুটি নিয়ে চলে গেলাম এটা সাহেবকে বলবেন না।

আজিজ কিছু জিজ্ঞেস না করলে অবশ্যই বলব না। তবে জিজ্ঞেস করলে তো বলতেই হবে। আমি মিথ্যা কথা বলি না।

মাঝে মধ্যে দু-একটা মিথ্যা বললে কিছু হয় না স্যার। সত্য যেমন আল্লাহপাকের সৃষ্টি মিথ্যাও তেমন তারই সৃষ্টি।

তুমি এখন যাও হরমুজ।

হরমুজ চলে গেল, তবে যাবার আগে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মনসুর সাহেবের পা ছুঁয়ে সালাম করল।

স্যার, গরিবের জন্যে একটু দোয়া রাখবেন।

আচ্ছা রাখব। দোয়া রাখব। এখন তুমি যাও।

আপনাকে একা ফেলে যেতে খুব পেরেসান, কিন্তু…

তুমি যাও তো।

 

মনসুর সাহেব সন্ধ্যার আগে নেত্রকোনা শহরের দিকে রওনা হলেন। যে কাজগুলি সারতে হবে সেগুলি হচ্ছে :

১. কাগজ কিনতে হবে।

২. চিনি কিনতে হবে।

৩. লেবু কিনতে হবে।

৪. ডাক্তার বজলুর রহমানকে চোখ দেখাতে হবে।

৫. ফাউনটেনপেনের কালি কিনতে হবে। মোট পাঁচটা কাজ।

পাঁচ সংখ্যাটা ইন্টারেস্টিং। মৌলিক সংখ্যা। প্রাইম নাম্বার। সংখ্যার জগতে চতুর্থ প্রাইম নাম্বার। প্রথমটা হল ১, তারপর ২, তারপর ৩, তারপরই ৫, পাঁচের পর ৭, সাতের পর ১১, এগারোর পর ১৩, তেরোর পর ১৭, সতেরোর পর ১৯…

এক থেকে দশের ভেতর প্রাইম নাম্বার হল পাঁচটা।

দশ থেকে কুড়ির ভেতর চারটা…

কুড়ি থেকে ত্রিশের মধ্যে মাত্র দুটা সংখ্যা বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাইম নাম্বারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

ত্ৰিশ থেকে চল্লিশের ভেতর…

মনসুর সাহেব মাথা থেকে মৌলিক সংখ্যার চিন্তা-ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। সারাক্ষণ মাথায় এইসব ঘুরলে ভালো লাগে না।

আকাশে মেঘ জমছে। চৈত্রমাসে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করার অর্থ ভালো না। ঝড় হবে। ভোলা মাঠে ঝড়ের ভেতর পড়ার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ হবার কথা। মনসুর সাহেবকে তেমন উদ্বিগ্ন দেখা গেল না। অথচ তাঁর মতো আরো যারা শহরের দিকে যাচ্ছে তারা উদ্বিগ্ন। দ্রুত হাঁটছে। বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। সবচে বড় আশঙ্কা হল শিলাবৃষ্টির। চৈত্রের শেষাশেষি আকাশ ঘন কালো হয়ে উঠলে শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা থাকেই। খোলামাঠে শিলাবৃষ্টির হাতে পড়লে ভয়াবহ সমস্যা। আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। ইউনিয়ন বোর্ডের এই রাস্তা নতুন হয়েছে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা কিছু নেই। বছর দুই আগে বনবিভাগ চারা লাগিয়েছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে ছাগলে খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছে।

ছোটবাজারে আজিজ বেপারির একটা স্টেশনারি দোকান আছে। মনসুর সাহেব সেখান থেকেই কাগজ, কালি কিনলেন। দাম দিতে হল না। তারা খাতায় লিখে রাখে। মাসের শুরুতে বিল করে টাকা নেয়। মনসুর সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ এরা হিসেবে কোনো গণ্ডগোল করে, কারণ তিনি প্রচুর কাগজ কেনেন, কিন্তু বিল এত কম হয়। আজিজ বেপারিকে তিনি তাঁর সন্দেহের কথা বলেছিলেন। আজিজ বলেছে, এইসব নিয়ে আপনি ভাববেন না তো স্যার। আমরা পাইকারি হিসেবে বিল করি। এতে খানিকটা কম হয়।

আজিজ আজ দোকানে ছিল না। তার এক কর্মচারী বদরুল কাগজ এবং কালি পলিথিনের ব্যাগে ভরতে ভরতে বলল, দিনের অবস্থা ভালো না, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান স্যার। ঝড় হবে। স্যারের সঙ্গে কি ছাতা আছে?

না।

একটা ছাতা নিয়ে যান।

ছাতা নিব না। আমার ছাতা খুব হারায়।

হারালে হারাবে, ছাতাটা নিয়ে যান। আমি বরং একটা রিকশা ঠিক করে দেই। রিকশা আপনাকে নিয়ে যাবে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে রিকশাও পাবেন না-কাঁচা রাস্তায় রিকশা যাবে না।

না না, রিকশা লাগবে না। রিকশায় আমি চড়ি না। রিকশার কঁকুনিতে আমার চিন্তার অসুবিধা হয়।

দোকানি বিস্মিত হয়ে বলল, কি চিন্তা?

মনসুর সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, তেমন কিছু না। হাঁটতে হাঁটতে যা মাথায় আসে। যেমন ধর প্রাইম সংখ্যা…

সেটা কি?

মৌলিক সংখ্যা, যে সংখ্যাকে সেই সংখ্যা এবং ১ এই দুটি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ভাগ দেয়া যায় না। যেমন ধর তিন একটা মৌলিক সংখ্যা, আবার চার মৌলিক সংখ্যা না। চারকে তুমি দুই দিয়ে ভাগ দিতে পারছ। তারপর আসে পাঁচ। পাঁচ মৌলিক সংখ্যা। পাঁচের পর আসছে সাত…

বদরুল হতচকিত গলায় বলল, আর বলতে হবে না স্যার। মাথা আউলা হয়ে যাচ্ছে। আপনি হাঁটতে হাঁটতে এইসব চিন্তা করেন?

হ্যাঁ। কি হয় এসব চিন্তা করে? কিছু হয় না। মনের আনন্দ।

স্যার, এর মধ্যে আনন্দের কি আছে?

মনসুর সাহেব আনন্দের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। ব্যাখ্যা তার নিজেরও জানা নেই। চিন্তা করলে আনন্দ হয়—এটাই শুধু জানেন।

মনসুর সাহেব বললেন, কাগজ কতগুলি দিয়েছ?

তিন দিস্তা দিয়েছি। স্যার, আরো লাগবে?

আরো কিছু দিয়ে দাও। কাগজ এখন বেশি লাগছে।

প্রতি সপ্তাহে কাগজ নেন। আপনি স্যার এত কাগজ দিয়ে করেন কি?

হিসাব-নিকাশ করি।

কীসের হিসাব-নিকাশ?

ইয়ে মানে একটা অঙ্ক করছি। জটিল অঙ্ক…মানে ঠিক…

বদরুল হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সে এই দোকানে কাজ করছে বেশিদিন। নাতিন বছরের মতো হবে। এই তিন বছর ধরেই সে এই মানুষটাকে কাগজ দিয়ে যাচ্ছে। কোনো সপ্তাহে তিন দিস্তা, কোনো সপ্তাহে পাঁচ।

স্যার, অঙ্কটা কি?

তেমন কিছু না। শখের একটা ব্যাপার। যাই কেমন?

চা খেয়ে যান স্যার। ঝড়-বাদলের দিন, চা খেলে ভালো লাগবে।

ঝড়-বাদলা কোথায়?

এখনো নাই, তবে স্যার শুরু হবে।

চা খেতে ইচ্ছা করছে না।

একটু খান স্যার। আপনি কিছু না খেয়ে শুধু-মুখে চলে গেলে সাহেব রাগ করবেন। চা আনতে ফ্ল্যাস্ক নিয়ে লোক গেছে। এসে পড়বে।

মনসুর সাহেব বসলেন। বদরুল বলল—আপনার অঙ্কটার বিষয়ে কিছু বলেন স্যার শুনি। শখের একটা অঙ্ক করছেন। শুনেই কেমন লাগে। অঙ্ক আর মানসাঙ্ক এই দুইয়ের নাম শুনলেই এখনো কলিজা কঁপে। তাও ভালো, এখনকার ছাত্রদের মানসাঙ্ক করতে হয় না…মণের দামের বামে ইলেক মাত্ৰ দিলে…ওরে বাপরে, কী জিনিস ছিল! স্যার, আপনার অঙ্কটা কি?

ঐটা হল তোমার ফিবোনাক্কি রাশিমালা নিয়ে একটা কাজ।

বদরুল হতভম্ব হয়ে বলল, কি রাশিমালা বললেন?

ফিবোনাক্কি। ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত গণিতবিদ লিওনার্ডো ফিবোনাক্কি এই রাশিমালা বের করেছিলেন। মরবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন প্রকৃতির মূল সমস্যা এই রাশিমালাতে আছে।

স্যার, বলেন কি?

মৃত্যুর সময় তিনি খুব আফসোস নিয়ে মারা গিয়েছিলেন।

আফসোস কি জন্যে?

রহস্যময় এক রাশিমালা বের করলেন কিন্তু সেই রাশিমালা নিয়ে কাজ করে যেতে পারলেন না—এই নিয়ে আফসোস। মৃত্যুর সময় চিৎকার করে বলছিলেন–হে ইশ্বর, আমাকে আর মাত্র তিন বছর আয়ু দাওমাত্র তিন…

আহা বেচারা! আর তিন বছর বচলে ফাটাফাটি হয়ে যেত। তাই না স্যার?

মনসুর সাহেব এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না। চা এসে গেছে। তিনি চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছেন। ঠাণ্ডা চিনির সরবত। না খেলে বদরুল মন খারাপ করবে বলেই খাওয়া।

ফিক্কি রাশিমালা ব্যাপারটা কি স্যার? ফিল্কি না, ফিবোনাক্কি। আমাদের সাধারণ রাশিমালা তো তুমি জানই।

জানি না স্যার। অঙ্কে আমি মারাত্মক কাঁচা। মেটিকে একচল্লিশ পেয়েছিলাম। অঙ্কের স্যার আমি এত নাম্বার পেয়েছি শুনে কী যে অবাক হয়েছিলেন! আমি স্যার কিছুই জানি না।

মনসুর সাহেব সহজ গলায় বললেন, অবশ্যই জান। ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, …এই হল সাধারণ রাশিমালা।

এটা জানি।

এরকম আরো রাশিমালা আছে, যেমন—শুধু মৌলিক সংখ্যার রাশিমালা ১, ৩, ৫, ৭, ৯, ১১… ফিবোনাক্কি রাশিমালা হল—১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫, ৮৯…

একেবারে বেড়াছেড়া অবস্থা।

না, বেড়াছেড়া না। এই রাশিমালার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রাশিমালার প্রতিটি সংখ্যা হল আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। যেমন ধর, এই রাশিমালার চতুর্থ সংখ্যা হল পাঁচ। পাঁচ হল ২য় এবং ৩য় সংখ্যার যোগফল। বড়ই রহস্যময় রাশিমালা।

আমি তো স্যার কোনোই রহস্য দেখতে পাচ্ছি না।

তুমি তো অঙ্ক নিয়ে চর্চা কর না, তাই এই রাশিমালার রহস্য ধরতে পারছ। না। এই রাশিমালার ১১ নম্বর সংখ্যা হল ৮৯। রাশিমালার প্রথম সংখ্যা এককে যদি তুমি ৮৯ দিয়ে ভাগ দাও তাহলে আবার এই রাশিমালা দিয়ে আসে।

যেমন…

১/৮৯= .০১১২৩৫৮১৩২১…

বদরুল চোখ বড় বড় করে তাকাল। কিছু না বুঝেই চোখ বড় করল। পাগলা ধরনের লোক আগ্রহ নিয়ে একটা কথা বলছে—সেই সব কথা বিস্মিত হয়ে না শুনলে ভালো দেখায় না। এই কারণেই বিস্মিত হওয়া।

মনসুর সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, প্রকৃতিতে ফিবোনাকি সিরিজের খুব প্রয়োগ দেখা যায়। সূর্যমুখী ফুলের পাপড়ির বিন্যাস এই রাশিমালা অনুসারে হয়। শামুকের যে স্পাইরেল ও এই রাশিমালা অনুসারে হয়। সমুদ্রে এক ধরনের লাল কাঁকড়া থাকে। সেই কাঁকড়া যে সব নকশা বালিতে তৈরি করে তার মধ্যে থাকে ফিবোনাক্কি রাশিমালা…

বলেন কি?

শীতের সময় সাগর পাড়ি দিয়ে অতিথি পাখিরা যে আসে, ওরা ঝাক বেঁধে উড়ে। ঝুকে পাখির সংখ্যা ফিবোনাক্কি রাশিমালায় যে সব সংখ্যা আছে তার বাইরে কখনো হয় না। যেমন ধর, একটা ঝুঁকে ২১ টা পাখি থাকতে পারে, কিন্তু কখনো ২২ বা ২৩টা পাখি থাকবে না। কারণ ২২ বা ২৩ ফিবোনাক্কি রাশিমালায় নেই। ২১ আছে। আজ উঠি বদরুল?

জ্বি আচ্ছা, স্যার। আপনার কাছ থেকে জ্ঞানের কথা শুনে মনটা বড় ভালো হয়েছে।

তুমি তো মনে হয় কিছু বুঝতে পারনি।

স্যার বুঝেছি। আপনি জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছেন। আপনার মতো একজন শিক্ষক পেলে মেট্রিকে অঙ্কে লেটার থাকত। স্যার, ছাতাটা নিয়ে যান। বৃষ্টি নামলো বলে। আচ্ছা স্যার, বৃষ্টির ফোঁটাও কি ফিবোনাক্কি রাশিমালার মতো পড়ে?

মনসুর সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হল, ছেলেটা তাঁর সাথে রসিকতা করার চেষ্টা করছে।

রাস্তায় নামতেই বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিনি ডাক্তার বজলুর রহমানের ফার্মেসিতে উঠলেন। ফার্মেসি অন্ধকার। কাটআউট জ্বলে গেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে বজলুর রহমান সাহেব জমিয়ে গল্প করছেন। কয়েকজন আগ্রহী শ্রোতা তাঁকে ঘিরে আছে। টেবিলে মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি। মরিচ এমন ঢেসে দেয়া হয়েছে যে ঘরে পা দিতেই মরিচের গন্ধ নাকে এল।

মনসুর সাহেবকে দেখেই বজলুর রহমান বললেন, স্যার আসুন, মুড়ি খান। হেডস্যার বলেছেন আপনার চোখের সমস্যার কথা। বাতি নেই, চোখ দেখতে পারব না। কাম্পাউন্ডার ইলেকট্রিসিয়ান আনতে গেছে। বাতি আসুক, তারপর চোখ দেখব।

আড্ডার একজন বলল, গল্পটা শেষ করুন।

ভূতের গল্প হচ্ছিল। গল্পে বাধা পড়ায় সবাই খানিকটা বিরক্ত। মনসুর সাহেব এক কোণায় চেয়ারে গুটিগুটি হয়ে বসলেন। বজলুর রহমান ভূতের গল্প আবার শুরু করলেন। ছেলেমানুষি সব ভূতের গল্প শুনতে ইচ্ছা করে না। মনসুর সাহেব বাধ্য হয়ে শুনছেন।

ঘটনাটা বরিশালের।

বরিশালের ঠিক না—পিরোজপুর সাবডিভিশনের গোয়ারেখা গ্রামে। আমার নিজের দেখা। অন্যের কাছে শোনা গল্প হলে আপনাদের বলতাম না। তখন ঢাকা মেডিক্যালে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার ছোটমামা বিয়ে করেছেন গোয়ারেখা গ্রামে। আমাকে একবার পাঠালেন মামিকে পৌঁছে দিয়ে আসতে। আমি ভেবেছি যাব মামিকে পৌঁছে দিয়ে পরদিন চলে আসব। মেডিক্যাল কলেজ খোলা। ইচ্ছা করলেও থাকার উপায় নেই। পৌছার পর এমন বিপদে পড়লাম। শুরু হল লঞ্চ স্ট্রাইক। ঐসব অঞ্চলের কায়দাকানুনই অন্যরকম। একটা কিছু শুরু হলে আর শেষ হয় না। দশদিন ধরে চলল স্ট্রাইক। আমি তিক্ত-বিরক্ত। যার কীভাবে? যোগাযোগের একটাই ব্যবস্থা—লঞ্চ বা স্টিমার। ইচ্ছা করছে সাঁতরে রওনা দিয়ে দেই। এই সময়ের ঘটনা। গোয়ারেখা গ্রামের জঙ্গলে একটা ডেডবডি পাওয়া গেল। কেউ মেরে ফেলে রেখে গেছে। টাটকা ডেডবডি। নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে তখনো রক্ত পড়ছে। এক গরুর রাখাল জঙ্গলে গিয়েছিল গরুর খোঁজে—সে-ই ডেডবডি প্রথম দেখল। গ্রামের সমস্ত লোক ভেঙে পড়ল।

অপরিচিত মানুষের ডেডবডি। আগে কেউ কখনো দেখেনি। মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পরনে নীল লুঙ্গি। গায়ে ফতুয়ার মতো একটা জিনিস। মাদ্রাসার কম বয়েসী। তালেবুল এলেমদের যেমন অল্প কয়েক গোছা দাড়ি থাকে, সেরকম দাড়ি।

পুলিশে খবর দেবে সেই উপায় নেই। স্বরূপকাঠি থানা সতেরো মাইল দূরে। গ্রামের লোকজন পরামর্শ করে জানাজা পড়ে গোর কবর দিয়ে ফেলল। সকাল বেলা কবর দিয়েছে, সন্ধ্যাবেলা পুলিশ এসে উপস্থিত। ওদের নিজেদের স্পিড বোট আছে। ফটফট করে স্বরূপকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার চারজন কন্সটেবল নিয়ে হাজির। এসেই বিরাট হস্থিতম্বি। কেন পুলিশে খবর না দিয়ে ডেডবডি কবর দেয়া হল। এর মধ্যে রহস্য আছে। তিনি কাউকে ছাড়বেন না। প্রয়োজনে গ্রামসুদ্ধ বেঁধে নিয়ে যাবেন।

পয়সা খাওয়ার মতলব আর কি? গ্রাম অঞ্চলে খুনখারাবি হওয়া মানে। পুলিশের জন্যে ঈদ উৎসব। আসামি-ফরিয়াদি দুই তরফ থেকেই স্রোতের মতো টাকা আসতে থাকে।

গ্রামের মুরুঝিরা চাঁদা তুলে হাজার খানিক টাকা সেকেন্ড অফিসার সাহেবকে দিয়ে আপাতত ঠাণ্ডা করল।

ডাব-টাব কেটে আনল। সেকেন্ড অফিসার সাহেব বললেন—গোর খোদাই করে ডেডডি তোল। আমি দেখব। সবাই বলল সন্ধ্যাবেলা এই কাজটা করা ঠিক হবে না।

ভদ্ৰলোক হুংকার দিয়ে বললেন, পুলিশের কাছে আবার সকাল-সন্ধ্যা কি?

কবর খোঁড়া শুরু হল। গ্রামের সব লোক ভেঙে পড়ল। আমিও কৌতূহলী হয়ে গেলাম। দুটা হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। অনেকেই এসেছে হ্যারিকেন হাতে।

কবর খুঁড়ে সবাই হতভম্ব। কারণ ডেডবডির গায়ে কাফনের কাপড়টা নেই। ডেডবডি তার কাফনের কাপড় নিজেই খেয়ে ফেলেছে। সবটা খেতে পারেনি—খানিকটা কাপড় মুখ থেকে বের হয়ে আছে…

আড্ডায় অস্ফুট গুঞ্জন উঠল।

দুজন একসঙ্গে বলল, তারপর তারপর?

বজলুর রহমান সিগারেট ধরাতে ধারতে বললেন—পরের ব্যাপার আরো ভয়ংকর। দাঁড়ান বলছি, চা-টা খেয়ে নেই। কথা বলতে বলতে টায়ার্ড হয়ে গেছি।

মনসুর সাহেবের অসহ্য লাগছে। এই গল্পের বাকি অংশ শোনার তার আর। ধৈর্য নেই। তিনি উঠে দাঁড়ালেন—বজলুর রহমান সাহেব! আমি আজ উঠি। আরেকদিন আসব।

আরে বসুন বসুন। চোখটা দেখে দেই। বাতি নেই, দেখবেন কি? গল্পের শেষটা শুনে যান। শেষটা ভয়ংকর। ইচ্ছা করছে না।

মনসুর সাহেব ঘরের বাইরে পা দিলেন। ফোঁটা ফেঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। তিনি দ্রুত হাঁটছেন। তাঁর মন বলছে কী একটা জিনিস যেন বাকি আছে। একটা কিছু ভুল হয়ে গেছে। তিনি সেই ভুল ধরতে পারছেন না। মনের অস্বস্তি দূর হচ্ছে না। ছোটবাজার ছাড়িয়ে যখন কাঁচা পথে উঠে এলেন তখনি নিজের অস্বস্তির কারণ ধরতে পারলেন। ছাতা ফেলে এসেছেন। এখন ফিরে গিয়ে ছাতা আনতে যাবার অর্থ হয় না।

 

বৃষ্টি কেঁপে আসছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। তিনি ভিজে সার হয়েছেন। কাগজগুলি না ভিজলেই হল—কাগজগুলির জন্যেই তার দুশ্চিন্তা। চিনি আর লেবু কেনা হয়নি। আজ রাতে লেবুর সরবত খাওয়া যাবে না। তার চেয়েও বড় সমস্যা—ভাত রাঁধতে হবে। ডিম নিশ্চয়ই আছে। ভাত আর ডিমভাজি। রান্না তেমন জটিল নয়—চুলা ধরানোটাই জটিল।